সম্মেলন- আওয়ামী লীগের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা by আবদুল মান্নান
২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন (১৯তম জাতীয় সম্মেলন)। কেউ কেউ বলেন, এটি স্রেফ নিয়ম রক্ষার সম্মেলন।
আবার অন্যদের মতে, এই সম্মেলন এ কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু দলের নতুন কমিটিই আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের সার্বিক কৌশল নির্ধারণ করবে এবং নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। এই সম্মেলন নিয়ে ইতিমধ্যে দলের সর্বস্তরে এবং দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে বেশ আলাপ-আলোচনা হচ্ছে এবং অনেকের মধ্যে নানা ধরনের প্রত্যাশাও সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু বর্তমানে দেশ শাসন করছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার, সেহেতু মহাজোট প্রত্যাশা করবে আগামী নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে এবং সে কারণেই যারা মহাজোট সরকারকে পুনরায় ক্ষমতায় দেখতে চায়, তাদেরও দৃষ্টি এই ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের ওপর। আর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো অন্তরে ধারণ করেন, তাঁরা অবশ্যই চান এই সম্মেলনের মাধ্যমে একটি কার্যকর প্রেসিডিয়াম আর ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে দলকে আওয়ামী লীগ আরও গতিশীল করুক এবং তারা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করুক। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আবার একাত্তরের ঘাতকদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেখতে চায় না।
তবে একটি সত্য না বললেই নয়, কারণ যাঁরা দলের শীর্ষ পদে আসীন থাকেন, তাঁরা প্রায় সাধারণ কর্মী ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং বাস্তবটা বুঝতে পারেন না। এই মুহূর্তে বাস্তবটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ শুধু যে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল, তা কিন্তু নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, আওয়ামী লীগকে সব সময় অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে এবং ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের রাজনীতি হচ্ছে আওয়ামী লীগ বনাম অন্যরা। এই অন্যদের মধ্যে যেমন আছে বিরোধী দলগুলো, তেমনি আছে সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এবারও তেমন ব্যতিক্রম ছিল না। শুধু একটি ব্যতিক্রম ছিল; আর তা হচ্ছে, সরকারের কিছু অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগের অনেক বন্ধু অথবা শুভাকাঙ্ক্ষী হয় আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অথবা নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয়ের পেছনে কাজ করেছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদের চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরের দুঃশাসন। এই বিজয়ের পর প্রত্যাশিত ছিল যে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে আরও গতিশীল হবে। কিন্তু চিত্রটি বর্তমানে সম্পূর্ণ বিপরীত। অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের ভেতরে বিলীন হয়ে পড়েছে। অথচ সরকারের চেয়ে দল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন।
২০০৯ সালে দলের সর্বশেষ ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়েছিল এবং সেই সম্মেলনে বেশ কিছু নতুন মুখকে দলের নীতিনির্ধারণী কমিটিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পুরোনো অনেক পরীক্ষিত নেতা হয় বাদ পড়েছিলেন, অথবা দলের সবচেয়ে অকার্যকর উপদেষ্টামণ্ডলীতে তাঁদের স্থান হয়েছিল। এই কমিটিকে অকার্যকর বলছি এ কারণেই, এই কমিটির কদাচিৎ সভা হয়েছে এবং হলেও তারা দলকে তেমন কোনো কার্যকর উপদেশ দিয়েছিল বলে মনে হয় না। যাঁরা বাদ পড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কিছু বাদ পড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, তাঁরা শেখ হাসিনা মাইনাস আওয়ামী লীগের কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকাশ্যে বলেছিলেন। অবশ্য এটি জানার সুযোগ নেই, তাঁদের মধ্যে কজন এই মাইনাস ফর্মুলা নিজ থেকে বলেছিলেন, আর কজন চাপে পড়ে বলেছিলেন। যাঁরা চাপে পড়ে বলেছিলেন, সম্ভবত তাঁদের মানসিক শক্তি খুবই দুর্বল ছিল। এঁদের অনেককেই দলের মূল কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন দলের মনোনয়ন পেলেও অনেকে আবার পাননি। এঁদের সবাই যে দল ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তা-ও নয়। কেউ কেউ চুপচাপ থেকেছেন, আবার কয়েকজন দলের বিরুদ্ধে গিয়েও নানা ধরনের রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কয়েকজন আবার দলের সরাসরি বিরোধিতাও করেছেন। আবার যেসব নতুন মুখকে দলীয় সভানেত্রী দলের নীতিনির্ধারণী কমিটি এবং সরকারে স্থান দিয়েছিলেন, তাঁদের সবার দায়িত্ব যে তাঁরা সফলভাবে পালন করতে পেরেছেন, তা-ও নয়। কারও কারও কর্মকাণ্ড দলের নীতিনির্ধারকদের বিব্রত করেছে এবং সরকারের কর্মকাণ্ডকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে সাধারণ সম্পাদকের পদটি; যে পদে মনোনীত হয়েছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কান্ডারি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি অত্যন্ত মার্জিত এবং একজন শিক্ষিত মানুষ। তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কে আমার বা কারও মনে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দলের নেতা-কর্মীদের বড় অভিযোগ, তাঁর সঙ্গে দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সামনের সম্মেলনে তিনি হয়তো তাঁর পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন, কিন্তু তাঁকে তো তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় নেতা-কর্মীদের আনা অভিযোগ খণ্ডন করার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান সরকারের যেমন বেশ কিছু ব্যর্থতা আছে, তেমনি অনেক বড় অর্জনও আছে। কিন্তু সরকারের ও দলের প্রচারযন্ত্র খুবই দুর্বল। দলের কর্মকাণ্ড প্রচারে যিনি দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরও যোগ্যতার ঘাটতি নেই, কিন্তু সম্ভবত তাঁর কাছে যোগ্য জনবলের অভাব বেশি; যে কারণে তিনি হয়তো অনেক কিছুই করতে পারেন না। এমনও হতে পারে, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রচারের গুরুত্বটা বুঝতে পারে না। এদিক দিয়ে বিএনপির কাছ থেকে আওয়ামী লীগের অনেক কিছু শেখার আছে। মধ্যরাতের টক শো অথবা পত্রপত্রিকা খুললেই তার সত্যতা মিলবে। টক শোর সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু এটি তো সত্য যে এসব টক শো দেশে ও দেশের বাইরে লাখ লাখ দর্শক দেখে ও শোনে। এখানে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আশা করি, সম্মেলনে এসব বিষয় গুরুত্ব পাবে। একটি নির্বাচনে ভালো করতে হলে সঠিক প্রচারযন্ত্র সৃষ্টি করা একান্তভাবে অপরিহার্য।
বর্তমানে দেশের মানুষ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। একেবারে দলের অন্ধ সমর্থক ছাড়া এখন আর কেউ মার্কা দেখে ভোট দেন না। তাঁরা ভালো-মন্দ বিচার করেন। এঁদের সংখ্যাই নির্ধারণ করবে সামনের নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কেমন করবে। যাদের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ আছে, তাদের এড়িয়ে চলাই ভালো। দলে কালোটাকা আর পেশিশক্তির জায়গা যতই সংকুচিত হয়, ততই দলের জন্য ভালো। আমার মতো একজন নগণ্য ব্যক্তির প্রত্যাশা, আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কাছে তেমন গুরুত্ব পাবে, তা মনে করি না। তবে এটা বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হারলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হেরে যায়। আর চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারকাজকে সামনে রেখে এটি তো আরও বেশি সত্য। সামনের বার একাত্তরের ঘাতকদের গাড়িতে পতাকা উড়লে অনেককে দেশত্যাগী হতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিরাই আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের মাধ্যমে দলের নীতিনির্ধারণী কমিটিগুলোতে স্থান পাক, এটাই দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রত্যাশা। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে দেশের মানুষের যত বেশি প্রত্যাশা, অন্য দলগুলো সম্পর্কে তেমনটি বলা যাবে না; কারণ তৃণমূল থেকে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগই। সামনের সম্মেলনই হোক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের দিকে ফিরে চলার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের সাফল্য কামনা করছি। সবাইকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে একটি সত্য না বললেই নয়, কারণ যাঁরা দলের শীর্ষ পদে আসীন থাকেন, তাঁরা প্রায় সাধারণ কর্মী ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং বাস্তবটা বুঝতে পারেন না। এই মুহূর্তে বাস্তবটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ শুধু যে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল, তা কিন্তু নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, আওয়ামী লীগকে সব সময় অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে এবং ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের রাজনীতি হচ্ছে আওয়ামী লীগ বনাম অন্যরা। এই অন্যদের মধ্যে যেমন আছে বিরোধী দলগুলো, তেমনি আছে সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এবারও তেমন ব্যতিক্রম ছিল না। শুধু একটি ব্যতিক্রম ছিল; আর তা হচ্ছে, সরকারের কিছু অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগের অনেক বন্ধু অথবা শুভাকাঙ্ক্ষী হয় আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অথবা নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয়ের পেছনে কাজ করেছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদের চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরের দুঃশাসন। এই বিজয়ের পর প্রত্যাশিত ছিল যে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে আরও গতিশীল হবে। কিন্তু চিত্রটি বর্তমানে সম্পূর্ণ বিপরীত। অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের ভেতরে বিলীন হয়ে পড়েছে। অথচ সরকারের চেয়ে দল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন।
২০০৯ সালে দলের সর্বশেষ ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়েছিল এবং সেই সম্মেলনে বেশ কিছু নতুন মুখকে দলের নীতিনির্ধারণী কমিটিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পুরোনো অনেক পরীক্ষিত নেতা হয় বাদ পড়েছিলেন, অথবা দলের সবচেয়ে অকার্যকর উপদেষ্টামণ্ডলীতে তাঁদের স্থান হয়েছিল। এই কমিটিকে অকার্যকর বলছি এ কারণেই, এই কমিটির কদাচিৎ সভা হয়েছে এবং হলেও তারা দলকে তেমন কোনো কার্যকর উপদেশ দিয়েছিল বলে মনে হয় না। যাঁরা বাদ পড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কিছু বাদ পড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, তাঁরা শেখ হাসিনা মাইনাস আওয়ামী লীগের কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকাশ্যে বলেছিলেন। অবশ্য এটি জানার সুযোগ নেই, তাঁদের মধ্যে কজন এই মাইনাস ফর্মুলা নিজ থেকে বলেছিলেন, আর কজন চাপে পড়ে বলেছিলেন। যাঁরা চাপে পড়ে বলেছিলেন, সম্ভবত তাঁদের মানসিক শক্তি খুবই দুর্বল ছিল। এঁদের অনেককেই দলের মূল কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন দলের মনোনয়ন পেলেও অনেকে আবার পাননি। এঁদের সবাই যে দল ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তা-ও নয়। কেউ কেউ চুপচাপ থেকেছেন, আবার কয়েকজন দলের বিরুদ্ধে গিয়েও নানা ধরনের রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কয়েকজন আবার দলের সরাসরি বিরোধিতাও করেছেন। আবার যেসব নতুন মুখকে দলীয় সভানেত্রী দলের নীতিনির্ধারণী কমিটি এবং সরকারে স্থান দিয়েছিলেন, তাঁদের সবার দায়িত্ব যে তাঁরা সফলভাবে পালন করতে পেরেছেন, তা-ও নয়। কারও কারও কর্মকাণ্ড দলের নীতিনির্ধারকদের বিব্রত করেছে এবং সরকারের কর্মকাণ্ডকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে সাধারণ সম্পাদকের পদটি; যে পদে মনোনীত হয়েছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কান্ডারি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি অত্যন্ত মার্জিত এবং একজন শিক্ষিত মানুষ। তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কে আমার বা কারও মনে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দলের নেতা-কর্মীদের বড় অভিযোগ, তাঁর সঙ্গে দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সামনের সম্মেলনে তিনি হয়তো তাঁর পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন, কিন্তু তাঁকে তো তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় নেতা-কর্মীদের আনা অভিযোগ খণ্ডন করার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান সরকারের যেমন বেশ কিছু ব্যর্থতা আছে, তেমনি অনেক বড় অর্জনও আছে। কিন্তু সরকারের ও দলের প্রচারযন্ত্র খুবই দুর্বল। দলের কর্মকাণ্ড প্রচারে যিনি দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরও যোগ্যতার ঘাটতি নেই, কিন্তু সম্ভবত তাঁর কাছে যোগ্য জনবলের অভাব বেশি; যে কারণে তিনি হয়তো অনেক কিছুই করতে পারেন না। এমনও হতে পারে, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রচারের গুরুত্বটা বুঝতে পারে না। এদিক দিয়ে বিএনপির কাছ থেকে আওয়ামী লীগের অনেক কিছু শেখার আছে। মধ্যরাতের টক শো অথবা পত্রপত্রিকা খুললেই তার সত্যতা মিলবে। টক শোর সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু এটি তো সত্য যে এসব টক শো দেশে ও দেশের বাইরে লাখ লাখ দর্শক দেখে ও শোনে। এখানে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আশা করি, সম্মেলনে এসব বিষয় গুরুত্ব পাবে। একটি নির্বাচনে ভালো করতে হলে সঠিক প্রচারযন্ত্র সৃষ্টি করা একান্তভাবে অপরিহার্য।
বর্তমানে দেশের মানুষ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। একেবারে দলের অন্ধ সমর্থক ছাড়া এখন আর কেউ মার্কা দেখে ভোট দেন না। তাঁরা ভালো-মন্দ বিচার করেন। এঁদের সংখ্যাই নির্ধারণ করবে সামনের নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কেমন করবে। যাদের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ আছে, তাদের এড়িয়ে চলাই ভালো। দলে কালোটাকা আর পেশিশক্তির জায়গা যতই সংকুচিত হয়, ততই দলের জন্য ভালো। আমার মতো একজন নগণ্য ব্যক্তির প্রত্যাশা, আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কাছে তেমন গুরুত্ব পাবে, তা মনে করি না। তবে এটা বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হারলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হেরে যায়। আর চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারকাজকে সামনে রেখে এটি তো আরও বেশি সত্য। সামনের বার একাত্তরের ঘাতকদের গাড়িতে পতাকা উড়লে অনেককে দেশত্যাগী হতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিরাই আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের মাধ্যমে দলের নীতিনির্ধারণী কমিটিগুলোতে স্থান পাক, এটাই দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রত্যাশা। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে দেশের মানুষের যত বেশি প্রত্যাশা, অন্য দলগুলো সম্পর্কে তেমনটি বলা যাবে না; কারণ তৃণমূল থেকে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগই। সামনের সম্মেলনই হোক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের দিকে ফিরে চলার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের সাফল্য কামনা করছি। সবাইকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments