ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন, বিচার বিলম্বিত হওয়ার কারণ নেই ॥ ইনু
একাত্তরে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে কোন হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, এই বিচার বিলম্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ‘বিভ্রান্তিকর প্রচারের’ কারণে জনগণকে স্বচ্ছ ধারণা দিতে ও সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে বুধবার তথ্য অধিদফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী এ কথা বলেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, একটি মহল একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে ‘সেই মহল’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলা শুরু করেছে। সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতি পদত্যাগ করার পর ঐ সকল দল-মহল-ব্যক্তি বিচারের বিরোধিতা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গে আত্মস্বীকৃত ও সরাসরি যুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াত বিচার বন্ধ করার জন্য সরাসরি রাষ্ট্র প্রশাসন-পুলিশ-আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা শুরু করেছে।সংবাদ সম্মেলনে তিনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ, সে সময় পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের পরিচালিত হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন ঘটনা, বঙ্গবন্ধুর সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার, পরবর্তীতে এই বিচার আটকে থাকা এবং বর্তমান সরকারের সময়ে নতুন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন। এছাড়া বিচারাধীন বিষয় নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য, একটি মহলের মিথ্যাচার, বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার, বিচারের মানদ-, বিচারপতির কথিত স্কাইপে কথোপকথনসহ নানা বিষয় আসে হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যে।
টাইব্যুনালকে ‘সম্পূর্ণ স্বাধীন’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা বিচার কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং তারা স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে স্বাধীনভাবেই বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। তারপরও এ বিচার ভ-ুল করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আইনের ‘অপব্যাখ্যা, ভুল ব্যাখ্যা ও ঢালাও বক্তব্যের’ মাধ্যমে ‘গুজব’ ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, সামরিক শাসন ও সামরিক শাসন সমর্থিত বিএনপি-জামায়াত সরকার বিচার বন্ধ রেখেছিল। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জিয়াউর রহমান এই বিচারের কাজ বন্ধ করে দেন। আইনটা বাতিল করে দেন। জিয়া সরকার ১০ হাজার অভিযুক্তকে কারাগার থেকে মুক্তি দেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার। বিচার দ্রুত এগিয়ে নিতে এরপর গঠন করা হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ও বর্তমান আমিরসহ শীর্ষ নয় নেতা ও বিএনপির দুই নেতার বিচার চলছে এ দুই ট্রাইব্যুনালে।
স্কাইপের মাধ্যমে প্রবাসী এক আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথিত কথোপকথন নিয়ে বিতর্কের মুখে গত ১১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দেন বিচারপতি নিজামুল হক। এরপর পুনর্গঠন করা হয় দুই ট্রাইব্যুনাল।
প্রবাসী আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে বিচারপতি নিজামুল হকের কথিত কথোপকথনের অনুলিপি ও প্রতিবেদন বিএনপি ও জামায়াতপন্থী পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ ও সংগ্রামে প্রকাশের পর বিরোধী দল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ নতুন করে শুরু করার দাবি তোলে।
এরপর ওই কথিত কথোপকথনের ভিত্তিতে কোন ধরনের প্রতিবেদন বা শ্রুতিলিখন প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
সংবাদ সম্মেলনে বিচারকের পদত্যাগ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইনু বলেন, এটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। বিচারক পদত্যাগও করতে পারেন, সরেও যেতে পারেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে বিচারকাজ বিলম্বিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
তিনি বিএনপি ও জামায়াতকে ‘ধ্বংসাত্মক কাজ’ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে বিচারকাজে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
ইনু বলেন, আমরা নির্যাতন করে সামরিক শাসনের মতো বিচার করতে চাই না। আমরা সভ্য মানুষ, গণতান্ত্রিকভাবে বিচার করতে চাই। এই বিচারের জন্য ৪০ বছর অপেক্ষা করেছি, আইন নিজের হাতে তুলে নেইনি। একে একে দেশের সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বিচার কাজ শুরু হয়েছে এবং এটা চলতে থাকবে। আগামী নির্বাচনে যদি এই সরকার ক্ষমতায় আসে তাহলে বিচারকাজ চলতে থাকবে। আর যদি আফগানিস্তান বা পাকিস্তানপন্থী সরকার আসে তাহলে বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে দখলদার পাকহানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশী সহযোগী রাজাকার, আদলবদর, আলশামস্ বাহিনী লাখ লাখ মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ নানা ধরনের পৈশাচিকতার মাধ্যমে ইতিহাসের বর্বরতম মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করে। সমগ্র বাঙালী জাতির ওপর পরিচালিত এই বর্বরতম গণহত্যা-গণধর্ষণের বিচারের কথা উঠলেই কিছু দল-মহল-ব্যক্তি নানাভাবে বিভ্রান্তি অপপ্রচার-মিথ্যাচার চালিয়ে বিচারের বিরোধিতা করে।
মুক্তিযুদ্ধে জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার ও দ- প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ জারি করা হয় এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ প্রণয়ন করা হয়।
বাংলাদেশ কলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী বিচার কার্যক্রম ॥ বাংলাদেশ কলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২-এর অধীনে প্রায় ৩৭ হাজার অপরাধীকে আটক করা হয়। যাদের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ যেমন খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, বলপূর্বক ধর্মান্তারিত করা ইত্যাদি শাস্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধসহ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে দ-যোগ্য অন্যান্য অপরাধ সংঘটনকারী প্রায় ১১ হাজার অপরাধীকে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয়। এই সকল অপরাধীর বিচারের জন্য সারাদেশে মোট ৭৩ স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে বিচারান্তে ২২ জনকে মৃত্যুদ-, ৬৮ জনকে যাবজ্জীবন এবং ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত করা হয়। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর সামরিক শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশ কলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২-এর অধীনে পরিচালিত বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এক সামরিক ফরমান দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ কলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ বাতিল করে উক্ত আইনের অধীনে দণ্ডিত ও আটক সকল অপরাধীকে মুক্তি দিয়ে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল এই সকল সামরিক ফরমানের বৈধতা প্রদান করেন।
সামরিক ফরমান দিয়ে বাতিল করা এই বিচার প্রক্রিয়া যেমন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তেমনি এই বিচারের সাজাও বাতিল করে দেয়া হয়েছে। অথচ যুদ্ধাপরাধীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে যে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করেছে। এবার তো বিচার হয়েছে।
No comments