শিক্ষা-পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে, ই-বুকেও by সুবোধ চন্দ্র ঢালী
সাড়ে তিন কোটির অধিক শিশু-কিশোরের বুকভরা আনন্দের দিন_ পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস। ১ জানুয়ারি এমন আনন্দের দিন জাতি দেখবে চতুর্থবারের মতো। শিক্ষা খাতে সবচেয়ে দুঃসাহসিক, যুগান্তকারী ও আশা জাগানিয়া বিশাল সফল কর্মযজ্ঞ হলো বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ।
প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি স্তরের সব ছাত্রছাত্রীর নতুন বই প্রাপ্তি আজ বাস্তবতা। ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ শুরু করেছে। পর পর চার বছর ১ জানুয়ারি সারাদেশে ঘরে ঘরে বই পেঁৗছে দেওয়া সরকারের সফলতার নজিরে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও ঝরে পড়া রোধে এটি একটি বড় উদ্যোগ।
২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ১৯ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও ঝরে পড়া হ্রাসের ফলে পরের দু'বছরেই তা বেড়ে প্রায় ২৩ কোটিতে পেঁৗছায়। ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রায় ২৭ কোটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমান সরকারের আগে কখনও ১ জানুয়ারিতে ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই পেঁৗছানো সম্ভব হয়নি। বরং তখন বই কিনতে মার্চ-এপ্রিল মাস গড়িয়ে যেত। সরকার মূল্য নির্ধারণ করে মাধ্যমিকের বই ছাপাত এবং ছাত্রছাত্রীরা বইয়ের দোকান থেকে কিনে নিত। গ্রামে-গঞ্জে অসংখ্য হতদরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা বছরের শুরুতে বই কিনতে না পেরে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ত, ঝরে যেত অনেকে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিকেই প্রাথমিকের শতভাগ বইসহ সব ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম থেকে নবম-দশম শ্রেণীর শতভাগ বই বিনামূল্যে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি এক্ষেত্রে বিশাল ঝুঁকিও নিয়েছেন। এমন একটি দুঃসাধ্য ও দুঃসাহসিক কাজে হাত দেওয়ার জন্য অনেকেই তার উদ্যোগকে 'অবাস্তব' বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এ অসম্ভব কাজটি বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সত্যি কথা বলতে কি, স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে পাঠ্যবই ছাপানোর কাজটি ছিল গুটিকয়েক প্রকাশনা মালিকের হাতে বন্দি। ছাত্রছাত্রীদের কিনতে হতো নোটবই, গাইডবই। কেউ কেউ সরকারের কাছ থেকে কম দামে কাগজ নিয়ে বেশি দামে বাইরে বিক্রি করে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপাত। ২০০৯ সালের শেষ দিকে বই ছাপানো যখন শেষ পর্যায়ে, সে সময় একটি বিশেষ মহল সরকারের বইয়ের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়, এ কথা সবারই জানা। চারদিন চার রাত ধরে আগুন জ্বলল। শুরু থেকেই ছিল নানামুখী চাপ-হুমকি, ছিল ষড়যন্ত্র, ছিল শক্তিশালী তদবির। সরকার অত্যন্ত ধৈর্য আর সাহসের সঙ্গে তা মোকাবেলা করছে। পরপর তিন বছর সব বাধা পেরিয়ে ১ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর হাতে বই পেঁৗছানো সম্ভব হয়েছে এবং আগামী ১ জানুয়ারিতেও পেঁৗছে দেওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। 'জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০'-এর আলোকে প্রণীত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের নতুন পাঠ্যপুস্তকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিচয়, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিধৃত হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর বাংলা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়া পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি' নামে একটি নতুন বিষয় প্রবর্তন করা হয়েছে। ওই বিষয়টি পর্যায়ক্রমে সপ্তম, অষ্টম ও নবম-দশম শ্রেণীর জন্যও প্রণীত হবে। তাছাড়া প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক স্তরের বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বই দেওয়া হবে।
এনসিটিবি ডায়নামিক ওয়েবসাইট (িি.িহপঃন.মড়া.নফ) তৈরি করে সেখানে ২০১০ শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যপুস্তকের পিডিএফ ভার্সন আপলোড করা হয়েছে। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এটুআই প্রোগ্রামের সহযোগিতায় প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যপুস্তক আকর্ষণীয় ও সহজে ব্যবহারযোগ্য ই-বুকে কনভার্ট করে িি.িবনড়ড়শ.মড়া.নফ আপলোড করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা গবেষক, বিভিন্ন সংস্থা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো সময় পাঠ্যপুস্তক সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে ই-লার্নিং কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়া রয়েছে, সেখানে ই-বুক ব্যবহার করে পাঠদান করতে পারছে।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে যেসব পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হচ্ছে তা লেখা হয়েছে ১৭ বছর আগে। এ সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশেষ করে প্রযুক্তির জগতে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে গেছে। এর কোনো প্রতিফলন আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ছিল না। সরকার কম সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কারিকুলাম যুগোপযোগী করেছে। ২০১২ সালে নতুন কারিকুলামের ৭টি নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পেঁৗছানো হয়েছে। আগামী ১ জানুয়ারি প্রাথমিকের ৩৩টি, ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণীর ৫১টি এবং নবম-দশম শ্রেণীর ২৭টি বই হবে নতুন কারিকুলামের। কারিকুলাম যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কারিকুলামের বৈশিষ্ট্য, নম্বর বিন্যাস, বিষয় সংযোজন-বিয়োজনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করা হয়েছে। আগে যে কোনো বইয়ের যে কোনো অধ্যায়ের শেষে সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে কী শেখা হলো তার উল্লেখ ছিল। এখন শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা ও বিষয়ের প্রতি অধিক আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে অধ্যায়ের শুরুতেই সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে কী কী শেখা যাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, জীবনমুখী শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্ম ও জীবনভিত্তিক শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা, ক্যারিয়ার এডুকেশন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, চারু ও কারুকলা নতুন বিষয় হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। আগের ধর্ম বইয়ের পরিবর্তে এখন ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বই করা হয়েছে। বইয়ে ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হবে। কর্ম ও জীবনভিত্তিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয় দুটি ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে পর্যায়ক্রমে প্রবর্তন করা হচ্ছে। সমাজ বিষয়ে বইয়ের আধুনিক সংস্করণ 'বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়' নামে বই করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীতে ১০০ নম্বরের ১টি ঐচ্ছিক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। বানান রীতিও একই পদ্ধতি অর্থাৎ বাংলা একাডেমীর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয় প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিভিন্ন ধারার (সাধারণ, মাদ্রাসা ও ইংরেজি) আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আরও আশার কথা, ২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
বিনামূল্যে বই দেওয়ার পাশাপাশি বর্তমান সরকার সর্বজনগ্রাহ্য একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সারাদেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পঞ্চম শ্রেণী শেষে সমাপনী পরীক্ষা, অষ্টম শ্রেণী শেষে জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা গ্রহণ, বছর শুরুর দিন থেকে ক্লাস শুরু করা, কারিকুলামের যুগোপযোগী উন্নয়ন ও পরিমার্জন, সুনির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা গ্রহণ, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শেষে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা, সর্বস্তরে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে নানা যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সব মিলিয়ে বলতেই হয়, বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা খাতে ঘটে গেছে নীরব বিপ্লব। আগামী ১ জানুয়ারি সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব ছাত্রছাত্রীর কাছে পাঠ্যবই বিতরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ৩ কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থী এখন বই পাওয়ার প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। ভবিষ্যতেও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ছাত্রছাত্রীদের এ আনন্দের ধারা অব্যাহত থাকবে, সেটাই প্রত্যাশা।
সুবোধ চন্দ্র ঢালী :সিনিয়র তথ্য অফিসার
শিক্ষা মন্ত্রণালয়
২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ১৯ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও ঝরে পড়া হ্রাসের ফলে পরের দু'বছরেই তা বেড়ে প্রায় ২৩ কোটিতে পেঁৗছায়। ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রায় ২৭ কোটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমান সরকারের আগে কখনও ১ জানুয়ারিতে ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই পেঁৗছানো সম্ভব হয়নি। বরং তখন বই কিনতে মার্চ-এপ্রিল মাস গড়িয়ে যেত। সরকার মূল্য নির্ধারণ করে মাধ্যমিকের বই ছাপাত এবং ছাত্রছাত্রীরা বইয়ের দোকান থেকে কিনে নিত। গ্রামে-গঞ্জে অসংখ্য হতদরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা বছরের শুরুতে বই কিনতে না পেরে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ত, ঝরে যেত অনেকে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিকেই প্রাথমিকের শতভাগ বইসহ সব ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম থেকে নবম-দশম শ্রেণীর শতভাগ বই বিনামূল্যে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি এক্ষেত্রে বিশাল ঝুঁকিও নিয়েছেন। এমন একটি দুঃসাধ্য ও দুঃসাহসিক কাজে হাত দেওয়ার জন্য অনেকেই তার উদ্যোগকে 'অবাস্তব' বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এ অসম্ভব কাজটি বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সত্যি কথা বলতে কি, স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে পাঠ্যবই ছাপানোর কাজটি ছিল গুটিকয়েক প্রকাশনা মালিকের হাতে বন্দি। ছাত্রছাত্রীদের কিনতে হতো নোটবই, গাইডবই। কেউ কেউ সরকারের কাছ থেকে কম দামে কাগজ নিয়ে বেশি দামে বাইরে বিক্রি করে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপাত। ২০০৯ সালের শেষ দিকে বই ছাপানো যখন শেষ পর্যায়ে, সে সময় একটি বিশেষ মহল সরকারের বইয়ের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়, এ কথা সবারই জানা। চারদিন চার রাত ধরে আগুন জ্বলল। শুরু থেকেই ছিল নানামুখী চাপ-হুমকি, ছিল ষড়যন্ত্র, ছিল শক্তিশালী তদবির। সরকার অত্যন্ত ধৈর্য আর সাহসের সঙ্গে তা মোকাবেলা করছে। পরপর তিন বছর সব বাধা পেরিয়ে ১ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর হাতে বই পেঁৗছানো সম্ভব হয়েছে এবং আগামী ১ জানুয়ারিতেও পেঁৗছে দেওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। 'জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০'-এর আলোকে প্রণীত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের নতুন পাঠ্যপুস্তকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিচয়, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিধৃত হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর বাংলা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়া পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি' নামে একটি নতুন বিষয় প্রবর্তন করা হয়েছে। ওই বিষয়টি পর্যায়ক্রমে সপ্তম, অষ্টম ও নবম-দশম শ্রেণীর জন্যও প্রণীত হবে। তাছাড়া প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক স্তরের বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বই দেওয়া হবে।
এনসিটিবি ডায়নামিক ওয়েবসাইট (িি.িহপঃন.মড়া.নফ) তৈরি করে সেখানে ২০১০ শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যপুস্তকের পিডিএফ ভার্সন আপলোড করা হয়েছে। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এটুআই প্রোগ্রামের সহযোগিতায় প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যপুস্তক আকর্ষণীয় ও সহজে ব্যবহারযোগ্য ই-বুকে কনভার্ট করে িি.িবনড়ড়শ.মড়া.নফ আপলোড করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা গবেষক, বিভিন্ন সংস্থা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো সময় পাঠ্যপুস্তক সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে ই-লার্নিং কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়া রয়েছে, সেখানে ই-বুক ব্যবহার করে পাঠদান করতে পারছে।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে যেসব পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হচ্ছে তা লেখা হয়েছে ১৭ বছর আগে। এ সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশেষ করে প্রযুক্তির জগতে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে গেছে। এর কোনো প্রতিফলন আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ছিল না। সরকার কম সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কারিকুলাম যুগোপযোগী করেছে। ২০১২ সালে নতুন কারিকুলামের ৭টি নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পেঁৗছানো হয়েছে। আগামী ১ জানুয়ারি প্রাথমিকের ৩৩টি, ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণীর ৫১টি এবং নবম-দশম শ্রেণীর ২৭টি বই হবে নতুন কারিকুলামের। কারিকুলাম যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কারিকুলামের বৈশিষ্ট্য, নম্বর বিন্যাস, বিষয় সংযোজন-বিয়োজনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করা হয়েছে। আগে যে কোনো বইয়ের যে কোনো অধ্যায়ের শেষে সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে কী শেখা হলো তার উল্লেখ ছিল। এখন শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা ও বিষয়ের প্রতি অধিক আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে অধ্যায়ের শুরুতেই সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে কী কী শেখা যাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, জীবনমুখী শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্ম ও জীবনভিত্তিক শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা, ক্যারিয়ার এডুকেশন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, চারু ও কারুকলা নতুন বিষয় হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। আগের ধর্ম বইয়ের পরিবর্তে এখন ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বই করা হয়েছে। বইয়ে ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হবে। কর্ম ও জীবনভিত্তিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয় দুটি ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে পর্যায়ক্রমে প্রবর্তন করা হচ্ছে। সমাজ বিষয়ে বইয়ের আধুনিক সংস্করণ 'বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়' নামে বই করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীতে ১০০ নম্বরের ১টি ঐচ্ছিক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। বানান রীতিও একই পদ্ধতি অর্থাৎ বাংলা একাডেমীর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয় প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিভিন্ন ধারার (সাধারণ, মাদ্রাসা ও ইংরেজি) আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আরও আশার কথা, ২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
বিনামূল্যে বই দেওয়ার পাশাপাশি বর্তমান সরকার সর্বজনগ্রাহ্য একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সারাদেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পঞ্চম শ্রেণী শেষে সমাপনী পরীক্ষা, অষ্টম শ্রেণী শেষে জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা গ্রহণ, বছর শুরুর দিন থেকে ক্লাস শুরু করা, কারিকুলামের যুগোপযোগী উন্নয়ন ও পরিমার্জন, সুনির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা গ্রহণ, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শেষে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা, সর্বস্তরে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে নানা যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সব মিলিয়ে বলতেই হয়, বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা খাতে ঘটে গেছে নীরব বিপ্লব। আগামী ১ জানুয়ারি সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব ছাত্রছাত্রীর কাছে পাঠ্যবই বিতরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ৩ কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থী এখন বই পাওয়ার প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। ভবিষ্যতেও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ছাত্রছাত্রীদের এ আনন্দের ধারা অব্যাহত থাকবে, সেটাই প্রত্যাশা।
সুবোধ চন্দ্র ঢালী :সিনিয়র তথ্য অফিসার
শিক্ষা মন্ত্রণালয়
No comments