আমার দল আওয়ামী লীগ- সুভাষ সিংহ রায়
বাংলাদেশে সরাসরি রাজনীতি করেন এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি হবে না। বড়
জোর ৫ শতাংশ। কিন্তু রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল আমরা সবাই। কেননা দেশের
রাজনীতি ভাল থাকলে বাদবাকি সব এমনিতেই ভাল থাকে।
আমাদের প্রতিদিনের যাপিত
জীবনের বেশ কিছুটা সময় রাজনীতি নিয়ে ব্যয় করি। রাস্তা দিয়ে একটা বড় মিছিল
গেলে দৌড়ে বারান্দায় এসে তা দেখি। আমরা রাজনীতি নিয়ে গল্প করতেও ভালবাসি।
গ্রামে-গঞ্জে চায়ের দোকানে রাজনীতি নিয়েই যত কথা। তথ্যপ্রযুক্তি যতই
মানুষের কাছে যাচ্ছে মানুষ ততই রাজনীতি সচেতন হচ্ছে। সবাই স্বীকার করে
থাকেন, এ সরকারের আমলে তথ্যপ্রযুক্তি খুব সম্প্রসারিত হয়েছে। এবং সঙ্গে
সঙ্গে রাজনীতির পরিধিও বেশ বিস্তৃত হয়েছে। আবার এই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা
নেত্রীরা বেশি বেশি সমালোচিত হচ্ছে। বোধ করি এখন তথ্যপ্রযুক্তির প্লাবনে
দেশের মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে। ১৯৪৮ সালে জন্মলাভ করা আওয়ামী লীগও
তথ্যপ্রযুক্তির বড় বড় ঢেউ মোকাবেলা করছে। নাটোরের এক উপজেলা চেয়ারম্যান
হত্যাকা- কয়েক মিনিটের মধ্যে সচিত্র প্রতিবেদন দেশবাসীর সামনে উপস্থাপিত
হয়েছে। সেখানেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর এবং যা কোনভাবেই
অস্বীকার করার উপায় থাকে না। একেবারেই বোধগম্য কারণে বিশ্বজিৎ হত্যাকা-
আওয়ামী লীগকেই দায় নিতে হচ্ছে। কট্টর আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও মনে করেন,
দলের রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য দলের ছত্রছায়ায় অর্বাচীনরা যা ইচ্ছে
তাই করছে। গ্রামে-গঞ্জের চায়ের দোকানে বসে গল্প করা লোকজনও সরকারকে ছেড়ে
কথা বলছে না। দুই.
১৯৪৮ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয় নিয়ে। এই সংগঠনটি দুর্দা- প্রতাপের মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। রাজনীতি যে গণমানুষের সেটা বার বার প্রমাণ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই দলটি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, বিত্তহীন সকল বাঙালীকে এক কাতারে জড়ো হয়েছিল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গণদেবতা’ যাঁরা পড়েছেন তাদের মনে পড়বে সেখানে একটি সংলাপ আছেÑ ‘সেকালের কিছু আর রইল না। কিন্তু আমরা জনাকতক মানুষ যে সেকালের মানুষ অকালের মতন পড়ে রয়েছি একালে, বিপদ যে সেইখানে।’ এখন যখনই আওয়ামী লীগের নীতি আর্দশের কথা বলা হবে তখন নতুন আগত সদস্যদের অনেকেরই কাছে মনে হতে পারে কথাগুলো অতিসেকেলে। মহাত্মা গান্ধী একবার ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, যেদিন কংগ্রেসে গু-ামি, ভ-ামি দলে জায়গা পাবে সেদিন সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করবো। মাহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই, ঢাকার আরমানিটোলার বাদশা গু-া আওয়ামী লীগের জনসভা প- করতে এসেছিল। মুসলিম লীগ তাকে এই কাজের জন্য ৫০০ টাকা দিয়েছিল। কিন্তু বাদশা গু-া শেখ মুজিবের নেতৃত্বের ইন্দ্রলিক জালে ধরা পড়েছিল। সভা তো প- করেই নাই; বরং জনসভার ভিতরে দাঁড়িয়ে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়েছিল। পাঁচ টাকার নোটগুলো (মোট পাঁচশত টাকা) জনসভার ভিতরে ছুড়ে মেরেছিল। সেই আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় আজ বিশ্বজিৎ হত্যাকারীরা জায়গা পাবে না সেটাই স্বাভাবিক। সেকালের মানুষগুলোর যারা এখনও এই অকালে পড়ে আছেন তারা তো কল্পনাই করতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আদর্শের দৃঢ়তা নিয়ে জাতীয় চার নেতা জীবন দিয়ে গেছেন। অথচ স্বাধীনতার পর সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবারের ঢাকা শহরে এক টুকরা জমি ছিল না। অবাঙালীদের অনেক খালি বাড়ি ছিল; সরকার তা বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের বরাদ্দ দিতে পারত। শোনা যায়, তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে মিসেস সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বলা হয়েছিল তাঁর স্বামীর অনুমতি নিয়ে রাখলে সুবিধা হয়। প্রসঙ্গ উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, এই সমস্ত বরাদ্দ ভোগ করার জন্য সৈয়দ নজরুল মুক্তিযুদ্ধ করেনি। আজকের প্রজন্মের আওয়ামী লীগের ক’জনই বা একথাগুলো জানে। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যাকে নিয়ে অনেক শ্রুতিকথা আছে, অনেক স্মৃতিকথাও আছে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনসমূহের উদ্যোগে সারাদেশে যদি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নিয়ে পাঠচক্র গড়ে তোলা হতো তাহলে অনেক বড় একটা কাজ করা হতো। কেননা আজকের নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে জানে না; আর জানলেও খ-িত বঙ্গবন্ধুকে জানে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এদেশে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, ভুল তথ্য দিয়ে জাতির একটা প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগ বছরব্যাপী রাজনৈতিক শিক্ষা কর্মসূচীর আয়োজন করতে পারে।
তিন.
আওয়ামী লীগের বিশাল গবেষণা বিভাগ থাকা দরকার। যাদের কাজই হবে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে নানামুখী চিন্তা চেতনার উদ্ভব ঘটানো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ভাবনাচিন্তা, সমস্যা, সম্ভবনা নিয়ে কাজ করবে। একটা সিপিপি (কন্টিনিউ পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম) আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষ জরুরী। যারা আজ ছাত্র তাদের কোনো প্রকার রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা নেই। কোথাও কোনো পাঠচক্র নেই, তাহলে ছাত্ররা রাজনীতি শিখবে কোথা থেকে। রাজনীতিতে নৈতিকতার শিক্ষা যেমন পরিবার থেকে আসে, তেমনি পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেও আসে। রাজনীতি কি এতই সহজ ব্যাপার। তাহলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় অনুশীলন সমিতির প্রয়োজন হতো না। খামোখা ছাত্রলীগকে আমরা দোষারোপ করে থাকি। তাদের কেউ শেরে বাংলার কথা কেউ শোনায়? মওলানা ভাসানীর কথা জানানোর প্রয়োজন রয়েছে। সেই ১৯০৫ সালে কলকাতা শহরের ছাত্রদের প্রথম সমাবেশের কথা ছাত্রদের কেউ শোনায়? এ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি যারা সেই সময় যুক্ত ছিলেন, যেমনÑ বিপিন চন্দ্র পাল, বরিশালের গোলাম রসুল, অশ্বিনী কুমার দত্তের কথা আজকের রাজনীতির শ্রুতিকথায় আছে? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া ছাত্রলীগের জন্য কোনো নেতা কিছু করেননি। আওয়াামী লীগের পতাকা তলে যে সমস্ত তরুণ, যুবকরা সমবেত হয় তারা অনেক বাধা অতিক্রম করে এই সংগঠনে যুক্ত হয়। বলতে গেলে স্বপ্রণোদিত হয়ে ছাত্ররা যে কোনো ছাত্রসংগঠন বেছে নেয় কিংবা জড়িয়ে পড়ে। দু’তিন মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের এক অধ্যাপিকার সন্তান হিজবুত তাহেরীর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়। আমার প্রিয় শিক্ষিকার দুঃখ, সারাজীবন যে নীতি ও আদর্শ নিয়ে চলছেন একেবারে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার সঙ্গে সন্তানটি যুক্ত হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা কখনও এগুলো নিয়ে ভাবেন? কেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আমার সেই শিক্ষিকার ছেলেটি হিজবুত তাহেরীর সঙ্গে যুক্ত হয়? কেননা মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত ধারার সঙ্গে যুক্ত হলে জাগতিক সুযোগ-সুবিধা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি পাওয়া যায়। তাছাড়া ধর্মীয় অনুভূতির একটা অনুসঙ্গ তো মানুষের জীবনে বিশাল একটা ব্যাপার। তারপরও যারা প্রগতিশীল রাজনৈতিক ঘরণার সঙ্গে যুক্ত থাকে তারা ভাল মানসিকতা নিয়েই আসে। কিশোর বয়সের স্পর্শকাতর সময়ে নীতি নৈতিকতার বিষয়গুলো সংযুক্ত না হলে তাদেরকে বিপথে নিয়ে অনেক সুযোগ থেকে যায়। মানতেই হবে অপশিক্ষার কারণে ছাত্রদের রীতিনীতি, মতিগতি, আচার-ধর্ম সব পাল্টে যায়। রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ যুক্ত থাকলে ছাত্রলীগের কোনো ছেলে কখনও বিচ্যুত হয় না। তাছাড়া আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বাড়ি তানভির নামে এক যুবককে আওয়ামী ঘরনার প্রায় সবাই জানেন, চেনেন। সবার বিপদে আপদে ছেলেটা এগিয়ে আসে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয় দেবার সময় বলা হয় তার পরিবার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শিবিরের। ছেলেটা পরিবারের সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগ করে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ রাজনীতিবিদরা কি বলতে পারবেন, ছেলেটা কি করবে। জামায়াতী পরিবারের একটা ছেলে মনে প্রাণে আওয়ামী লীগকে ভালবাসতে কি পারে না? বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের পারিবারিক পরিচয় সামনে চলে এসেছে। পরিবারের সদস্যদের বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সেখানে পরিবারের কেউ কেউ মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ততার কথা বলা হয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকতার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অতএব সরকারের কোনো বক্তব্যে কোনভাবেই যেন বিভ্রান্তির সুযোগ করে না দেয়। সর্বক্ষেত্রে যেন তাড়াহুড়া করার একটা সংস্কৃতি দেখা আছে।
চার.
আওয়ামী লীগ এখনও এদেশে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এই দল দেশের নানা পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়েছে। এখনও এই দল বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতে ধারণ করে থাকে। এই দলে কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়মিত সভা হয়ে থাকে। এখনও গঠনতন্ত্র মোতাবেক সময়মতো কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের তাগিদ দেখা যায়। কিন্তু বছরের অন্যান্য সময়ে দেশব্যাপী সংগঠন গড়ে তোলার তাগিদ দেখা যায় না। বছরব্যাপী জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ইত্যাদি নানাস্তরে সাংগঠনিক কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায় না। জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা অনুপস্থিত রয়েছে। লিডারশীপ হঠাৎ করে বিকশিত হয় না। নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন হয় ভিশন, পরিকল্পনা ও দক্ষতা। প্রয়োজনীয় শিক্ষা ছাড়া এই গুণগুলো অর্জিত হয় না। বর্তমান আওয়ামী লীগে কোন পর্যায়ে তার তাগিদ দেখা যায় না। এবারের কাউন্সিলে যেন বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করা ও তা মোকাবেলার কর্মসূচী প্রণয়ন করা হয়। সেই আওয়ামী লীগকে মানুষ দেখতে চায় যেখানে সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনার মূল্যায়ন হয়। সমালোচকদেরকেও যেন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এমনিতেই নানাকারণে আওয়ামী লীগের শত্রু বেশি; নতুন করে যেন শত্রু না বাড়ানো হয়। হঠাৎ করে যেন বন্ধুকে শত্রু না বানানো হয়। যে দলের আদর্শ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই দলের শক্তি সার্মথ্য এমনিতেই বেশি থাকার কথা। টানা ৩২ বছর যে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা; এই দলে অভিজ্ঞতার ঝুড়ি আরো সমৃদ্ধ হওয়ার কথা। শেখ হাসিনা সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে পরিশ্রমী রাজনৈতিক নেতা; সে বিচারে দল ও সরকারের সাফল্যের অবয়ব আরও খানিকটা ঝকঝকে থাকা। অনেক কিছু থাকার পর মাঝে মাঝে কেন যেন বেসুরা লাগে। আমার দল আওয়ামী লীগ সপ্রতিভ ও সুদৃঢভাবে যেন ভিশন ’২১ এর স্বপ্নকে দেশের আপামর মানুষের ভিতরে যেন সম্প্রসারিত করে। আওয়ামী লীগকে বিজয়ী হতেই হবে; কেননা আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে সমগ্র বাঙালী জাতি পরাজিত হয়।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments