কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-আমরাও লড়েছি একাত্তরে পথে ও প্রান্তরে by রণজিৎ বিশ্বাস
আপনাকে আমি ও আমরা পছন্দ করি না। আমাদের পথ আলগ-আলগ। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি বুঝে বেজায় এক স্টাইলে ডিজাইনে আপনাদের মাথার মালা ফাটিয়ে দিলাম মহাজোরের এক মুগুরপেটায়- ইত্যাদি অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে আছে।
আমরা এমন কিছু কখনো ভাবিও না, ভাবতে ভাবতে আনন্দেও লুটি না। আমরা আমাদের আদর্শ ও বিশ্বাস নিয়ে থাকি। আমরা বড় সিম্পল মানুষ। একাত্তরে যুদ্ধ করলেও আমরা বড় সিধে মানুষ। স্ট্রেইট পথে চলা মানুষ! আমরা আমাদের যুদ্ধ নিয়ে থাকি। পুরনো যুদ্ধ। ধর্মযুদ্ধ।
: একাত্তরে তাহলে আপনিও যুদ্ধ করেছিলেন! আমার তো বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে! করেছিলেন যুদ্ধ আপনি!
: করেছিলাম মানে! প্রবলভাবে করেছিলাম!
: আপনি তখন নিশ্চয়ই ছাত্র?
: অবশ্যই ছাত্র! বরিশালের একটা স্কুলে আমি তখন কৃতী ছাত্র! আমার এক বন্ধু চট্টগ্রাম থেকে, এক বন্ধু পাবনা থেকে, একজন জয়পুরহাট থেকে, একজন রংপুর থেকে, একজন ঢাকার মগবাজার থেকে, একজন মিরপুর থেকে এবং আরো অনেকজন অনেক দিক থেকে এসে আমাদের সিনিয়র-জুনিয়র-সহপাঠীদের নিয়ে প্রবলভাবে যুদ্ধ করেছি। আপনাদের মতো খুব বেশি লোককে না পারলেও কিছু মানুষকে আমরা দেশের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলাম। অনেক প্রতিপক্ষকে আমরা সংসার থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের বুকের গভীরে ছিল একটি আদর্শ, শত্রুর হাত থেকে দেশ বাঁচানোর আদর্শ। নিজের মাটির প্রতি মমতা, প্রভুর প্রতি আনুগত্য, পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, নিজের জন্মপরিচয় ও বিশ্বাস-পরিচয়ের জন্য অহম এবং বিধর্মী ও ভিনবিশ্বাসীদের প্রতি ঘৃণা ও ক্রোধ, হয় হনন নয় পীড়ন, নয় লাঞ্ছনা ইত্যাদির পবিত্র সংকল্প মাথায় নিয়ে আমাদের দেশের ও আমাদের মাটির পাক-পবিত্র ভুবন থেকে তাদের তাড়ন-বিতাড়নের মানসিকতা।
: দেশে একটি পাবলিক পরীক্ষা হয়েছিল তখন, প্রবেশিকা পরীক্ষা। তখন আপনি কী পরীক্ষায় বসেছিলেন?
: বসেছিলাম মানে! দাঁড়িয়ে ছিলাম! গৌরবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম! পরীক্ষায় আমি স্ট্যান্ড করেছিলাম। আমাদের অনেকেই তখন উচ্চ সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হয়েছিলাম! আমাদের এক সহপাঠী, ব্যবহারজীবী, টক শোতে আসে, বিশেষ ভঙ্গিতে চিবিয়ে চিবিয়ে এক্সপার্ট অপিনিয়ন দেয়, অনেক জ্ঞানগম্যি ও অভিজ্ঞতার মালিক।
- সেও স্ট্যান্ড করেছিল! আপনি দেখলেই তাকে চিনবেন।
: আমি চিনি তাকে। এবার বলুন, এই যুদ্ধে, দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আপনাদের কয়েকজনের কঠিন ও প্রবল যুদ্ধে কেমন স্যাটিসফেকশন পেয়েছিলেন আপনি বা আপনারা?
: দেখুন, আমাদের তৃপ্তি-পরিতৃপ্তি কিংবা তুষ্টি-সন্তুষ্টি অথবা স্যাটিসফেকশনের কথা যদি বলেন, বলব- পেয়েছি, পুরোপুরিই পেয়েছি। আর পাবই না বা কেন! ব্যাপারটি তো আদর্শের, অন্তরের, মনের, মাইন্ডের, মাইন্ডসেটের, অন্তরলিপির, ভাবনছবির, বিশ্বাসের স্বরলিপির। সেই আদর্শ আমরা কখনো ছাড়িনি, বরং আমরা পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মস্তকে-মগজে ও মাথায় খোপে-প্রকোষ্ঠে প্রবলভাবে সেঁধিয়ে দিচ্ছি, সিঁধ কেটে কেটে, দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ আমাদের ডিজাইন ও নকশামতো অত্যন্ত বিরূপ ছবিতে আঁকবার ও সাজাবার চেষ্টায়-প্রচেষ্টায়।
আর যুদ্ধের ফলাফলের কথা যদি বলেন, আমি আপনাকে থামাব। খুব বেশিদূর এগোতে দেব না।
: কেন! সে রকম কেন হবে?
: হবে এ জন্য যে, রেজাল্টকে আপনারা যেভাবে দেখেন, আমরা সেভাবে দেখি না। আমাদের কাছে এর মাত্রা ভিন্ন। আমরা ভাবি, দুনিয়াকে বাদ দিয়ে কিংবা টোটালি অবহেলা করে নিজের জন্য অপার্থিব কল্যাণচেতনায় আমি উদ্বুদ্ধ হতে পারলাম কি না। আমরা ভাবি, 'হৌল হার্টিডলি' একটি ক্রুসেডে কিংবা ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারলাম কি না; অংশগ্রহণের পুণ্য আমি নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারলাম কি না, স্বর্গলোকে যাওয়ার পথে কিছু মাইলেজ আমার অনুকূলে নিয়ে আসতে পারলাম কি না।
তা ছাড়া একটা জিনিস ভুলে গেলে একেবারেই চলবে না যে আমাদের অবস্থান ছিল নৈতিক ও আদর্শিক। তখন আমাদের গোপন সমর্থন দিয়েছে, এখনো তাদের অনেকে আমাদের নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও তাদের কাছে বিশ্বস্ত, তারাও আমাদের কাছে বিশ্বস্ত। তাদের বিশ্বস্ততার মাপ, ওজন, বেড়-বহর ও দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আমাদের তুলনায় অনেক বড়, অনেক বেশি। তারাই আমাদের 'পেম্পার' করে, 'ফ্ল্যাটার' করে, 'সাপোর্ট' করে এবং পরম আদরে কাঁধে চড়িয়ে রাখে। দে আর রিয়েলি গুড! পার্থক্য, আমাদের চেনা যায়, তাদের যায় না। আমাদের দেখে অরি-বৈরীরা শস্ত্র শানাতে পারে, তাদের দেখে পারে না, কারণ তাদের দেখে ও শুনে মানুষ ভ্রান্ত-বিভ্রান্ত হয়।
দেশের অনেক মানুষ, এই আপনারাই ধরুন না, আমাদের সামাজিক অবদানের কথাও তো কখনো স্বীকার করেননি। আমরা তো বারবার বঞ্চিত হয়েছি! আমরা তো বারবার নৈতিক পিটুনি খেয়েছি! সেদিকে তো আপনারা ফিরেও তাকাননি! সো ক্রুয়েল অ্যান্ড মাইজার য়্যু আর!
: যেমন?
: আমরা তখন, ১৯৭১ সালে আমাদের যুদ্ধের সময় একটি পুরনো অভিধাকে আমাদের লোকদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিলাম। 'গণিমতের মাল'। আমাদের গৌরবগাথা ও বীরত্বের কথা আরো কি জানতে চান?
: চাই তো অবশ্যই! ভেরি ইন্টারেস্টিং, অত্যন্ত গৌরবদীপ্ত, অত্যন্ত বীরত্বব্যঞ্জক!
: আরো বলব তাহলে?
: বলবেন। তবে আজ নয়। আজ এখানে 'ক্ষেমা' দেব। যেটুকু পেয়েছি, সেটুকু আগে লিখে ফেলি। সেটুকু আগে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও পবিত্র দেশের সরলসোজা ও বিশ্বাসপ্রবণ মানুষগুলোকে জানিয়ে রাখি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
: একাত্তরে তাহলে আপনিও যুদ্ধ করেছিলেন! আমার তো বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে! করেছিলেন যুদ্ধ আপনি!
: করেছিলাম মানে! প্রবলভাবে করেছিলাম!
: আপনি তখন নিশ্চয়ই ছাত্র?
: অবশ্যই ছাত্র! বরিশালের একটা স্কুলে আমি তখন কৃতী ছাত্র! আমার এক বন্ধু চট্টগ্রাম থেকে, এক বন্ধু পাবনা থেকে, একজন জয়পুরহাট থেকে, একজন রংপুর থেকে, একজন ঢাকার মগবাজার থেকে, একজন মিরপুর থেকে এবং আরো অনেকজন অনেক দিক থেকে এসে আমাদের সিনিয়র-জুনিয়র-সহপাঠীদের নিয়ে প্রবলভাবে যুদ্ধ করেছি। আপনাদের মতো খুব বেশি লোককে না পারলেও কিছু মানুষকে আমরা দেশের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলাম। অনেক প্রতিপক্ষকে আমরা সংসার থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের বুকের গভীরে ছিল একটি আদর্শ, শত্রুর হাত থেকে দেশ বাঁচানোর আদর্শ। নিজের মাটির প্রতি মমতা, প্রভুর প্রতি আনুগত্য, পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, নিজের জন্মপরিচয় ও বিশ্বাস-পরিচয়ের জন্য অহম এবং বিধর্মী ও ভিনবিশ্বাসীদের প্রতি ঘৃণা ও ক্রোধ, হয় হনন নয় পীড়ন, নয় লাঞ্ছনা ইত্যাদির পবিত্র সংকল্প মাথায় নিয়ে আমাদের দেশের ও আমাদের মাটির পাক-পবিত্র ভুবন থেকে তাদের তাড়ন-বিতাড়নের মানসিকতা।
: দেশে একটি পাবলিক পরীক্ষা হয়েছিল তখন, প্রবেশিকা পরীক্ষা। তখন আপনি কী পরীক্ষায় বসেছিলেন?
: বসেছিলাম মানে! দাঁড়িয়ে ছিলাম! গৌরবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম! পরীক্ষায় আমি স্ট্যান্ড করেছিলাম। আমাদের অনেকেই তখন উচ্চ সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হয়েছিলাম! আমাদের এক সহপাঠী, ব্যবহারজীবী, টক শোতে আসে, বিশেষ ভঙ্গিতে চিবিয়ে চিবিয়ে এক্সপার্ট অপিনিয়ন দেয়, অনেক জ্ঞানগম্যি ও অভিজ্ঞতার মালিক।
- সেও স্ট্যান্ড করেছিল! আপনি দেখলেই তাকে চিনবেন।
: আমি চিনি তাকে। এবার বলুন, এই যুদ্ধে, দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আপনাদের কয়েকজনের কঠিন ও প্রবল যুদ্ধে কেমন স্যাটিসফেকশন পেয়েছিলেন আপনি বা আপনারা?
: দেখুন, আমাদের তৃপ্তি-পরিতৃপ্তি কিংবা তুষ্টি-সন্তুষ্টি অথবা স্যাটিসফেকশনের কথা যদি বলেন, বলব- পেয়েছি, পুরোপুরিই পেয়েছি। আর পাবই না বা কেন! ব্যাপারটি তো আদর্শের, অন্তরের, মনের, মাইন্ডের, মাইন্ডসেটের, অন্তরলিপির, ভাবনছবির, বিশ্বাসের স্বরলিপির। সেই আদর্শ আমরা কখনো ছাড়িনি, বরং আমরা পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মস্তকে-মগজে ও মাথায় খোপে-প্রকোষ্ঠে প্রবলভাবে সেঁধিয়ে দিচ্ছি, সিঁধ কেটে কেটে, দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ আমাদের ডিজাইন ও নকশামতো অত্যন্ত বিরূপ ছবিতে আঁকবার ও সাজাবার চেষ্টায়-প্রচেষ্টায়।
আর যুদ্ধের ফলাফলের কথা যদি বলেন, আমি আপনাকে থামাব। খুব বেশিদূর এগোতে দেব না।
: কেন! সে রকম কেন হবে?
: হবে এ জন্য যে, রেজাল্টকে আপনারা যেভাবে দেখেন, আমরা সেভাবে দেখি না। আমাদের কাছে এর মাত্রা ভিন্ন। আমরা ভাবি, দুনিয়াকে বাদ দিয়ে কিংবা টোটালি অবহেলা করে নিজের জন্য অপার্থিব কল্যাণচেতনায় আমি উদ্বুদ্ধ হতে পারলাম কি না। আমরা ভাবি, 'হৌল হার্টিডলি' একটি ক্রুসেডে কিংবা ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারলাম কি না; অংশগ্রহণের পুণ্য আমি নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারলাম কি না, স্বর্গলোকে যাওয়ার পথে কিছু মাইলেজ আমার অনুকূলে নিয়ে আসতে পারলাম কি না।
তা ছাড়া একটা জিনিস ভুলে গেলে একেবারেই চলবে না যে আমাদের অবস্থান ছিল নৈতিক ও আদর্শিক। তখন আমাদের গোপন সমর্থন দিয়েছে, এখনো তাদের অনেকে আমাদের নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও তাদের কাছে বিশ্বস্ত, তারাও আমাদের কাছে বিশ্বস্ত। তাদের বিশ্বস্ততার মাপ, ওজন, বেড়-বহর ও দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আমাদের তুলনায় অনেক বড়, অনেক বেশি। তারাই আমাদের 'পেম্পার' করে, 'ফ্ল্যাটার' করে, 'সাপোর্ট' করে এবং পরম আদরে কাঁধে চড়িয়ে রাখে। দে আর রিয়েলি গুড! পার্থক্য, আমাদের চেনা যায়, তাদের যায় না। আমাদের দেখে অরি-বৈরীরা শস্ত্র শানাতে পারে, তাদের দেখে পারে না, কারণ তাদের দেখে ও শুনে মানুষ ভ্রান্ত-বিভ্রান্ত হয়।
দেশের অনেক মানুষ, এই আপনারাই ধরুন না, আমাদের সামাজিক অবদানের কথাও তো কখনো স্বীকার করেননি। আমরা তো বারবার বঞ্চিত হয়েছি! আমরা তো বারবার নৈতিক পিটুনি খেয়েছি! সেদিকে তো আপনারা ফিরেও তাকাননি! সো ক্রুয়েল অ্যান্ড মাইজার য়্যু আর!
: যেমন?
: আমরা তখন, ১৯৭১ সালে আমাদের যুদ্ধের সময় একটি পুরনো অভিধাকে আমাদের লোকদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিলাম। 'গণিমতের মাল'। আমাদের গৌরবগাথা ও বীরত্বের কথা আরো কি জানতে চান?
: চাই তো অবশ্যই! ভেরি ইন্টারেস্টিং, অত্যন্ত গৌরবদীপ্ত, অত্যন্ত বীরত্বব্যঞ্জক!
: আরো বলব তাহলে?
: বলবেন। তবে আজ নয়। আজ এখানে 'ক্ষেমা' দেব। যেটুকু পেয়েছি, সেটুকু আগে লিখে ফেলি। সেটুকু আগে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও পবিত্র দেশের সরলসোজা ও বিশ্বাসপ্রবণ মানুষগুলোকে জানিয়ে রাখি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
No comments