বিশেষ সাক্ষাৎকার-বিচার বিভাগ নিয়ে বিতর্ক কাম্য নয় by মাহ্বুবে আলম

অধস্তন আদালতের একটি নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মুখোমুখি অবস্থানে। কমিটি সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রারের কাছে চিঠি লিখে পদায়নের ব্যাপারে তথ্য জানতে চেয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট মনে করেন, এটি সংসদীয় কমিটির এখতিয়ারবহির্ভূত।


এ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। দুজনের দুটি সাক্ষাৎকার ছাপা হলো।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো  সংসদ ও বিচার বিভাগের সার্বভৌমত্ব নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মাহ্বুবে আলম  আমাদের সংবিধান লিখিত। এতে লেখা আছে, রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা জনগণের। জনগণের পক্ষ থেকে সরকার এটা চালনা করে। সংবিধানে তিনটি বিভাগ রয়েছে। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ। প্রতি বিভাগে আলাদা আলাদা অনুচ্ছেদ আছে। তিনটি বিভাগের ক্ষমতা লেখা আছে। কোনো আইন প্রণয়নের পর যদি দেখা যায়, এটা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, তাহলে সে আইন বাতিল করার এখতিয়ার বিচার বিভাগের আছে। অনুরূপভাবে কোনো বিচারক যদি দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হন, তাঁর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সংবিধানেই ব্যবস্থা আছে। সেটা হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। আর নির্বাহী বিভাগকে সংসদে জবাবদিহি করতে হয়। সংবিধানেই লেখা আছে, মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের কাছে জবাবদিহি করবে। কিন্তু বিচার বিভাগের বিষয়ে এ রকম কোনো বিধান সংবিধানে লেখা নেই। তবে বিচার বিভাগ যে সব রকম দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে, সেটাও বলা যাবে না।
প্রথম আলো  বিচারিক বিষয়ে সংসদের কাছে জবাবদিহির প্রশ্নই আসে না। প্রশ্ন হলো, তাদের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয় সংসদীয় কমিটিতে আলোচিত হতে পারে কি না। ২০০ বিচারককে ডিঙানোর পরামর্শ নির্বাহী আদেশেই ঘটেছে। আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের একটি কমিটি পরামর্শ দেয়। এর সঙ্গে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন কী করে আসে?
মাহ্বুবে আলম  নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি ও কর্মস্থল নির্ধারণ এখনো আইন মন্ত্রণালয়ই করে থাকে। তবে হ্যাঁ, তারা বিচার বিভাগের সম্মতি নেয়। তর্কিত আদেশটি জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। তারা যেহেতু সংসদীয় কমিটির কাছে নানাভাবে দায়বদ্ধ, তাই তাদের কাছে স্থায়ী কমিটি ও সংসদ এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, বিচার বিভাগের কোনো লোককে সংসদীয় কমিটি ডেকে নিতে পারে কি না।
প্রথম আলো  সংসদীয় কমিটির সভাপতি সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেছেন যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে ডাকা হয়নি। এর আগে সংসদীয় কমিটিতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার স্বেচ্ছায় গিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তখন প্রশ্ন না উঠলে এখন উঠবে কেন?
মাহ্বুবে আলম  না, মূল প্রশ্ন হলো আমাদের লিখিত সংবিধান। প্রতিটি বিভাগই তার নিজস্ব ক্ষমতায় বলীয়ান। বিচার বিভাগসহ অন্য দুটি বিভাগকেও সংবিধানের আওতায় থেকে কাজ করতে হয়। আমাদের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের, সেটাই মূল কথা। একটি অঙ্গ সার্বভৌম এবং অন্য অঙ্গের ওপরে তার কর্তৃত্ব থাকবে, সেটা সংবিধান বলে না। কাজেই এ প্রসঙ্গটা তোলারই কোনো অর্থ হয় না যে কে সার্বভৌম, কে অধীনস্থ। সবারই স্মরণ রাখা উচিত, সাংবিধানিক বিধানে কী আছে।
প্রথম আলো  যদি মাসদার হোসেন ও পঞ্চম সংশোধনীর মামলার রায় অনুযায়ী ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারকদের বদলি, নিয়োগ ও কর্মস্থল নির্ধারণ পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত করা হয়, তাহলে কি এ-সংক্রান্ত আলোচনার অধিকার কি সংসদীয় কমিটির থাকবে না?
মাহ্বুবে আলম  বিচার বিভাগ কিছু কিছু বিষয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা-ও বিচারিক কাজের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। কাজেই আমি মুখ্যভাবে যে কথা বলতে চাই, তিনটি অঙ্গের ভেতরে সার্বভৌমত্বের যে প্রশ্ন, তার অবতারণা করা সঠিক নয়। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী মহোদয় যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে আমি একমত।
প্রথম আলো  আইনমন্ত্রী বলেছেন সংসদ সার্বভৌম নয়। সেটা ঠিক কথা হলে সুপ্রিম কোর্টও সার্বভৌম নয়।
মাহ্বুবে আলম  তিনি যেটা বলেছেন সেটা হলো, তিনটি অঙ্গই সংবিধান দ্বারা পরিচালিত। তিনটি অঙ্গ যার যার দায়িত্ব পালন করবে। কারও কাজে যদি কোনো বিচ্যুতি বা গাফিলতি থাকে, তাহলে তার প্রতিকারের উপায় সংবিধানেই উল্লেখ করা আছে।
প্রথম আলো  সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট যদি নিম্ন আদালতের বিচারকদের তদারকির বিষয়ে সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি বা কথাবার্তা না বলেন, তাহলে তাঁরাই বলুন কীভাবে তাঁরা এর সুরাহা করবেন।
মাহ্বুবে আলম  বিচারকদের বদলি ও কর্মস্থল নির্ধারণ কিন্তু হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয় থেকে।
প্রথম আলো  না। সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন না পেলে তাদের সেটা করার কথা নয়।
মাহ্বুবে আলম  হ্যাঁ, তাদের সম্মতি নিতে হয়, কিন্তু আসল প্রস্তাবটা তো আসে আইন মন্ত্রণালয় থেকে। এখন তারা তো সব সময়ই সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করছে। সংসদে আইনমন্ত্রী প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমেও জবাবদিহি করছেন।
প্রথম আলো  আইন মন্ত্রণালয় কাজটা একা করছে না। একজন বিচারকের কর্মস্থল কোথায় হবে, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থানই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আপিল বিভাগই বলেছেন, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শই প্রাধান্য পাবে। আপনি কি এমন একটি অবস্থার কথা ভাবতে পারেন যে সংসদীয় কমিটির সামনে সুপ্রিম কোর্টের কেউ কোনো কারণেই হাজির হবেন না?
মাহ্বুবে আলম  এ প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমত্বের দাবি অবান্তর। রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে একটি বলবে আমি সার্বভৌম, তুমি আমার অধীন, এ ধারণা ঠিক নয়।
প্রথম আলো  সংসদীয় কমিটি যে কারণে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রারের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে, সে বিষয়ে আপনি কোনো মন্তব্য করবেন কি? বিচারকদের বদলির বিষয়ে নীতিমালা করবে কে? আইন মন্ত্রণালয় না সুপ্রিম কোর্ট?
মাহ্বুবে আলম  এ বিষয়ে সাধারণভাবে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। লক্ষ করছি, আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বগুলো নির্দিষ্ট করা আছে। সংসদীয় কমিটির দায়িত্বগুলো সেভাবেই নির্দিষ্ট করা আছে। একজন সাংসদ, একজন উপজেলা চেয়ারম্যান কী করবেন বা করবেন না, তা নির্দিষ্ট করা আছে। আমি এটাই বলব যে আত্মসংযম বলে একটা কথা আছে। নিজেকে সংযত রাখা। ক্ষমতা যত সংযতভাবে ব্যবহার করা হবে, প্রত্যেকের মহত্ত্ব ততই প্রকাশ পাবে। এ বিষয়টি সবারই মানা উচিত।
প্রথম আলো  তাহলে আপনি আত্মসংযমের ওপরই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন।
মাহ্বুবে আলম  আমি তা-ই মনে করি। আত্মসংযমের দিকেই সবার যত্নশীল হওয়া উচিত। হতে পারে কোনো একটি নিয়োগ আমার কাছে পছন্দনীয় না-ও হতে পারে। হতে পারে, সেই নিয়োগের বিষয়ে কোনো ভুলত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে এসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের যে আস্থা আছে, সেটা নষ্ট করে ফেললে মহাসর্বনাশ হবে। চূড়ান্ত অর্থে একটি দেশের উন্নয়ন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চাকরির নিরাপত্তা, মানুষের নিরাপত্তা সবকিছু নির্ভর করে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থার ওপর। এটা যদি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে খুব ক্ষতি হবে। আপনি লক্ষ করবেন, বিশ্বে এমন বহু দেশ আছে যেখানে মানুষ কিছুতেই বিনিয়োগ করতে যায় না। আবার এমন অনেক দেশ আছে যাদের নীতির বিষয়ে সমালোচনা থাকতে পারে। তদুপরি দেখা যায়, মানুষ সেখানে গিয়ে সম্পত্তি কেনে। সেখানে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখতে পাঠায়। অথচ তারা নৈতিকভাবে তাদের অনেক কাজ অনুসরণ করে না। কেন? তার কারণ, সেখানকার বিচার বিভাগ প্রচণ্ডভাবে শক্তিশালী। যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থায় পৌঁছে গেছে সেখানে তাদের প্রধান বিচারপতি মার্শালের বিরাট অবদান আছে। মারবারি বনাম মেডিসন মামলার রায়ের মাধ্যমে তিনি বিচার বিভাগের একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করেছেন। এবং সেই রায়ে মুখ্য কথাটা এসেছে সংসদ বা নির্বাহী বিভাগ, যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে না। তাদের কাজ যাচাই-বাছাইয়ের এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আছে। তাই বলছি, এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করে কোনো নিয়োগ ঠিক না হলে তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে যে কেউ তো মামলাও করতে পারত।
প্রথম আলো  আগের মতো সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার যদি কমিটিতে গিয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য দিতেন, তাহলে তা কি সংবিধানের চেতনা নস্যাৎ হতো?
মাহ্বুবে আলম  আমি যেটুকু বুঝি, স্থায়ী কমিটি হলো মন্ত্রণালয়ের ওয়াচডগ।
প্রথম আলো  অনেকের মতে, যখনই বিচার বিভাগের সঙ্গে সংসদের শ্রেষ্ঠত্বের কোনো তর্ক আসে, তখন আইনজীবী মহল বিচার বিভাগের পক্ষ নেয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক হয়ে যায়।
মাহ্বুবে আলম  তিনটি বিভাগের মধ্যে সংসদ পাঁচ বছর অন্তর বদলায়। মন্ত্রিসভা আসে সংসদ থেকে। কিন্তু বিচারকেরা নির্দিষ্ট বয়সসীমা পর্যন্ত পদে বহাল থাকেন। তাঁরা সংবিধানে নির্দিষ্ট করা দায়িত্ব পালন করেন। আমরা আইনজীবীরাও সংবিধানে যা লেখা আছে, সে অনুযায়ী কথা বলি। কোনো আবেগ বা সস্তা জনপ্রিয় হওয়ার ইচ্ছে অন্তত জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের থাকার কথা নয়। বিচারকেরা যখন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তখন আমরা তার সমালোচনা করি। আদালত বর্জন করি। সুতরাং আপনি যেটা বলছেন সেটা সত্য নয়। আমরা যদি প্রতিষ্ঠানটিকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাই, তাহলে তা ভয়ংকর পরিস্থিতি ডেকে আনবে। জনগণের আস্থা, জনগণের মানসম্মানের চূড়ান্ত জায়গা হচ্ছে বিচার বিভাগ।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ
মাহ্বুবে আলম  ধন্যবাদ

No comments

Powered by Blogger.