বিলেতের স্ন্যাপশট- বিলেতের আদমসুরত by শামীম আজাদ
ক্রিসমাসের ধুমে সুপার মার্কেটে ঢুকে বিদেশি মানুষের ভিড় দেখে তাজ্জব বনে যাই। কিনছে যারা, বেচছে তারা, ঘুরছে তারা, ঘোরাচ্ছেও তারা। পোলিশ, ফ্লেমিশ, ভারতীয়, ত্রিনিদাদীয়, সোমালীয়, ইতালীয়, বাংলাদেশি—সবাই নানা দেশের অনাবাসী। ককেশীয়রা গেল কোথায়!
লন্ডনের সবচেয়ে প্রাচীন আন্ডারগ্রাউন্ড হলো সেন্ট্রাল লাইন। টিউব ম্যাপে লাল দিয়ে তা টানা। এ লাইনটি লন্ডনের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ফুঁড়ে গেছে। সেন্ট্রাল লাইনে উঠে ট্রেন চলতে শুরু করলে স্টেশনে স্টেশনে মানুষের ওঠাউঠি ও নামানামি দেখে ঠিক বুঝে ফেলা যায়, কোথায় কোন জাতের মানুষের ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। একপর্যায়ে আপনি আর কোনো ইংরেজি শব্দও শুনবেন না। যে ইংরেজ এই গাদাগাদি ভিড়ে একা বসে আছে, সে হয়তো চুপচাপ বই পড়ছে আর মনে মনে বলছে, লন্ডন ভরে গেছে অ্যাসাইলাম সিকার আর ইমিগ্র্যান্টে। মাঝেমধ্যে রাতে তাই পার্টি-ফেরত শ্বেতাঙ্গ তরুণের চিৎকার শোনা যাচ্ছে, ‘গো ব্যাক ব্ল্যাডি ফরেনারস।’
কথা হলো, জাতিতে এরা বিদেশি হলেও, বিভিন্ন ভাষায় কথা বললেও, দেখতে নীল চোখ আর সাদা ত্বক না হলেও—জাতীয়তায় এরা সবাই ব্রিটিশ। সবাই কোনো না কোনোভাবে এ দেশে অভিবাসিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ ব্যাপারটা সবাই অবগতই। কিন্তু কখনোই জানতাম না যে বর্তমান লন্ডনে শ্বেতাঙ্গ মানুষই এখন সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পর দুই বছর ধরে ব্যাপক হারে পোলিশ জনগণের প্রবেশের পরও শ্বেতাঙ্গরাই সংখ্যালঘু! আর এশিয়ান তথা বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানি পরিবারেই জন্মহার সবচেয়ে বেশি। এ মেগা সিটির কোনো কোনো এলাকায় এখন প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ। যেহেতু এ সময় অর্থনৈতিক দুর্যোগের সময়, তাই এ শহরের সাদা মানুষ খেপে উঠেছে কিন্তু পারছে না কারণ, তাদের সংখ্যাই এখন কম!
অতিসম্প্রতি বের হওয়া ব্রিটেনের আদমশুমারি অনুযায়ী, গত ১০ বছরে লন্ডনে সাদা মানুষের সংখ্যা শতকরা ৯১ থেকে ৮৬তে নেমে এসেছে। রাজধানীতে মোট শ্বেতাঙ্গের সংখ্যা ৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ, যার মধ্যে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশই ইউরোপের নানা দেশ থেকে দেশান্তরি হওয়া শ্বেতাঙ্গ। পথে সুপার মার্কেটে এখন কেবল বসনীয় ভিক্ষুক দেখা যায়। যত ক্লিনার, কিচেন পোর্টার, বিল্ডার—সব পোলিশ আর ক্রোয়েশিয়ান। এশিয়ানদের সংখ্যা বেড়ে (১৮ দশমিক ৪) গিয়ে এ দেশের আদি অভিবাসী কালোদের ছাড়িয়ে (১৩ দশমিক ৩) গেছে।
আদমশুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিসংখ্যান দপ্তর দেখেছে যে, লন্ডনে এখন কেনসিংটন পাড়ায় সবচেয়ে বেশি বিদেশি পাসপোর্টধারী (৪৪ শতাংশ) রয়েছে। বাঙালি বসবাসপূর্ণ টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালির হার ৩২ দশমিক ৩, আর শ্বেতাঙ্গ ইংলিশ, স্কটিশ ও ওয়েলস মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ৩১ দশমিক ১৮ শতাংশ। ভাবা যায়!
এভাবে অভিবাসী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের বিগ ব্রাদার রক্ষণশীল দল অতীতের শ্রমিক দলের উদার অভিবাসন নীতিকেই দায়ী করছে। তার কারণেই ১৯৯৭-এর পর ব্রিটেনের জনসংখ্যা বেড়েছে তিন মিলিয়ন। আর যদি এ হার অব্যাহত থাকে, তবে আগামী ২০ বছরে এ দেশের জনসংখ্যা বেড়ে হবে ৭০ মিলিয়ন, যা কি না বর্তমান ৬৩ মিলিয়ন। কিছুটা দায় অবশ্য শ্রমিক দলের বর্তমান নেতা এড মিলিব্যান্ড স্বীকারও করছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা তাদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে এই ব্যাপকসংখ্যক অভিবাসীর কোনো শিক্ষা ও সক্ষমতাও ছিল না। এমনকি শ্রমিক দলের শাসনামলে এই বহিরাগতদের ইংরেজি বিদ্যা পরখ না করে আনার ফলে এবং এখানে আসার পর তাদের জন্য সবকিছু তাদের ভাষায় অনুবাদ করে দেওয়াটাই ছিল প্রচণ্ড ভুল। তাই এক প্রজন্ম এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করেনি। আর দিন দিন পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে সাংঘর্ষিক। শহর হয়েছে নোংরা, ইংরেজদের পাব হয়েছে বিলুপ্ত, শত শত মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির হয়েছে। আর তাতেই কিনা ককেশীয়রা লন্ডন শহর ছেড়ে পালিয়ে বাসা বাঁধছে শহরতলিতে।
অপেক্ষাকৃত কম অবস্থাপন্ন দেশগুলোর ঝড়-বন্যা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অন্য দেশের আগ্রাসন, যুদ্ধ, নিজেদের অন্তঃকলহ এবং অপরদিকে তুলনামূলকভাবে উন্নত দেশগুলোর সর্বজনীন সাধারণ সেবাদান, ন্যূনতম চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য ও উচ্চশিক্ষার সম্ভাবনাই মানুষকে দেশান্তরি করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবসম্পদকে যথাযথ ব্যবহার করতে পারেনি, পারছে না। আবার ব্রিটেনের মতো কিছু উন্নত দেশ বিভিন্ন দেশের মানবসম্পদ এনেও নীতি ও কৌশলের সমন্বয়ের অভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদী বৈষম্যের কারণে তাদের কাজে লাগায়নি। ফলে সময়মতো তা এক ব্যাপক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর দিশাহীন হয়ে বর্তমান সরকার নানা বজ্র আঁটুনির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ক্রিসমাসের আগের দিন শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান মহা প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বেরোয় না। আগেই তো ক্রিসমাস ট্রি ও যাবতীয় কেনা শেষ। আর ওদের কেউ-ই কিন্তু তার আগের দিন কাজ করবে না। তাই এসব কাজ সবই ভিনদেশি ও ভিন্নধর্মীরা চালায়। দুই দশক আগেও উইকএন্ডে সব বন্ধ থাকত। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক চাকা ঘুমাত। এখন উইকএন্ড, জাতীয় ছুটি সব সময় এবং বহু রাত পর্যন্ত পোস্ট অফিস খোলা থাকে ভারতীয়দের জন্য, পেট্রলপাম্প খোলা থাকে শ্রীলঙ্কানদের জন্য, নির্মাণকাজ চলতে থাকে পোলিশদের জন্য, পাব ও সুপার মার্কেট খোলা থাকে বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের জন্য।
এদিকে আবার জাতিগত উৎসবের সময় লন্ডনের একেক জায়গা একেক রূপ ধরে। সে এলাকা সাজে এলাকার বেশির ভাগ মানুষের মেজাজ-মর্জি ও কৃষ্টিতে। টাওয়ার হ্যামলেটস হয়ে ওঠে বাংলাদেশ, পার্মাসগ্রিন গ্রিস, সাউথহল ভারত আর এজওয়ার মধ্যপ্রাচ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে মিশ্রণ দেখা যায় নিউহ্যাম বারাতে। এখানে সবচেয়ে বেশি অভিবাসীর মিশ্রণ। এখন এ শহর হয়ে উঠেছে এক উদ্বাস্তু নগর। আর আমিও তার একজন।
যেকোনো ঈদের আগের রাত চাঁদরাতে লন্ডনের ইলফোর্ডে গেলে কিছুতেই মনে হবে না, আপনি বিলেতে আছেন। চারদিকে কদাচিৎ কোনো সাদা মানুষ দেখতে পাবেন। আর রাত ১২টা-একটা পর্যন্ত গাড়ির হর্ন, কাবাব-কুলফি খাওয়া, সালোয়ার-কুর্তা কেনা, পথে পথে পাতা টেবিলে মেহেদি পরানো, জোরে জোরে রাস্তার এপার থেকে ওপারের বন্ধুর নাম ধরে চিৎকার, ‘আরে ইয়ার কাহা যারে হো...’ তো চলেই; তার ওপর হঠাৎ কোনো গাড়ি পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়েও এসে যায়। আর তখন সেখান থেকে উচ্চ স্বরে গান শুনতে ভাসে, ‘তোমহারি লিয়ে হ্যাম ভ্যালা কা জিয়েঙ্গে...’ ইত্যাদি।
এই বিশ্বে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মাইগ্রেশন সব সময়ই ছিল। আর যুগে যুগে যে দেশগুলোয় মানুষ অভিবাসী হয়েছে কারণ খুঁজলে দেখা যাবে, পৃথিবীজুড়ে সাধারণ মানুষের অভিবাসনের মূলেও কিন্তু সেসব দেশই দায়ী। সৃষ্টির নিয়মই পুনর্নির্মাণ ও ঘূর্ণি। কোনো কিছুই যায় না বিফলে। বর্জ্য বলে কিছু নেই। সবই রিসাইকেল হয়। একসময় ব্রিটিশ কলোনি যারা ছিল, অত্যাচারিত হয়েছিল ব্রিটিশদের দ্বারা, এই অভিবাসিত মানুষ তাদেরই জ্ঞাতি ও বংশধর। বুমেরাং হয়ে তারাই কাঁধে চেপেছে। চাপারই কথা। বৈশ্বিক দুনিয়ায় সবই একদিন এক রং হয়ে যাবে।
শামীম আজাদ: কবি ও কলামিস্ট।
কথা হলো, জাতিতে এরা বিদেশি হলেও, বিভিন্ন ভাষায় কথা বললেও, দেখতে নীল চোখ আর সাদা ত্বক না হলেও—জাতীয়তায় এরা সবাই ব্রিটিশ। সবাই কোনো না কোনোভাবে এ দেশে অভিবাসিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ ব্যাপারটা সবাই অবগতই। কিন্তু কখনোই জানতাম না যে বর্তমান লন্ডনে শ্বেতাঙ্গ মানুষই এখন সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পর দুই বছর ধরে ব্যাপক হারে পোলিশ জনগণের প্রবেশের পরও শ্বেতাঙ্গরাই সংখ্যালঘু! আর এশিয়ান তথা বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানি পরিবারেই জন্মহার সবচেয়ে বেশি। এ মেগা সিটির কোনো কোনো এলাকায় এখন প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ। যেহেতু এ সময় অর্থনৈতিক দুর্যোগের সময়, তাই এ শহরের সাদা মানুষ খেপে উঠেছে কিন্তু পারছে না কারণ, তাদের সংখ্যাই এখন কম!
অতিসম্প্রতি বের হওয়া ব্রিটেনের আদমশুমারি অনুযায়ী, গত ১০ বছরে লন্ডনে সাদা মানুষের সংখ্যা শতকরা ৯১ থেকে ৮৬তে নেমে এসেছে। রাজধানীতে মোট শ্বেতাঙ্গের সংখ্যা ৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ, যার মধ্যে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশই ইউরোপের নানা দেশ থেকে দেশান্তরি হওয়া শ্বেতাঙ্গ। পথে সুপার মার্কেটে এখন কেবল বসনীয় ভিক্ষুক দেখা যায়। যত ক্লিনার, কিচেন পোর্টার, বিল্ডার—সব পোলিশ আর ক্রোয়েশিয়ান। এশিয়ানদের সংখ্যা বেড়ে (১৮ দশমিক ৪) গিয়ে এ দেশের আদি অভিবাসী কালোদের ছাড়িয়ে (১৩ দশমিক ৩) গেছে।
আদমশুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিসংখ্যান দপ্তর দেখেছে যে, লন্ডনে এখন কেনসিংটন পাড়ায় সবচেয়ে বেশি বিদেশি পাসপোর্টধারী (৪৪ শতাংশ) রয়েছে। বাঙালি বসবাসপূর্ণ টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালির হার ৩২ দশমিক ৩, আর শ্বেতাঙ্গ ইংলিশ, স্কটিশ ও ওয়েলস মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ৩১ দশমিক ১৮ শতাংশ। ভাবা যায়!
এভাবে অভিবাসী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের বিগ ব্রাদার রক্ষণশীল দল অতীতের শ্রমিক দলের উদার অভিবাসন নীতিকেই দায়ী করছে। তার কারণেই ১৯৯৭-এর পর ব্রিটেনের জনসংখ্যা বেড়েছে তিন মিলিয়ন। আর যদি এ হার অব্যাহত থাকে, তবে আগামী ২০ বছরে এ দেশের জনসংখ্যা বেড়ে হবে ৭০ মিলিয়ন, যা কি না বর্তমান ৬৩ মিলিয়ন। কিছুটা দায় অবশ্য শ্রমিক দলের বর্তমান নেতা এড মিলিব্যান্ড স্বীকারও করছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা তাদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে এই ব্যাপকসংখ্যক অভিবাসীর কোনো শিক্ষা ও সক্ষমতাও ছিল না। এমনকি শ্রমিক দলের শাসনামলে এই বহিরাগতদের ইংরেজি বিদ্যা পরখ না করে আনার ফলে এবং এখানে আসার পর তাদের জন্য সবকিছু তাদের ভাষায় অনুবাদ করে দেওয়াটাই ছিল প্রচণ্ড ভুল। তাই এক প্রজন্ম এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করেনি। আর দিন দিন পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে সাংঘর্ষিক। শহর হয়েছে নোংরা, ইংরেজদের পাব হয়েছে বিলুপ্ত, শত শত মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির হয়েছে। আর তাতেই কিনা ককেশীয়রা লন্ডন শহর ছেড়ে পালিয়ে বাসা বাঁধছে শহরতলিতে।
অপেক্ষাকৃত কম অবস্থাপন্ন দেশগুলোর ঝড়-বন্যা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অন্য দেশের আগ্রাসন, যুদ্ধ, নিজেদের অন্তঃকলহ এবং অপরদিকে তুলনামূলকভাবে উন্নত দেশগুলোর সর্বজনীন সাধারণ সেবাদান, ন্যূনতম চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য ও উচ্চশিক্ষার সম্ভাবনাই মানুষকে দেশান্তরি করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবসম্পদকে যথাযথ ব্যবহার করতে পারেনি, পারছে না। আবার ব্রিটেনের মতো কিছু উন্নত দেশ বিভিন্ন দেশের মানবসম্পদ এনেও নীতি ও কৌশলের সমন্বয়ের অভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদী বৈষম্যের কারণে তাদের কাজে লাগায়নি। ফলে সময়মতো তা এক ব্যাপক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর দিশাহীন হয়ে বর্তমান সরকার নানা বজ্র আঁটুনির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ক্রিসমাসের আগের দিন শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান মহা প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বেরোয় না। আগেই তো ক্রিসমাস ট্রি ও যাবতীয় কেনা শেষ। আর ওদের কেউ-ই কিন্তু তার আগের দিন কাজ করবে না। তাই এসব কাজ সবই ভিনদেশি ও ভিন্নধর্মীরা চালায়। দুই দশক আগেও উইকএন্ডে সব বন্ধ থাকত। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক চাকা ঘুমাত। এখন উইকএন্ড, জাতীয় ছুটি সব সময় এবং বহু রাত পর্যন্ত পোস্ট অফিস খোলা থাকে ভারতীয়দের জন্য, পেট্রলপাম্প খোলা থাকে শ্রীলঙ্কানদের জন্য, নির্মাণকাজ চলতে থাকে পোলিশদের জন্য, পাব ও সুপার মার্কেট খোলা থাকে বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের জন্য।
এদিকে আবার জাতিগত উৎসবের সময় লন্ডনের একেক জায়গা একেক রূপ ধরে। সে এলাকা সাজে এলাকার বেশির ভাগ মানুষের মেজাজ-মর্জি ও কৃষ্টিতে। টাওয়ার হ্যামলেটস হয়ে ওঠে বাংলাদেশ, পার্মাসগ্রিন গ্রিস, সাউথহল ভারত আর এজওয়ার মধ্যপ্রাচ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে মিশ্রণ দেখা যায় নিউহ্যাম বারাতে। এখানে সবচেয়ে বেশি অভিবাসীর মিশ্রণ। এখন এ শহর হয়ে উঠেছে এক উদ্বাস্তু নগর। আর আমিও তার একজন।
যেকোনো ঈদের আগের রাত চাঁদরাতে লন্ডনের ইলফোর্ডে গেলে কিছুতেই মনে হবে না, আপনি বিলেতে আছেন। চারদিকে কদাচিৎ কোনো সাদা মানুষ দেখতে পাবেন। আর রাত ১২টা-একটা পর্যন্ত গাড়ির হর্ন, কাবাব-কুলফি খাওয়া, সালোয়ার-কুর্তা কেনা, পথে পথে পাতা টেবিলে মেহেদি পরানো, জোরে জোরে রাস্তার এপার থেকে ওপারের বন্ধুর নাম ধরে চিৎকার, ‘আরে ইয়ার কাহা যারে হো...’ তো চলেই; তার ওপর হঠাৎ কোনো গাড়ি পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়েও এসে যায়। আর তখন সেখান থেকে উচ্চ স্বরে গান শুনতে ভাসে, ‘তোমহারি লিয়ে হ্যাম ভ্যালা কা জিয়েঙ্গে...’ ইত্যাদি।
এই বিশ্বে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মাইগ্রেশন সব সময়ই ছিল। আর যুগে যুগে যে দেশগুলোয় মানুষ অভিবাসী হয়েছে কারণ খুঁজলে দেখা যাবে, পৃথিবীজুড়ে সাধারণ মানুষের অভিবাসনের মূলেও কিন্তু সেসব দেশই দায়ী। সৃষ্টির নিয়মই পুনর্নির্মাণ ও ঘূর্ণি। কোনো কিছুই যায় না বিফলে। বর্জ্য বলে কিছু নেই। সবই রিসাইকেল হয়। একসময় ব্রিটিশ কলোনি যারা ছিল, অত্যাচারিত হয়েছিল ব্রিটিশদের দ্বারা, এই অভিবাসিত মানুষ তাদেরই জ্ঞাতি ও বংশধর। বুমেরাং হয়ে তারাই কাঁধে চেপেছে। চাপারই কথা। বৈশ্বিক দুনিয়ায় সবই একদিন এক রং হয়ে যাবে।
শামীম আজাদ: কবি ও কলামিস্ট।
No comments