সম্পাদকের কলাম-দেশের অবস্থা কী by ইমদাদুল হক মিলন
বুলু আমার সামনে বসে আছে। ছয় ফিট দুই ইঞ্চি লম্বা। আগের সেই শরীর বুলুর নেই। বেশ ভেঙেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি। ছোট করে ছাঁটা চুল এখনো বেশ ঘন। সাত-আট মাস আগে স্ট্রোক করেছিল। মুখের বাঁ দিকটা একটু বেঁকে গেছে। তবে বুলুর কথা জড়ায় না, স্পষ্টই বলতে পারে।
বুলুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চলে যাই ১৯৭১-এ। এই যে বুলু আমার সামনে বসে আছে, এই বুলুকে আমি আর দেখতে পাই না। আমি দেখি এসএসসি পরীক্ষা দেবে এমন একজন ছাত্রকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ওই বয়সী ছেলেটি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেল। আমাদের ক্লাসের একমাত্র ছাত্র বুলু, যে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করল। দেশ স্বাধীন করল।
আমি সেই বুলুকে দেখতে পাই।
বুলুর বাবা ব্রিটিশ আর্মিতে কাজ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সিরিয়ায় যুদ্ধ করেছেন। ১৬-১৭ বছরের বুলুকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে তিনি উৎসাহিত করেছিলেন। বুলু ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিল। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়েছিল।
এক গভীর বৃষ্টিরাতের কথা আমার মনে আছে।
রাত দেড়টার মতো বাজে। আমরা থাকি গেণ্ডারিয়ার সাবেক শরাফতগঞ্জ লেনের এক বাড়িতে। বাড়ির পেছন দিককার গেটে মৃদু মৃদু শব্দ হচ্ছে। ওই গেটের সঙ্গে খুপরিমতো একটা রুমে আমি আর আমার বড় ভাই থাকি। সে রাতে বড় ভাই চলে গেছে দীননাথ সেন রোডে আমার মায়ের মামাবাড়িতে। আমি একা রুমে।
কিন্তু এত রাতে কে গেট ধাক্কায়?
দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, পাকিস্তানিরা যখন-তখন হানা দিচ্ছে যেখানে-সেখানে। মানুষ মারছে, মানুষ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আছে রাজাকার-আলবদররা। যাদের তুলে নেয় তারা আর ফিরে আসে না। বর্ষাকাল চলছে, দু-তিন দিন ধরে একটানা বৃষ্টি। কখনো গুঁড়িগুঁড়ি, কখনো মুষলধারে। রাত দেড়টায় বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপিয়ে। এ অবস্থায় গেট ধাক্কায় কে?
কয়েকবার ধাক্কাধাক্কি শুনলাম। তারপর পা টিপে টিপে বন্ধ গেটের এপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
আমি বুলু। তাড়াতাড়ি গেট খোল, দোস্ত।
বুলু আমার প্রিয়বন্ধু। তার গলা চিনতে একমুহূর্তও লাগল না। কিন্তু এত রাতে কোত্থেকে এলো সে? আমি গেট খুললাম। ভেজা শার্ট-প্যান্ট পরা, খালি পা বুলু ঢুকল। কোনো শব্দ না করে আমার রুমে এলো। আজকের রাতটা তোর এখানে থাকতে হবে। আজানের সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে যাব।
আমি বুলুকে একটা গামছা দিয়েছি, লুঙ্গি দিয়েছি। ঘটনা কিরে?
বুলু শরীর-মাথা মুছতে মুছতে বলল, পাগলা রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে এলাম।
বলিস কী!
হ্যাঁ। দু-তিন দিন ধরে প্ল্যান করেছি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনের যেকোনো একটা ব্রিজ উড়িয়ে দেব, যাতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। শ্যামপুর ব্রিজে পাহারা বসিয়েছে পাকিস্তান আর্মি। বাংকার করেছে। ব্রিজটা ছোট। ওটা উড়িয়ে তেমন কাজ হবে না। ওয়াসা ডিপোর ওদিকে পাজাখোলা ব্রিজ। ওটাও ছোট। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম পাগলা ব্রিজ ওড়াব।
কয়জন ছিলি তোরা?
আট-দশজন। এক্সপ্লোসিভ, ফিউজ, ডেটনেটর বিছানার চাদরে পেঁচিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে রওনা দিলাম। তবে বিচ্ছিন্নভাবে। তুমুল বৃষ্টি। আমার পরনে রেইনকোট ছিল। দুই কাঁধে দুটো স্টেনগান। ব্রিজের পশ্চিম পাশের একটা পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িতে একত্র হলাম সবাই। রাত ৮টায় যে ট্রেনটা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসবে ওটা আমরা ফেলে দেব। কিন্তু ৮টার ট্রেন এলো রাত ১০টায়। ততক্ষণে ব্রিজের তলায় গার্ডারের সঙ্গে চাদরে পেঁচানো এক্সপ্লোসিভ বাঁধা হয়ে গেছে। রেললাইনে কান পেতে শুনলাম, দূর থেকে ট্রেন আসছে। ট্রেনটির ইঞ্জিনের আগে মালগাড়ির একটা বগি দেওয়া ছিল। ইঞ্জিনটা ছিল উল্টোদিকে, যাতে বাতিটা চোখে না পড়ে। আমরা যে যার অস্ত্র নিয়ে পজিশন নিলাম। এসএলআর ছিল একজনের কাছে। স্টেন তো ছিলই। ব্রিজের নিচে এক্সপ্লোসিভ, ডেটনেটরের সঙ্গে ইলেকট্রিক তার সংযোগ দিয়ে দ্রুত চলে এসেছে আমার দুই সহযোদ্ধা। কমান্ডারের নির্দেশমতো আমরা যে যার পজিশনে। বৃষ্টিতে অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ট্রেনের আলো উল্টোদিকে থাকার ফলে আমরা আন্দাজেই ব্যাটারির সংযোগ দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ আর তীব্র আলোয় পাগলা ব্রিজ খালি বগিসহ ভেঙে নিচে পড়ে গেল। একটা বগিতে পাক সেনারা ছিল। সেটার কোনো ক্ষতি হলো না। মুহূর্তে তারা লাফিয়ে নামল মাটিতে, তারপর অন্ধকারে অবিরাম গুলি চালাতে লাগল। বৃষ্টির মতো গুলি। আমরা ততক্ষণে ক্রলিং করে করে একেকজন একেকদিকে। আমি তোর এখানে চলে এসেছি। অস্ত্র আর রেইনকোট তোদের বাড়ির আশপাশেই আছে। ভোরবেলা নিয়ে যাব।
সেই বুলু আজ আমার কাছে এসেছে দেশের অবস্থা জানার জন্য। আমি ম্লান গলায় বললাম, কী বলব বল! দেশের অবস্থা তো আমরা সবাই দেখছি। নতুন করে কী বলার আছে?
বুলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই দেশের জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। পাগলা ব্রিজ ওড়াবার খবর পরদিন বিবিসি থেকে প্রচারিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে 'চরমপত্র' পাঠ করতেন এম আর আখতার মুকুল। তিনি মজা করে ব্রিজ ওড়াবার বর্ণনা দিলেন। কত স্বপ্ন তখন আমাদের চোখে। দেশ স্বাধীন হবে, তৈরি হবে সোনার বাংলা। দেশ স্বাধীন হলো ঠিকই কিন্তু আমাদের দেখা স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। গত চল্লিশ বছরে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই আমরা সবাই জানি। পুরনো কথা বলে আর লাভ কী। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে কী হচ্ছে দেশে! দেশ কোন দিকে যাচ্ছে! মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে, হদিস করতে পারছে না কেউ। বিদেশি খুন হচ্ছে, কূলকিনারা করা যাচ্ছে না। দুর্নীতি জনদুর্ভোগ ভঙ্গুর অর্থনীতি লাগামছাড়া দ্রব্যমূল্য হরতালের পর হরতাল। রাস্তার ধারে মানুষ বসে আছে কাজের আশায়। ঘরে খাবার নেই। ডাকাতি করে বাড়ির মালামালের সঙ্গে আট মাসের শিশুটিকেও তুলে নিয়ে যাচ্ছে ডাকাতরা। বিরাট অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। ক্লান্ত ড্রাইভার যাত্রী নামিয়ে বাসে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। আগুন দেওয়া হলো সেই বাসে। পুড়ে কয়লা হয়ে গেল মানুষটা। একজন নেতা যেমন দেশের নাগরিক, ওই বাস ড্রাইভারও তো দেশের নাগরিক। কেন এভাবে মরতে হবে তাঁকে। রাজনীতির জল ঘোলা করছে কারা? এ কেমন দেশ তৈরি করলাম আমরা? আজ আমি তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, জানি না বাড়ি ফিরে যেতে পারব কি না। শুধু রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে নয়, দেশের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আতঙ্ক। না জানি কখন কী হয়! এ রকম দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? ওইটুকু বয়সে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম একটা সুখী-সমৃদ্ধ দেশের জন্য। কোথায় আমার সেই দেশ? শামসুর রাহমানের কোনো একটা কবিতার লাইন ছিল, 'মুক্তিযুদ্ধ, হায় বৃথা যায়'। আমার মুক্তিযুদ্ধ কি তাহলে বৃথা যাচ্ছে?
বুলু হু হু করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, স্বাধীনতার পর থেকে একটার পর একটা দুঃসময় এসেছে, তার পরও আশায় বুক বেঁধেছি। ভেবেছি, এটাই বোধ হয় শেষ দুঃসময়। সুসময় সামনে। সেই সুসময় আর এলো না। চল্লিশটা বছর অপেক্ষায় কাটালাম। রোজ ভাবি, ঠিক আছে, আমি না হয় দেশের সুসময় দেখে যেতে পারছি না, আমার ছেলেমেয়েরা পারবে, পরের প্রজন্ম পারবে। কোথায় কী? দেশ প্রতিদিনই যাচ্ছে খারাপের দিকে। এ রকম দেশ আমি চাইনি, কোনো মুক্তিযোদ্ধা চাননি, দেশের কোনো মানুষ চায়নি।
বুলু চোখ মুছল। তারপর বড় করে একটা হাঁফ ছাড়ল। তার পরও আবার স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে, জানিস। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন স্বপ্ন দেখতাম, দেশ একদিন স্বাধীন হবে। লাল টকটকে বড় একটা সূর্য উঠবে স্বাধীন বাংলাদেশে, ঠিক তেমন করে এক সুন্দর সকালে সত্যিকার সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে দেশ। মানুষ হাসবে খেলবে আনন্দ করবে, সুখে ঘুমাবে। পচা রাজনীতি নেই, গুপ্তহত্যা নেই, দুর্নীতি দুর্ভোগ নেই, বেকারত্ব নেই, অভাব নেই। দেশের মানুষের জীবন সর্বান্তকরণে নিরাপদ।
বুলুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোর স্বপ্ন সফল হোক, বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধ বৃথা যেতেই পারে না। সুসময় নিশ্চয় আসবে।
আমি সেই বুলুকে দেখতে পাই।
বুলুর বাবা ব্রিটিশ আর্মিতে কাজ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সিরিয়ায় যুদ্ধ করেছেন। ১৬-১৭ বছরের বুলুকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে তিনি উৎসাহিত করেছিলেন। বুলু ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিল। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়েছিল।
এক গভীর বৃষ্টিরাতের কথা আমার মনে আছে।
রাত দেড়টার মতো বাজে। আমরা থাকি গেণ্ডারিয়ার সাবেক শরাফতগঞ্জ লেনের এক বাড়িতে। বাড়ির পেছন দিককার গেটে মৃদু মৃদু শব্দ হচ্ছে। ওই গেটের সঙ্গে খুপরিমতো একটা রুমে আমি আর আমার বড় ভাই থাকি। সে রাতে বড় ভাই চলে গেছে দীননাথ সেন রোডে আমার মায়ের মামাবাড়িতে। আমি একা রুমে।
কিন্তু এত রাতে কে গেট ধাক্কায়?
দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, পাকিস্তানিরা যখন-তখন হানা দিচ্ছে যেখানে-সেখানে। মানুষ মারছে, মানুষ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আছে রাজাকার-আলবদররা। যাদের তুলে নেয় তারা আর ফিরে আসে না। বর্ষাকাল চলছে, দু-তিন দিন ধরে একটানা বৃষ্টি। কখনো গুঁড়িগুঁড়ি, কখনো মুষলধারে। রাত দেড়টায় বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপিয়ে। এ অবস্থায় গেট ধাক্কায় কে?
কয়েকবার ধাক্কাধাক্কি শুনলাম। তারপর পা টিপে টিপে বন্ধ গেটের এপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
আমি বুলু। তাড়াতাড়ি গেট খোল, দোস্ত।
বুলু আমার প্রিয়বন্ধু। তার গলা চিনতে একমুহূর্তও লাগল না। কিন্তু এত রাতে কোত্থেকে এলো সে? আমি গেট খুললাম। ভেজা শার্ট-প্যান্ট পরা, খালি পা বুলু ঢুকল। কোনো শব্দ না করে আমার রুমে এলো। আজকের রাতটা তোর এখানে থাকতে হবে। আজানের সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে যাব।
আমি বুলুকে একটা গামছা দিয়েছি, লুঙ্গি দিয়েছি। ঘটনা কিরে?
বুলু শরীর-মাথা মুছতে মুছতে বলল, পাগলা রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে এলাম।
বলিস কী!
হ্যাঁ। দু-তিন দিন ধরে প্ল্যান করেছি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনের যেকোনো একটা ব্রিজ উড়িয়ে দেব, যাতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। শ্যামপুর ব্রিজে পাহারা বসিয়েছে পাকিস্তান আর্মি। বাংকার করেছে। ব্রিজটা ছোট। ওটা উড়িয়ে তেমন কাজ হবে না। ওয়াসা ডিপোর ওদিকে পাজাখোলা ব্রিজ। ওটাও ছোট। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম পাগলা ব্রিজ ওড়াব।
কয়জন ছিলি তোরা?
আট-দশজন। এক্সপ্লোসিভ, ফিউজ, ডেটনেটর বিছানার চাদরে পেঁচিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে রওনা দিলাম। তবে বিচ্ছিন্নভাবে। তুমুল বৃষ্টি। আমার পরনে রেইনকোট ছিল। দুই কাঁধে দুটো স্টেনগান। ব্রিজের পশ্চিম পাশের একটা পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িতে একত্র হলাম সবাই। রাত ৮টায় যে ট্রেনটা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসবে ওটা আমরা ফেলে দেব। কিন্তু ৮টার ট্রেন এলো রাত ১০টায়। ততক্ষণে ব্রিজের তলায় গার্ডারের সঙ্গে চাদরে পেঁচানো এক্সপ্লোসিভ বাঁধা হয়ে গেছে। রেললাইনে কান পেতে শুনলাম, দূর থেকে ট্রেন আসছে। ট্রেনটির ইঞ্জিনের আগে মালগাড়ির একটা বগি দেওয়া ছিল। ইঞ্জিনটা ছিল উল্টোদিকে, যাতে বাতিটা চোখে না পড়ে। আমরা যে যার অস্ত্র নিয়ে পজিশন নিলাম। এসএলআর ছিল একজনের কাছে। স্টেন তো ছিলই। ব্রিজের নিচে এক্সপ্লোসিভ, ডেটনেটরের সঙ্গে ইলেকট্রিক তার সংযোগ দিয়ে দ্রুত চলে এসেছে আমার দুই সহযোদ্ধা। কমান্ডারের নির্দেশমতো আমরা যে যার পজিশনে। বৃষ্টিতে অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ট্রেনের আলো উল্টোদিকে থাকার ফলে আমরা আন্দাজেই ব্যাটারির সংযোগ দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ আর তীব্র আলোয় পাগলা ব্রিজ খালি বগিসহ ভেঙে নিচে পড়ে গেল। একটা বগিতে পাক সেনারা ছিল। সেটার কোনো ক্ষতি হলো না। মুহূর্তে তারা লাফিয়ে নামল মাটিতে, তারপর অন্ধকারে অবিরাম গুলি চালাতে লাগল। বৃষ্টির মতো গুলি। আমরা ততক্ষণে ক্রলিং করে করে একেকজন একেকদিকে। আমি তোর এখানে চলে এসেছি। অস্ত্র আর রেইনকোট তোদের বাড়ির আশপাশেই আছে। ভোরবেলা নিয়ে যাব।
সেই বুলু আজ আমার কাছে এসেছে দেশের অবস্থা জানার জন্য। আমি ম্লান গলায় বললাম, কী বলব বল! দেশের অবস্থা তো আমরা সবাই দেখছি। নতুন করে কী বলার আছে?
বুলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই দেশের জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। পাগলা ব্রিজ ওড়াবার খবর পরদিন বিবিসি থেকে প্রচারিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে 'চরমপত্র' পাঠ করতেন এম আর আখতার মুকুল। তিনি মজা করে ব্রিজ ওড়াবার বর্ণনা দিলেন। কত স্বপ্ন তখন আমাদের চোখে। দেশ স্বাধীন হবে, তৈরি হবে সোনার বাংলা। দেশ স্বাধীন হলো ঠিকই কিন্তু আমাদের দেখা স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। গত চল্লিশ বছরে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই আমরা সবাই জানি। পুরনো কথা বলে আর লাভ কী। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে কী হচ্ছে দেশে! দেশ কোন দিকে যাচ্ছে! মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে, হদিস করতে পারছে না কেউ। বিদেশি খুন হচ্ছে, কূলকিনারা করা যাচ্ছে না। দুর্নীতি জনদুর্ভোগ ভঙ্গুর অর্থনীতি লাগামছাড়া দ্রব্যমূল্য হরতালের পর হরতাল। রাস্তার ধারে মানুষ বসে আছে কাজের আশায়। ঘরে খাবার নেই। ডাকাতি করে বাড়ির মালামালের সঙ্গে আট মাসের শিশুটিকেও তুলে নিয়ে যাচ্ছে ডাকাতরা। বিরাট অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। ক্লান্ত ড্রাইভার যাত্রী নামিয়ে বাসে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। আগুন দেওয়া হলো সেই বাসে। পুড়ে কয়লা হয়ে গেল মানুষটা। একজন নেতা যেমন দেশের নাগরিক, ওই বাস ড্রাইভারও তো দেশের নাগরিক। কেন এভাবে মরতে হবে তাঁকে। রাজনীতির জল ঘোলা করছে কারা? এ কেমন দেশ তৈরি করলাম আমরা? আজ আমি তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, জানি না বাড়ি ফিরে যেতে পারব কি না। শুধু রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে নয়, দেশের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আতঙ্ক। না জানি কখন কী হয়! এ রকম দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? ওইটুকু বয়সে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম একটা সুখী-সমৃদ্ধ দেশের জন্য। কোথায় আমার সেই দেশ? শামসুর রাহমানের কোনো একটা কবিতার লাইন ছিল, 'মুক্তিযুদ্ধ, হায় বৃথা যায়'। আমার মুক্তিযুদ্ধ কি তাহলে বৃথা যাচ্ছে?
বুলু হু হু করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, স্বাধীনতার পর থেকে একটার পর একটা দুঃসময় এসেছে, তার পরও আশায় বুক বেঁধেছি। ভেবেছি, এটাই বোধ হয় শেষ দুঃসময়। সুসময় সামনে। সেই সুসময় আর এলো না। চল্লিশটা বছর অপেক্ষায় কাটালাম। রোজ ভাবি, ঠিক আছে, আমি না হয় দেশের সুসময় দেখে যেতে পারছি না, আমার ছেলেমেয়েরা পারবে, পরের প্রজন্ম পারবে। কোথায় কী? দেশ প্রতিদিনই যাচ্ছে খারাপের দিকে। এ রকম দেশ আমি চাইনি, কোনো মুক্তিযোদ্ধা চাননি, দেশের কোনো মানুষ চায়নি।
বুলু চোখ মুছল। তারপর বড় করে একটা হাঁফ ছাড়ল। তার পরও আবার স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে, জানিস। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন স্বপ্ন দেখতাম, দেশ একদিন স্বাধীন হবে। লাল টকটকে বড় একটা সূর্য উঠবে স্বাধীন বাংলাদেশে, ঠিক তেমন করে এক সুন্দর সকালে সত্যিকার সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে দেশ। মানুষ হাসবে খেলবে আনন্দ করবে, সুখে ঘুমাবে। পচা রাজনীতি নেই, গুপ্তহত্যা নেই, দুর্নীতি দুর্ভোগ নেই, বেকারত্ব নেই, অভাব নেই। দেশের মানুষের জীবন সর্বান্তকরণে নিরাপদ।
বুলুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোর স্বপ্ন সফল হোক, বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধ বৃথা যেতেই পারে না। সুসময় নিশ্চয় আসবে।
No comments