মেঘমেদুর স্মৃতি by ওয়াসি আহমেদ

এখন খর-বৈশাখ। এই বৈশাখে দীর্ঘদিন আগে, আজ মনে হয় কোনো সুদূর বিস্মৃত অতীতে আমাদের প্রধান কবি সৈয়দ শামসুল হক এক অপার্থিব ঘোরমগ্নতায় রচনা করেছিলেন আনন্দ-বেদনা-ক্ষোভমথিত প্রায় ৭০০ পঙিক্তর দিঘল কবিতা। আধুনিক বাংলা কাব্যের এই দীর্ঘতম কবিতা বৈশাখে রচিত হলেও কবির ভাবনায় বৈশাখ ছিল না।


বৈশাখ তাঁকে উসকে দিয়েছিল, স্নায়ুকোষে চকমকি ঠুকে জ্বালিয়েছিল ধিকিধিকি লাল অঙ্গার—তাঁকে উন্মত্ত-অধীর-দুর্বিনীত করেছিল, নিস্তরঙ্গ জলের মতো শান্ত-প্রশান্তও করেছিল, বেদনাদগ্ধ-উন্মুল-ভরসাহীন করেছিল, আবার খরচৈত্রে পদ্মায় চর হয়ে জেগে ওঠার প্রতিশ্রুতিবদ্ধও করেছিল। গোটা একটা জীবনভাষ্য কবির সচেতন-অবচেতনের বিচিত্র মন্থনে যেভাবে নির্গত হয়েছে, তা কি বাংলার বৈশাখের রুদ্র-কোমল, অনিশ্চিত রূপবৈভবে প্রভাবিত এক ভিন্নমাত্রিক প্রকাশ? হ্যাঁ, এমনটা ভাবতেই সাধ জাগে। বলে রাখা ভালো, আমাদের উন্মুখ প্রথম যৌবনে একান্ত বন্ধুমহলে বাংলার বৈশাখ আর সৈয়দ হকের ‘বৈশাখে রচিত পঙিক্তমালা’ প্রায় এক সুতোয় গাঁথা হয়েই ছিল। বৈশাখী প্রকৃতির উপস্থিতি কবিতায় নেই, তবে যে প্রবল মুহুর্মুহু চিত্তবিক্ষেপ কবিকে নাড়িয়ে-ঝাঁকিয়ে গেছে, তার প্রতিচ্ছায়া হিসেবে বৈশাখকেই মানায়; জ্যৈষ্ঠ, শ্রাবণ, অগ্রহায়ণকে নয়। সেই বৈশাখ। রোদ-বৃষ্টি-হাওয়ার দামামায় সরব, কখনো আক্ষরিক অর্থেই তোপধ্বনিময়। প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাও? এ তো সেই প্রশ্ন মানুষ ভুল করে নয়, জেনে-বুঝেও ভুলে থাকতে চায়। মানুষ বলেই সে জয়ী হতে চায়, জয় তার সবকিছুতেই কাম্য। পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে ভাবে জয় সারা, আকাশে-সাগরে চরে ফিরেও সে জয়ী; ভবিষ্যতে চন্দ্রজয়, আরও কত জয় তার কবজায় আসবে তার হিসাব সে নিজেই রাখে না। কিন্তু এক টুকরো মেঘ, এক কণা রোদ, এক ফোঁটা মাত্র বৃষ্টি তার জয়যাত্রার অসম্ভব সব কল্পনাকে ছাপিয়ে অনতিক্রম্যই থেকে যায়। এ কি শুধুই শক্তি, পরাক্রমী, বিপুল? প্রকৃতিকে নিয়ে বড়ই নির্বোধ জিজ্ঞাসা। প্রকৃতি তার শক্তির চেয়ে বড়।
এখন প্রখর মধ্যদিন। চারপাশে কেশর-ফোলানো উদ্দাম আলো-রোদ। তীব্র তাপে টান টান আকাশে বুঝি চিড় ধরছে, হাওয়ায় ফুলে উঠছে দিকচিহ্নহীন রোদ। নাগরিক এই মধ্যাহ্নে শুনতে কি পাও হাহাকার, দিগন্তপ্লাবী নীরব ক্রন্দন? প্রতিদ্বন্দ্বী হবে? কতটা হাহাকার, ক ফোঁটা ক্রন্দন ধারণ করবে পাঁজরবন্দী তোমার এইটুকু বুক!
তার পরও ধারণক্ষমতায় যত সামান্যই হোক, একেকটা সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা, রোদ-বৃষ্টি-হাওয়া একেকভাবে মানুষের বুকেই জাগে। আর জাগবেই বা কোথায়! মানুষকে তার ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে বের করে আনে। আমরা তখন যার যার সাধ্যমতো জাগি। একই আলোময় রোদ, একই বৃষ্টি একেক সকালে দুপুরে একেক রকম; নাকি এক নয় মোটেও। নিত্যদিনই আনকোরা টাটকা নতুন। কোনো একটি মুহূর্তেই পূর্বস্মৃতিময় নয়। আমার ধারণক্ষমতা যত ক্ষুদ্রই হোক, প্রকৃতি যখন তাতে টোকা দেয়, জোরে দেয় বা আস্তে, সংগোপনে, কানে কানে, ইশারা-ইঙ্গিতে দেয়, আমি কি তখন বিচ্ছিন্ন থাকি প্রকৃতি থেকে—স্বতন্ত্র, আমিময়? অস্তিত্বের মর্মমূল থেকে কে যেন আমার অজান্তেই সাড়া দিয়ে ফেলে। তখন কী করা, হতবাক হওয়ারই পালা। কে আমি? এ প্রশ্ন প্রকৃতির মতো অকপটে আর তো কেউ করে না। তাই তো তপ্ত মধ্যদিনে শুনতে পাই, অবিকল শুনতে পাই, গুমরে ওঠা কান্নার মতো পৃথিবীর হূৎপিণ্ড মোচড়ানো শব্দ। আবার এই নীরব-নিঃশব্দ কান্নার ভেতরেই হঠাৎ চমকে শিউরে উঠি। জানালার এপারে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকি। কালচে সবুজ ঝাঁকড়ামাথা অচিন গাছ; ঠাসবুনোট পাতার গায়ে চকচকে গাঢ়-বেগুনি ফুলগুলো কোন রহস্যের অন্তরাল থেকে খুদে পাপড়ি মেলে এমন বিস্ময়কর হয়ে উঠল! শিউরেই উঠি।
কত কিছুতেই না শিউরে উঠি। রোদজ্বলা রাস্তার পাশে ছেঁড়া-খোঁড়া ছায়ায় পা জুড়ে বসেছে প্রায়-বৃদ্ধ অন্ধ ভিক্ষুক। পাখির ছানার মতো হাঁ-করা মুখটা সামনে বাড়ানো, আর সেই হাঁ-মুখে ছ-সাত বছরের শিশুকন্যা পুরে দিচ্ছে পাউরুটির টুকরো। অন্ধ পিতার আহার শেষ, মুখ মুছে নিচ্ছে কাঁধের ময়লা গামছায়, কিন্তু কন্যা নাছোড়—এই শ্যাষ বাজান, এই শ্যাষ বলে অবশিষ্ট একটি মাত্র রুটির টুকরো আঁটো মুখে পুরবে বলে কী সাধাসাধি! এসব ও আরও এমন অজস্র কত কিছু নিয়েই তাপদগ্ধ একেকটা মধ্যাহ্ন। গুমরে ওঠা কান্নাটা যে উঠে পৃথিবীর হূৎপিণ্ড মুচড়ে, তা হয়তো এমনি এমনি না।
কিন্তু শুধুই নীরব কান্নায় প্রকৃতি সান্ত্বনা খুঁজবে, তা কি হয়! তাই তো স্থবির মধ্যাহ্ন-অপরাহ্নের পথে গড়াতে না-গড়াতে আচমকাই চারদিক ঘোরকালো। অপেক্ষা করি, শন্ শন্ হাওয়া বইবে এখনই, বজ্র-বিদ্যুতে চৌচির হবে আকাশ। শ্রবণশক্তি সত্ত্বেও যারা বধির, স্নায়বিক দুর্বলতা নেই, তবু তন্দ্রালস, এবার তাদেরও জেগে ওঠার পালা। অপেক্ষা করি, বজ্র-শিলাসহ নামবে বৃষ্টি। এমন রাগী নাগরিক বৃষ্টিকে ছবির পর ছবি এঁকে দেখিয়েছিলেন প্রিয় কবি শহীদ কাদরী—সেও কতকাল আগে। এ বৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের ধারাবরিষণ নয়। কাদরীর বৃষ্টি সন্ত্রাস হানে, সন্ত্রস্ত জনমানুষ ছুটে পালায় ‘ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মতো’। শুধু ধুয়ে-মুছে ক্ষান্ত হওয়ার নয় এ বৃষ্টি। মড়কে শহর উজাড় করে দেওয়ার ভয় দেখায়, মহাজ্ঞানী-মহাজন-মোসাহেবসহ সভ্যতার ভবিতব্যহীন স্মৃতিকেও নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।
মনে হয় আমার অপেক্ষায় আমি একা, নিঃসঙ্গ নই। এই বৈশাখে এমন বৃষ্টির অপেক্ষায় গোটা স্বদেশ। শক্তি-সামর্থ্যহীন, ক্ষমতাহীন স্বজনের একই প্রার্থনা, বৃষ্টির কাছে—যেন ধেয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলাদের দিগ্বিদিক ছুটিয়ে। গর্তে ঢুকিয়ে পারে তো গর্তের মুখটা যেন বুজে দেয়।

No comments

Powered by Blogger.