খালেদার গাড়ির চারপাশে স্লোগান ছিল ‘ট্রাইব্যুনাল ঘেরাও হবে’
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে জনসংযোগ কর্মসূচীর বিষয় উল্লেখ করা হলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের বুধবারের গণসংযোগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবি গুরুত্ব পেয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে স্লোগানে চাপা পড়ে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির বিষয়টি। খালেদা জিয়ার এ কর্মসূচীতে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিই যেন প্রধান দাবি হয়ে উঠেছিল। জোট নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতিটি পথসভায় জামায়াতের নেতাকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। গণসংযোগকালে পথিমধ্যেও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবি সংবলিত নানা স্লোগানে সরব দেখা গেছে। একই দাবিতে শত শত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে এ কর্মসূচীতে অংশ নেয় জামায়াত নেতাকর্মীরা।গণসংযোগের প্রথম পথসভা অনুষ্ঠিত হয় গাবতলীতে। খালেদা জিয়া সভাস্থলে পৌঁছার আগে থেকেই সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের দাবিতে মিছিল করতে থাকে শিবির কর্মীরা। মানবতাবিরোধী অপরাধে কারাগারে আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে গাবতলী এলাকায় শত শত ব্যানার নিয়ে অবস্থান নেয় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। গাবতলীর এসএ খালেক বাস কাউন্টার মাঠ, মিরপুর বাঙলা কলেজ, টেকনিক্যাল মোড়, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল তারা। পথসভা শেষে খালেদা জিয়া গাবতলী থেকে কারওয়ান বাজারের উদ্দেশে রওয়ানা হলে তার গাড়ির চারপাশে শিবিরের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে ‘সাঈদীর কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ ‘ঘেরাও ঘেরাও ঘেরাও হবে ট্রাইব্যুানাল ঘেরাও হবে’ স্লোগানে ওই এলাকা উত্তপ্ত করে তোলে। এভাবে শুধু সাঈদী নয়, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতের সব নেতার মুক্তির দাবিতে সেøাগান তোলে তারা। খালেদা জিয়ার গাড়ি ধীরগতিতে টেকনিক্যাল মোড়ের দিকে এগোতে থাকলে মিছিলকারীরাও গাড়ির পেছনে এগোতে থাকে। মিছিলকারীদের হাতে থাকে প্ল্যাকার্ডে আটক জামায়াত নেতাদের ছবিও ছিল।
একই চিত্র দেখা গেছে কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও বালুর মাঠ, ভাটারা এলাকায়। কারওয়ান বাজারে খালেদা জিয়ার মঞ্চের সামনেই যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দাবি সংবলিত ব্যানার দেখা যায়। প্রগতি টাওয়ারের সামনে অনুষ্ঠিত এ সভার সামনের দিক ছিল জামায়াত ও শিবিরের দখলে। এখানে অনুষ্ঠিত পথসভায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ১৯৭৫ সালে বাকশাল কায়েম করে আওয়ামী লীগকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। এবারও তথাকথিত ও ষড়যন্ত্রমূলক ট্রাইব্যুনালের নামে জাতীয় নেতৃবৃন্দের বিচার করলে চরম মূল্য দিতে হবে। কাজেই এখনও সময় আছে ট্রাইব্যুনাল বাতিল করুন।
খিলগাঁও বালুর মাঠ এলাকাও রীতিমতো শিবিরের দখলে ছিল। এ মাঠের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়। ভাটারার পথসভায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার, আটককৃতদের মুক্তির দাবি, ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতে নেতাকর্মীরা ছিল সোচ্চার। ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, মঞ্চের বক্তব্যে ছিল একই দাবি। দিনব্যাপী রাজধানীজুড়ে খালেদার গণসংযোগকালে শিবিরের নেতাকর্মীরা তাদের দাবির বিষয়টি এ কর্মসূচীর প্রধান দাবি হিসেবে তুলে ধরে। শিবিরের একদল নেতাকর্মী গণসংযোগকালে পুরো সময়ই খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের চারপাশে তাদের দাবির স্লোগান দেয়। খিলগাঁও বালুর মাঠের মঞ্চে বক্তব্য দেয়ার সময় ঢাকা মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ও শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি শফিকুল ইসলাম মাসুদ অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ না করলে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঘেরাও করার হুমকি দেন। এ সময় তিনি ট্রাইব্যুালকে ‘অবৈধ’ বলেও দাবি করেন। এর আগে গাবতলীতে পথসভায় ১৮ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি শফিউল আলম প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের দালাল আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনাকে জেলে পাঠিয়ে জামায়াত নেতা নিজামী, সাঈদীকে মুক্ত করে আনার ঘোষণা দেন।
গণসংযোগ কর্মসূচী চলাকালে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা লিফলেট বিতরণ করে। এই লিফলেটে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর খোলা চিঠি রয়েছে। সেই চিঠিতে সাঈদী বলেছেন, গণতন্ত্রের লেবাসধারী এই সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত যুদ্ধাপরাধের দায় চাপানোর মিশন নিয়ে হেলাল উদ্দিনকে (সাঈদীর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা) আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। মিথ্যাচার প্রতিষ্ঠায় স্বনামখ্যাত হেলাল উদ্দিন আমার বিরুদ্ধে ২০টি জঘন্য মিথ্যা অভিযোগ এনে, সরকারী ও দলীয় আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গিয়ে আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য আমার নাম বিকৃত করেছে। আমার পারিবারিক পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে লুটেরা, খুনী, ধর্ষক, নারী সরবরাহকারী, অগ্নিসংযোগকারী, পাক বাহিনীর দোসর, দুর্ধর্ষ রাজাকার, এক কথায় এই তদন্ত কর্মকর্তা মনের মাধুরী মিশিয়ে চার হাজার পৃষ্ঠার নাটক রচনা করেছেন আমার বিরুদ্ধে। খোলা চিঠিতে সাঈদী বলেন, কোন মুসলমানের কলিজায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস থাকলে, মৃত্যুর ভয় থাকলে, পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় থাকলে, জাহান্নামের কঠিন শাস্তির ভয় থাকলে অন্য কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে শুধু আদর্শিক ও রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে এত জঘন্য মিথ্যাচার করা সম্ভব হতো না। স্বয়ং খালেদা জিয়াও যুদ্ধাপরাধের বিচারের সমালোচনা করেছেন পথসভাগুলোতে। খালেদা দাবি করেছেন, সরকার সত্যিকার অর্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারছে না। এর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ কেন নেয়নি সে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা যুদ্ধাপরাধের সুবিচার ও স্বচ্ছ বিচার করুন। প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন ও ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে যাঁরা আছেন তাঁদেরও বিচারের আওতায় নিয়ে আসুন। তাহলে মানুষ বুঝবে যুদ্ধাপরাধের স্বচ্ছ বিচার হচ্ছে।
No comments