অরণ্যে রোদন-বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হবে by আনিসুল হক
বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে আমি এখন থেকেই উত্তেজিত। চার বছর পরপর বিশ্বকাপের মহোৎসবটা আসে এই মাটির পৃথিবীতে; আমাদের বিবর্ণ দিনগুলোকে, বিষণ্ন রাত্রিগুলোকে রঙিন আর ঘটনাবহুল করে তুলবে বলে। আর এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম স্বাগতিক দেশ কিনা স্বয়ং বাংলাদেশ, আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ! আনন্দে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
এই রকমের একটা দুনিয়া-কাঁপানো ঘটনা ঘটবে আমাদের এই দেশে!
আমরা শুধু স্বাগতিকই নই, আমরা এই বিশ্বকাপের একটা প্রতিযোগী দেশ। পৃথিবীর ১৪টা দেশ এই চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় জায়গা পাচ্ছে, আমার বাংলাদেশ তাতে এক অনিবার্য অংশী। আর একটা স্বপ্নের বীজ আমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের শিশুসাহিত্যিক ডেভিড হিল। বাংলাদেশ যেদিন নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে এক দিনের সিরিজ ম্যাচে ৪-০তে জয়লাভ করল, সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আনিসুল, শ্রীলঙ্কা যেবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়, তার আগে শ্রীলঙ্কার নাম কেউই জানত না। বিশ্বকাপের আগে শ্রীলঙ্কা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল, তখনই পৃথিবী নড়েচড়ে বসল, একটা নতুন শক্তি কি এল ক্রিকেটে! তোমাদেরও বিশ্বকাপটা দেখো ভালো হবে।’
শ্রীলঙ্কা যেবার চ্যাম্পিয়ন হয়, সেই বিশ্বকাপটাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ায়। এবারও তাই। শুধু তা-ই নয়, অনেকগুলো খেলা হবে বাংলাদেশে। শ্রীলঙ্কার ছিলেন জয়াসুরিয়া। আমাদের আছেন তামিম ইকবাল, যিনি কিনা উইজডেন ক্রিকেটার সাময়িকীর চোখে বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার। এর আগে আমাদের সাকিব আল হাসানও এই মর্যাদা পেয়েছেন। সাকিব আল হাসান এক দিনের ম্যাচের অনেক দিন ধরেই পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডারের জায়গা ধরে রেখেছেন। বাংলাদেশ ইংল্যান্ডের মাটিতে এক দিনের ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে অতিসম্প্রতি। গত বিশ্বকাপে হারিয়েছে ভারতকে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে। খেলা হবে আমাদের এশিয়ায়, যেখানে অবশ্যই স্পিনাররা বাড়তি সুবিধা পাবেন। তার ওপর থাকবে সেই অতিবিখ্যাত শিশির-উপাদান, ডিউ ফ্যাক্টর। সবগুলো একখানে করলে, অনেকগুলো সমাপাতন বা কোইনসিডেন্স ঠিকঠাক ঘটে গেলে ব্যাপারটা কি হয় না? কোন ব্যাপারটা? বাংলাদেশ কি এই বিশ্বকাপেই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না?
৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর স্টেডিয়াম পাতায় উৎপল শুভ্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাকিব আল হাসান কী বলেছেন আগে শুনে নিই।
সাকিব বলছেন, ‘আমরা ভালো ক্রিকেট খেললে যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারি। শুধু ইন্ডিয়ার সঙ্গে ম্যাচটাতে ইন্ডিয়া যদি সেভেন্টি-এইট্টি পার্সেন্ট খেলে আর আমরা হানড্রেড পার্সেন্ট খেলি, তাহলে হয়তো জেতা সম্ভব। তবে এর বাইরে আমাদের গ্রুপে যেসব টিম আছে, হানড্রেড পার্সেন্ট খেলতে পারলে ভালোভাবে ম্যাচ জেতা সম্ভব। গত কিছুদিন যেমন খেলেছি, তাতে একটা আত্মবিশ্বাস তো আমাদের আছেই। আসলে ক্যাম্প শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই টের পেয়ে যাব, বিশ্বকাপে আমাদের রেজাল্ট কেমন হতে পারে। ক্যাম্পের প্রথম দিন থেকেই একটা ইতিবাচক আবহাওয়া তৈরি হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত বিশ্বকাপ শুরুর আগেই যেমন আমাদের মনে হচ্ছিল, আমরা ভালো কিছু করতে পারি। আমাদের গ্রুপে দুটি ভালো টিম ছিল, তার পরও সবার মনে হয়েছে, আমরা কিছু করতে পারি। এই বিশ্বাসটা খুব জরুরি। নয়জন প্লেয়ার বিশ্বাস করলেও হবে না। ১১ জনই যদি বিশ্বাস করে, শুধু তাহলেই এই বিশ্বকাপে আমাদের ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব।’
শুভ্রর প্রশ্ন, ‘সেই ভালো রেজাল্টটা কী? কী হলে বলবেন, ভালো রেজাল্ট হয়েছে?’
সাকিবের উত্তর, ‘সেকেন্ড রাউন্ডে কোয়ালিফাই করা। বড় দুইটা দলকে হারালে সেকেন্ড রাউন্ড কনফার্ম। একটাকে হারালে হয়তো ফিফটি-ফিফটি চান্স, তখন রানরেটের ব্যাপার আসবে। তবে আমার মনে হয় সম্ভব, এটা অসম্ভব কিছুই নয়। দেশের মাটিতে খেলা, অবশ্যই সেকেন্ড রাউন্ডে যাওয়া সম্ভব। আর সেকেন্ড রাউন্ডে গেলে সেমিফাইনালে যাওয়ার চান্সও খুব বেশি। তখন এক ম্যাচের খেলা...সবারই মনে হবে, ‘একটাই তো ম্যাচ, দেখি না সবাই চেষ্টা করে।’ তা ছাড়া সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে গেলে দলের আত্মবিশ্বাসটাই হবে অন্য রকম।’
‘নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার পর তো অতি আশাবাদী অনেকে এমনও বলছেন, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারে...!’
সাকিব হেসে বলেছেন, ‘আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, আমাদের সেকেন্ড রাউন্ডে কোয়ালিফাই করাটাই কঠিন। এটি করতে পারলে খুব ইজি হয়ে যাবে। সেকেন্ড রাউন্ডে কোয়ালিফাই করলে আমরা ফাইনালও খেলে ফেলতে পারি। আর ফাইনাল পর্যন্ত গেলে কী হবে কে বলতে পারে...!’
‘ফাইনালে উঠে গেলে আর চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা বাদ থাকে কেন?’
সাকিব হাসি দিয়ে বলেছেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারি। তবে আগে সেকেন্ড রাউন্ডে তো উঠি।’
সাকিব কথা বলেছেন বাস্তবতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে, আমি স্বপ্নবিলাসী মানুষ। বাংলাদেশ নিয়ে আমার স্বপ্নের কোনো সীমা নেই। আর স্বপ্ন যদি খেতে হয়, তাহলে পোড়া রুটি কেন খাব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবারগুলোই খাব। আমার স্বপ্ন তাই চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। আমি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই উক্তির নাছোড় সমর্থক, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।’ স্বপ্নটাই যদি আমরা বড় না দেখি, কাজেকর্মে বাস্তবের দুনিয়ায় আমরা বড় হব কী করে! আমাদের ক্রিকেটাররা আগে যখন এশিয়ান কাপে খেলতে যেতেন, তখন তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হতো, আপনাদের লক্ষ্য কী? তাঁরা বলতেন, পত্রিকায় সাধু ভাষায় অধিনায়কের সেই বক্তব্য প্রকাশিত হতো, ‘৫০ ওভার ব্যাট করিব’। সেই দিন আমরা কবে পেরিয়ে এসেছি। এখন বাংলাদেশ প্রতিটা খেলায় নামে জয়ের জন্য। প্রতিটা খেলায় জয়লাভ তারা করে না, তবুও সর্বশেষ ১০টা খেলায় তো আমরা বেশির ভাগই জিতেছি, তাই নয় কি? আমরা কেন আশাবাদী হব না?
এই পাগলামোয় এখন আমাকে পেয়ে বসেছে। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবে। ফেসবুকে একটা পাতাও খুলে ফেলেছি, বাংলাদেশ: বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নস: মিরাকলস ক্যান হ্যাপেন হোয়েন ইউ বিলিভ।
অলৌকিক ঘটনা ঘটে যেতে পারে, যখন তুমি তা বিশ্বাস করো। ম্যারায়া ক্যারির একটা গান আছে:
আমরা এখন ভীত নই আর মোটে
যদিও ভয়ের অনেক কারণই জোটে
আমরা পাহাড় ডিঙিয়েছি অতি উচ্চ
ডিঙোনোর আগে ভাবিনি পাহাড়ও তুচ্ছ!
ঘটে যেতে পারে অলীক ঘটনা বিশ্বাস করো যদি,
যদিও আশার আলো নেই শুধু, হতাশাই নিরবধি,
কী অলৌকিক অর্জিত হবে, কে বা জানে সেই কথা—
যদি বিশ্বাস রাখো তবে তুমি সেটা ঘটাবেই জেনো,
তুমি সেটা ঠিক ঘটিয়ে ফেলবে বিশ্বাস শুধু মেনো। (অনুবাদ লেখকের)
বাংলাদেশ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হবে, এটা নিশ্চয়ই হবে একটা অলৌকিক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। কিন্তু এখন আমি অলৌকিকেই বিশ্বাস করি। এবং বিশ্বাস করি যে বিশ্বাস করলে, স্বপ্ন দেখলেই কেবল সেটা একদিন সম্ভব করে তোলা যায়। যেমন করেছেন মুসা ইব্রাহীম—আর্থিক বাধা, স্বজনদের নিষেধাজ্ঞা সবকিছু তুচ্ছ করে প্রশিক্ষণ, মনোবল, জিদ আর স্থির লক্ষ্য সম্বল করে উঠে পড়েছেন এভারেস্টের চূড়ায়। এখন কি আর আমাদের সেই দিন আছে, যখন আমরা মাঠে নামব সম্মানজনক হারের জন্য? পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করার জন্য? আমাদের অকুতোভয় তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম আর সাকিব আল হাসান বিগত বিশ্বকাপে শিরোপাপ্রত্যাশী ভারতকে কী তুলাধোনাটাই করেছিলেন! এ বছর তাঁরা আরও পরিপক্ব হয়েছেন।
প্রথমে ১৪টা দল। সাতটা করে দল নিয়ে দুটো গ্রুপ। প্রতি গ্রুপ থেকে চারটা করে দল অর্থাৎ মোট আটটা দল উঠবে দ্বিতীয় পর্বে। তার পর থেকেই নক-আউট। মাত্র তিনটা খেলা জিততে পারলেই চ্যাম্পিয়ন। অলৌকিক ঘটনা কি ঘটতে পারে না? আমরা নিজেরাই যদি বিশ্বাস না করি, স্বপ্ন না দেখি, তাহলে কীভাবে ঘটবে। তাই আমি স্বপ্ন দেখে চলেছি, স্বপ্ন দেখব বলে দুচোখ পেতেছি যে বাংলাদেশই এবার চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে।
বলতে পারেন, প্রত্যাশা বড় হলে প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনাটাও যে বড় হয়। হায়! জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার খেতে খেতে যে আমরা স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাই। সত্য, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে ভয় পাওয়ার কী আছে? আমরা যে ফুটবল বিশ্বকাপে পুরো দেশটাকে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাম, তো আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল কি প্রতিবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে? তাই বলে কি আগামী বিশ্বকাপে আমরা আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের জন্য উন্মত্ত হব না? তাহলে এবার আমরা নিজের দেশের জন্য যদি পাগল হই, ক্ষতি কী!
না, আমি দলের খেলোয়াড়দের কোনো চাপে ফেলতে চাই না। আমরা শুধু তাঁদের জানাতে চাই আমাদের নিঃশর্ত ভালোবাসা, অতুল সমর্থন, অপরিসীম শুভেচ্ছা।
আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি, যখন তোমরা ভালো করো তখনো, যখন তোমাদের খারাপ সময় যায় তখনো আমরা তোমাদের ফেলে রেখে যাই না। ইয়াহু পাতার এক সাক্ষাৎকারে সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের সমর্থকদের এই ভালোবাসার কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন পরিপক্ব এক অধিনায়কের মতোই।
একটা জায়গায় আমরা অবশ্যই চ্যাম্পিয়ন হতে পারি, যদি স্বাগতিক হিসেবে আমরা আমাদের হূদয়ের দরজাটা সারা পৃথিবীর জন্য খুলে রাখি। আমাদের দল হারুক (তা যেন না হয়) বা জিতুক, আমরা পৃথিবীর সভ্যতম জাতির মতো আচরণ করব। আমরা বিদেশি অতিথিদের সম্মান জানাব, ভালোবাসা দেখাব। পথেঘাটে স্টেডিয়ামে হোটেলে রেস্টুরেন্টে বিপণিবিতানে তাঁদের হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানাব, তাঁদের সহযোগিতা করব। আমরা সেই ভারতীয় বা পাকিস্তানি উন্মত্ত সমর্থকদের মতো হব না, যারা দল হেরে গেলে খেলোয়াড়দের বাড়ি গিয়ে চড়াও হয়। বরং এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা হতে পারে অনুসরণীয়, তারা ক্রিকেট-অন্তঃপ্রাণ, কিন্তু কখনো ভোলে না যে ক্রিকেটটা একটা খেলাই।
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার এ হচ্ছে এক মহা সুযোগ। পৃথিবীর অনেক মানুষের ধারণা, বাংলাদেশ পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্রতিদিনই বন্যা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। সারা পৃথিবী থেকে মানুষজন, সাংবাদিক এ দেশে আসবেন। তাঁরা দেখবেন এক আশ্চর্য দেশ, যে দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশের একটা, মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইল জায়গা নিয়ে যারা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁরা দেখতে পাবেন এক অপূর্ব বদ্বীপ, যেখানে আছে পৃথিবীর সেরা স্থাপত্যকর্মের একটা—জাতীয় সংসদ ভবন। যাদের আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত, আছে সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। দেখবেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটা কতটা গণতান্ত্রিক আর প্রগতিশীল। কিন্তু সবচেয়ে মধুর যে সম্পদ তাঁরা দেখে যাবেন, তা হলো বাংলাদেশের মানুষের হূদয়। আমি একটা পর্যটন কোম্পানির কথা জানি, যারা সুন্দরবনে প্রতিবছর বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে যায়, তাঁদের মন্তব্য-খাতায় পর্যটকেরা লিখে রেখে গেছেন, সুন্দরবন দেখে তাঁরা মোহিত, কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা তাঁদের মুগ্ধ করেছে তা হলো এই দেশের মানুষের আতিথেয়তা। আমরা যেন আমাদের বিদেশি অতিথিদের আমাদের ঐতিহ্যবাহী আতিথেয়তা দিয়ে মুগ্ধ করতে পারি।
আর আছে ব্যবস্থাপনা। সময় বেশি নেই, কিন্তু নিশ্চয়ই সরকার আর যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিশ্বকাপের আগেই শহরগুলোকে, ভেনুগুলোকে, রাস্তাঘাটগুলোকে সুন্দর করে ফেলবে যথাসাধ্য। ইন্টারনেটের ব্লগে একটা প্রচারণা চলছে, সেটা খুবই জোরদার, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হিন্দি ছবির শিল্পীদের প্রাধান্য থাকবে, বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করা হবে। এ বিষয়ে আমি জানার চেষ্টা করেছি। এই বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ তিনটা। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা। মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিন দেশই তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরার সুযোগ পাবে। আর অংশগ্রহণকারী সব দেশেরই অংশগ্রহণ থাকবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। কিন্তু আইসিসির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বাইরেও অন্য সময়ে বা অন্য দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, যেটা আইসিসির অনুষ্ঠানের অংশ নয়, যেটা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হবে না। তাতে দেশি-বিদেশি শিল্পীরা অংশ নেবেন। কাজেই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে বলিউডি সংস্কৃতি প্রচারের কাজে আমরা ব্যবহূত হব বলে যে প্রচারণাটা জোরেশোরে ইন্টারনেটের ব্লগে ও ফেসবুকে চলছে তা খুব সত্য নয়। তবু কর্তৃপক্ষকে বলি, এ ব্যাপারে নাগরিকদের একাংশের মনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তার উত্তর আপনারা আনুষ্ঠানিকভাবে দিন। স্বচ্ছতা সব সময়ই ভালো। আর আইসিসির অনুষ্ঠানের বাইরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও যেন বাংলাদেশের ঋদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের যথাযথ প্রতিফলন থাকে।
অন্যদিকে চমকের ব্যাপারটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা সব আয়োজক দেশই পরিকল্পনা করে অতি গোপনীয়তা বজায় রেখে। পর্দা ওঠার পরই সবাই চমকিত হয়, বাহ, বেশ তো দেখাল! ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোর সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, তারাও চেষ্টা করছেন সারপ্রাইজটা বজায় রাখতে।
বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হবে—স্বপ্ন আমার যায় না। আমরা শুধু ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হব তা-ই নয়, আমরা জাতীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হব। হয়তো আর ২০টা বছর লাগবে এই দেশটাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন করে তুলতে। কিন্তু সাফল্য আসবেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কোনো ম্যাচ জেতার পর সবাই মিলে গলা ছেড়ে আর গলা জড়িয়ে ধরে একটা গান করেন, ‘আমরা করব জয় একদিন। মনের গভীরে আছে প্রত্যয় যে আমরা করব জয় একদিন।’
আমরা অবশ্যই জয়লাভ করব। একদিন না একদিন। আমরা মরে যেতে পারি, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন মরবে না। আমরা জাতি হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন হব।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আমরা শুধু স্বাগতিকই নই, আমরা এই বিশ্বকাপের একটা প্রতিযোগী দেশ। পৃথিবীর ১৪টা দেশ এই চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় জায়গা পাচ্ছে, আমার বাংলাদেশ তাতে এক অনিবার্য অংশী। আর একটা স্বপ্নের বীজ আমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের শিশুসাহিত্যিক ডেভিড হিল। বাংলাদেশ যেদিন নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে এক দিনের সিরিজ ম্যাচে ৪-০তে জয়লাভ করল, সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আনিসুল, শ্রীলঙ্কা যেবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়, তার আগে শ্রীলঙ্কার নাম কেউই জানত না। বিশ্বকাপের আগে শ্রীলঙ্কা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল, তখনই পৃথিবী নড়েচড়ে বসল, একটা নতুন শক্তি কি এল ক্রিকেটে! তোমাদেরও বিশ্বকাপটা দেখো ভালো হবে।’
শ্রীলঙ্কা যেবার চ্যাম্পিয়ন হয়, সেই বিশ্বকাপটাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ায়। এবারও তাই। শুধু তা-ই নয়, অনেকগুলো খেলা হবে বাংলাদেশে। শ্রীলঙ্কার ছিলেন জয়াসুরিয়া। আমাদের আছেন তামিম ইকবাল, যিনি কিনা উইজডেন ক্রিকেটার সাময়িকীর চোখে বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার। এর আগে আমাদের সাকিব আল হাসানও এই মর্যাদা পেয়েছেন। সাকিব আল হাসান এক দিনের ম্যাচের অনেক দিন ধরেই পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডারের জায়গা ধরে রেখেছেন। বাংলাদেশ ইংল্যান্ডের মাটিতে এক দিনের ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে অতিসম্প্রতি। গত বিশ্বকাপে হারিয়েছে ভারতকে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে। খেলা হবে আমাদের এশিয়ায়, যেখানে অবশ্যই স্পিনাররা বাড়তি সুবিধা পাবেন। তার ওপর থাকবে সেই অতিবিখ্যাত শিশির-উপাদান, ডিউ ফ্যাক্টর। সবগুলো একখানে করলে, অনেকগুলো সমাপাতন বা কোইনসিডেন্স ঠিকঠাক ঘটে গেলে ব্যাপারটা কি হয় না? কোন ব্যাপারটা? বাংলাদেশ কি এই বিশ্বকাপেই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না?
৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর স্টেডিয়াম পাতায় উৎপল শুভ্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাকিব আল হাসান কী বলেছেন আগে শুনে নিই।
সাকিব বলছেন, ‘আমরা ভালো ক্রিকেট খেললে যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারি। শুধু ইন্ডিয়ার সঙ্গে ম্যাচটাতে ইন্ডিয়া যদি সেভেন্টি-এইট্টি পার্সেন্ট খেলে আর আমরা হানড্রেড পার্সেন্ট খেলি, তাহলে হয়তো জেতা সম্ভব। তবে এর বাইরে আমাদের গ্রুপে যেসব টিম আছে, হানড্রেড পার্সেন্ট খেলতে পারলে ভালোভাবে ম্যাচ জেতা সম্ভব। গত কিছুদিন যেমন খেলেছি, তাতে একটা আত্মবিশ্বাস তো আমাদের আছেই। আসলে ক্যাম্প শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই টের পেয়ে যাব, বিশ্বকাপে আমাদের রেজাল্ট কেমন হতে পারে। ক্যাম্পের প্রথম দিন থেকেই একটা ইতিবাচক আবহাওয়া তৈরি হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত বিশ্বকাপ শুরুর আগেই যেমন আমাদের মনে হচ্ছিল, আমরা ভালো কিছু করতে পারি। আমাদের গ্রুপে দুটি ভালো টিম ছিল, তার পরও সবার মনে হয়েছে, আমরা কিছু করতে পারি। এই বিশ্বাসটা খুব জরুরি। নয়জন প্লেয়ার বিশ্বাস করলেও হবে না। ১১ জনই যদি বিশ্বাস করে, শুধু তাহলেই এই বিশ্বকাপে আমাদের ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব।’
শুভ্রর প্রশ্ন, ‘সেই ভালো রেজাল্টটা কী? কী হলে বলবেন, ভালো রেজাল্ট হয়েছে?’
সাকিবের উত্তর, ‘সেকেন্ড রাউন্ডে কোয়ালিফাই করা। বড় দুইটা দলকে হারালে সেকেন্ড রাউন্ড কনফার্ম। একটাকে হারালে হয়তো ফিফটি-ফিফটি চান্স, তখন রানরেটের ব্যাপার আসবে। তবে আমার মনে হয় সম্ভব, এটা অসম্ভব কিছুই নয়। দেশের মাটিতে খেলা, অবশ্যই সেকেন্ড রাউন্ডে যাওয়া সম্ভব। আর সেকেন্ড রাউন্ডে গেলে সেমিফাইনালে যাওয়ার চান্সও খুব বেশি। তখন এক ম্যাচের খেলা...সবারই মনে হবে, ‘একটাই তো ম্যাচ, দেখি না সবাই চেষ্টা করে।’ তা ছাড়া সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে গেলে দলের আত্মবিশ্বাসটাই হবে অন্য রকম।’
‘নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার পর তো অতি আশাবাদী অনেকে এমনও বলছেন, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারে...!’
সাকিব হেসে বলেছেন, ‘আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, আমাদের সেকেন্ড রাউন্ডে কোয়ালিফাই করাটাই কঠিন। এটি করতে পারলে খুব ইজি হয়ে যাবে। সেকেন্ড রাউন্ডে কোয়ালিফাই করলে আমরা ফাইনালও খেলে ফেলতে পারি। আর ফাইনাল পর্যন্ত গেলে কী হবে কে বলতে পারে...!’
‘ফাইনালে উঠে গেলে আর চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা বাদ থাকে কেন?’
সাকিব হাসি দিয়ে বলেছেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারি। তবে আগে সেকেন্ড রাউন্ডে তো উঠি।’
সাকিব কথা বলেছেন বাস্তবতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে, আমি স্বপ্নবিলাসী মানুষ। বাংলাদেশ নিয়ে আমার স্বপ্নের কোনো সীমা নেই। আর স্বপ্ন যদি খেতে হয়, তাহলে পোড়া রুটি কেন খাব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবারগুলোই খাব। আমার স্বপ্ন তাই চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। আমি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই উক্তির নাছোড় সমর্থক, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।’ স্বপ্নটাই যদি আমরা বড় না দেখি, কাজেকর্মে বাস্তবের দুনিয়ায় আমরা বড় হব কী করে! আমাদের ক্রিকেটাররা আগে যখন এশিয়ান কাপে খেলতে যেতেন, তখন তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হতো, আপনাদের লক্ষ্য কী? তাঁরা বলতেন, পত্রিকায় সাধু ভাষায় অধিনায়কের সেই বক্তব্য প্রকাশিত হতো, ‘৫০ ওভার ব্যাট করিব’। সেই দিন আমরা কবে পেরিয়ে এসেছি। এখন বাংলাদেশ প্রতিটা খেলায় নামে জয়ের জন্য। প্রতিটা খেলায় জয়লাভ তারা করে না, তবুও সর্বশেষ ১০টা খেলায় তো আমরা বেশির ভাগই জিতেছি, তাই নয় কি? আমরা কেন আশাবাদী হব না?
এই পাগলামোয় এখন আমাকে পেয়ে বসেছে। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবে। ফেসবুকে একটা পাতাও খুলে ফেলেছি, বাংলাদেশ: বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নস: মিরাকলস ক্যান হ্যাপেন হোয়েন ইউ বিলিভ।
অলৌকিক ঘটনা ঘটে যেতে পারে, যখন তুমি তা বিশ্বাস করো। ম্যারায়া ক্যারির একটা গান আছে:
আমরা এখন ভীত নই আর মোটে
যদিও ভয়ের অনেক কারণই জোটে
আমরা পাহাড় ডিঙিয়েছি অতি উচ্চ
ডিঙোনোর আগে ভাবিনি পাহাড়ও তুচ্ছ!
ঘটে যেতে পারে অলীক ঘটনা বিশ্বাস করো যদি,
যদিও আশার আলো নেই শুধু, হতাশাই নিরবধি,
কী অলৌকিক অর্জিত হবে, কে বা জানে সেই কথা—
যদি বিশ্বাস রাখো তবে তুমি সেটা ঘটাবেই জেনো,
তুমি সেটা ঠিক ঘটিয়ে ফেলবে বিশ্বাস শুধু মেনো। (অনুবাদ লেখকের)
বাংলাদেশ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হবে, এটা নিশ্চয়ই হবে একটা অলৌকিক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। কিন্তু এখন আমি অলৌকিকেই বিশ্বাস করি। এবং বিশ্বাস করি যে বিশ্বাস করলে, স্বপ্ন দেখলেই কেবল সেটা একদিন সম্ভব করে তোলা যায়। যেমন করেছেন মুসা ইব্রাহীম—আর্থিক বাধা, স্বজনদের নিষেধাজ্ঞা সবকিছু তুচ্ছ করে প্রশিক্ষণ, মনোবল, জিদ আর স্থির লক্ষ্য সম্বল করে উঠে পড়েছেন এভারেস্টের চূড়ায়। এখন কি আর আমাদের সেই দিন আছে, যখন আমরা মাঠে নামব সম্মানজনক হারের জন্য? পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করার জন্য? আমাদের অকুতোভয় তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম আর সাকিব আল হাসান বিগত বিশ্বকাপে শিরোপাপ্রত্যাশী ভারতকে কী তুলাধোনাটাই করেছিলেন! এ বছর তাঁরা আরও পরিপক্ব হয়েছেন।
প্রথমে ১৪টা দল। সাতটা করে দল নিয়ে দুটো গ্রুপ। প্রতি গ্রুপ থেকে চারটা করে দল অর্থাৎ মোট আটটা দল উঠবে দ্বিতীয় পর্বে। তার পর থেকেই নক-আউট। মাত্র তিনটা খেলা জিততে পারলেই চ্যাম্পিয়ন। অলৌকিক ঘটনা কি ঘটতে পারে না? আমরা নিজেরাই যদি বিশ্বাস না করি, স্বপ্ন না দেখি, তাহলে কীভাবে ঘটবে। তাই আমি স্বপ্ন দেখে চলেছি, স্বপ্ন দেখব বলে দুচোখ পেতেছি যে বাংলাদেশই এবার চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে।
বলতে পারেন, প্রত্যাশা বড় হলে প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনাটাও যে বড় হয়। হায়! জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার খেতে খেতে যে আমরা স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাই। সত্য, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে ভয় পাওয়ার কী আছে? আমরা যে ফুটবল বিশ্বকাপে পুরো দেশটাকে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাম, তো আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল কি প্রতিবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে? তাই বলে কি আগামী বিশ্বকাপে আমরা আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের জন্য উন্মত্ত হব না? তাহলে এবার আমরা নিজের দেশের জন্য যদি পাগল হই, ক্ষতি কী!
না, আমি দলের খেলোয়াড়দের কোনো চাপে ফেলতে চাই না। আমরা শুধু তাঁদের জানাতে চাই আমাদের নিঃশর্ত ভালোবাসা, অতুল সমর্থন, অপরিসীম শুভেচ্ছা।
আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি, যখন তোমরা ভালো করো তখনো, যখন তোমাদের খারাপ সময় যায় তখনো আমরা তোমাদের ফেলে রেখে যাই না। ইয়াহু পাতার এক সাক্ষাৎকারে সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের সমর্থকদের এই ভালোবাসার কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন পরিপক্ব এক অধিনায়কের মতোই।
একটা জায়গায় আমরা অবশ্যই চ্যাম্পিয়ন হতে পারি, যদি স্বাগতিক হিসেবে আমরা আমাদের হূদয়ের দরজাটা সারা পৃথিবীর জন্য খুলে রাখি। আমাদের দল হারুক (তা যেন না হয়) বা জিতুক, আমরা পৃথিবীর সভ্যতম জাতির মতো আচরণ করব। আমরা বিদেশি অতিথিদের সম্মান জানাব, ভালোবাসা দেখাব। পথেঘাটে স্টেডিয়ামে হোটেলে রেস্টুরেন্টে বিপণিবিতানে তাঁদের হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানাব, তাঁদের সহযোগিতা করব। আমরা সেই ভারতীয় বা পাকিস্তানি উন্মত্ত সমর্থকদের মতো হব না, যারা দল হেরে গেলে খেলোয়াড়দের বাড়ি গিয়ে চড়াও হয়। বরং এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা হতে পারে অনুসরণীয়, তারা ক্রিকেট-অন্তঃপ্রাণ, কিন্তু কখনো ভোলে না যে ক্রিকেটটা একটা খেলাই।
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার এ হচ্ছে এক মহা সুযোগ। পৃথিবীর অনেক মানুষের ধারণা, বাংলাদেশ পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্রতিদিনই বন্যা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। সারা পৃথিবী থেকে মানুষজন, সাংবাদিক এ দেশে আসবেন। তাঁরা দেখবেন এক আশ্চর্য দেশ, যে দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশের একটা, মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইল জায়গা নিয়ে যারা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁরা দেখতে পাবেন এক অপূর্ব বদ্বীপ, যেখানে আছে পৃথিবীর সেরা স্থাপত্যকর্মের একটা—জাতীয় সংসদ ভবন। যাদের আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত, আছে সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। দেখবেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটা কতটা গণতান্ত্রিক আর প্রগতিশীল। কিন্তু সবচেয়ে মধুর যে সম্পদ তাঁরা দেখে যাবেন, তা হলো বাংলাদেশের মানুষের হূদয়। আমি একটা পর্যটন কোম্পানির কথা জানি, যারা সুন্দরবনে প্রতিবছর বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে যায়, তাঁদের মন্তব্য-খাতায় পর্যটকেরা লিখে রেখে গেছেন, সুন্দরবন দেখে তাঁরা মোহিত, কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা তাঁদের মুগ্ধ করেছে তা হলো এই দেশের মানুষের আতিথেয়তা। আমরা যেন আমাদের বিদেশি অতিথিদের আমাদের ঐতিহ্যবাহী আতিথেয়তা দিয়ে মুগ্ধ করতে পারি।
আর আছে ব্যবস্থাপনা। সময় বেশি নেই, কিন্তু নিশ্চয়ই সরকার আর যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিশ্বকাপের আগেই শহরগুলোকে, ভেনুগুলোকে, রাস্তাঘাটগুলোকে সুন্দর করে ফেলবে যথাসাধ্য। ইন্টারনেটের ব্লগে একটা প্রচারণা চলছে, সেটা খুবই জোরদার, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হিন্দি ছবির শিল্পীদের প্রাধান্য থাকবে, বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করা হবে। এ বিষয়ে আমি জানার চেষ্টা করেছি। এই বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ তিনটা। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা। মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিন দেশই তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরার সুযোগ পাবে। আর অংশগ্রহণকারী সব দেশেরই অংশগ্রহণ থাকবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। কিন্তু আইসিসির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বাইরেও অন্য সময়ে বা অন্য দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, যেটা আইসিসির অনুষ্ঠানের অংশ নয়, যেটা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হবে না। তাতে দেশি-বিদেশি শিল্পীরা অংশ নেবেন। কাজেই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে বলিউডি সংস্কৃতি প্রচারের কাজে আমরা ব্যবহূত হব বলে যে প্রচারণাটা জোরেশোরে ইন্টারনেটের ব্লগে ও ফেসবুকে চলছে তা খুব সত্য নয়। তবু কর্তৃপক্ষকে বলি, এ ব্যাপারে নাগরিকদের একাংশের মনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তার উত্তর আপনারা আনুষ্ঠানিকভাবে দিন। স্বচ্ছতা সব সময়ই ভালো। আর আইসিসির অনুষ্ঠানের বাইরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও যেন বাংলাদেশের ঋদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের যথাযথ প্রতিফলন থাকে।
অন্যদিকে চমকের ব্যাপারটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা সব আয়োজক দেশই পরিকল্পনা করে অতি গোপনীয়তা বজায় রেখে। পর্দা ওঠার পরই সবাই চমকিত হয়, বাহ, বেশ তো দেখাল! ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোর সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, তারাও চেষ্টা করছেন সারপ্রাইজটা বজায় রাখতে।
বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হবে—স্বপ্ন আমার যায় না। আমরা শুধু ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হব তা-ই নয়, আমরা জাতীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হব। হয়তো আর ২০টা বছর লাগবে এই দেশটাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন করে তুলতে। কিন্তু সাফল্য আসবেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কোনো ম্যাচ জেতার পর সবাই মিলে গলা ছেড়ে আর গলা জড়িয়ে ধরে একটা গান করেন, ‘আমরা করব জয় একদিন। মনের গভীরে আছে প্রত্যয় যে আমরা করব জয় একদিন।’
আমরা অবশ্যই জয়লাভ করব। একদিন না একদিন। আমরা মরে যেতে পারি, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন মরবে না। আমরা জাতি হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন হব।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments