সহজিয়া কড়চা-পুরানো সেই দিনের কথা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

২৪ মার্চ, ১৯৮২-র সকাল। তখন বেলাবেলি উঠে গেছি। অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে বারান্দায় বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছিলাম। আমার ফ্ল্যাটসংলগ্ন পাশের বাড়ির ভদ্রলোক, যাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হলে সালাম বিনিময় ছাড়া কথাবার্তা হতো না; গলাখাঁকারি দিয়ে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন।


তাঁর বারান্দা থেকে আমার বারান্দার দূরত্ব ছয়-সাত ফুটের বেশি হবে না। আমি তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, ‘খবর শোনেন নাই? ক্যু হইয়া গেছে।’
বললাম, ‘ক্যু মানে? মার্শাল ল নাকি?’
তিনি বললেন, ‘সেনাবাহিনীপ্রধান ক্ষমতা নিয়া নিছেন। দ্যাশে সামরিক আইন জারি হইছে। রেডিও ধরেন।’
গালে সাবান মাখানো অবস্থায়ই রেডিও অন করি। ভদ্রলোকের কথা এক শ ভাগ সত্য। মধ্যরাতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।
১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রার্থী ছিলেন মোট ৩১ জন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তার এবং আওয়ামী লীগের ড. কামাল হোসেনের মধ্যে। আবদুস সাত্তার ১,৪২,৩৩,৯৫৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। কামাল হোসেন পেয়েছিলেন ৫৬,৩৬,১১৩ ভোট। সব দলই ওই নির্বাচন মেনে নিয়েছিল। কারচুপির অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু ফলাফলটা সেনাবাহিনীপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মনঃপূত হয়নি। তিনি প্রকাশ্যেই সাত্তার সরকারের সমালোচনা করা শুরু করেন।
যখন শুনলাম জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছেন, কিছুমাত্র বিস্মিত হইনি। কারণ, দু-আড়াই মাস যাবৎ অপরিচিত কোনো কোনো সাপ্তাহিক কাগজ বিরাট বিরাট হেডিং দিয়ে সন্ধ্যাবেলা প্রতিবেদন করছিল: দেশে সামরিক শাসন জারি হচ্ছে ইত্যাদি। আমাদের দেশে কখনো কখনো বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একেবারে চূড়ায় গিয়ে ঠেকে। যার যা খুশি বলতে পারে, যা খুশি তা-ই লিখতে পারে। কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সেনাবাহিনীর প্রধানও এ-অনুষ্ঠান সে-অনুষ্ঠানে সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। তাঁর সুরে সুর মেলানোর মতো নীতিবাগীশ রাজনীতিকও ছিলেন অনেকে। রাষ্ট্রপতির উচিত ছিল সেনাবাহিনীর প্রধানকে সরিয়ে দেওয়া। তিনি তা পারেননি। কারণ, তত দিনে জেনারেল এরশাদের শেকড় সেঁধিয়ে গেছে মাটির অনেক নিচে। তাঁকে উপড়ানো বৃদ্ধ ও বন্ধুহীন বিচারপতি সাত্তারের শক্তিতে কুলাত না।
মধ্যরাতে বঙ্গভবনে কী নাটক হয়েছে, তা আমরা জানি না। কিন্তু ভোররাতে বাংলাদেশের মালিকানা বদলে যায়। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের যাবতীয় জীব ও জড় পদার্থের মালিক হয়ে যান জেনারেল এরশাদ। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করে ফরমান জারি করে বলেন:
‘যেহেতু দেশে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে যাতে অর্থনৈতিক জীবনে নেমে এসেছে অচলাবস্থা, বেসামরিক প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছে না, সকল স্তরে যথেচ্ছ দুর্নীতি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ফলে জনগণ অসহনীয় দুর্দশায় পড়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিপজ্জনক অবনতি ঘটেছে, শান্তিস্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন করা মুশকিল হয়ে পড়েছে, রাষ্ট্রীয় কর্তব্যে অবহেলা করে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেছে।
‘যেহেতু দেশের জনগণ চরম নৈরাশ্য, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে গেছে,
‘যেহেতু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এবং জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে কষ্টার্জিত দেশকে সামরিক আইনের অধীনে ন্যস্ত করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে এবং জনগণ ও দেশের প্রতি তাদের কর্তব্যের অংশ হিসেবে এ দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর উপর পড়েছে,
‘এখন অতএব আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য ও করুণায় এবং আমাদের মহান দেশপ্রেমিক জনগণের দোয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বুধবার থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সকল ও পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করছি এবং ঘোষণা করছি যে গোটা বাংলাদেশ অবিলম্বে সামরিক আইনের আওতায় আসবে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আমি বাংলাদেশের সকল সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছি।
‘এ ব্যাপারে আমার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা বলে আমি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আরো ঘোষণা করছি যে:
(ক) ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বুধবার থেকে আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করছি।
(খ) আমি যে-কোনো ব্যক্তিকে দেশের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করতে পারি, যিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি অথবা আমার মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। আমি সময় সময়ে এ মনোনয়ন বাতিল বা রদ করতে পারি এবং আর এক ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান হবেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রূপে আমার উপদেশ অনুসারে কাজ করবেন এবং আমি তাকে যেসব কাজের দায়িত্ব দেব তা পালন করবেন।’
এই ফরমানটির পুরো উদ্ধৃতির প্রয়োজন রয়েছে। লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের এই ফরমানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হওয়া দরকার। যদিও জেনারেল বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বলেই সম্বোধন করেছিলেন, বস্তুত ওই দিন থেকে ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা হস্তান্তর করা পর্যন্ত এই ভূখণ্ডটি ছিল স্রেফ তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো। প্রতিটি নাগরিক পরিণত হয়েছিল তাঁর গোলামে। মানুষ যেমন গৃহভৃত্যের চাকরি দেয়, আবার তাড়িয়েও দেয়, সেইভাবে তিনি ‘যেকোনো ব্যক্তিকে দেশের প্রেসিডেন্ট মনোনীত’ করতে পারতেন এবং তাঁকে তাড়িয়েও দিতে পারতেন। এবং রাষ্ট্রপতিকে ‘যেসব কাজের দায়িত্ব’ দেবেন, তা যদি তিনি ঠিকঠাকভাবে পালন না করেন—সঙ্গে সঙ্গে চাকরি নট। বিধাতা যদি বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারতেন, তা হলে সেদিন এই জেনারেলকে বলতেন: তোমার ক্ষমতা তো দেখছি আমার চেয়ে কম নয় হে!
যিনি নতুন নতুন রাষ্ট্রপতিকে চাকরি দিতে পারেন, তিনি পুরোনো রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে যা খুশি তা-ই বলিয়েও নিতে পারেন। সাত্তারের অবস্থা তখন বাহাদুর শাহ জাফরের মতো। বিটিভির ক্যামেরা তাঁর সামনে নিয়ে একটি চোতা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, ছোটবেলায় স্কুলে যেমন বাংলা র্যাপিড রিডার পড়তেন, সেইভাবে পাঠ করুন। তিনি লক্ষ করেন যে স্টেনগান হাতে লোকজন এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। সুতরাং বয়স যতই হোক, মৃত্যুর আগে কে মরতে চায়? তিনি কম্পিত কণ্ঠে পাঠ করেন:
‘দেশের আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জাতীয় স্বার্থে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সারা জীবন আমি ঐকান্তিকতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করেছি এবং সর্বদাই দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের সার্বিক অবস্থার যাতে উন্নতি হয়, তাই কামনা করেছি। দেশের বর্তমান এই অবস্থায় দেশের জন্য রয়েছে আমার আন্তরিক মঙ্গল কামনা। আমি পরম করুণাময় আল্লাহতালার কাছে এই মোনাজাতই করি যে তাঁর অশেষ রহমতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে শান্তি, ন্যায়বিচার, প্রগতি ও সমৃদ্ধির এক নবযুগের সূচনা হবে।
‘বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমার সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমাকে সব রকমভাবে সাহায্য করার জন্যে সকলকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
‘আমাদের দেশবাসীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর এই মহান প্রচেষ্টার আমি সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করছি। জাতির প্রয়োজনে দেশের জন্য আমি যেকোনো কর্তব্য পালনে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’
পরম করুণাময় তাঁর প্রতি সদয় ও সহায় ছিলেন না, তবে যিনি তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন, তাঁর প্রতি খুবই প্রসন্ন ছিলেন। কী পরিস্থিতিতে সেদিন বিচারপতি ওই চোতা পাঠ করে জীবন রক্ষা করেছিলেন, তা মৃত্যুর আগে বর্ণনা করে গেছেন। যারা ৩২ নম্বরে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে জাতির মহানায়ককে সপরিবারে শেষ করতে পারে, তারা বঙ্গভবনে নিঃসন্তান বৃদ্ধকে খতম করতে এক সেকেন্ড চিন্তা করবে না—তা বোঝার মতো বুদ্ধি তাঁর ছিল। সাত্তার আরও জানতেন যে, তিনি মহানায়ক তো ননই, নায়কও নন—ইতিহাসের এক পার্শ্বচরিত্র।
যা হোক, জেনারেল এরশাদ আলেকজান্ডার বা চেঙ্গিস খাঁর মতো দিগ্বিজয়ী বীর ছিলেন না যে ১০ কোটি মানুষকে বুটের নিচে পিষতে পারেন। রাতবিরাতে ওসব ক্যু-কাজ একা কোনো পাগলও করে না। সেদিন এরশাদের পাশে তাঁর সহযোগী ছিলেন বহু। তাঁদের কারও কারও নাম অনেকেই জানে। অনেকেরই নাম অজানা। কয়েক মাস দামাদামি করে অনেক রাজনৈতিক নেতাকে কিনেছিলেন। কাউকে বেশি দামে, কাউকে কম দামে। সিনিয়র অনেক আমলাকে পেয়েছিলেন সঙ্গী। সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও এনজিওর মালিকদের পেয়েছিলেন। তাতেও কুলাত না, যদি বিদেশি দোস্ত না থাকত।
আমেরিকার সম্মতি ছাড়া পৃথিবীর কোনো সেনানিবাসের একটি পিঁপড়াও নড়াচড়া করতে পারে না। এরশাদ সে সম্মতিও পেয়েছিলেন। ভারতের নেতারা মনে করলেন, তিনি তাঁদের কবজাতেই থাকবেন। পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকেরা দেখলেন, তাঁর ‘বন্দুকের নলের ডগায় প্রজাপতি’ বসা। পাকিস্তানকে তিনি এমন ধারণা দিলেন যে ইসলাম ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না তিনি। রাষ্ট্রধর্ম করার বহু আগেই তিনি রেডিও-টেলিভিশনে আজানের দোয়া যোগ করলেন। সৌদি আরবসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্য মনে করল: ইনি আমাদেরই লোক। চীনপন্থীদের সঙ্গে তিনি এমন মহব্বত শুরু করলেন যে তাঁরা ভাবলেন, এই নেতাকে ‘কমরেড’ সম্বোধন করলে ক্ষতি নেই। অর্থাৎ তিনি এমনই খেলোয়াড় যে সৌদিপন্থী, বাগদাদপন্থী, ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী ও চীনপন্থীদের বশ করে ফেললেন।
এরশাদের মতো ভাগ্যবান সামরিক শাসক দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। সব দলের মধ্যেই তিনি বন্ধু পেয়েছিলেন। বিএনপির একটি অংশের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ছিল গোড়া থেকেই। ক্ষমতা দখলে তাঁরা তাঁকে সহায়তা করেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকের সঙ্গে তাঁর গভীর প্রণয় হয়েছিল, তা অপ্রকাশ্য থাকেনি। বিএনপি সরকারের পতন ঘটানোতে অন্তরের অন্তস্তল থেকে আওয়ামী লীগের আশীর্বাদ পান। চীনপন্থী বামদের একটি অংশ একপায়ে খাড়াই ছিল যেকোনো সামরিক শাসককে সমর্থন জানাতে। মাওলানা মান্নানের মাধ্যমে মাদ্রাসার শিক্ষকদের আপন করে নেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সদস্যদের তিনি কিনে ফেলেন। একপর্যায়ে তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শিক্ষাঙ্গন কলঙ্কিত করেন। ছাত্রনেতাদের বৈষয়িক ব্যাপারে কলুষিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করেন ‘জাতীয় ছাত্র পরিষদ’। ছাত্র পরিষদের প্রধান, যাঁর পদবি ছিল ‘সমন্বয়কারী’, তাঁকে নিয়োগ দেন তাঁর অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বা রাষ্ট্রপতির ‘ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা’। তাঁর পদমর্যাদা ছিল যুগ্ম সচিবের। ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন বাবলু ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে প্রথমে এরশাদের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন, তারপর হন শিক্ষা উপমন্ত্রী। ছাত্রদল, ছাত্রলীগ প্রভৃতির বহু নেতাকে কিনে ফেলেন। প্রথমবার ছাত্র পরিষদকে অনুদান দেন ৩৭ লাখ টাকা, দ্বিতীয় বছরে ৮৬.৪৯ লাখ। এটা প্রকাশ্য অনুদান। অপ্রকাশ্যে কত টাকা বণ্টন করেছেন, তার হিসাব বিধাতা ছাড়া কেউ জানে না।
এরশাদ সাহেব ছিলেন পাকা খেলোয়াড় ও মনোবিশ্লেষক—ফ্রয়েড বা য়ুঙ তাঁর কাছে কিছু না। ক্ষমতা দখলের সোয়া দুই মাস পরে এল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুদিন। তিনি ছুটলেন চন্দ্রিমা উদ্যানে। সপারিষদ ও ঘটা করে। দুই বছর তিনি চন্দ্রিমায় দৌড়ান। জিয়ার অগণিত অনুসারী ও সমর্থক ছিল সারা দেশে। তারা মনে করল, তিনি জিয়ার সহকর্মী নন, ভাই। সেনাবাহিনীতে জিয়ার ভক্তরা ভাবলেন, জিয়া হত্যাকাণ্ডে ইনি জড়িত থাকতেই পারেন না।
টুঙ্গিপাড়ায় তিনি প্রথম দিকে গেলেন না। আওয়ামী লীগের লোকদের বোঝালেন, আমি ঠিক অবস্থানেই আছি। যখন যা দরকার তা-ই করব। ওখানেও যাব, একটু পরে। গিয়েছিলেন ঠিকই। গিয়ে কাঁদো কাঁদোভাবে বলেছিলেন, আমার আসতে দেরি হয়ে গেল। এবার রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত বছর। তাই গাইতে ইচ্ছা করছে: পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ১৫ দলীয় জোট থেকে শেখ হাসিনা এবং সাতদলীয় জোট থেকে খালেদা জিয়া উত্তাল আন্দোলন করেছেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দেশের ছাত্র-শিক্ষক-সংস্কৃতিসেবী, আইনজীবী, কৃষক, শ্রমিক, চিকিৎসক—সব শ্রেণীর মানুষ। পতনের পর ১০ বছর না যেতেই তিনি হন পুনর্বাসিত।
সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে এরশাদ তাঁর শাসনকে বৈধ করেছিলেন। গত ২৬ আগস্ট হাইকোর্টের এক রায়ে সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে ১৩৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি। রায়ে বলা হয়েছে: ‘সামরিক শাসন জারির জন্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ করেছেন। এ জন্য তাঁর বিচার হওয়া উচিত। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে কি না, সরকার তা খতিয়ে দেখতে পারে।’
এই রায় প্রকাশের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সরকার ব্যবস্থা নিতেন, যদি তিনি আজ থাকতেন খালেদা জিয়ার জোটে। ব্যবস্থার পরিবর্তে পক্ষকাল না পেরোতেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘটা করে গেলেন রংপুরে। পোস্টারে পোস্টারে উত্তরবঙ্গ ছেয়ে গেল। হাসিনা-এরশাদ বোন ও ভাই। রংপুরের উন্নয়ন করতে চাইলে তা সেখানকার সুযোগ্য ‘ছাওয়াল’টিকে ছাড়াও করা যায়। ছাওয়ালের গঠিত জাতীয় পার্টি কোনো অভ্যুত্থান ঘটায়নি। তাদের নিয়েও করা যায়। জাতীয় পার্টির অন্য কোনো নেতার বিরুদ্ধে আদালতের রায় নেই।
এরশাদ যে অবৈধ ছিলেন, তা তিনি নিজেও অন্তত একদিন স্বীকার করেছেন। নাজিমউদ্দিন রোডের বিশেষ আদালতে এরশাদ যে লিখিত জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তা প্রকাশিত হয়নি। বর্তমান বিচারকদ্বয় সেই জবানবন্দি পাঠ করেছিলেন কি না জানি না, নিশ্চয়ই করে থাকবেন। তাতে তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন—‘সেদিন আমার ক্ষমতা গ্রহণ সংবিধানসম্মত ছিল না।’
অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অপরাধ। রাষ্ট্রদ্রোহ—বলেছেন মাননীয় বিচারপতিরা। আদালতের রায়ের বাইরেও অন্য দিক রয়েছে। জনগণ তাঁকে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। তাঁকে সসম্মানে স্বীকৃতি দেওয়া হলে জনগণকে অপমান করা হয়। জাতীয় পার্টির অন্য সদস্যদের নিয়ে সমস্যা নেই। তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। এরশাদ সাহেবও নির্বাচিত এবং তাঁর এলাকায় জনপ্রিয়। তা সত্ত্বেও আদালতের রায়ের পরে তাঁকে পাশে নিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতি করা দৃষ্টিকটু। দেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে জানে টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে—লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ‘ভাই’ হিসেবে নয়। চির সামরিক শাসকবিরোধী বঙ্গবন্ধুর আত্মা ৮ জানুয়ারি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.