নদীর জন্য মেলা by শেখ রোকন
আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী 'দ্বিতীয় জাতীয় নদী মেলা ১৪১৮'। এ আর নতুন কী? বলা চলে হাজার বছর ধরে বাংলাদেশজুড়েই চলছে নদীর মেলা। এত ছোট ভূখণ্ডে জালের মতো ছড়ানো এত নদী আর কোথায় আছে? ছোট-বড়, নাম জানা-অজানা কিংবা একই নামে একাধিক নদীর এ দেশ তো নদীরই সন্তান_ নদীমাতৃক।
নদীই নিজের বুকের পলি তিল তিল করে পলি জমিয়ে গড়ে তুলেছে এ ব-দ্বীপ। কবি বাংলাদেশের নাম দিয়েছেন 'নদী মেখলা'_ এ দেশের অঙ্গে গয়নার মতো জড়িয়ে আছে নদী। বস্তুত আমাদের ভূমি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, খাদ্য-পুষ্টি, কৃষি ব্যবস্থা, যোগাযোগ থেকে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মনন তো এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমারই অবদান। এ দেশের মানুষ নদীরই সন্তান, নদীবর্তী। ইংরেজিতে বললে, রিভারাইন পিপল।
স্বাভাবিক ছিল, নদীবর্তী মানুষ নদ-নদীর সর্বব্যাপী অবদান মনে রাখবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখছি উল্টো যাত্রা। নদীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নতজানু হওয়ার বদলে গুটি কয়েক মানুষ বরং দিচ্ছে সর্বনাশা প্রতিদান। দখল, দূষণ, পানি প্রত্যাহার, প্রবাহ বিকৃতি আমাদের প্রিয় ও প্রয়োজনীয় নদীগুলোকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এরই মধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি বেশ কিছু নদী। আরও কিছু নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। বুড়িগঙ্গার মতো নগর-সংশ্লিষ্ট নদীগুলো কাঠামোগত দিক থেকে ঠিক থাকলেও জৈবিকভাবে মরে গেছে। বিপুল মৎস্যসম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের আধার নদীগুলো এখন প্রাণহীন।
আশার কথা, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী গুটি কয়েক মানুষের কথা বাদ দিলে মাতৃরূপী নদীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণে প্রাণ কাঁদে নদীবর্তী সব মানুষের। আমরা দেখছি, দখল-দূষণ, বিকৃতি যখন চরমে উঠেছে, নদী বাঁচানোর তাগিদও তখন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। নদীর পক্ষে ক্রমেই সোচ্চার হচ্ছে হাজারো কণ্ঠস্বর। ক্রমেই বাড়ছে নদীবিষয়ক লেখালেখি, গবেষণা-সমীক্ষা, সভা-সেমিনার, আলাপ-আলোচনা, আয়োজন। সন্দেহ নেই, জাতীয় নদীমেলা এরই ধারাবাহিকতা। দেশজুড়ে বিস্তৃত পরিসরে প্রবহমান নদীগুলোকে নাগরিক হৃদয়ের একান্তে বইয়ে দিতেই এমন আয়োজন।
আজ শনিবার থেকে পরশু সোমবার (২৩-২৫ জুলাই, ২০১১) পর্যন্ত নদীপ্রেমী মানুষের মিলনমেলা বসছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে। বসছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২৫টি স্টল। আয়োজক দুর্যোগ ফোরাম ও স্বাগতিক প্রতিষ্ঠানের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ। সকালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির। উদ্বোধন করবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
অনেকের মনে আছে, দুর্যোগ ফোরামের উদ্যোগে জাতীয় নদীমেলার প্রথম আয়োজন বসেছিল গাইবান্ধায় ১৩-১৪ এপ্রিল, ২০১০-এ। আগের বছরের চৈত্রসংক্রান্তি থেকে ১৪১৭ সনের প্রথম দিন, বাংলা নববর্ষ পর্যন্ত। 'নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে' স্লোগানকে মুখ্য করে ব্রহ্মপুত্র আর ঘাঘট নদীর পাড়ে অনুষ্ঠিত ওই মেলায় অংশ নিয়েছিল ৩৩টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
এবারের মেলায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ এলাকার নদীর প্রতিনিধিত্ব করবে। স্টলগুলোর নামও হচ্ছে একেকটি নদীর নামে। মেলার তিন দিনকেও সাজানো হয়েছে তিনটি নদীর নামে_ চিত্রা, হালদা ও আদি যমুনা। নদী রক্ষায় জনমত গঠনে আয়োজন করা হয়েছে সেমিনার ও কর্মঅধিবেশনের। সেখানে থাকবে মুক্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব। এ ছাড়া নদীর প্রতি জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য থাকছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শিশু চিত্রাঙ্কন, পটগান, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, কবিতা পাঠ, গান, মূকাভিনয় প্রভৃতি। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এসব আয়োজন।
আয়োজকরা আশা করছেন, সবাই সপরিবারে নদীমেলায় যাবে এবং নদীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হবে। বলা বাহুল্য, নদীমেলার মতো আয়োজনের সার্থকতা কিন্তু সেখানেই।
এবারের নদীমেলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'ছোট নদী ছোট নয়'। যথার্থ। ছোট-বড় প্রত্যেক নদীরই নিজ নিজ অববাহিকায় রয়েছে অনন্য অবদান। বিশেষ করে ছোট নদীগুলোই নদীবর্তী মানুষের কাছে একান্ত আপন হয়ে থাকে। বড় নদীতে বরং ভাঙনের ভীতি থাকে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বড় বড় নদী তাও যা মনোযোগ পায়, ছোট নদী থাকে একেবারেই উপেক্ষিত। অথচ আমরা জানি, প্রয়োজন ছোট-বড় সব নদীর প্রতি সমান মনোযোগ। নদীবিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আরও নানা আয়োজনের তুলনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট এ আয়োজন সেই প্রয়োজনীয়তার কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক; নদীবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ রিভারাইন
পিপলের সঙ্গে যুক্ত
skrokon@gmail.com
স্বাভাবিক ছিল, নদীবর্তী মানুষ নদ-নদীর সর্বব্যাপী অবদান মনে রাখবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখছি উল্টো যাত্রা। নদীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নতজানু হওয়ার বদলে গুটি কয়েক মানুষ বরং দিচ্ছে সর্বনাশা প্রতিদান। দখল, দূষণ, পানি প্রত্যাহার, প্রবাহ বিকৃতি আমাদের প্রিয় ও প্রয়োজনীয় নদীগুলোকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এরই মধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি বেশ কিছু নদী। আরও কিছু নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। বুড়িগঙ্গার মতো নগর-সংশ্লিষ্ট নদীগুলো কাঠামোগত দিক থেকে ঠিক থাকলেও জৈবিকভাবে মরে গেছে। বিপুল মৎস্যসম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের আধার নদীগুলো এখন প্রাণহীন।
আশার কথা, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী গুটি কয়েক মানুষের কথা বাদ দিলে মাতৃরূপী নদীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণে প্রাণ কাঁদে নদীবর্তী সব মানুষের। আমরা দেখছি, দখল-দূষণ, বিকৃতি যখন চরমে উঠেছে, নদী বাঁচানোর তাগিদও তখন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। নদীর পক্ষে ক্রমেই সোচ্চার হচ্ছে হাজারো কণ্ঠস্বর। ক্রমেই বাড়ছে নদীবিষয়ক লেখালেখি, গবেষণা-সমীক্ষা, সভা-সেমিনার, আলাপ-আলোচনা, আয়োজন। সন্দেহ নেই, জাতীয় নদীমেলা এরই ধারাবাহিকতা। দেশজুড়ে বিস্তৃত পরিসরে প্রবহমান নদীগুলোকে নাগরিক হৃদয়ের একান্তে বইয়ে দিতেই এমন আয়োজন।
আজ শনিবার থেকে পরশু সোমবার (২৩-২৫ জুলাই, ২০১১) পর্যন্ত নদীপ্রেমী মানুষের মিলনমেলা বসছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে। বসছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২৫টি স্টল। আয়োজক দুর্যোগ ফোরাম ও স্বাগতিক প্রতিষ্ঠানের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ। সকালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির। উদ্বোধন করবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
অনেকের মনে আছে, দুর্যোগ ফোরামের উদ্যোগে জাতীয় নদীমেলার প্রথম আয়োজন বসেছিল গাইবান্ধায় ১৩-১৪ এপ্রিল, ২০১০-এ। আগের বছরের চৈত্রসংক্রান্তি থেকে ১৪১৭ সনের প্রথম দিন, বাংলা নববর্ষ পর্যন্ত। 'নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে' স্লোগানকে মুখ্য করে ব্রহ্মপুত্র আর ঘাঘট নদীর পাড়ে অনুষ্ঠিত ওই মেলায় অংশ নিয়েছিল ৩৩টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
এবারের মেলায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ এলাকার নদীর প্রতিনিধিত্ব করবে। স্টলগুলোর নামও হচ্ছে একেকটি নদীর নামে। মেলার তিন দিনকেও সাজানো হয়েছে তিনটি নদীর নামে_ চিত্রা, হালদা ও আদি যমুনা। নদী রক্ষায় জনমত গঠনে আয়োজন করা হয়েছে সেমিনার ও কর্মঅধিবেশনের। সেখানে থাকবে মুক্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব। এ ছাড়া নদীর প্রতি জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য থাকছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শিশু চিত্রাঙ্কন, পটগান, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, কবিতা পাঠ, গান, মূকাভিনয় প্রভৃতি। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এসব আয়োজন।
আয়োজকরা আশা করছেন, সবাই সপরিবারে নদীমেলায় যাবে এবং নদীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হবে। বলা বাহুল্য, নদীমেলার মতো আয়োজনের সার্থকতা কিন্তু সেখানেই।
এবারের নদীমেলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'ছোট নদী ছোট নয়'। যথার্থ। ছোট-বড় প্রত্যেক নদীরই নিজ নিজ অববাহিকায় রয়েছে অনন্য অবদান। বিশেষ করে ছোট নদীগুলোই নদীবর্তী মানুষের কাছে একান্ত আপন হয়ে থাকে। বড় নদীতে বরং ভাঙনের ভীতি থাকে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বড় বড় নদী তাও যা মনোযোগ পায়, ছোট নদী থাকে একেবারেই উপেক্ষিত। অথচ আমরা জানি, প্রয়োজন ছোট-বড় সব নদীর প্রতি সমান মনোযোগ। নদীবিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আরও নানা আয়োজনের তুলনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট এ আয়োজন সেই প্রয়োজনীয়তার কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক; নদীবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ রিভারাইন
পিপলের সঙ্গে যুক্ত
skrokon@gmail.com
No comments