শিক্ষা-শিক্ষাবর্ষ ও কর্মদিবস বিষয়ে কিছু প্রস্তাব by শেখ শাহবাজ রিয়াদ

 শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরন, ব্যবস্থাপনা, স্তর ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিক্ষাবর্ষ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সরকারি-বেসরকারি সর্বস্তরে শিক্ষাবর্ষ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের শিক্ষাবর্ষ হচ্ছে জুলাই থেকে জুন।
বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিনটি একাডেমিক_ সামার, ফল ও উইন্টার সেশনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ২০১১ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বিদ্যালয়ের শিক্ষাবর্ষের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর করা হয়েছে, যা আগে ছিল জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত। প্রত্যেক দেশে কিংবা একই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বা বিষয়ের শিক্ষাবর্ষে যেমন পার্থক্য দেখা যায়, তেমনি বিভিন্ন দেশে একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাবর্ষের কোনো কর্মদিবসের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কর্মদিবস হচ্ছে, কোন নির্দিষ্ট শিক্ষাবর্ষে মোট যত দিন বিদ্যালয়ে শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তার সমষ্টি। তবে সব কর্মদিবসেই শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাসহ অন্যান্য কার্যক্রম চলাকালে ক্লাস বন্ধ থাকে। এনসিটিবি কর্তৃক প্রণীত শিক্ষাক্রমে মোট কর্মদিবস ২২০ দিন উল্লেখ করলেও বাস্তবে সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মতো পাওয়া যায় শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। বছরের মোট ৫২টি শুক্রবারের সঙ্গে ৮৫ দিন সরকারি ছুটি এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও বার্ষিক পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ৪৫ দিন যোগ করলে ক্লাস হয় না, এমন দিনের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮২ দিনের মতো। অর্থাৎ ৩৬৫ দিনের মধ্যে আমাদের শ্রেণী কার্যক্রম চলে মাত্র অর্ধেক সময়। তবে এটি সেসব বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার জন্য, যেগুলো এসএসসি, এইচএসসি, দাখিল, আলিম ও বৃত্তি পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। অন্যদিকে যেসব বিদ্যালয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেগুলোতে শ্রেণী কার্যক্রম আরও ব্যাহত হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখা যায় না। কারণ বিদ্যালয়ের শ্রেণী কার্যক্রমেই তারা একমাত্র নির্ভর নয়, বরং আমাদের অধিকাংশ অধিক নম্বরপ্রত্যাশী ভালো শিক্ষার্থী ও তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী অভিভাবকরা কোচিং ও প্রাইভেট পড়াশোনাতেই বেশি নির্ভরশীল। আবার শিক্ষকদের কাছে পরামর্শ চাইলে তারা সরাসরি অথবা ইনিয়ে-বিনিয়ে যে পরামর্শটি দেন তা হলো, ভালো করতে হলে তাকে কোচিং বা এক্সট্রা কেয়ার নিতে হবে। ফলে কোনো কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে কোচিং ব্যবসায়ী শিক্ষকরা সে সময় যথাযথভাবে কাজে লাগান। শিক্ষার যে সার্বিক লক্ষ্য শিক্ষার্থীর আত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক দিকের বিকাশ, তা কোনোভাবেই অর্জিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। বর্তমানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কোচিংপ্রীতি অনেকটা কোচিং আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েকজন শিক্ষক তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানান, ক্লাস চলাকালে তাদের ভালো ছাত্রীরা লুকিয়ে লুকিয়ে কোচিংয়ের শিট মুখস্থ করে এবং ক্লাসের প্রতি অমনোযোগী থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, যেহেতু আমেরিকার শিক্ষার্থীদের তাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে, তাই তাদের বেশি সময় বিদ্যালয়ে থাকা উচিত। তিনি বর্তমান শিক্ষাপঞ্জিকে আমেরিকার কৃষক যুগের উল্লেখ করে আরও বলেছেন, সে সময় এটির যৌক্তিকতা ছিল, কারণ তখন আমেরিকার শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় থেকে ফিরে প্রতিদিন তাদের কৃষক বাবা-মাকে চাষে সাহায্য করতে হতো। কর্মদিবস বাড়াতে তিনি বিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থানকালীন সময় বৃদ্ধি অথবা সামার ভেকেশন কমাতে পরামর্শ দিয়েছেন। বারাক ওবামার এ মন্তব্যটি আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য। আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত উন্নয়নের জন্য এত আয়োজন, এত কর্মতৎপরতার পরও বিদ্যালয়ের কর্মদিবসগুলোকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করা এখনও সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন দিবসে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণার কারণে এসব দিবসের আদর্শ, তাৎপর্য ও মূল্যবোধ জানা, অর্জন এবং অনুশীলনের সর্বোত্তম সুযোগ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও ছুটির তালিকায় বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে কিছু কিছু দিবস পালনের নির্দেশ দেওয়া থাকে। তবে তা পালিত হয় সরকারি আদেশের বাধ্যবাধকতা পালনের জন্যই, অনেকটা দায়সারা ভঙ্গিতে; মূল্যবোধ অর্জনের জন্য নয়। সুতরাং এসব দিবসকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, শ্রমের মর্যাদা, বাঙালিত্ব অর্জন ও বিকাশ এবং সর্বোপরি ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অর্জনের সবচেয়ে কার্যকর দিবস হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। নৈতিকতা, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, নেতৃত্ব চর্চা, সামাজিক দায়বদ্ধতা_ সবকিছু চর্চা ও অর্জনের উপযুক্ত এবং আনন্দদায়ক স্থান হবে বিদ্যালয়গুলো। রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীতে জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে বিদ্যালয়গুলোতে থাকবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। কর্মদিবসের ব্যাপ্তি আরও বাড়াতে অভ্যন্তরীণ ও পাবলিক পরীক্ষার জন্য বর্তমান বরাদ্দকৃত সময়ও কমাতে হবে। বছরের পর বছর প্রচলিত তিন ঘণ্টার পরীক্ষাকে দুই ঘণ্টায় আনা যায় কি না, তা-ও ভেবে দেখতে হবে। কেননা বর্তমান যে লিখিত পরীক্ষা সংস্কৃতি চলছে, তা শুধু শিক্ষার্থীদের জ্ঞানগত দিকটিই পরিমাপ করে তার কর্মদক্ষতা (মনো-পেশিজ) এবং বিশ্বাস ও মূল্যবোধের দিকগুলো (আবেগিক) এখানে সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষিত। যার কারণে শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণভাবেই মুখস্থমুখী, পরীক্ষামুখী, নম্বরমুখী, সার্টিফিকেটমুখী সর্বোপরি প্রাইভেট ও কোচিংমুখী হয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরাও। ফলে শিক্ষার্থীদের অন্যান্য প্রতিভা ও সৃজনশীলতাকে আমরা লিখিত পরীক্ষার ভারে প্রকাশ ও বিকশিত হতে দিচ্ছি না। শিক্ষার এই খণ্ডিত অংশের মূল্যায়নের জন্য এত আয়োজনকে কমিয়ে তাদের দক্ষতা ও মূল্যবোধকে মূল্যায়নের আওতায় আনার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেকেশন বিভাগ হিসেবে বিবেচনা করা একটি পুরনো মানসিকতা, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে বছরব্যাপী কর্মচঞ্চলতায় পূর্ণ। তা ছাড়া বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে এত বেশি কাজ-কর্ম, বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ-মনিটরিং পরিচালিত হচ্ছে যে, এগুলোকে ভেকেশন বিভাগ বলা এক ধরনের অবিচার ও সত্য অস্বীকার করা হবে; বরং বর্তমানে যারা সাপ্তাহিক ছুটি দু'দিন পাচ্ছেন, তাদের চেয়ে অনেক বেশি কর্মদিবস ও কর্মঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে শিক্ষকদের। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও ক্লাস্টার ট্রেনিং শুরু হয়েছে। টিকিউআই-সেপ প্রকল্পের অধীন সিপিডি-১ ও সিপিডি-২ প্রশিক্ষণের ধারাবাহিকতায় একদিনের এ প্রশিক্ষণ শিক্ষক মহলে ইতিবাচক সাড়া পড়েছে। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ হচ্ছে শুক্রবার। ফলে প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের সাপ্তাহিক ছুটিও আর থাকছে না। এ অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নন-ভেকেশন বিভাগ ঘোষণা করাই যৌক্তিক হবে। শিক্ষা ক্যাডারের দীর্ঘদিনের দাবিও এটি। বরং গ্রীষ্মকালীন, শীতকালীন ছুটি, পরীক্ষার জন্য বর্তমান নির্ধারিত সময় কমিয়ে বিদ্যালয়ের কর্মদিবস বাড়ানো ও শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেওয়া হোক এবং জাতীয় দিবসগুলো সত্যিকার অর্থে পালন করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান ছুটির তালিকা থেকে এগুলো বাদ দেওয়া হোক। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সাপ্তাহিক দু'দিন_ বৃহস্পতি ও শুক্রবার বন্ধ থাকবে। কোনো অর্ধদিবস থাকবে না। শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত পূর্ণদিবস বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড চলবে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বন্ধের দু'দিন তাদের বাকি পাঁচ দিনের বাড়ির কাজ, খাতা দেখা, প্রশ্ন তৈরি করা, পাঠ পরিকল্পনা ও শিক্ষণ-সহায়ক উপকরণ তৈরির যথেষ্ট সময় পাবে। শিক্ষকরা ক্লাস্টার প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণেও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। অধিকন্তু যে উদ্দেশ্যে সাপ্তাহিক ছুটি দু'দিন করা হয়েছে, তার সুবিধাও পাওয়া যাবে। সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও যানজট হ্রাসসহ বেশ কিছু আর্থ-সামাজিক সুফলও পাওয়া যাবে।

শেখ শাহবাজ রিয়াদ : সহকারী অধ্যাপক
টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা
riadisrat1971@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.