কোর্টের তত্ত্বাবধায়ক বাতিল প্রসঙ্গে খালেদা ॥ টাকার বিনিময়ে রায়- ০ যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠিকমতো হচ্ছে না- ০ প্রধানমন্ত্রী চোরের মা- ০ মানুষ বিদ্যুত পাচ্ছে না
যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠিকমতো হচ্ছে না বলে অভিযোগ করে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছেন, শুধু জামায়াত-বিএনপির নয়, আপনার দল ও পরিবারের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধী রয়েছে।
তাদেরও বিচার আগে করুন তাহলে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকবে না। আপনারা যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারবেন না। তবে আমরা ক্ষমতায় গেলে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজাকার বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এক রাজাকারকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করে সরকার কিভাবে রাজাকারদের বিচার করবে। তিনি বলেন, তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো চলবে না। এসবের দাম বাড়লে সব কিছুর দাম বাড়বে। জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে। তাই সরকার তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী পালন করে এর প্রতিবাদ জানানো হবে। দেশে এখন এখন জংলী শাসন চলছে বলে অভিযোগ তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য নয়, দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আন্দোলন করছি। তত্ত্বাবধায়ক বাতিল প্রসঙ্গে কোর্টের রায় সম্পর্কে তিনি বলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে এনে রায় দেয়া হয়েছে। শোনা যায় টাকার বিনিময়ে রায় দেয়া হয়েছে। বুধবার রাজধানীতে গণসংযোগ কর্মসূচী পালনকালে বিভিন্ন পথসভায় তিনি এ কথা বলেন। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বুধবার সারাদেশের সব মহানগরে গণসংযোগ কর্মসূচী পালন করেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট।র্যাব-পুলিশের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাজধানীতে খালেদা জিয়ার গণসংযোগ কর্মসূচী শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হলেন যাত্রবাড়ীতে স্থানীয় বিএনপি নেতা নবীউল্লাহ নবী ও সালাউদ্দিন আহমেদের গ্রুপের মধ্যে চেয়ার ছোড়াছুড়ির ঘটনা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। খালেদা জিয়া যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কের পথসভা মঞ্চে আগমনের আগেই দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি শোডাউন করাকে নিয়ে এ ঘটনা ঘটে।
সরকারের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, আপনারা নির্ধারিত ৫ বছর সময় পার করুন। এতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আপনাদেরই পাস করতে হবে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল আনলে আমরা সংসদে গিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করতে রাজি আছি। তাই এ বিল এনে একটি ভাল কাজ করুন। তত্ত্বাবধায়ক বিল না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সংসদে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দেশে কোন নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠিকমতো হচ্ছে না মাহমুদুর রহমান সেটাই প্রকাশ করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিরোধী দলকে হয়রানি করার জন্য একদিন দুদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা ও গান পাউডার দিয়ে গাড়ি পোড়ানের দায়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হুকুমের আসামি করা হবে। আদালতের এক মন্তব্য ধরে প্রধানমন্ত্রীর মাথা খারাপ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সকালে ঘুম থেকে উঠে সারাদিন মিথ্যা কথা বলেন। আমাদের বিরুদ্ধে সারাক্ষণ গালিগালাজ করেন। এরকম অবস্থার জন্য একদিন সুপ্রীমকোর্ট তাকে রং হেডেড বলেছিল। এমন মাথা খারাপ মানুষকে রাষ্ট্রের চেয়ারে রাখা যায় না।
জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধা নিয়ে সরকারী দলের সমালোচনার জবাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এ দলটির নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, দলের নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর ছবি পথসভায় জনতার সামনে তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ৯৫ সালে এই জামাতকে নিয়ে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছে। ’৮৬ সালে এ জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গিয়েছিল। তখন জামায়াতী যুদ্ধাপরাধী না হলে এখন কেন যুদ্ধাপরাধী হলো জামায়াত। জামায়াত যুদ্ধাপরাধী হলে শেখ মুজিবুর রহমান কেন তাদের মাফ করে দিলেন। আর ’৯৬ তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই বা কেন তাদের বিচার করল না। আসলে জামায়াত যখন তাদের সঙ্গে থাকে তখন যুদ্ধাপরাধী থাকে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ছেলে, জামাইসহ আত্মীয়স্বজনরা দুর্নীতি করছে। তিনিই হচ্ছেন চোরের মা। আজ তার বড় গলা। আপনি নিজেই দুর্নীতি করছেন। এখন ভয় দেখানোর জন্য বড় গলায় কথা বলছেন। এ যেন চোরের মায়ের বড় গলা। প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলেকে নিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, অর্থ পাচার করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরে ডলারসহ ধরা পড়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। এই টাকা সে বাংলাদেশ থেকে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদে আছেন বলে তাকে সম্মান করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এত অর্থ কোথা থেকে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে পেয়েছে, তার তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী ও তার আত্মীয় স্বজনের দুর্নীতি তদন্ত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করা হবে। অর্থ পাচারের সঙ্গে একদিন প্রধানমন্ত্রী ও তার ছেলেকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী তাঁর পরিবার কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আমাদের কাছে তাদের দুর্নীতির অনেক তথ্যপ্রমাণ আছে।
আরাফাত রহমান ও তারেক রহমানের দুর্নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনার জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, তাঁর মুখে দুর্নীতির কথা জনগণ বিশ্বাস করে না। আমাদের অর্থ পাচারের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করতে পারবেন, কিন্তু তা প্রমাণ করতে পারবেন না।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, দুর্নীতির টাকা শুধু দুই আবুল নেননি। তারা ওপর মহলেও ভাগ দিয়েছে। এ কারণে তাদের ধরা হচ্ছে না। কারণ আবুলদের ধরলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশ করে। এ কারণে এ সরকার ক্ষমতায় এসে ১৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করেছে। সাগর-রুনি সরকারের দুর্নীতির কথা জানতেন এবং তারা তা প্রকাশ করতে চেয়ছিলেন। তাই তাদের হত্যা করা হয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ দেশ বিক্রি করে হলেও ক্ষমতায় থাকতে চায়। আর ক্ষমতার জন্য তারা যা খুশি তাই করছে। দেশবাসীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আগেও আপনাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেছে। এবারও নির্বাচনের আগে নতুন নতুন আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু সাপকে বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি বলেন, আমরা আন্দোলন কর্মসূচী পালন করছি। এ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন বন্ধ হবে না এ সরকারকে না হটিয়ে আমরা ঘরে ফিরে যাব না। মিথ্যে অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ১৮ দলের অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার ও ২৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি করেন।
বিরোধী দলের নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও দেশে নারীদের ওপর নির্যাতন চলছে। কয়েক দিন আগে কয়েকজন পর্দানশীল নারীকে পুলিশ ধরে রিমান্ডে নিয়েছে। তাদের নির্যাতন করেছে। এর নাম কি গণতন্ত্র? আসলে দেশে কোন গণতন্ত্র নেই। তাই সরকারী দলের লোকদের সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে বিরোধী দলকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারী দলের নেতাদের ৭ হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যতই মামলা প্রত্যাহার করেন তাতে কাজ হবে না। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এ মামলা আবার চালু হবে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, দেশের মানুষ ভাল নেই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, সরকারের টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে মানুষ অতিষ্ঠ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে গুম-খুন বেড়ে গেছে। ৬ মাস হলো বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে এখনও তার খবর নেই। স্বাধীনতার পর রক্ষী বাহিনী দিয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সিকদার ও জলিলসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করেছে। তখন আওয়ামী লীগ ৪০ হাজার মানুষ হত্যা করেছে। তাই এ সরকারের কাছ থেকে বাঁচতে এখন আর বসে থাকার সময় নেই। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। যুবসমাজকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আর ঘুমিয়ে থাকার সময় নেই ঘরে ঘরে চাকরি চাইলে, দেশের উন্নয়ন চাইলে এখন এ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন দল থাকলে তা আমাদের দল বিএনপিই।
খালেদা জিয়া বলেন, দেশে এখন গণতন্ত্র নেই, মানুষের গণতান্ত্রিক কোন অধিকার নেই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। আমরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছি। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আন্দোলন করছি। এজন্য দরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্দলীয় সরকার ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কারণ আওয়ামী লীগ কী জিনিস তা এদেশের মানুষ জানেন। তাদের অধীনে ’৭৩ সালে কেমন নির্বাচন হয়েছে তাও জানেন। তিনি বলেন, এই সরকার কথায় কথায় কোর্টের দোহাই দেয়। কিন্তু কোর্টতো রায় দিয়েছেন আরও দুই বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, এখনও সময় আছে ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দিন। তা না হলে এর জন্য একদিন আপনাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই দায়ী। তিনিই দলীয় ক্যাডারদের এ অপকর্মের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্বজিৎ কোন দল করে না। তাঁকে ছাত্রলীগের ক্যাডারবাহিনী কী ভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তা আপনারা দেখেছেন। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিথ্যা কথা বলেন।
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গণসংযোগ কর্মসূচীতে অংশ নিতে সকাল ১০টা ৩৩ মিনিটে গুলশানের বাসা থেকে রওনা দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বেলা ১১টায় তিনি গাবতলী বাসস্টেশনে গিয়ে পৌঁছেন। তবে সেখানে উপস্থিত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে পাশ কাটিয়ে গাবতলীর হানিফ পরিবহন বাস ডিপো (পুরনো বিউটি সিনেমা হল) প্রাঙ্গণের মঞ্চে পৌঁছতে আরও ১০ মিনিট সময় লাগে। মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মী-সমর্থকরা করতালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। হাল্কা ঘিয়ে রঙের শাড়ির ওপর শাল পরিহিত খালেদা জিয়া হাত নেড়ে তাদের অভিনন্দনের জবাব দেন। এই পথসভাকে কেন্দ্র করে গাবতলী থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে র্যাব-পুলিশ। খালেদা জিয়া সোয়া ১১টা থেকে শুরু করে প্রায় আধঘণ্টা এই পথসভায় বক্তব্য রাখেন। এর পর তিনি সেখান থেকে কল্যাণপুর, আগারগাঁও সড়ক ও ফার্মগেট হয়ে কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজারে যান ১২টা ৩৩ মিনিটে। সেখানে পথসভা শেষে এফডিসি সড়ক হয়ে মগবাজার রেলক্রসিং, মগবাজার মোড়, রমনা থানা সড়ক, বেইলি রোড সড়ক, কাকরাইল মসজিদ, মৎস্যভবন, হাইকোর্ট হয়ে কার্জন হল সড়ক, নগরভবন, গুলিস্তানে গোলাপ শাহ মাজার সড়ক, নর্থ সাউথ সড়ক, রায়সাবাজার সড়ক হয়ে ধোলাইখালে যান বিকেল ৩টায়। অন্য পথসভায় মঞ্চে উঠে বক্তব্য দিলেও ধোলাইখালে হুড খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখেন তিনি। এরপর দয়াগঞ্জ সড়ক হয়ে যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কের পথসভা মঞ্চে ওঠেন বিকেল ৪টায়। সেখান থেকে সায়েদাবাদ, মানিকনগর, বৌদ্ধ মন্দির হয়ে সবুজবাগের বাসাবো বালুর মাঠে পথসভা করেন পৌনে ৫টায়। এরপর খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বাসাবো হয়ে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে মালিবাগ মোড়, মৌচাক, রামপুরা সড়ক দিয়ে বারিধারা মার্কিন দূতাবাস অতিক্রম করে বাড্ডার ভাটারা মাঠে গিয়ে পৌঁছে সন্ধ্যা ৬টায়। সেখানে সর্বশেষ পথসভায় বক্তব্য রাখেন খালেদা জিয়া। এভাবে ৬টি পথসভায় বক্তব্য রাখার পর তিনি তার গুলশানের বাসায় চলে যান। গণসংযোগ কর্মসূচীতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা, সদস্য সচিব আবদুস সালামসহ অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা।
গণসংযোগ কর্মসূচী চলাকালে খালেদা জিয়া যখন যে এলাকা অতিক্রম করেছেন তখন সে এলাকার নেতাকর্মীরা রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে করতালি ও স্লোগানের মধ্য দিয়ে তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তবে জামায়াতের নেতাকর্মীরা যুদ্ধাপরাধী দলীয় নেতাদের ছবি প্রদর্শন করে তাদের মুক্তি ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বাতিল চেয়ে স্লোগান দিয়েছেন। এমন কর্মসূচীতে দীর্ঘদিন দেখা যায়নি বিএনপি চেয়ারপার্সনকে। বিগত নির্বাচনের সময় সর্বশেষ তিনি এ ধরনের কর্মসূচী পালন করেন। বুধবারের গণসংযোগ চলাকালেও নির্বাচনের আমেজ ফুটে ওঠে। আর খালেদা যে ৬টি পথসভায় বক্তব্য রাখেন তার প্রতিটিতেই আগামীতে ক্ষমতায় গেলে কী কী করবেন তা বলেন।
গণসংযোগ কর্মসূচী চলাকালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অন্য নেতারা গণসংযোগ করেন ঢাকা ছাড়া ৬ বিভাগীয় শহরে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সিলেটে এমকে আনোয়ার, রাজশাহীতে নজরুল ইসলাম খান, রংপুরে লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান, খুলনায় আবদুল মঈন খান ও বরিশালে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গণসংযোগ কর্মসূচীর নেতৃত্ব দেন। কর্মসূচী পালনের মূল দাবি নির্দলীয় সরকার হলেও এর সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিচার বিভাগের দলীয়করণের প্রতিবাদ এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতাকর্মীদের মুক্তি ও তাদের মামলা প্রত্যাহারের দাবিও যোগ করে ১৮ দলীয় জোট।
খালেদা জিয়া বলেন, সরকার হটাতে গণঅভ্যুত্থানই একমাত্র পথ। আর কোন পথ নেই। আজ আমি সেই ডাক দিতে এসেছি। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। এভাবে দেশ চলতে দেয়া যায় না। আমরা গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকারে বিশ্বাস করি। কিন্তু এ সরকারের হাতে গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকার আজ বিঘ্নিত। কোন ধর্মের মানুষ নিরাপদ নয়। এ সরকার হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টানদের ওপরও অত্যাচার চালাচ্ছে। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদে থাকতে হলে আন্দোলন কর্মসূচীতে শরিক হতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিষয়ে খালেদা জিয়া বলেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে এনে নিজেদের সুবিধামতো রায় দেয়া হয়েছে। এখন এ নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। টাকা নিয়ে রায় দেয়া হয়েছে বলেও কথা উঠেছে। এই সরকারের মুখেই শুধু সংবিধানের কথা। কার্যত সংবিধানকে তারাই গুরুত্বহীন করেছে এ সরকার।
খালেদা জিয়া বলেন, দেশ আজ দুর্নীতিবাজ, দখলবাজের হাতে পড়েছে। শিক্ষাঙ্গনকে অস্ত্রাগার বানানো হয়েছে। সরকারদলীয় লোকদের হাতে অস্ত্র দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেয়ায় সারাদেশই যেন আজ অস্ত্রাগারে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা হারাচ্ছেন। তারা চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ। শিল্প কারখানায় অস্থিরতা চলছে, কৃষিখাতে পিছিয়ে পড়ছে দেশ, প্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, দেশে প্রশাসন বলতে কিছু নেই। সার্বিকভাগে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে। পুরো দেশই ধ্বংস করে দিচ্ছে এ সরকার। বিশ্বজিৎ দাশ হত্যার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংবাদপত্রে ছবি ছাপা হওয়ার পরেও সরকার তার দায় এড়াতে চায়। প্রথমে বলেছে, তাদের ছাত্রলীগ জড়িত নয়। এখন প্রকাশিত হচ্ছে সরকারের হুকুমেই ওই সন্ত্রাসীরা রাস্তায় নেমে বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুকুমেই ছাত্রলীগ মাঠে নামে বলে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নয়, আসলে হুকুমের আসামি প্রধানমন্ত্রী নিজেই। তিনিই বলেছেন, প্রতিবাদ করতে প্রয়োজনে মাঠে নামতে। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছিলেন। তিনি বলেন, সরকার পতনের মধ্য দিয়েই বিশ্বজিৎ হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হবে।
ক্ষমতায় গেলে শেয়ারবাজারে লুটপাটকারীদের টাকা ফিরিয়ে এনে বিনিয়োগকারীদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হবে মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার এবারই নয়, আগের বারও শেয়ারবাজারের টাকা লুটপাট করেছিল। তিনি বলেন, কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুত খাতে লুটপাট চালিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পরিবার। মানুষ বিদ্যুত না পেলেও ৬ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে এ সরকার। অনেকবার জ্বলানি তেলের দাম বাগড়ানো হয়েছে। সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে আছে। এ অবস্থা থেকে দেশের মানুষ ও দেশকে বাঁচাতে যুব সমাজকে রাজপথে নেমে আসতে হবে। একবার মুক্তিযুদ্ধ করেছি, প্রয়োজনে দেশ রক্ষার জন্য আরেকবার যুদ্ধ করব।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা জনগণের জন্য, দেশের উন্নয়নের জন্য, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে নির্যাতন-মিথ্যা মামলা প্রতিবাদে এবং নির্দলীয় সরকারের দাবিতে কর্মসূচী দিচ্ছি। আর সরকার বলছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে আন্দোলন করছি। কিন্তু আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। তবে তা হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ও দলে যুদ্ধাপরাধী আছে। তাদের আগে ধরুক, আন্তর্জাতিক মানের বিচার করুক। তা না করে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করবেন না। তিনি বলেন, কান টানলে মাথা আসবে। তাই পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ধরা হচ্ছে না। তিনি বলেন, দুদক সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান। তারা চোর ধরার নামে টাকা হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে। আবুলকে ধরা হলে আসল ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে। এজন্য তাঁকে ধরা হচ্ছে না। কারণ কান টানলে মাথা আসবে।
খালেদা জিয়া বলেন, সরকার তাদের নেতাকর্মীদের সাত হাজার মামলা প্রত্যাহার ও ২১ জনের ফাঁসি মওকুফ করেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দিচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশকে ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছে। পিলখানা হত্যার লোক দেখানো বিচার করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এই মামলার আসল আসামিদেরও বিচার হবে। আর সরকারী দলের নেতাদের প্রত্যাহার করে নেয়া মামলা আবার চালু করা হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা করার অধিকার নেই। পিলখানার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী তা না করে সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিলে এতগুলো অফিসার মারা যেত না।
পুলিশকে হুঁশিয়ার করে খালেদা জিয়া বলেন, বিশ্বজিৎকে হত্যার সময় পুলিশ ঠেকায়নি, অথচ আমাদের লোকজন রাস্তায় নামলে অত্যাচার করে। এজন্যই কি পুলিশকে জনগণের ট্যাক্স দিয়ে বেতন দেয়া হয়। অপরাধীরা দায়িত্বশীল জায়গায় থাকতে পারে না। আপনাদের এই জায়গা আগামীতে অন্যরা পূরণ করবে। কারণ দেশের অন্য যুবকদেরও চাকরি দিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার বলে তারা দেশকে সোনার বাংলা করছে কিন্তু বিশ্বজিৎকে যেভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, পথে-ঘাটে যেভাবে লুটপাট করা হচ্ছে, এরই নাম কি সোনার বাংলা? তারা দেশকে শ্মশানের বাংলায় পরিণত করেছে। আওয়ামী লীগের আমলে সংঘটিত সব গুম, খুন, হত্যার বিচার হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
খালেদ জিয়া বলেন, এ সরকারের পাচার করা সব টাকা একদিন দেশে ফেরত আসবে। জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সজাগ করার জন্য আমরা বেরিয়েছি। সময়মতো নির্বাচন হতে হবে। উপ-নির্বাচন দেখেছি। ’৭৩ সালেও আওয়ামী লীগের নির্বাচন দেখেছি। তারা দলের বাইরে কাউকে চেনে না। তাই তাদের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। এখন মানুষ খুন করে রাস্তায়, জলা-জঙ্গলে লাশ ফেলে রাখা হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য লুটপাট করেছে বলেও অভিযোগ করে তিনি বলেন, আপনাদের আর কত টাকা দরকার। যত টাকা আপনারা বানিয়েছেন তা ভোগ করার সময় পাবেন না।
নির্মল সেনের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, সত্যিই আজ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। তিনি বলেন, নির্মলসেন গুরুতর অসুস্থ। তিনি তার গ্রামে শিক্ষাঙ্গনসহ যা যা করতে চেয়েছিলেন বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তা তা করে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা হবে।
No comments