আত্মহত্যা করলে দাফন না করার ফতোয়া চলছে বছরের পর বছর- সোনারগাঁওয়ের বুরুমদি গ্রাম by রুমন রেজা
ফাঁসির লাশ, বিষের লাশ আমাগো গেরামে কবর দেয়া হয় না। পঞ্চায়েত কমিটির নিষেধ আছে। নেতারা কইছে আত্মহত্যা করলে কবর দেয়ার নিয়ম ধর্মে নাই।
তাই গেরামের মানুষ পিংকির লাশ কবরস্থানে দাফন করতে বাধা দিছে’ বুধবার সকালে এভাবে বললেন সোনারগাঁও উপজেলার বুরুমদি গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক। বখাটেদের অপমান-লাঞ্ছনা সইতে না পেরে রাজধানী ঢাকার ধলপুর সিটি কর্পোরেশনের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সাদিয়া আক্তার পিংকির আত্মহননের পর তার লাশ দাফনের জন্য নিয়ে আসা হয় গ্রামের বাড়ি সোনারগাঁওয়ের বুরুমদিতে। গ্রামের কবরস্থানে দাফন করতে দেয়নি পঞ্চায়েত কমিটি। এ বিষয়ে পিংকির বাবা-চাচা প্রতিবাদ করলে তাদের সমাজচ্যুত করার হুমকি দেয়া হয়। পরে পিংকির পরিবার বাধার মুখে তাদের বাড়ির পুকুরপাড়ের এক পাশে লাশ দাফন করতে বাধ্য হয়। বুধবার বুরুমদি গ্রামে গিয়ে জানা যায়, স্থানীয় মসজিদের ইমাম আব্দুল্লাহ পিংকির জানাজা পড়ান। মুয়াজ্জিন ফরিদুজ্জামান জানাজা পড়ালেও গ্রাম্য মাতবরদের রোষে পড়ার ভয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। অন্যদিকে মুখ খুলছেন না পঞ্চায়েত কমিটির লোকজন। পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি শাহজাদা ভূঁইয়া বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। থাকেন ঢাকার নারিন্দায়। সাধারণ সম্পাদক ফজলুল করিম ভূঁইয়াও ঢাকায় থাকেন। চাকরি করেন পোস্টঅফিসে ঢাকার বাংলাবাজারে। পঞ্চায়েত কমিটির অন্য নেতারাও গ্রামে নেই। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি শাহজাদা ভূঁইয়া বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তড়িঘড়ি করে তিনি ফোন কেটে দেন।বুরুমদি গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের মতোই আবুল কাশেমও বললেন, পঞ্চায়েত কমিটির নেতারা আমাদের বলেছেন ধর্মীয় বিধিবিধান অনুযায়ী ফঁাঁস দিয়ে বা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলে লাশ কবরস্থানে দাফন করার নিয়ম নেই।
গ্রাম্য মাতবরদের এই অপব্যাখায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষকগণ। ইসলামী গবেষক ও নারায়ণগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইসলামী শিক্ষা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. ইব্রাহিম আজাদ সিরাজী বলেন, ‘এসব একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। আত্মহত্যা করুক বা যেভাবেই মৃত্যু হোক মুসলমান হলে তাকে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জানাজার পর দাফন করতে হবে। আত্মহত্যা করলে দাফন করা যাবে না- এ রকম কথা ইসলামবিরোধী। জানা গেছে, পিংকির বাবা বাবুল হোসেন পেশায় সিএনজি বেবিট্যাক্সিচালক। তাঁরা থাকেন মুগদা থানার মা-া ছাতামসজিদ এলাকায়। সাদিয়া আক্তার পিংকি স্কুলে যাওয়া-আসার সময় এলাকার বখাটে রনি প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। বাধা দেয়ায় গত ২৮ নবেম্বর স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে রনি তার লোকজন নিয়ে অপহরণ করে তাকে। এ ঘটনায় পিংকির বাবা যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করে। মামলার পর যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানা পুলিশের সহযোগিতায় পিংকিকে উদ্ধার করে। গ্রেফতার করে রনিকে। রনি এখন কারাগারে আটক রয়েছে। বখাটেরা হুমকি দেয় পিংকির পরিবারকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য। রনির বোন পাখি উল্টো পিংকিদের বাসায় গিয়ে তাকে কটূক্তি করে। লজ্জায়-ক্ষোভে-অপমানে রবিবার পিংকি আত্মহত্যা করে। মঙ্গলবার লাশ আনা হয় গ্রামের বাড়ি সোনারগাঁওয়ের বুরুমদি গ্রামে। কিন্তু এখানে কবরস্থানে দাফনে বাধা দেয় গ্রাম্য মাতবরদের লোকজন। তারা জানিয়ে দেয়, আত্মহত্যা করায় পিংকির লাশ দাফন করা যাবে না কবরস্থানে। পরে বাড়ির পুকুরপাড়ে এক পাশে দাফন করা হয় পিংকিকে।
জামপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ওয়ালিউল্লাহ বলেন, আমরা বিষয়টি জানি না। তবে কবরস্থানে লাশ দাফনে বাধা দেয়া মোটেই উচিত হয়নি।
জামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ হানিফ বলেন, এ রকম ঘটনা সমর্থন করা যায় না। পরে আমার সঙ্গে পিংকির বাবা যোগাযোগ করেছে। আমি তাকে আসতে বলেছি।
সোনারগাঁও থানার ওসি হারুন অর-রশিদ বলেন, আমরা ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না। কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি।
No comments