ভারত- প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন মোদি? by শান্তনু মজুমদার
চতুর্থবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনার দায়ে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদিকে পুরস্কৃত করার রেকর্ড অক্ষুণ্ন রাখলেন গুজরাটের ভোটাররা। গুজরাট ট্র্যাজেডির পরে এবার নিয়ে তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হলেন মোদি, যা তাঁকে আগামী নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে শামিল হওয়ার ব্যাটন অনেকটাই হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মোদির মতো লোককে বারবার নির্বাচিত করার জন্য গুজরাটের ভোটারদের উদ্দেশে ‘শেইম’ বলা যায় কি?
মৌলবাদীরা অবশ্য সাংঘাতিক আপত্তি তুলবেন। কেননা, ধোঁকাবাজি করার জন্য তাঁরা ক্লিশে একটি যুক্তি ব্যবহার করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট দিয়েছেন, তাই মোদি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাচ্ছেন; এতে অসুবিধা কোথায়? মৌলবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি তুলে তাঁদের সবচেয়ে অপছন্দের ব্যাপার অর্থাৎ গণতন্ত্রের বুলি কপচিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। গণতন্ত্রমনা অনেক মানুষও সময়-সময় এই বিভ্রান্তির ফেরে পড়ে যান। বিভ্রান্তিটা বোঝার জন্য এমন একজন শিক্ষকের কথা ভাবা যাক, যিনি নিয়মিত ক্লাস না নিয়ে শর্টকাটের ওস্তাদি দেখিয়ে দ্রুত কোর্স শেষ করে পরীক্ষায় সবাইকে ‘ভালো’ নম্বর দিয়ে থাকেন; আর এর সুবাদে হয়তো তিনি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন। ধরা যাক, অন্যায় সুবিধা বিতরণের পুরস্কার হিসেবে শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষক মূল্যায়নে তিনি সবার চেয়ে বেশি ‘নম্বর’ও পেয়ে যান। এই শিক্ষকের ক্ষেত্রে কী বলা যাবে? বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ‘খুব পছন্দ করি’, ‘বেশ পছন্দ করি’, ‘পছন্দ করি’-এর ঘরগুলোতে টিক মারলেই হয়ে গেল? কখনো না। সংখ্যা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যার প্রকোপ সম্পর্কে সতর্ক থাকাও জরুরি। ১০০ জনের মধ্যে ১০০ জন শিক্ষার্থীও যদি ফাঁকিবাজি করা শিক্ষকের পক্ষে দাঁড়ায়, তবু তাকে জনমত বলা যাবে না। ঠিক তেমনিভাবে মৌলবাদীর ভোট জেতাকেও জনমত বলা ঠিক হবে না। জনমত তখনই হবে, যখন এর মধ্যে জনমঙ্গল যুক্ত থাকবে। মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে কোনো জনমঙ্গল কোনো দিনই নেই। গুজরাটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা এই শিক্ষা আত্মস্থকরণে ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে ‘মউত কা সওদাগর’ মোদিকে মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রাস্তায় যাওয়ার লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই ‘শেইম’ শব্দটা ব্যবহার করা যায় কি না, প্রশ্নটা এসে যায়।
মৌলবাদী মোদির এবারের জয়লাভ স্বয়ংক্রিয় ঘটনা নয়। এর পেছনে কাজ করছে ‘টিম মোদি’র ক্ষুরধার মস্তিষ্কগুলো। মোদির টিম সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী ভোটব্যাংকে এতটুকু আঘাত না লাগিয়ে অনেক দিন ধরে অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে একের পর এক ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করে চলেছে মোদির। এই ব্যক্তি অতীতে অনেক দিন ধরে কখনো হিন্দুত্ববাদী পার্টিম্যান, কখনো হিন্দুর রক্ষক আবার কখনো সংখ্যালঘু মুসলিমদের শত্রু রূপে বিরাজ করছিলেন। একটা সময় এসে মোদির পাবলিক রিলেশন্সের লোকেরা ভিন্নপথ ধরলেন। মুখ্যমন্ত্রী মোদি দেখা দিলেন উন্নয়নগুরু, প্রযুক্তিবান্ধব পরিবর্তনকামী, সার্থক উদ্যোক্তাসহ নানা ইতিবাচক রূপে। এমনকি মোদির আমলে মুসলমানদেরও অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়ার নানা সাজানো-গোছানো প্রমাণ পেশ হতে থাকল। প্রথমদিকে অপাঙেক্তয় থাকলেও সরকারি কার্যক্রমে বড় বণিকদের পথের কাঁটাগুলো দূর করায় ব্যাপক সহায়তা দিয়ে মোদি হয়ে উঠলেন তাঁদের নয়নমণি। বড় বণিকবান্ধব সরকারি উদ্যোগমালার পরিণতিতে গুজরাটের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের দুস্তর ক্ষতি হওয়ার প্রমাণ আছে। উন্নয়নের নামে আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষজনের দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে চলেছে। কিন্তু তাতে কী? মিডিয়া মূলত বড় বণিক ও তাদের লোকদের। ফলে বড় বণিকবান্ধব উন্নয়ননীতি চালুর সুবাদে মোদি পেতে থাকলেন নিরবচ্ছিন্ন ইতিবাচক প্রচারণা। আসলে সামপ্রতিক সময়ের অতিপ্রচারিত ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ স্লোগানের সঙ্গে এসব ব্যাপার বেশ যায়। এ ছাড়া নতুন ইমেজগুলোর সুবাদে একটা বিভ্রম তৈরি হলো; জনসাধারণের মধ্যে মোদির নানা মূর্তি তৈরি হলো। জনগণের একেক অংশের কাছে একেক মোদি গৃহীত হতে থাকলেন, যার ফলে এবারের নির্বাচনেও দেখা গেল জয়ের মুখ।
নিজের নামকে দলের নামের সঙ্গে একাকার করতে পারাটাও মোদির নির্বাচনী সাফল্যের আরেকটি কারণ। গুজরাটে এখন বিজেপি আর মোদি বলতে গেলে সমার্থক। এ প্রসঙ্গে নির্বাচনী মৌসুমে বিজেপির একটি রেডিও-টিভি বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করা যায়। বিজ্ঞাপনটিতে মোদিকে বিশ্বাস করলে বিজেপিকে বেছে নেওয়ার জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই বিজ্ঞাপনে একজন কৃষক আরেকজন কৃষককে বলে, ‘আমি মোদির লোক, তুমি?’ উত্তরে অপর কৃষকটি উৎসাহের সঙ্গে বলেন, ‘আমিও তা-ই’। লক্ষণীয়, বিজেপির বিজ্ঞাপনের চরিত্রগুলো নিজেদের বিজেপির লোক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে না, দিচ্ছে মোদির লোক হিসেবে। নিজের নামকে দলের নামের সঙ্গে একাকার করে ফেলতে পারাটা মোদির জন্য বিশাল এক লাভ।
লন্ডনে এক ছাত্র একবার এক গল্প শুনিয়েছিল। তার এলাকায় মৌলবাদীদের একটি প্রতিষ্ঠানে অনেক যুক্তিতর্কের পর শুধু খবর শোনার শর্তে একটি টিভি কেনা হয়েছিল। আর সেই সঙ্গে টিভিতে খবর পাঠকের জায়গায় খবর পাঠিকার মুখ ও কণ্ঠ ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই টিভি স্ক্রিনের আলো কমিয়ে ফেলা ও সাউন্ড বন্ধ করার দায়িত্ব পালনের জন্য একজন লোককে নাকি নিয়োগও দেওয়া হয়েছিল! এই গল্প কতটা সত্য কে জানে? কিন্তু কিছু লোক এসব গল্পটল্প শুনেটুনে মৌলবাদীদের প্রযুক্তিবিমুখ ভাবতে শুরু করে দেয়। ভাবনাটা যে এতটুকু সত্য নয়, মোদির এবারের নির্বাচনে সর্বশেষ প্রযুক্তির বিপুল ব্যবহার তার প্রমাণ। গত ১৮ নভেম্বর গান্ধীনগরের একটি স্টুডিও থেকে মোদি যে ভাষণ দেন, তা থ্রিডি হলোগ্রাম ব্যবহার করে মোদির চারটি প্রতিরূপযোগে আহমেদাবাদ, ভাদোদারা, রাজকোট ও সুরাটে একযোগে দেখানো হয়। এবার নির্বাচনী মৌসুমে দুই ডজনের বেশি থ্রিডি-মোদি গুজরাটজুড়ে ভাষণ দিয়ে বেড়িয়েছে! শোনা গেছে, শুধু থ্রিডি হলোগ্রাম প্রযুক্তির পেছনে ২০০ কোটি রুপি খরচ করা হয়েছে। তাহলে অন্যান্য প্রযুক্তির পেছনে কত খরচ হয়েছে?
কথাবার্তা ও হাবভাবেও মোদি-মৌলবাদী এগিয়ে থেকেছেন। তিনি এবার নিজেকে একজন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়েও বেশি মাত্রায় জাতীয় নেতা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। নির্বাচনী ভাষণগুলোতে রাজ্যের সমস্যা-সম্ভাবনা-উন্নয়নের চেয়ে বেশি শোনা গেছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার কড়া সমালোচনা; সোনিয়া গান্ধী ও মনমোহন সিংয়ের কড়া সমালোচনা। স্পষ্টতই মোদির চোখ নয়াদিল্লির দিকে। দলের ভেতরে এত দিন কিছু বিরোধিতা ছিল। কিন্তু চতুর্থবারের মতো গুজরাট-বিজয় বিজেপিতে মোদির অবস্থান সুসংহত করেছে। আগামী নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইয়ে নামার সমূহ সম্ভাবনা আছে মোদির। সে ক্ষেত্রে তাঁর লড়াই হবে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর সঙ্গে। প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির আশা যা-ই হোক না কেন, মোদি-গান্ধী লড়াইয়ের ফল কেমন হবে, তা এত আগে বলা সম্ভব নয়। তবে রাজ্য নির্বাচনের একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুজরাটে রাহুলকে না নামিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব দৃশ্যত মোদিভীতির পরিচয় দিয়েছে। অথবা এমন হতে পারে যে কিছুদিন আগে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে রাহুল-ম্যাজিক কাজ করেনি দেখে গুজরাটেও একই পরিণতির সঙ্গে রাহুলের নাম যুক্ত করাতে চাওয়া হয়নি। সে যা-ই হোক, দলের ভেতর থেকে সমর্থন পেয়ে গেলে নরেন্দ্র মোদি যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে মৌলবাদ ও আধুনিকতার ঘোল বানিয়ে কংগ্রেসকে তা খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। মোদি সবকিছুই করছেন খুব সাবধানে, খুব বুঝেশুনে। ইদানীং আধুনিক-আধুনিক ভাব দেখালেও আসল জায়গা নষ্ট করেননি। উন্নয়নগুরুর ইমেজের পেছনে সুকৌশলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির মনের মানুষটি হিসেবে থেকে যেতেও সক্ষম হয়েছেন তিনি।
১৭ ডিসেম্বরের এক বক্তব্যে নিজেকে ‘হনুমান’ হিসেবে পরিচয় দেন মোদি। এই হনুমান আজকালকার হনুমান নয় অবশ্যই। মোদি জানান, জনগণ হচ্ছে তাঁর কাছে রামচন্দ্র আর তিনি হচ্ছেন তাদের ভক্ত হনুমান। শীর্ষ মৌলবাদী মোদি হিন্দু সেন্টিমেন্টের কোন জায়গায় টান দিয়েছেন ভাবা যায় না! হনুমানের লেজের আগুনে সোনার লঙ্কাপুরি পুড়ে ছাই হওয়ার গল্প চালু আছে; ‘মোদি হনুমান’ ভারতবর্ষকে ভবিষ্যতে কোন আগুনে ঠেসে ধরে সেটা চিন্তার বিষয়।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
মৌলবাদীরা অবশ্য সাংঘাতিক আপত্তি তুলবেন। কেননা, ধোঁকাবাজি করার জন্য তাঁরা ক্লিশে একটি যুক্তি ব্যবহার করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট দিয়েছেন, তাই মোদি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাচ্ছেন; এতে অসুবিধা কোথায়? মৌলবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি তুলে তাঁদের সবচেয়ে অপছন্দের ব্যাপার অর্থাৎ গণতন্ত্রের বুলি কপচিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। গণতন্ত্রমনা অনেক মানুষও সময়-সময় এই বিভ্রান্তির ফেরে পড়ে যান। বিভ্রান্তিটা বোঝার জন্য এমন একজন শিক্ষকের কথা ভাবা যাক, যিনি নিয়মিত ক্লাস না নিয়ে শর্টকাটের ওস্তাদি দেখিয়ে দ্রুত কোর্স শেষ করে পরীক্ষায় সবাইকে ‘ভালো’ নম্বর দিয়ে থাকেন; আর এর সুবাদে হয়তো তিনি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন। ধরা যাক, অন্যায় সুবিধা বিতরণের পুরস্কার হিসেবে শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষক মূল্যায়নে তিনি সবার চেয়ে বেশি ‘নম্বর’ও পেয়ে যান। এই শিক্ষকের ক্ষেত্রে কী বলা যাবে? বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ‘খুব পছন্দ করি’, ‘বেশ পছন্দ করি’, ‘পছন্দ করি’-এর ঘরগুলোতে টিক মারলেই হয়ে গেল? কখনো না। সংখ্যা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যার প্রকোপ সম্পর্কে সতর্ক থাকাও জরুরি। ১০০ জনের মধ্যে ১০০ জন শিক্ষার্থীও যদি ফাঁকিবাজি করা শিক্ষকের পক্ষে দাঁড়ায়, তবু তাকে জনমত বলা যাবে না। ঠিক তেমনিভাবে মৌলবাদীর ভোট জেতাকেও জনমত বলা ঠিক হবে না। জনমত তখনই হবে, যখন এর মধ্যে জনমঙ্গল যুক্ত থাকবে। মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে কোনো জনমঙ্গল কোনো দিনই নেই। গুজরাটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা এই শিক্ষা আত্মস্থকরণে ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে ‘মউত কা সওদাগর’ মোদিকে মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রাস্তায় যাওয়ার লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই ‘শেইম’ শব্দটা ব্যবহার করা যায় কি না, প্রশ্নটা এসে যায়।
মৌলবাদী মোদির এবারের জয়লাভ স্বয়ংক্রিয় ঘটনা নয়। এর পেছনে কাজ করছে ‘টিম মোদি’র ক্ষুরধার মস্তিষ্কগুলো। মোদির টিম সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী ভোটব্যাংকে এতটুকু আঘাত না লাগিয়ে অনেক দিন ধরে অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে একের পর এক ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করে চলেছে মোদির। এই ব্যক্তি অতীতে অনেক দিন ধরে কখনো হিন্দুত্ববাদী পার্টিম্যান, কখনো হিন্দুর রক্ষক আবার কখনো সংখ্যালঘু মুসলিমদের শত্রু রূপে বিরাজ করছিলেন। একটা সময় এসে মোদির পাবলিক রিলেশন্সের লোকেরা ভিন্নপথ ধরলেন। মুখ্যমন্ত্রী মোদি দেখা দিলেন উন্নয়নগুরু, প্রযুক্তিবান্ধব পরিবর্তনকামী, সার্থক উদ্যোক্তাসহ নানা ইতিবাচক রূপে। এমনকি মোদির আমলে মুসলমানদেরও অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়ার নানা সাজানো-গোছানো প্রমাণ পেশ হতে থাকল। প্রথমদিকে অপাঙেক্তয় থাকলেও সরকারি কার্যক্রমে বড় বণিকদের পথের কাঁটাগুলো দূর করায় ব্যাপক সহায়তা দিয়ে মোদি হয়ে উঠলেন তাঁদের নয়নমণি। বড় বণিকবান্ধব সরকারি উদ্যোগমালার পরিণতিতে গুজরাটের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের দুস্তর ক্ষতি হওয়ার প্রমাণ আছে। উন্নয়নের নামে আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষজনের দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে চলেছে। কিন্তু তাতে কী? মিডিয়া মূলত বড় বণিক ও তাদের লোকদের। ফলে বড় বণিকবান্ধব উন্নয়ননীতি চালুর সুবাদে মোদি পেতে থাকলেন নিরবচ্ছিন্ন ইতিবাচক প্রচারণা। আসলে সামপ্রতিক সময়ের অতিপ্রচারিত ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ স্লোগানের সঙ্গে এসব ব্যাপার বেশ যায়। এ ছাড়া নতুন ইমেজগুলোর সুবাদে একটা বিভ্রম তৈরি হলো; জনসাধারণের মধ্যে মোদির নানা মূর্তি তৈরি হলো। জনগণের একেক অংশের কাছে একেক মোদি গৃহীত হতে থাকলেন, যার ফলে এবারের নির্বাচনেও দেখা গেল জয়ের মুখ।
নিজের নামকে দলের নামের সঙ্গে একাকার করতে পারাটাও মোদির নির্বাচনী সাফল্যের আরেকটি কারণ। গুজরাটে এখন বিজেপি আর মোদি বলতে গেলে সমার্থক। এ প্রসঙ্গে নির্বাচনী মৌসুমে বিজেপির একটি রেডিও-টিভি বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করা যায়। বিজ্ঞাপনটিতে মোদিকে বিশ্বাস করলে বিজেপিকে বেছে নেওয়ার জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই বিজ্ঞাপনে একজন কৃষক আরেকজন কৃষককে বলে, ‘আমি মোদির লোক, তুমি?’ উত্তরে অপর কৃষকটি উৎসাহের সঙ্গে বলেন, ‘আমিও তা-ই’। লক্ষণীয়, বিজেপির বিজ্ঞাপনের চরিত্রগুলো নিজেদের বিজেপির লোক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে না, দিচ্ছে মোদির লোক হিসেবে। নিজের নামকে দলের নামের সঙ্গে একাকার করে ফেলতে পারাটা মোদির জন্য বিশাল এক লাভ।
লন্ডনে এক ছাত্র একবার এক গল্প শুনিয়েছিল। তার এলাকায় মৌলবাদীদের একটি প্রতিষ্ঠানে অনেক যুক্তিতর্কের পর শুধু খবর শোনার শর্তে একটি টিভি কেনা হয়েছিল। আর সেই সঙ্গে টিভিতে খবর পাঠকের জায়গায় খবর পাঠিকার মুখ ও কণ্ঠ ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই টিভি স্ক্রিনের আলো কমিয়ে ফেলা ও সাউন্ড বন্ধ করার দায়িত্ব পালনের জন্য একজন লোককে নাকি নিয়োগও দেওয়া হয়েছিল! এই গল্প কতটা সত্য কে জানে? কিন্তু কিছু লোক এসব গল্পটল্প শুনেটুনে মৌলবাদীদের প্রযুক্তিবিমুখ ভাবতে শুরু করে দেয়। ভাবনাটা যে এতটুকু সত্য নয়, মোদির এবারের নির্বাচনে সর্বশেষ প্রযুক্তির বিপুল ব্যবহার তার প্রমাণ। গত ১৮ নভেম্বর গান্ধীনগরের একটি স্টুডিও থেকে মোদি যে ভাষণ দেন, তা থ্রিডি হলোগ্রাম ব্যবহার করে মোদির চারটি প্রতিরূপযোগে আহমেদাবাদ, ভাদোদারা, রাজকোট ও সুরাটে একযোগে দেখানো হয়। এবার নির্বাচনী মৌসুমে দুই ডজনের বেশি থ্রিডি-মোদি গুজরাটজুড়ে ভাষণ দিয়ে বেড়িয়েছে! শোনা গেছে, শুধু থ্রিডি হলোগ্রাম প্রযুক্তির পেছনে ২০০ কোটি রুপি খরচ করা হয়েছে। তাহলে অন্যান্য প্রযুক্তির পেছনে কত খরচ হয়েছে?
কথাবার্তা ও হাবভাবেও মোদি-মৌলবাদী এগিয়ে থেকেছেন। তিনি এবার নিজেকে একজন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়েও বেশি মাত্রায় জাতীয় নেতা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। নির্বাচনী ভাষণগুলোতে রাজ্যের সমস্যা-সম্ভাবনা-উন্নয়নের চেয়ে বেশি শোনা গেছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার কড়া সমালোচনা; সোনিয়া গান্ধী ও মনমোহন সিংয়ের কড়া সমালোচনা। স্পষ্টতই মোদির চোখ নয়াদিল্লির দিকে। দলের ভেতরে এত দিন কিছু বিরোধিতা ছিল। কিন্তু চতুর্থবারের মতো গুজরাট-বিজয় বিজেপিতে মোদির অবস্থান সুসংহত করেছে। আগামী নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইয়ে নামার সমূহ সম্ভাবনা আছে মোদির। সে ক্ষেত্রে তাঁর লড়াই হবে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর সঙ্গে। প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির আশা যা-ই হোক না কেন, মোদি-গান্ধী লড়াইয়ের ফল কেমন হবে, তা এত আগে বলা সম্ভব নয়। তবে রাজ্য নির্বাচনের একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুজরাটে রাহুলকে না নামিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব দৃশ্যত মোদিভীতির পরিচয় দিয়েছে। অথবা এমন হতে পারে যে কিছুদিন আগে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে রাহুল-ম্যাজিক কাজ করেনি দেখে গুজরাটেও একই পরিণতির সঙ্গে রাহুলের নাম যুক্ত করাতে চাওয়া হয়নি। সে যা-ই হোক, দলের ভেতর থেকে সমর্থন পেয়ে গেলে নরেন্দ্র মোদি যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে মৌলবাদ ও আধুনিকতার ঘোল বানিয়ে কংগ্রেসকে তা খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। মোদি সবকিছুই করছেন খুব সাবধানে, খুব বুঝেশুনে। ইদানীং আধুনিক-আধুনিক ভাব দেখালেও আসল জায়গা নষ্ট করেননি। উন্নয়নগুরুর ইমেজের পেছনে সুকৌশলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির মনের মানুষটি হিসেবে থেকে যেতেও সক্ষম হয়েছেন তিনি।
১৭ ডিসেম্বরের এক বক্তব্যে নিজেকে ‘হনুমান’ হিসেবে পরিচয় দেন মোদি। এই হনুমান আজকালকার হনুমান নয় অবশ্যই। মোদি জানান, জনগণ হচ্ছে তাঁর কাছে রামচন্দ্র আর তিনি হচ্ছেন তাদের ভক্ত হনুমান। শীর্ষ মৌলবাদী মোদি হিন্দু সেন্টিমেন্টের কোন জায়গায় টান দিয়েছেন ভাবা যায় না! হনুমানের লেজের আগুনে সোনার লঙ্কাপুরি পুড়ে ছাই হওয়ার গল্প চালু আছে; ‘মোদি হনুমান’ ভারতবর্ষকে ভবিষ্যতে কোন আগুনে ঠেসে ধরে সেটা চিন্তার বিষয়।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
No comments