চট্টগ্রামে সাগর ও নদীর তীরে ১৩ মাসে ১৩ অজ্ঞাত লাশ-পরিচয় জানতে ওয়েবসাইট চালুর প্রস্তাব পুলিশের by একরামুল হক

অজ্ঞাত লাশের পরিচয় জানার সুবিধার্থে একটি ওয়েবসাইট চালু করার প্রস্তাব করেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। গতকাল বুধবার প্রস্তাবটি ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। নগর পুলিশ সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের সাগর ও নদীর তীর থেকে গত চার মাসে চার ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।


এর আগের ১০ মাসে (গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর) সাগর ও নদীর তীরে নয়টি লাশ পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ তদন্ত করে তিনজনের পরিচয় উদ্ধার করতে পেরেছে। আগের বাকি ছয়জন ও এ বছরের চার লাশের পরিচয় পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ৫ মে সকালে নগরের বন্দর থানাধীন আনন্দবাজার এলাকার সাগরপাড়ে একটি গলিত লাশ পাওয়া গেছে। অনেক দিন পানিতে থাকায় লাশটি পুরুষ নাকি মহিলার তা বোঝারও কোনো উপায় ছিল না। গত চার মাসে বন্দর এলাকা থেকে উদ্ধার তিনটি এবং ডবলমুরিং এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া একটি লাশের বিষয়ে তদন্তে নেমে কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি বলে পুলিশ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাগর ও নদীর তীরে অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যাচ্ছে, যাদের ছবি পত্রিকায় ছাপানো হয় না। ফলে বেশির ভাগ লাশের পরিচয় বের করতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এ পর্যায়ে নগর পুলিশ থেকে প্রস্তাব আসে, এ বিষয়ে একটি ওয়েবসাইট থাকলে এবং তাতে উদ্ধার হওয়া লাশের ছবি ও বর্ণনা প্রকাশ করলে দেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে ভুক্তভোগী পরিবার ওয়েবসাইটে গিয়ে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে পারবে।
ঢাকায় পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়, বেওয়ারিশ লাশের ছবি, আঙুলের ছাপ, লাশ পাওয়ার জায়গা ও তারিখ, লিঙ্গ, আনুমানিক বয়স ও লাশে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার বিস্তারিত বিবরণ ওয়েবসাইটে থাকবে। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ হলে সংশ্লিষ্ট থানায় এ-সংক্রান্তে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। তা ধরে বিভিন্ন থানায় নিখোঁজ ব্যক্তির ব্যাপারে বেতার বার্তা পাঠানো হয়। ওয়েবসাইট থাকলে নিখোঁজ ব্যক্তির বিষয়ে করা জিডির বিস্তারিত তথ্য তথা নিখোঁজ ব্যক্তির ছবি, হারানোর জায়গা, তারিখ, সময়, নাম, বয়স, লিঙ্গ তাতে দেওয়া যেতে পারে।
প্রস্তাবে বলা হয়, ওয়েবসাইটে তথ্য সংযোজনের জন্য মহানগর এলাকায় পুলিশ কমিশনার ও জেলায় পুলিশ সুপারকে ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনে প্রায় আট কোটি নাগরিকের আঙুলের ছাপ আছে। কমিশনের সঙ্গে পুলিশের চুক্তি ও এ ধরনের কোনো নির্দেশনা না থাকায় এই সুবিধা কাজে লাগানো যায় না। এই আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে মৃত ব্যক্তির পরিচয় বের সম্ভব বলে প্রস্তাবে বলা হয়।
১৩ মাসে ১৩ লাশ: নগর পুলিশ সূত্র জানায়, গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের ৫ মে পর্যন্ত নগরের বন্দর ও পশ্চিমাঞ্চলের ছয়টি থানা এলাকার সাগর-নদী ও খালে ১৩টি লাশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বন্দর থানা এলাকায় পাঁচটি, ডবলমুরিংয়ে তিনটি, হালিশহরে দুটি এবং পাহাড়তলী, কর্ণফুলী ও পতেঙ্গা থানা এলাকায় একটি করে লাশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তদন্তে তিনটি লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। বাকি ১০টির মধ্যে একটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। কর্ণফুলী থানা পুলিশ ইছানগর ডায়মন্ড কারখানার কাছে নদীর কূল থেকে এই লাশটি উদ্ধার করেছিল গত বছরের ১ জুন। অন্য নয়টি লাশের ব্যাপারে তদন্ত এখনো চলছে।
নগরের উপপুলিশ কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ধারণা বাইরের কোথাও খুন করে লাশগুলো চট্টগ্রাম মহানগর অঞ্চলের সাগর কিংবা নদীতে ফেলা হয়েছে। তদন্তে পুলিশ বেশির ভাগ লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি।’ তিনি বলেন, ওয়েবসাইট হলে ছবি ও বিস্তারিত তথ্য দেখে স্বজনেরা সাড়া দিতে পারে। এতে লাশের পরিচয় বের করে তদন্ত করতে আর বেগ পেতে হবে না।
তিনটি লাশের পরিচয়: হালিশহর থানাধীন টোল সড়কের গলাচিপাপাড়া এবং একই সড়কের পাহাড়তলী থানাধীন দক্ষিণ কাট্টলী এলাকা থেকে উদ্ধার করা দুই ব্যক্তির লাশের পরিচয় পেয়েছে পুলিশ। গত বছরের ২৮ জুন মিরসরাই উপজেলার বাসিন্দা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য মো. মাসুদ মিয়া এবং গত ২৭ আগস্ট একই উপজেলার বাসিন্দা রেজাউল হোসেনের লাশ পুলিশ উদ্ধার করে।
তদন্তে জানা যায়, মাসুদ মিয়াকে তাঁর বন্ধুরা খুন করে। চোরাই মালের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধের জের ধরে হত্যাকাণ্ড ঘটে। হত্যাকারীদের একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁর নাম মো. জাবেদ মিয়া। এ ঘটনায় জাবেদসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, জাবেদ মিয়া গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন। ওই দিন তিনি মহানগর হাকিম মুনতাসির আহমেদের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এতে বলা হয়, ‘মাসুদ মিয়ার সঙ্গে টাকা-পয়সা নিয়ে আমাদের মনোমালিন্য হয়। এতে আমাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, যে কারণে ঝগড়াও হয়েছিল। একপর্যায়ে মাসুদ মিয়া আমাদের ক্ষতি করবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন। পরে ২৭ জুন রাতে আমি, মাসুদ মিয়া ও চালক মোস্তাক প্রাইভেট কারে চড়ে টোল সড়কের দিকে যাই। সেখানে একসঙ্গে নেশা করি। ফাঁকা সড়কে কেউ ছিল না। নেশা করার পর রাত একটার দিকে মাসুদ মিয়াকে ছুরি মেরে বাসায় চলে যাই। পরদিন জানতে পারি মাসুদ মিয়া মারা গেছে।’
মাসুদের ভাতিজা ও মামলার বাদী মো. নুর উদ্দিন বাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চাচা মাসুদ মিয়াকে তাঁর দুই বন্ধু খুন করে। ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আমরা এর ন্যায়বিচার চাই।’
হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, দুই বন্ধু মাসুদকে খুন করেছে। তাদের আসামি করে গত মাসে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলাটি এখন বিচারাধীন।
মিরসরাইয়ের আরেক বাসিন্দা রেজাউল হোসেনকেও তাঁর বন্ধুরা খুন করে বলে পুলিশি তদন্তে জানা গেছে। হত্যাকাণ্ডের পর রেজাউলের লাশ নির্জন টোল সড়কের পাশে সাগরের কোলে ফেলে দেয় সন্ত্রাসীরা। পাহাড়তলী থানায় করা এজাহারে রেহেনা আক্তার তাঁর ভাইয়ের খুনের কারণ হিসেবে বলেন, ‘আসামিরা আমার ভাইয়ের সঙ্গে মেসে থাকতেন। দুটি দোকান ও কিছু জমা টাকার জন্য আসামিরা আমার ভাইকে খুন করেন।’ রেজাউল খুনের ঘটনায় চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি মো. আবুল কালাম ও মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করে।
ডবলমুরিং অঞ্চলের সহকারী কমিশনার আরেফিন জুয়েল প্রথম আলোকে বলেন, আসামি দুজনই রেজাউলের পরিচিত। পূর্বশত্রুতার জের ধরে তারা রেজউলকে খুন করে।
পতেঙ্গা থানা পুলিশ বেড়িবাঁধের নিচে সাগরের পাড় থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করেছে। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ মাস পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে পুলিশ মো. মামুনুর রশিদ, মো. জাকির হোসেন, আবদুল করিম ও মোসাদ্দেক আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করে। মামুনের বাড়ি চাঁদপুর, জাকিরের বাড়ি যশোর, করিমের বাড়ি পতেঙ্গা এবং মোসাদ্দেকের বাড়ি ভোলায় বলে জানা গেছে।
পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, নিহত তরুণীর বয়স ২৫ বছর হবে। তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। তাঁকে গত বছরের ৬ এপ্রিল ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয়। প্রায় পাঁচ মাস তদন্ত করে কৌশলে ঘটনার ক্লু উদ্ঘাটন করা হয়। পরে একে একে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ২০ বছর। ওসি প্রদীপ জানান, গ্রেপ্তার আবদুল করিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন।
যে ১০ জনের পরিচয় মিলল না: পুলিশ জানিয়েছে, এক বা দুজন ছাড়া এই ১০ জনের বাকিদের লাশ সাগর বা সংলগ্ন নদীতে ভেসে এসেছিল। অনেক দিন পানিতে থাকার করণে লাশ বিকৃত হয়ে গেছে। এদের বিষয়ে পুলিশের তদন্ত অব্যহত থাকলেও কোনো কিনারা করতে পারছে না এখনো।
পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত দেড় বছর সাগর ও নদীর তীরে অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যাচ্ছে। বাইরের কোথাও খুন করে লাশগুলো সাগর বা নদীতে ফেলা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।’

No comments

Powered by Blogger.