গোলটেবিল বৈঠক- প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি: সাফল্য, সমস্যা ও সম্ভাবনা

১৭ ডিসেম্বর ২০১২, ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি: সাফল্য, সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সহযোগিতায় ছিল সেভ দ্য চিলড্রেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
যাঁরা অংশ নিলেন
আফছারুল আমীন
মন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়
সৈয়দ রাশেদ আল জায়েদ যশ, বিশ্বব্যাংক, অর্থনীতিবিদ
হোসেন জিল্লুর রহমান
উপদেষ্টা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার
মোহাম্মদ নোমান উর রশীদ
মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা, বাংলাদেশ, ঢাকা
আখতার আহমেদ
পার্টিপ্রধান, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান
মনজুর আহমদ
জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, শিক্ষা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
ম. হাবিবুর রহমান
উপদেষ্টা, শিক্ষা বিভাগ, সেভ দ্য চিলড্রেন
খন্দকার সাখাওয়াত আলী, ফেলো, পিপিআরসি
সাহিদা বেগম: পরিচালক, প্রোগ্রাম, সেভ দ্য চিলড্রেন
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি। প্রতিটি উদ্যোগের কিছু সমস্যা, সম্ভাবনা থাকে। উপবৃত্তির সঙ্গে পুষ্টির বিষয়টি বারবার আলোচিত হয়। এতে শিশুর পুষ্টির নিরাপত্তা হয়, অন্যদিকে স্কুলে উপস্থিতির সংখ্যা বাড়ে।
রতন সেন স্মরণে খুলনায় অসচ্ছল পরিবারের মেয়েশিশুদের জন্য একটি স্কুল আছে। স্থানীয় উদ্যোগে স্কুলে শিশুদের খাওয়া, বিশ্রাম ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে স্কুলের উপস্থিতি বেড়েছে এবং শিশুরা আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়া করছে। দেশের স্কুলগুলোকে রতন সেন স্কুলের মতো করা যায় কি না, এ দিকটি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখার অনুরোধ করব। এ বিষয়ে এখন আলোচনা শুনব আফছারুল আমীনের কাছ থেকে।
আফছারুল আমীন: আজকের আলোচনার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। উপবৃত্তির সাফল্য, সম্ভাবনা, স্কুলে খাবার (স্কুল ফিডিং), মানসম্মত শিক্ষা, এমন অনেক বিষয় নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে। উপবৃত্তির কার্যক্রম এই আলোচনার সূত্রপাত করেছে। বর্তমানে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থী এক কোটি ৮৯ লাখ। সরকারি ও নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬০ হাজার। এনজিও পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা ৮০ হাজার। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে এখন স্কুল আছে। শহরের স্কুলের শিক্ষার্থীদের অবস্থা কমবেশি ভালো। শহরের বাইরের শিক্ষার্থীরা দরিদ্র। পরিবারপ্রতি এক বা দুজন শিক্ষার্থী হলে কত বৃত্তি পাবে, সবাই সেটা জানি। উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯৯.৪৭ শতাংশ। বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্যালয় পরিদর্শনে যাই। শিক্ষক নিয়োগ, আসবাবপত্র, ভবন নির্মাণ, শ্রেণীকক্ষ, বাথরুম এমন বিভিন্ন ধরনের দাবি থাকে। সরকারও সাধ্যমতো কাজ করছে। আপনারা জানেন, ৭১ হাজার প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৯৬টি স্কুলে স্কুলফিডিং দেওয়া হচ্ছে। কিছু এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল ফিডিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফিডিং স্কুলগুলোতে উপস্থিতি বেশি। উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য উপস্থিতির হার বেড়েছে। আরও অনেক কাজ করার আছে। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।
শতভাগ উপস্থিতি ধরে রাখতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। ভারতসহ কয়েকটি দেশে সরকারের সমর্থনে শিক্ষার্থীদের রান্না করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু শিক্ষকদের দ্বারা রান্নার কাজটি করা সম্ভব নয়। এতে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার জন্য স্কুলগুলোকে নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ করছি। শ্রেণীকক্ষসহ অন্যান্য পরিবেশ ভালো করার উদ্যোগ নিয়েছি। এখানে ছোট পার্কের ব্যবস্থা থাকবে। পার্কে শিশুদের জন্য কিছু খেলনার ব্যবস্থা থাকবে। স্কুল ফিডিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘক্ষণ আনন্দের সঙ্গে স্কুলে থাকবে। স্কুলে থাকার এই পরিবেশটি করতে চাই, যাতে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আগে আসবে এবং পরে যাবে। সরকারের কাজ অব্যাহতভাবে চলছে। আজকের আলোচনায় আপনাদের কাছ থেকে যে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আসবে, আমরা সেগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।
ম. হাবিবুর রহমান: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উপবৃত্তির বর্তমান অবস্থা জানার জন্য গবেষণা করেছি। এ গবেষণার মাধ্যমে শিশুর সুরক্ষা, শিশুশ্রম, শিশুশিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা পেয়েছি। গবেষণাকাজের ক্ষেত্র ছিল ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলা। এ গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, সরকারের উপবৃত্তির কার্যক্রম সম্পর্কে মানুষকে জানানো। অর্থাৎ কীভাবে মানুষ উপবৃত্তির সুযোগ নিতে পারে। এ বিষয়ে আরও অধিক জানতে পারে। উৎসাহিত হতে পারে। সরকারের অন্য যে নিরাপত্তা বেষ্টনী আছে, তার সঙ্গে শিক্ষাকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়। শিক্ষার্থীদের মূল শিক্ষার সঙ্গে আরও কিছু সংযোজন করা যায় কি না। সরকারের উপবৃত্তি কার্যক্রম কী ভূমিকা রাখছে, এর সমস্যা, সম্ভাবনা কী ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করেছি। এখন সবার লক্ষ্য থাকবে, মানসম্মত শিক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়। শ্রেণীকক্ষেই বেশি কাজ আদায় করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি (এসএমসি) দ্বারা শিক্ষার্থী নির্বাচন ঠিক হচ্ছে কি না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। একটা পর্যালোচনা থেকে দেখেছি ৬০.৫ শতাংশ বৃত্তি গ্রহণকারী টিনের ঘরে বাস করে। তাদের ৭৫ শতাংশ তিন বেলা ভাত খায়। এ কাজটি সঠিকভাবে হয়েছে কি না, সেটা দেখা দরকার। এসএমসি কোনো রকম প্রভাবিত হয়ে নির্বাচন করেছে কি না, সেটি নিশ্চিত করা দরকার। উপবৃত্তির টাকার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না, সঠিক শিক্ষার্থী টাকা পাচ্ছে কি না, সেটা দেখা দরকার।
কেউ অকৃতকার্য হলে উপবৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু যে মেয়েটি ১০ম শ্রেণীতে পড়ে, তার জন্য বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করি। শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা মানচিত্রায়ণ করা উচিত। তাহলে প্রতিটি এলাকার শিক্ষার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারব। শিক্ষায় অসুবিধাগ্রস্তদের নিয়ে একটা জাতীয় পরিকল্পনা করার প্রয়োজন। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য পাস নম্বরকে ৪০ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
খন্দকার সাখাওয়াত আলী: নব্বইয়ের দশকে প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে আসে দারিদ্র্য। সবার জন্য শিক্ষা। এটি ছিল তখন একটি আলোচিত স্লোগান। দরিদ্রদের শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার ভাবনা থেকে উপবৃত্তি কার্যক্রম শুরু হয়। আজ ২২ বছরে এর অনেক অগ্রগতি হয়েছে। যেমন, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা দিয়ে শুরু হয়েছিল। এর সঙ্গে পুষ্টি যুক্ত হয়েছে। তারপর এসেছে নগদ উপবৃত্তি। ২০১০ সালের দিকে একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে এ উপবৃত্তি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। নগদ উপবৃত্তি দেওয়ার সময় প্রথম বাচ্চার জন্য ১০০ টাকা, দ্বিতীয় বাচ্চার জন্য ১২৫ টাকা দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তৃতীয় ধাপে এসে উপবৃত্তির সঙ্গে ব্যয় সমন্বয় করার চেষ্টা হচ্ছে। সমন্বয় করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। সবার কথা থেকে মূল যে বিষয়টি এসেছে তা হলো, বর্তমানে যে অর্থ দেওয়া হয়, তার দ্বিগুণ দিতে হবে। তখন অভিভাবকদের বলা হয়, এ টাকা যে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় হবে তার নিশ্চয়তা কী? আমরা দেখার চেষ্টা করি একটা বাচ্চার জন্য তাঁরা কী পরিমাণ অর্থ খরচ করেন। দেখা গেছে, গ্রামের হতদরিদ্র থেকে সচ্ছল পরিবার পর্যন্ত তিন থেকে নয় হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করে। তাদের খরচের প্রধান খাত হচ্ছে পোশাক, টিউশন ও স্বাস্থ্য। এ বিষয়গুলো সমন্বয় করার ব্যবস্থা করতে হবে। ভর্তির হার ধরে রেখে, ঝরে পড়া কমাতে হলে উপবৃত্তি বাড়াতে হবে।
উপবৃত্তি পাওয়া প্রায় ৮০ শতাংশ পরিবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা দেওয়া যায় কি না, এ বিষয়টি কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারে। নব্বইয়ের দশকে নারীশিক্ষাকে উদ্দেশ্য করে মাধ্যমিকে উপবৃত্তি কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় ৪০ শতাংশ মেয়েকে উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়। ক্রমান্বয়ে মেয়েরা শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে থাকে। ২০১০ সালে এসে উপবৃত্তির ৩০ শতাংশ দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের। ১০ শতাংশ ছেলেদের। মেয়েদের ক্ষেত্রে আরও একটি ভালো কাজ হচ্ছে, যেমন মেয়ের অভিভাবকদের সঙ্গে স্কুলের একটি সামাজিক চুক্তি হচ্ছে। চুক্তির মধ্যে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলে লেখাপড়ার বাধ্যবাধকতা আছে। মোট উপস্থিতির ৭৫ শতাংশ উপস্থিত থাকতে হবে। লেখাপড়া চলার সময় তাকে বিয়ে দিতে পারবে না। প্রতিটি পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। এই উদ্যোগগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।
আখতার আহমেদ: ১৯৯০ সাল থেকে গবেষণাকাজের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালানো হয়েছে। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে, যেখানে শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের থেকে এগিয়ে। এমন কিছু বিষয় নিয়ে গর্ব করতে পারি। ২০১২ সালের একটি জাতীয় জরিপ থেকে দেখেছি, মাধ্যমিক থেকে উপবৃত্তির কার্যক্রম প্রাথমিকে বেশি সফল। প্রাথমিকে ভর্তির হার অনেক বেড়ে গেছে। তবে মানসম্মত শিক্ষার অভাব আছে। শিক্ষার মান বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, শহরে নিম্ন আয়ের মানুষের প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির হার ৪১ শতাংশ। গ্রামে এই হার ৮৬ শতাংশ।
শহরে উপবৃত্তি কার্যক্রমের কতগুলো সুবিধাও আছে। যেমন, উপবৃত্তি সফলভাবে কার্যকর করা গেলে, শিশুশ্রম কমে আসবে। শিক্ষার পরিবেশে থাকলে তারা সহিংসতার শিকার হবে না। শিক্ষাহীন অবস্থায় বস্তিতে বড় হতে হতে একসময় এরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সমাজের কিছু খারাপ মানুষ এদের মাদকসহ নানা ধরনের খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত করে। এই শিশুদের ফেরানোর একমাত্র উপায় কোনো না কোনোভাবে এদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা। সামাজিক সুরক্ষার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মাধ্যমিকে নগদ বৃত্তির সঙ্গে সকাল বা দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা। সব সময় মানুষের পুষ্টির প্রয়োজন হয়। কিন্তু মেয়েদের জীবনচক্রে বয়ঃসন্ধির সময় পুষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাধ্যমিকের এই মেয়েদের আয়রন ও আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে ভবিষ্যতে ভালো ফল পাওয়া যাবে। বিশেষ করে মা হওয়ার সময় পুষ্টির অভাবসহ নানা রোগে মেয়েরা ভুগতে থাকে। বয়ঃসন্ধির এ সময়টিতে পুষ্টি পেলে এই মেয়েরা ভবিষ্যতের অনেক ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে। উপবৃত্তি কার্যক্রমের মাধ্যমে মেয়েদের নগদ এবং পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে ভবিষ্যতে এই মায়েরা জাতীয় উন্নতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে।
মনজুর আহমদ: নব্বইয়ের দশকে উপবৃত্তির এ কার্যক্রম একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। সবাই এর প্রশংসা করেছে। একটি ফলপ্রসূ কার্যক্রমের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উপবৃত্তি কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। উপবৃত্তি একটা প্রেরণা বা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে। শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করেছে। একটা সময় পর্যন্ত এর প্রয়োজন ছিল। এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে। কিছুটা বাস্তবতার দিক থেকে বলতে চাই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে আগের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষার্থী পড়লেখা করছে। কিন্তু তারা কতটুকু মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে, সে বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পাসের হারের সঙ্গে প্রকৃত জেনেবুঝে পড়ালেখার অনেক পার্থক্য রয়েছে। প্রতিযোগিতার এই যুগে মানসম্মত লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই। লক্ষ করেছি, এখন সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করানোর কথা ভাবছেন। তাঁরা মানসম্মত লেখাপড়ার কথা ভাবছেন। সন্তানদের লেখাপড়া করানোর জন্য অনেক গরিব মা-বাবাকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে দেখি। দেশে এনজিওদের স্কুল আছে ৮০ হাজার। এখানে কোনো উপবৃত্তি নেই।
এনজিওগুলো শিক্ষার মানের দিকে গুরুত্ব দেয়। এসব স্কুলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অনেক বেশি। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি। জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এই বাস্তবতায় ১০০ টাকা উপবৃত্তির জন্য দরিদ্র মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠান এমন নয়। আসলে যেকোনো মূল্যে তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়া করাতে চান। উপবৃত্তির কার্যক্রম এখন আর চালানোর প্রয়োজন আছে কি না এ দিকটি ভেবে দেখতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য একটি পরিকল্পনার সময় এসেছে বলে মনে করি। উপবৃত্তি কার্যক্রমের সঙ্গে মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে আসতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা পেলে শিক্ষার্থীরা মানবসম্পদে পরিণত হবে। মানবসম্পদে পরিণত হলে দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। অন্যথায় শিক্ষিত হয়েও দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
সাহিদা বেগম: শিশুদের নিয়ে কাজ করি। শ্রমজীবী শিশুদের একটা সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে আনা আমাদের লক্ষ্য। প্রতিবছর এক লাখ ৮০ হাজার শিশু আমাদের কার্যক্রম থেকে সুবিধা পাচ্ছে। শিশুদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, উপবৃত্তি কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার যথেষ্ট সন্তোষজনক। উপবৃত্তির জন্যই এটি হয়েছে। গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এ কার্যক্রম আরও অধিক হারে চালাতে হবে। শহরে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে জরুরিভিত্তিতে উপবৃত্তির কার্যক্রম শুরু করা দরকার।
শহরের শিশুরা গ্রামের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। এ কথা সত্য, গ্রামাঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষার অভাব রয়েছে। উপবৃত্তির সঙ্গে এখন মানসম্মত শিক্ষার দিকটিও ভাবতে হবে। দেশে এনজিওদের শিক্ষার মান ভালো। এরা মানসম্মত শিক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু এনজিওগুলোর ওপর নির্ভর করা যাবে না। প্রকল্প শেষ হলে এনজিও বন্ধ হয়ে যায়। তাই সরকারের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থাকে মানসম্মত করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য সরকারকে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। মাধ্যমিকেও অধিকসংখ্যক ছেলেমেয়ে ঝরে পড়ছে। মাধ্যমিকের ব্যয় প্রাথমিকের থেকে বেশি। অনেক অভিভাবক ব্যয় চালাতে পারেন না। তা ছাড়া পরীক্ষায় পাসের পর তাদের জন্য কোনো কাজের ব্যবস্থা নেই। সবকিছু মিলিয়ে মা-বাবা হতাশ হয়ে পড়েন। মাধ্যমিকে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। তাহলে শিক্ষা শেষে দ্রুত কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে।
সৈয়দ রাশেদ আল জায়েদ যশ: বাংলাদেশের অনেক ভয়াবহ বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়। এ সময় কিছুটা ইতস্ততার মধ্যে থাকি। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে যখন আলোচনা হয় তখন বেশ স্বস্তি বোধ করি। শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। শিক্ষায় মিলেনিয়াম লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সফল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে উপবৃত্তির ক্ষেত্রেও সফল। বাংলাদেশে ছেলেদের তুলনায় শিক্ষায় মেয়েদের সাফল্য বেশি। কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই জায়গাতে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে সফলতা আসেনি। শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করতে হলে আরও কয়েক বছর উপবৃত্তি কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা আরও বাড়াতে হবে। উপবৃত্তির সঙ্গে বাংলাদেশকে আরও কিছু কাজ করতে হবে।
আজকাল গ্রামে কৃষিসহ সব শ্রমিকের উচ্চ মজুরি। জীবনযাত্রার ব্যয় অধিক থেকে অধিকতর। এসব বিবেচনায় ১০০ টাকা থেকে ১২৫ টাকা উপবৃত্তির জন্য অভিভাবকেরা সন্তানদের স্কুলে পাঠান না। সরকার, এনজিও—সবার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মানুষ সচেতন হচ্ছে। তা ছাড়া সব শ্রেণীর মানুষ এখন শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারছে। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেই মা-বাবা সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। তাই মনে করি, উপবৃত্তির সঙ্গে সচেতনতা কার্যক্রমের ওপরও অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ২০০৯ সালে নতুন একটি শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়। এ প্রকল্পের নাম হলো সেকায়েপ (সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি প্রজেক্ট) বৃত্তির শর্ত হলো, ৭৫ শতাংশ উপস্থিত থাকতে হবে। অবিবাহিত থাকতে হবে। এখানে দরিদ্র পরিবার নির্বাচন ও তত্ত্বাবধানের বিষয় আছে। টাকা দেওয়ার বিষয় আছে। সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি বিশাল ব্যবস্থাপনা। এ ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো ধরে রাখতে না পারলে, শিক্ষার অগ্রগতি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এখন শিক্ষাক্ষেত্রে কয়েক ধরনের উপবৃত্তি কার্যক্রম চালু আছে। এদের নীতিনির্ধারণসহ বিভিন্ন কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। এ কাজটি কিন্তু এখনো হয়নি। কোনো রকম ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এভাবে চলতে পারে না।
হোসেন জিল্লুর রহমান: শিক্ষা একটি বিশাল কার্যপ্রণালি। প্রতিটির আলাদা গুরুত্ব আছে। উপবৃত্তির একটি নিজস্ব ক্ষেত্র ও গুরুত্ব আছে। কিন্তু শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন উপবৃত্তির ওপর নির্ভর করে না। উপবৃত্তি দিয়ে কতটুকু অর্জন করতে চাই, সেটি ভাবতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার সঙ্গে উপবৃত্তিকে যুক্ত করলে হবে না। অর্থ ছাড়া আরও অনেক উপায়ে শিক্ষার মানকে বৃদ্ধি করা যায়। শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। স্কুল ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও উন্নত করতে হবে। এর একটিও অর্থের সঙ্গে জড়িত নয়। প্রতিটি নীতিনির্ধারণী বিষয়। এ কাজগুলো ঠিকমতো হলে শিক্ষার মান অনেকটা বেড়ে যাবে। এ জন্য কোনো অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই।
উপবৃত্তির মাধ্যমে ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু শিক্ষার্থী ধরে রাখার ক্ষেত্রে উপবৃত্তি ভূমিকা রাখতে পারছে না। এক জরিপে দেখা গেছে, ১০০ জন শিশুর মধ্যে প্রাথমিকে ঝরে পড়ছে, মাধ্যমিকে ঝরে পড়ছে, মাত্র ২২ জন ১০ম শ্রেণী পার হচ্ছে। উপবৃত্তি হয়তো শিক্ষার্থী ধরে রাখতে পারছে না। কিন্তু উপবৃত্তির প্রয়োজন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। শিক্ষার্থী তালিকাভুক্তিসহ বিভিন্নভাবে উপবৃত্তির এখনো যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। শিক্ষার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। শিক্ষার্থীকে একটা নির্দিষ্ট অর্থ সরকার দেয়। অভিভাবক তার থেকে বেশি অর্থ শিক্ষার্থীর জন্য ব্যয় করছেন। উপবৃত্তি কিছুটা হলেও অভিভাবককে ব্যয়ের চাপ কমাতে সাহায্য করছে। তাই এ ধরনের প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা সব সময় থাকবে। উপবৃত্তি কার্যক্রমের বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। কারণ, সঠিক বাস্তবায়নের ওপর তার কার্যকারিতা নির্ভর করে।
প্রাথমিক উপবৃত্তি নিয়ে সরকার ও অনুদানকারী সংস্থা সবার আগ্রহ আছে। সবাই এ ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। তবে মাধ্যমিক উপবৃত্তি সেভাবে আলোচনায় আসেনি। মাধ্যমিকে তিনটি প্রকল্প কাজ করছে। তাদের একটি মূল্যায়ন হওয়া দরকার। তাহলে ধারণা পাওয়া যাবে কোন প্রকল্প অধিক ফলপ্রসূ। এর ভিত্তিতে একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা সম্ভব হবে। নগদ উপবৃত্তি না বাড়িয়ে পোশাকসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে বাড়ানোর বিষয়টি ভাবতে হবে। শিক্ষার্থীদের খাবারের দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার বা এনজিও বিচ্ছিন্নভাবে করলেও ব্যাপকভাবে কেউ করতে পারেনি। খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় রকমের অগ্রগতি হবে। শিক্ষকদের দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলে ক্লাসে পাঠদান ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং শিক্ষকেরাও এটা চান না। ফলে এ বিষয়টি করলে কীভাবে করা যাবে সেটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনারও বিষয় রয়েছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত মান উন্নয়ন। এনজিওরা কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার মান উন্নয়ন করেছে। কিন্তু সব জায়গায় করতে পারেনি। সরকার পৃথকভাবে দু-একটি স্কুলে করতে পারে না। মান উন্নয়ন করলে সব জায়গায় করতে হবে। তাই একটি ব্যাপক পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়নের দিকে যেতে হবে। আগামী পাঁচ বছরে আমাদের অন্যতম কার্যসূচি হতে হবে পুষ্টি। কারণ, মিলেনিয়াম লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কিছু ক্ষেত্রে বেশ কাছাকাছি আছি। কিন্তু পুষ্টিতে অনেক পিছিয়ে আছি। শহরের দরিদ্রদের কথা এখন অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শহরে তাদের অর্থনৈতিক সুযোগ বাড়ছে। কিন্তু সামাজিক সুযোগ থেকে তারা গ্রাম থেকেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
মোহাম্মদ নোমান উর রশীদ: প্রত্যেকের একটি স্বপ্ন থাকে। জন্ম থেকেই স্বপ্নের শুরু। সবার জন্য শিক্ষা, এটি আমার স্বপ্ন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর এ স্বপ্ন আরও বেড়ে গেল। আর বিগত ৬৫ বছরের মধ্যে আমরা একটি শিক্ষানীতি পেলাম। আজকে শিক্ষার যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, শিক্ষানীতিতে এর সবই বলা হয়েছে। আলোচনায় বঞ্চিত, অনগ্রসর বিভিন্ন পর্যায়ের শিশুদের কথা এসেছে। শিক্ষানীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। শিক্ষানীতির আলোকে আমাদের স্বপ্ন এখন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। প্রাইভেট টিউশন, কোচিং বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় এসেছে। শিক্ষানীতির ২২ অধ্যায়ে সব ধরনের প্রাইভেট টিউশন বা কোচিং বাণিজ্যকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আপনারা জানেন, কিছু শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। ইতিমধ্যে শিক্ষানীতির আলোকে তাদের সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনার বিধান হচ্ছে শিক্ষানীতি। এর মাধ্যমে আমরা শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারব। উপবৃত্তির বাইরে এ বছর ২৭ কোটি বই ছাপানো হয়েছে। সরকার এখানে কয়েক কোটি টাকা খরচ করেছে। বড় রকমের দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া। আমরা সে কাজটি ঠিকমতো করতে পেরেছি। অর্থাৎ শিক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক পথে আছি। পিএসসি, (প্রাথমিক স্কুল সার্টিফিকেট) জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করছে। পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে আনন্দ কাজ করছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৫৬ লাখ দরিদ্র শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা দেওয়া হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে আমার একটি প্রার্থনা আছে, সেটি এখনো আলোচনায় আসেনি। সেটি হলো, নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নিরাপদ সড়ক দরকার। নিরাপদ মাতৃত্ব দরকার। তেমনি নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার। আজকে ভিকারুন্নিসাসহ বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিরাপদ নয়। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার এটি একটি বড় কারণ। এ বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আশা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিরাপদ না করতে পারলে আমাদের অনেক অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী: আজকের আলোচনার বিষয় উপবৃত্তি। কিন্তু শিক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কিছু বিষয় বলার আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজের ব্যাপকতা বিশাল। সে জন্য এ মন্ত্রণালয়ের অনেক সাফল্য আছে। অন্যদিকে সাফল্য অর্জনের চেষ্টাও আছে। শিক্ষানীতিসহ এ পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচুর কাজ হয়েছে। এ জন্য শিক্ষায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
গত তিন বছরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৫ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছে। এটাও উপবৃত্তির মতো এক ধরনের প্রণোদনা। ২০ হাজার ৫০০ স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করতে যাচ্ছি। তিন হাজার স্কুল, দেড় হাজার কলেজ ও এক হাজার মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ৩০টি মাদ্রাসায় সম্মান শ্রেণী (অনার্স কোর্স) খুলেছি। অনেক স্কুল-কলেজে কম্পিউটার গবেষণাগার (ল্যাব) দিয়েছি। লটারির মাধ্যমে স্কুলে ভর্তির প্রক্রিয়া চালু করেছি। আগে হাতে তৈরি (ম্যানুয়াল) ফলাফল দেওয়া হতো। সময় লাগত ৯০ দিন। এখন ৬০ দিনে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত (অনলাইন) ফলাফল দেওয়া হয়। আপনারা শুনে খুশি হবেন, গতবার মাত্র ৩৭ দিনে ফলাফল দিয়েছি। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত নিবন্ধন হচ্ছে। এগুলো আগে আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না। এ মুহূর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৭৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রায় ৫০টি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। এগুলো সম্ভব হয়েছে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবং আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। উপবৃত্তি কার্যক্রমের প্রশ্নে সবাই এটা চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। জিল্লুর রহমান সাহেব চমৎকারভাবে সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। ব্যক্তি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সরকারকে বিবেচনা করতে হয় সামগ্রিকভাবে। সমাজের সব মানুষ সমান নয়। উপবৃত্তির একটা বড় অর্জন হলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে লিঙ্গসাম্য। প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তির হার ১০০ শতাংশের কাছাকাছি। যেটা ২০১৫ সালে অর্জনের কথা ছিল। তাই অনস্বীকার্যভাবে উপবৃত্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করি।
পরিসংখ্যানে দেখেছি, ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর ৭৫ শতাংশ মেয়েদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের সামনে নিয়ে আসার জন্য উপবৃত্তি ভূমিকা রাখছে। কখনো উপবৃত্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে কী অবস্থা হবে? সে বিষয়টি আপনার ভেবেছেন কি না জানি না। উপবৃত্তির কার্যক্রমের উল্লেখযোগ্য সফলতা। এ জন্য অনুদারকারী সংস্থাগুলো খুবই খুশি।
এ ক্ষেত্রে তারা আরও সহযোগিতা করতে চায়। কিন্তু এই প্রকল্প যদি কখনো বন্ধ হয়ে যায়, তখন কী হবে? এর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লিখিতভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলেও যেন প্রথম শ্রেণী থেকে স্নাতক শ্রেণী পর্যন্ত সবাইকে বৃত্তি দেওয়া যায়, তার জন্য একটি ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যবস্থা করতে বলেছেন। সে লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বাজেটে এক হাজার কোটি টাকা এ ফান্ডের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। যেমন, সৃজনশীল প্রশ্নপত্র চালু করেছি। এ বিষয়ে দক্ষতার সঙ্গে পড়ানোর জন্য পাঁচ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। গণিত ও বিজ্ঞানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের যদি আলাদা বেতন কাঠামোর মধ্যে না আনা যায়, তাহলে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন ব্যাহত হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বাড়াতে হবে।
আফছারুল আমীন: শিক্ষাক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আজকের আলোচনায় সমবেত হয়েছেন। তাঁরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তাঁদের আলোচনা থেকে যেসব মতামত ও নির্দেশনা এসেছে, সেগুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে চেষ্টা করব। শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা থেমে নেই। সর্বক্ষণ কাজ করে যাচ্ছি। কয়েক লাখ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। কয়েক হাজার ভবন নির্মাণ করেছি। অনেক স্কুলে পিটিআই চালু করেছি। শিক্ষক প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমাদের প্রধান কাজ সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। তারপর তাদের ধরে রাখার ব্যবস্থা করা এবং মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া। শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন কার্যক্রমের জন্যই শিক্ষার চাহিদা আরও বেড়ে যাচ্ছে। ঝরে পড়ার শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে আসছে। বহুমুখী উদ্যোগের ফলে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। এ অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখার জন্য সব রকমের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
আব্দুল কাইয়ুম: শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রথম আলো কুড়িগ্রামের দুর্গম এক চরে একটি স্কুল পরিচালনা করছে। এখন স্কুলটিকে পঞ্চম শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। আজ এখানে উপবৃত্তি ব্যবস্থা ও শিক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি সফল আলোচনা হয়েছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রকম মতামত ও পরামর্শ এসেছে। সরকার এগুলো বিবেচনায় নিলে শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি হবে বলে আশা করি।
এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

No comments

Powered by Blogger.