আজ-কাল-পরশু- পাদপ্রদীপের আলোয় উচ্চাঙ্গসংগীত by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও ভারতের ‘আইটিসি সংগীত রিসার্চ একাডেমি’র (কলকাতা) যৌথ উদ্যোগে চার দিনব্যাপী উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদনের এই মহা উৎসব এ দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।
স্বাধীনতার পর এত বড় আন্তর্জাতিক মাপের সাংস্কৃতিক আয়োজন আর হয়নি। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগেও নয়। সরকারি উদ্যোগে তো আন্তর্জাতিক মাপের সাংস্কৃতিক আয়োজন কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না, এত বড় একটি শিল্পকলা একাডেমী থাকা সত্ত্বেও। একমাত্র ব্যতিক্রম দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী।
চার দিনব্যাপী এই উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে ভারত ও বাংলাদেশের শতাধিক গুণী সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী অংশ নেন। ভারত থেকে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই ভারতের উচ্চাঙ্গসংগীত জগতের দিকপাল। তাঁদের গান বা বাজনা টিভি অনুষ্ঠান বা সিডির মাধ্যমে এ দেশে অনেকেই শুনেছেন। নানা পত্রিকায় তাঁদের খবর পড়েছেন। বাংলাদেশে তাঁরা অনেকের কাছেই পরিচিত। ভারত থেকে শুধু যে দিকপালেরা এসেছেন তা নয়, সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ শিল্পী থেকে তরুণ শিল্পীও এসেছেন কয়েকজন। শিল্পী নির্বাচনের এই দিকও তাৎপর্যপূর্ণ। এঁদের দেখে আমাদের তরুণ শিল্পীরাও অনুপ্রাণিত হবেন। ভারতে উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন ভারতের বর্তমান প্রজন্মের কাছে কতটা আদৃত হয়েছে, এঁদের পারফরম্যান্স দেখে তা-ও অনুভব করা যায়।
আমরা জানি, উচ্চাঙ্গসংগীত বা উচ্চাঙ্গ বাদন উপমহাদেশে বংশ ও পরিবার-পরম্পরায় বিকশিত হয়েছে। এই গান বা বাদন একান্তই গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে বংশপরম্পরায় ভারতে উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন আজ এই পর্যায়ে এসেছে। উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদনে ভারতের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। শুধু সমাদৃত নয়, কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র আজ সারা পৃথিবীতে একটা বড় আকর্ষণ। একজন ‘রবিশঙ্কর’ শুধু সেতার বাজিয়ে ভারতের ভাবমূর্তিকে পৃথিবীর বুকে যে স্তরে নিয়ে গেছেন, তা অকল্পনীয়। সত্যজিৎ রায় ও রবিশঙ্কর পৃথিবীতে ভারতের যে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন, তা আরও কয়েক শতাব্দী ভারত ভোগ করতে পারবে।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২৫ হাজার আগ্রহী শ্রোতা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করেছেন। (বিজ্ঞাপন) শুধু ঢাকা থেকে নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করেছেন। হয়তো ২৫ হাজার দর্শক একসঙ্গে বসে প্রতি রাতে অনুষ্ঠান দেখেনি। কতজন দেখেছে, তা আমরা জানি না। তবে অনুমান ১০ থেকে ১৫ হাজার দর্শক প্রতি রাতে অনুষ্ঠান দেখেছে। এই সম্মেলনের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো: অনুষ্ঠানের জন্য টাকার বিনিময়ে কোনো টিকিট কাটতে হয়নি। সম্পূর্ণ ফ্রি। তা ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বাসযোগে দর্শকদের অনুষ্ঠানমণ্ডপে (আর্মি স্টেডিয়াম) আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। একটি বেসরকারি উদ্যোগে এ রকম বিনা পয়সায় এত বড় ও উঁচু মাপের অনুষ্ঠান দেখানোর উদ্যোগ বাংলাদেশে এই প্রথম। শুধু বিনে পয়সায় নয়, অনুষ্ঠানটি যেকোনো ব্যক্তির পক্ষে দেখার সুযোগ ছিল। এতটাই উন্মুক্ত ছিল। সাধারণত বিনে পয়সার অনুষ্ঠানেও আমরা এলিট শ্রেণীকে কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ জানাই। সাধারণেরা অনেক অনুষ্ঠানে ঢুকতেই পারে না। বিপুল দর্শক সমাগমের দিক থেকে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাংলাদেশে প্রথম এবং শীর্ষে। ঢাকায় কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এত দর্শক সমাগম হয়নি।
এই উৎসবে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গেও বহু দর্শকের পরিচয় ঘটেছে। যদিও সীমিত পরিসরে তাঁদের কাজের সঙ্গে অনেকে পূর্বপরিচিত। অনেকে দীর্ঘদিন এই ভুবনে বিচরণ করছেন। কেউ কেউ বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন জগতে প্রতিষ্ঠিত। তবে ঢাকায় উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠান খুব কম আয়োজন করা হয় বলে তাঁদের প্রতিভার সঙ্গে অনেকে পরিচিত নন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলও লঘু গানে বেশি আগ্রহী। উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদনের প্রতি বিমুখ। ফলে কোনোভাবেই তাঁরা প্রত্যাশিত পরিচিতি লাভ করেননি। এটা আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের দুর্ভাগ্য।
এই উৎসবের কয়েকটি দিক বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ১) বিপুলসংখ্যক দর্শকের উপস্থিতি। এই উৎসবের আগে এটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে সাধারণ দর্শক-শ্রোতা সারা রাত জেগে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনতে আসবে, এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে ছিল না। আমরা কলকাতার ‘ডোভার লেন সংগীত সম্মেলন’-এর কথা বহু বছর যাবৎ শুনে আসছি। অনুষ্ঠানটি সারা রাত চলে এবং যা কলকাতায় ঐতিহ্যবাহী উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব হিসেবে বহু বছর যাবৎ সমাদৃত। কিন্তু বাংলাদেশে ‘বেঙ্গল’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ রকম দর্শক সমাগম অভাবিত। তা-ও সারা রাত ধরে গান শোনা। ‘বেঙ্গল’ একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, যা আগামী বছর থেকে একটা রীতি হয়ে উঠবে বলে আমাদের আশা।
দর্শকের মধ্যে তরুণ ছেলেমেয়েদের ব্যাপক হারে উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তাদের খুব মনোযোগী শ্রোতার মতো সারা রাত গান শুনতে দেখা গেছে। এটা আমাদের তরুণদের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরেছে। দেশব্যাপী নানা স্থূল ও লঘু সংগীতের দাপটেও বিরাটসংখ্যক তরুণ উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন শুনতে আগ্রহী, এটা গর্ব করার মতো ঘটনা। ২) দ্বিতীয় প্রশংসনীয় দিক হলো: ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। প্যান্ডেল, মঞ্চ, অনেকগুলো বিগ স্ক্রিন, ফটো প্রদর্শনী, বুকস্টল, ফুড কোর্ট, প্রবেশপথ, সাউন্ড, লাইট, মঞ্চের ডিজিটাল চিত্র, বসার ব্যবস্থা সবই সুন্দর, সুপরিকল্পিত। একটা স্টেডিয়ামে এত বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করলে যত সুবিধা ও আরাম দেওয়া সম্ভব, তার প্রায় সবই ছিল। বলা বাহুল্য, এটা ‘ফাইভ স্টার’ সুযোগ নয়। তা কেউ আশাও করে না। ৩) ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রায় ১৫০ জন শিল্পী, যন্ত্রী, কলাকুশলীকে ঠিক দিনে ঠিক সময়ে ঢাকায় উপস্থিত করানো একটা বড় সাফল্য। কয়েকজন শিল্পী বক্তৃতায় বলেছেন: ‘আতিথেয়তা, সহায়তাকারী ও অন্যান্য লজিস্টিকস সবই উন্নতমানের ছিল।’ এত বড় অনুষ্ঠানের আয়োজনে বাংলাদেশের (বেঙ্গলের) সক্ষমতা দেখে ভারতীয় অতিথিরা যে মুগ্ধ হয়েছেন, এটা আমাদের জন্য একটা বড় পাওনা। কারণ, এই সেক্টরে বাংলাদেশের কোনো অবস্থান কোনোকালেই ছিল না। এখন বাংলাদেশ একটা নির্ভরযোগ্য ভেন্যু হিসেবে শিল্পী ও গুরুমহলে বিবেচিত হবে।
কয়েকটি প্রস্তাব: ১) উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন সম্পর্কে কিছু শ্রোতার যে আগ্রহ ও চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা ধরে রাখতে হলে এবং বাড়াতে হলে প্রতিবছর শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে ‘জাতীয়ভিত্তিক উৎসবের’ আয়োজন করা যায়। দেশীয় শিল্পী ও গুরুদের পরিচিতি বাড়াতে হবে। তাহলে তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বাড়বে ও শ্রোতা সৃষ্টি হবে। ২) বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দুই মাসে একবার রাতে দীর্ঘ সময়ব্যাপী উচ্চাঙ্গসংগীত, যন্ত্রসংগীত ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের অনুষ্ঠান প্রচার করা যায়। ৩) বেঙ্গল-এসআরএ আয়োজিত এই উৎসব প্রতিবছর আয়োজন করা (বলা বাহুল্য) ও ভারত থেকে নতুন নতুন শিল্পীকে আমন্ত্রণ করা। ৪) ঢাকার অনুষ্ঠানের পর পরই একটি জেলা শহরে ছোট আকারে হলেও অন্তত দুই দিনের একটি উৎসবের আয়োজন করা। (সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়া ঠিক নয়।) ৫) যেসব সংগঠন বা স্কুল শুধু উচ্চাঙ্গসংগীত, নৃত্য বা যন্ত্রসংগীতের প্রশিক্ষণ দেয়, তাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ বার্ষিক অনুদানের ব্যবস্থা করা। ৬) বেঙ্গল-এসআরএ যৌথভাবে যে প্রশিক্ষণ প্রকল্প নিতে যাচ্ছে, তার বাস্তবায়ন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ৭) এ ধরনের আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের আর্থিক দিকটি স্বচ্ছতার সঙ্গে জনসমক্ষে উপস্থাপন করা। ৮) ‘বেঙ্গলের’ ওপর আর্থিক বোঝা হ্রাসের লক্ষ্যে শর্তবিহীন সরকারি অনুদান ও বাণিজ্যিক স্পনসরদের এগিয়ে আসার ওপর গুরুত্ব দেওয়া। ৯) টিকিট ক্রয় ছাড়া অনুষ্ঠান দেখা সমর্থনযোগ্য নয়। ছাত্রদের জন্য ফ্রি হতে পারে। অন্যদের জন্য বিভিন্ন হারে টিকিট থাকা উচিত। শিল্প-সংস্কৃতি ফ্রি দেখার বা শোনার বিষয় নয়। এর পেছনে বহু টাকা ব্যয় করতে হয়। জনগণকেও এ জন্য সহযোগিতা করা উচিত। লাভের জন্য টিকিট নয়, আংশিক ব্যয় মেটানোর জন্য টিকিট-ব্যবস্থা দরকার।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমী কোনো দিন যা পারেনি, ‘বেঙ্গল’ তা করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই খাতে কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপ নিলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে অনেক দূর এগোনো যেতে পারে। উচ্চাঙ্গসংগীত, উচ্চাঙ্গ যন্ত্রসংগীত, উচ্চাঙ্গ নৃত্য সংস্কৃতি জগতে খুবই অবহেলিত, উপেক্ষিত ও স্বল্প পরিচিত। এখন সময় এসেছে এই খাতে পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের যৌথভাবে কিছু গঠনমূলক কাজ করার। বেঙ্গল-এসআরএ আয়োজিত প্রথম ‘উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’ আমাদের সেই কাজের ডাক দিয়েছে। আশা করি, সরকার ও সংস্কৃতিমান প্রাইভেট সেক্টর এই ডাকে সাড়া দেবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।
চার দিনব্যাপী এই উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে ভারত ও বাংলাদেশের শতাধিক গুণী সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী অংশ নেন। ভারত থেকে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই ভারতের উচ্চাঙ্গসংগীত জগতের দিকপাল। তাঁদের গান বা বাজনা টিভি অনুষ্ঠান বা সিডির মাধ্যমে এ দেশে অনেকেই শুনেছেন। নানা পত্রিকায় তাঁদের খবর পড়েছেন। বাংলাদেশে তাঁরা অনেকের কাছেই পরিচিত। ভারত থেকে শুধু যে দিকপালেরা এসেছেন তা নয়, সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ শিল্পী থেকে তরুণ শিল্পীও এসেছেন কয়েকজন। শিল্পী নির্বাচনের এই দিকও তাৎপর্যপূর্ণ। এঁদের দেখে আমাদের তরুণ শিল্পীরাও অনুপ্রাণিত হবেন। ভারতে উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন ভারতের বর্তমান প্রজন্মের কাছে কতটা আদৃত হয়েছে, এঁদের পারফরম্যান্স দেখে তা-ও অনুভব করা যায়।
আমরা জানি, উচ্চাঙ্গসংগীত বা উচ্চাঙ্গ বাদন উপমহাদেশে বংশ ও পরিবার-পরম্পরায় বিকশিত হয়েছে। এই গান বা বাদন একান্তই গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে বংশপরম্পরায় ভারতে উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন আজ এই পর্যায়ে এসেছে। উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদনে ভারতের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। শুধু সমাদৃত নয়, কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র আজ সারা পৃথিবীতে একটা বড় আকর্ষণ। একজন ‘রবিশঙ্কর’ শুধু সেতার বাজিয়ে ভারতের ভাবমূর্তিকে পৃথিবীর বুকে যে স্তরে নিয়ে গেছেন, তা অকল্পনীয়। সত্যজিৎ রায় ও রবিশঙ্কর পৃথিবীতে ভারতের যে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন, তা আরও কয়েক শতাব্দী ভারত ভোগ করতে পারবে।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২৫ হাজার আগ্রহী শ্রোতা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করেছেন। (বিজ্ঞাপন) শুধু ঢাকা থেকে নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করেছেন। হয়তো ২৫ হাজার দর্শক একসঙ্গে বসে প্রতি রাতে অনুষ্ঠান দেখেনি। কতজন দেখেছে, তা আমরা জানি না। তবে অনুমান ১০ থেকে ১৫ হাজার দর্শক প্রতি রাতে অনুষ্ঠান দেখেছে। এই সম্মেলনের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো: অনুষ্ঠানের জন্য টাকার বিনিময়ে কোনো টিকিট কাটতে হয়নি। সম্পূর্ণ ফ্রি। তা ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বাসযোগে দর্শকদের অনুষ্ঠানমণ্ডপে (আর্মি স্টেডিয়াম) আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। একটি বেসরকারি উদ্যোগে এ রকম বিনা পয়সায় এত বড় ও উঁচু মাপের অনুষ্ঠান দেখানোর উদ্যোগ বাংলাদেশে এই প্রথম। শুধু বিনে পয়সায় নয়, অনুষ্ঠানটি যেকোনো ব্যক্তির পক্ষে দেখার সুযোগ ছিল। এতটাই উন্মুক্ত ছিল। সাধারণত বিনে পয়সার অনুষ্ঠানেও আমরা এলিট শ্রেণীকে কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ জানাই। সাধারণেরা অনেক অনুষ্ঠানে ঢুকতেই পারে না। বিপুল দর্শক সমাগমের দিক থেকে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাংলাদেশে প্রথম এবং শীর্ষে। ঢাকায় কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এত দর্শক সমাগম হয়নি।
এই উৎসবে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গেও বহু দর্শকের পরিচয় ঘটেছে। যদিও সীমিত পরিসরে তাঁদের কাজের সঙ্গে অনেকে পূর্বপরিচিত। অনেকে দীর্ঘদিন এই ভুবনে বিচরণ করছেন। কেউ কেউ বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন জগতে প্রতিষ্ঠিত। তবে ঢাকায় উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠান খুব কম আয়োজন করা হয় বলে তাঁদের প্রতিভার সঙ্গে অনেকে পরিচিত নন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলও লঘু গানে বেশি আগ্রহী। উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদনের প্রতি বিমুখ। ফলে কোনোভাবেই তাঁরা প্রত্যাশিত পরিচিতি লাভ করেননি। এটা আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের দুর্ভাগ্য।
এই উৎসবের কয়েকটি দিক বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ১) বিপুলসংখ্যক দর্শকের উপস্থিতি। এই উৎসবের আগে এটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে সাধারণ দর্শক-শ্রোতা সারা রাত জেগে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনতে আসবে, এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে ছিল না। আমরা কলকাতার ‘ডোভার লেন সংগীত সম্মেলন’-এর কথা বহু বছর যাবৎ শুনে আসছি। অনুষ্ঠানটি সারা রাত চলে এবং যা কলকাতায় ঐতিহ্যবাহী উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব হিসেবে বহু বছর যাবৎ সমাদৃত। কিন্তু বাংলাদেশে ‘বেঙ্গল’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ রকম দর্শক সমাগম অভাবিত। তা-ও সারা রাত ধরে গান শোনা। ‘বেঙ্গল’ একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, যা আগামী বছর থেকে একটা রীতি হয়ে উঠবে বলে আমাদের আশা।
দর্শকের মধ্যে তরুণ ছেলেমেয়েদের ব্যাপক হারে উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তাদের খুব মনোযোগী শ্রোতার মতো সারা রাত গান শুনতে দেখা গেছে। এটা আমাদের তরুণদের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরেছে। দেশব্যাপী নানা স্থূল ও লঘু সংগীতের দাপটেও বিরাটসংখ্যক তরুণ উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন শুনতে আগ্রহী, এটা গর্ব করার মতো ঘটনা। ২) দ্বিতীয় প্রশংসনীয় দিক হলো: ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। প্যান্ডেল, মঞ্চ, অনেকগুলো বিগ স্ক্রিন, ফটো প্রদর্শনী, বুকস্টল, ফুড কোর্ট, প্রবেশপথ, সাউন্ড, লাইট, মঞ্চের ডিজিটাল চিত্র, বসার ব্যবস্থা সবই সুন্দর, সুপরিকল্পিত। একটা স্টেডিয়ামে এত বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করলে যত সুবিধা ও আরাম দেওয়া সম্ভব, তার প্রায় সবই ছিল। বলা বাহুল্য, এটা ‘ফাইভ স্টার’ সুযোগ নয়। তা কেউ আশাও করে না। ৩) ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রায় ১৫০ জন শিল্পী, যন্ত্রী, কলাকুশলীকে ঠিক দিনে ঠিক সময়ে ঢাকায় উপস্থিত করানো একটা বড় সাফল্য। কয়েকজন শিল্পী বক্তৃতায় বলেছেন: ‘আতিথেয়তা, সহায়তাকারী ও অন্যান্য লজিস্টিকস সবই উন্নতমানের ছিল।’ এত বড় অনুষ্ঠানের আয়োজনে বাংলাদেশের (বেঙ্গলের) সক্ষমতা দেখে ভারতীয় অতিথিরা যে মুগ্ধ হয়েছেন, এটা আমাদের জন্য একটা বড় পাওনা। কারণ, এই সেক্টরে বাংলাদেশের কোনো অবস্থান কোনোকালেই ছিল না। এখন বাংলাদেশ একটা নির্ভরযোগ্য ভেন্যু হিসেবে শিল্পী ও গুরুমহলে বিবেচিত হবে।
কয়েকটি প্রস্তাব: ১) উচ্চাঙ্গসংগীত ও বাদন সম্পর্কে কিছু শ্রোতার যে আগ্রহ ও চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা ধরে রাখতে হলে এবং বাড়াতে হলে প্রতিবছর শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে ‘জাতীয়ভিত্তিক উৎসবের’ আয়োজন করা যায়। দেশীয় শিল্পী ও গুরুদের পরিচিতি বাড়াতে হবে। তাহলে তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বাড়বে ও শ্রোতা সৃষ্টি হবে। ২) বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দুই মাসে একবার রাতে দীর্ঘ সময়ব্যাপী উচ্চাঙ্গসংগীত, যন্ত্রসংগীত ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের অনুষ্ঠান প্রচার করা যায়। ৩) বেঙ্গল-এসআরএ আয়োজিত এই উৎসব প্রতিবছর আয়োজন করা (বলা বাহুল্য) ও ভারত থেকে নতুন নতুন শিল্পীকে আমন্ত্রণ করা। ৪) ঢাকার অনুষ্ঠানের পর পরই একটি জেলা শহরে ছোট আকারে হলেও অন্তত দুই দিনের একটি উৎসবের আয়োজন করা। (সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়া ঠিক নয়।) ৫) যেসব সংগঠন বা স্কুল শুধু উচ্চাঙ্গসংগীত, নৃত্য বা যন্ত্রসংগীতের প্রশিক্ষণ দেয়, তাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ বার্ষিক অনুদানের ব্যবস্থা করা। ৬) বেঙ্গল-এসআরএ যৌথভাবে যে প্রশিক্ষণ প্রকল্প নিতে যাচ্ছে, তার বাস্তবায়ন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ৭) এ ধরনের আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের আর্থিক দিকটি স্বচ্ছতার সঙ্গে জনসমক্ষে উপস্থাপন করা। ৮) ‘বেঙ্গলের’ ওপর আর্থিক বোঝা হ্রাসের লক্ষ্যে শর্তবিহীন সরকারি অনুদান ও বাণিজ্যিক স্পনসরদের এগিয়ে আসার ওপর গুরুত্ব দেওয়া। ৯) টিকিট ক্রয় ছাড়া অনুষ্ঠান দেখা সমর্থনযোগ্য নয়। ছাত্রদের জন্য ফ্রি হতে পারে। অন্যদের জন্য বিভিন্ন হারে টিকিট থাকা উচিত। শিল্প-সংস্কৃতি ফ্রি দেখার বা শোনার বিষয় নয়। এর পেছনে বহু টাকা ব্যয় করতে হয়। জনগণকেও এ জন্য সহযোগিতা করা উচিত। লাভের জন্য টিকিট নয়, আংশিক ব্যয় মেটানোর জন্য টিকিট-ব্যবস্থা দরকার।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমী কোনো দিন যা পারেনি, ‘বেঙ্গল’ তা করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই খাতে কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপ নিলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে অনেক দূর এগোনো যেতে পারে। উচ্চাঙ্গসংগীত, উচ্চাঙ্গ যন্ত্রসংগীত, উচ্চাঙ্গ নৃত্য সংস্কৃতি জগতে খুবই অবহেলিত, উপেক্ষিত ও স্বল্প পরিচিত। এখন সময় এসেছে এই খাতে পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের যৌথভাবে কিছু গঠনমূলক কাজ করার। বেঙ্গল-এসআরএ আয়োজিত প্রথম ‘উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’ আমাদের সেই কাজের ডাক দিয়েছে। আশা করি, সরকার ও সংস্কৃতিমান প্রাইভেট সেক্টর এই ডাকে সাড়া দেবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।
No comments