স্মরণ-বিজ্ঞানমনস্ক মোজাফ্ফর হোসেন by যতীন সরকার
দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন মোজাফ্ফর হোসেন। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিনে। এদিনের আগ পর্যন্ত ১৮ মাস আমি ময়মনসিংহ কারাগারে বিনা বিচারে আটক ছিলাম। হাইকোর্টের নির্দেশে যেদিন আমি মুক্তি পেয়ে বাসায় ফিরে এলাম, সেদিনই মোজাফ্ফর সাহেব আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
এর মাত্র কয়েক দিন আগেই তিনি দিনাজপুর থেকে বদলি হয়ে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে যোগদান করেছিলেন।
পরিচয়ের প্রথম দিনেই আমরা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম এবং আমাদের সেই বন্ধুত্ব ক্রমেই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠেছিল। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা গত জুলাই মাসে (২০১০)। সে সময় আমি ঢাকার পান্থপথে অবস্থিত ‘হেলথ অ্যান্ড হোপ’ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শয্যাপাশে তিনি প্রায় তিন ঘণ্টা ছিলেন। আমরা দুজনই সেদিন অনেক কথা বলেছিলাম। কিন্তু তখন কি জানতাম যে এর কয়েক মাসের মধ্যেই মোজাফ্ফর আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যাবেন! ডিসেম্বরের ৭ তারিখেই তাঁর ভাই মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুর কাছ থেকে খবর পেলাম যে সেদিন বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মোজাফ্ফর ও আমি প্রায় সমবয়সী। তাঁর বয়স ছিল ৭৫।
দীর্ঘদিন থেকেই তিনি ডায়াবেটিস ও হূদেরাগে ভুগছিলেন। অনেকের ধারণা, হূদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচার করালে আরও কয়েক বছর তিনি বেঁচে থাকতেন হয়তো। কিন্তু অস্ত্রোপচার করাতে তিনি রাজি হননি। কারণ, অস্ত্রোপচারমূলক চিকিৎসাকে তিনি বিজ্ঞানসম্মত বলেই মনে করতেন না। সে রকম মনে করাটা সঠিক ছিল কি না, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারব না। তবে আমি জানি, তাঁর সমস্ত হূদয়-মন ছিল বিজ্ঞানচেতনায় স্নাত। অনেক বিজ্ঞানীও তো প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক নন। দর্শনবিজ্ঞানে প্রচুর পাণ্ডিত্য অর্জন করেও তো অনেকে অনেক কুসংস্কারকে লালন করেন। মোজাফ্ফর তাঁদের দলভুক্ত ছিলেন না। জীবন ও জগতের সবকিছুকেই তিনি বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে চাইতেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ঘনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন তিনি। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ না করলে কোনো কিছুরই প্রকৃত সত্য সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায় না—এমনই ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।
এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই আমরা দুজন একসঙ্গে বসে অনেক নতুন-পুরোনো বই পাঠ করেছি এবং সেসব বই থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদসম্মত বৈজ্ঞানিক সত্য আহরণ করে নিতে চেষ্টা করেছি। এভাবেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুশীলন ধর্মতত্ত্ব পাঠ করেও আমরা নতুনভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছি। যে বঙ্কিম কারও দৃষ্টিতে ঋষি এবং কারও দৃষ্টিতে জঘন্য সাম্প্রদায়িক অথবা প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদী, সেই বঙ্কিমই যে ‘ধর্ম’ ও ‘রিলিজিয়ন’কে সমার্থক মনে করতেন না; জনৈক পাশ্চাত্য মনীষীর অনুসরণে তিনি যে বলেছিলেন, ‘মানববৃত্তির সম্যক অনুশীলনই ধর্ম’; শারীরিক বৃত্তি, জ্ঞানার্জনই বৃত্তি, কার্যকারিণী বৃত্তি ও চিত্তরঞ্জনী বৃত্তি—এই বৃত্তিগুলোর যথাযথ বিকাশ ঘটিয়েই যে মানুষ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে এবং মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনাই যে মানুষের আসল ধর্মসাধনা—বঙ্কিমের এসব কথাকে মোজাফ্ফর একান্ত সংগত ও বিজ্ঞানসম্মত বলেই গ্রহণ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের রচনার একজন সনিষ্ঠ ও অনুরাগী পাঠক ছিলেন তিনি। দেবীপ্রসাদ যে ভাববাদী মনীষীদের রচনা থেকেও বস্তুবাদের অন্তঃসার নিংড়ে বের করে নিতেন, মোজাফ্ফরও সে রকম করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর প্রথম দিকের রচনায় দেবীপ্রসাদের চিন্তারই শুধু অনুসৃতি ছিল না, তাঁর ভাষাভঙ্গিতেও দেবীপ্রসাদেরই ছায়াপাত ঘটেছিল। এরপর অবশ্য তিনি নিজস্ব ও প্রসাদগুণসম্পন্ন একটি ভাষারীতিও আয়ত্ত করে নিতে পেরেছিলেন। পাভলভীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে তিনি সর্বপ্রকার ছদ্মভাববাদী ও যান্ত্রিক বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানের ভ্রান্তিগুলো পরিহার করতে পেরেছিলেন। এতে তাঁর চিন্তায় আরও স্বচ্ছতার সঞ্চার ঘটে। ফরাসি পণ্ডিত গিয়ামের ইসলাম ও জর্জ টম্পসনের মার্ক্সবাদ ও কবিতা বই দুটি তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর আরও অনেক রচনা এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলোকে একত্রে সন্নিবেশ করে প্রকাশ করা খুবই প্রয়োজন। তাহলে এ দেশের পাঠক প্রকৃত বিজ্ঞানচেতনাসমৃদ্ধ প্রাঞ্জল রচনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে।
ময়মনসিংহ শহরে আমরা দুজন পাশাপাশি বাস করেছি ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকে তাঁর চিন্তাচেতনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি খুবই উপকৃত হয়েছি। শুধু আমি নই, ময়মনসিংহ শহরের আরও অনেকেই তাঁর ভাবনার স্রোতধারায় অবগাহন করে পরিশুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। আমরা এখানে ‘মুক্তবাতায়ন পাঠচক্র’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। সেই সংগঠনটিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটানোয় তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। স্নিগ্ধ অথচ সরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটির সংস্পর্শে যারাই এসেছে, তারাই মুগ্ধ ও ধন্য হয়ে গেছে। অনেক কঠিন কথাকেও সহজে উপস্থাপন করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। সেই ক্ষমতাবলেই তিনি আমাদের পাঠচক্রটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন। মুক্তবাতায়ন পাঠচক্রের মাধ্যমেই দীর্ঘদিন ধরে ময়মনসিংহ শহরে মুক্তবুদ্ধিচর্চার বিস্তার ঘটেছে। সেই চর্চার ফলেই সে শহরে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রবাহটি অনেক বেগবান হয়ে উঠেছে। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সদর্থক প্রভাব এখানকার রাজনীতিকেও কলুষমুক্ত রাখতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
আনন্দমোহন কলেজে ১৫-১৬ বছর অধ্যাপনা করার পর বদলি হয়ে মোজাফ্ফর ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় চলে যান। কিছুদিন একটি মফস্বল কলেজে তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের শেষ বছরগুলো ঢাকায়ই কাটান। ঢাকায় দীর্ঘদিন তিনি ‘বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ’-এর সভাপতি ছিলেন। বিজ্ঞানচেতনার প্রসারে এ প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা মোটেই অবহেলা করার মতো নয়। বিশেষ করে তরুণসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়। অসুস্থ দেহেও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোজাফ্ফর বিজ্ঞানচেতনা পরিষদের দায়িত্ব পালন করে চলছিলেন। আগামী দিনগুলোতে এই পরিষদের কর্মীরা সারা দেশে বিজ্ঞানচেতনার প্রসার ঘটিয়ে মোজাফ্ফরের স্মৃতিকে অমলিন রাখবেন বলেই আমি বিশ্বাস করি। অবৈজ্ঞানিক ও পশ্চাৎপদ ভাবনার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সমাজকে বাঁচানোর জন্য মোজাফ্ফর হোসেনের মতো বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ভাবনা ও কর্মের প্রবাহকে অগ্রসর করে নিতেই হবে।
যতীন সরকার: শিক্ষাবিদ, লেখক।
পরিচয়ের প্রথম দিনেই আমরা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম এবং আমাদের সেই বন্ধুত্ব ক্রমেই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠেছিল। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা গত জুলাই মাসে (২০১০)। সে সময় আমি ঢাকার পান্থপথে অবস্থিত ‘হেলথ অ্যান্ড হোপ’ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শয্যাপাশে তিনি প্রায় তিন ঘণ্টা ছিলেন। আমরা দুজনই সেদিন অনেক কথা বলেছিলাম। কিন্তু তখন কি জানতাম যে এর কয়েক মাসের মধ্যেই মোজাফ্ফর আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যাবেন! ডিসেম্বরের ৭ তারিখেই তাঁর ভাই মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুর কাছ থেকে খবর পেলাম যে সেদিন বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মোজাফ্ফর ও আমি প্রায় সমবয়সী। তাঁর বয়স ছিল ৭৫।
দীর্ঘদিন থেকেই তিনি ডায়াবেটিস ও হূদেরাগে ভুগছিলেন। অনেকের ধারণা, হূদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচার করালে আরও কয়েক বছর তিনি বেঁচে থাকতেন হয়তো। কিন্তু অস্ত্রোপচার করাতে তিনি রাজি হননি। কারণ, অস্ত্রোপচারমূলক চিকিৎসাকে তিনি বিজ্ঞানসম্মত বলেই মনে করতেন না। সে রকম মনে করাটা সঠিক ছিল কি না, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারব না। তবে আমি জানি, তাঁর সমস্ত হূদয়-মন ছিল বিজ্ঞানচেতনায় স্নাত। অনেক বিজ্ঞানীও তো প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক নন। দর্শনবিজ্ঞানে প্রচুর পাণ্ডিত্য অর্জন করেও তো অনেকে অনেক কুসংস্কারকে লালন করেন। মোজাফ্ফর তাঁদের দলভুক্ত ছিলেন না। জীবন ও জগতের সবকিছুকেই তিনি বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে চাইতেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ঘনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন তিনি। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ না করলে কোনো কিছুরই প্রকৃত সত্য সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায় না—এমনই ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।
এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই আমরা দুজন একসঙ্গে বসে অনেক নতুন-পুরোনো বই পাঠ করেছি এবং সেসব বই থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদসম্মত বৈজ্ঞানিক সত্য আহরণ করে নিতে চেষ্টা করেছি। এভাবেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুশীলন ধর্মতত্ত্ব পাঠ করেও আমরা নতুনভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছি। যে বঙ্কিম কারও দৃষ্টিতে ঋষি এবং কারও দৃষ্টিতে জঘন্য সাম্প্রদায়িক অথবা প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদী, সেই বঙ্কিমই যে ‘ধর্ম’ ও ‘রিলিজিয়ন’কে সমার্থক মনে করতেন না; জনৈক পাশ্চাত্য মনীষীর অনুসরণে তিনি যে বলেছিলেন, ‘মানববৃত্তির সম্যক অনুশীলনই ধর্ম’; শারীরিক বৃত্তি, জ্ঞানার্জনই বৃত্তি, কার্যকারিণী বৃত্তি ও চিত্তরঞ্জনী বৃত্তি—এই বৃত্তিগুলোর যথাযথ বিকাশ ঘটিয়েই যে মানুষ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে এবং মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনাই যে মানুষের আসল ধর্মসাধনা—বঙ্কিমের এসব কথাকে মোজাফ্ফর একান্ত সংগত ও বিজ্ঞানসম্মত বলেই গ্রহণ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের রচনার একজন সনিষ্ঠ ও অনুরাগী পাঠক ছিলেন তিনি। দেবীপ্রসাদ যে ভাববাদী মনীষীদের রচনা থেকেও বস্তুবাদের অন্তঃসার নিংড়ে বের করে নিতেন, মোজাফ্ফরও সে রকম করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর প্রথম দিকের রচনায় দেবীপ্রসাদের চিন্তারই শুধু অনুসৃতি ছিল না, তাঁর ভাষাভঙ্গিতেও দেবীপ্রসাদেরই ছায়াপাত ঘটেছিল। এরপর অবশ্য তিনি নিজস্ব ও প্রসাদগুণসম্পন্ন একটি ভাষারীতিও আয়ত্ত করে নিতে পেরেছিলেন। পাভলভীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে তিনি সর্বপ্রকার ছদ্মভাববাদী ও যান্ত্রিক বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানের ভ্রান্তিগুলো পরিহার করতে পেরেছিলেন। এতে তাঁর চিন্তায় আরও স্বচ্ছতার সঞ্চার ঘটে। ফরাসি পণ্ডিত গিয়ামের ইসলাম ও জর্জ টম্পসনের মার্ক্সবাদ ও কবিতা বই দুটি তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর আরও অনেক রচনা এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলোকে একত্রে সন্নিবেশ করে প্রকাশ করা খুবই প্রয়োজন। তাহলে এ দেশের পাঠক প্রকৃত বিজ্ঞানচেতনাসমৃদ্ধ প্রাঞ্জল রচনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে।
ময়মনসিংহ শহরে আমরা দুজন পাশাপাশি বাস করেছি ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকে তাঁর চিন্তাচেতনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি খুবই উপকৃত হয়েছি। শুধু আমি নই, ময়মনসিংহ শহরের আরও অনেকেই তাঁর ভাবনার স্রোতধারায় অবগাহন করে পরিশুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। আমরা এখানে ‘মুক্তবাতায়ন পাঠচক্র’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। সেই সংগঠনটিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটানোয় তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। স্নিগ্ধ অথচ সরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটির সংস্পর্শে যারাই এসেছে, তারাই মুগ্ধ ও ধন্য হয়ে গেছে। অনেক কঠিন কথাকেও সহজে উপস্থাপন করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। সেই ক্ষমতাবলেই তিনি আমাদের পাঠচক্রটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন। মুক্তবাতায়ন পাঠচক্রের মাধ্যমেই দীর্ঘদিন ধরে ময়মনসিংহ শহরে মুক্তবুদ্ধিচর্চার বিস্তার ঘটেছে। সেই চর্চার ফলেই সে শহরে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রবাহটি অনেক বেগবান হয়ে উঠেছে। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সদর্থক প্রভাব এখানকার রাজনীতিকেও কলুষমুক্ত রাখতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
আনন্দমোহন কলেজে ১৫-১৬ বছর অধ্যাপনা করার পর বদলি হয়ে মোজাফ্ফর ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় চলে যান। কিছুদিন একটি মফস্বল কলেজে তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের শেষ বছরগুলো ঢাকায়ই কাটান। ঢাকায় দীর্ঘদিন তিনি ‘বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ’-এর সভাপতি ছিলেন। বিজ্ঞানচেতনার প্রসারে এ প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা মোটেই অবহেলা করার মতো নয়। বিশেষ করে তরুণসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়। অসুস্থ দেহেও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোজাফ্ফর বিজ্ঞানচেতনা পরিষদের দায়িত্ব পালন করে চলছিলেন। আগামী দিনগুলোতে এই পরিষদের কর্মীরা সারা দেশে বিজ্ঞানচেতনার প্রসার ঘটিয়ে মোজাফ্ফরের স্মৃতিকে অমলিন রাখবেন বলেই আমি বিশ্বাস করি। অবৈজ্ঞানিক ও পশ্চাৎপদ ভাবনার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সমাজকে বাঁচানোর জন্য মোজাফ্ফর হোসেনের মতো বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ভাবনা ও কর্মের প্রবাহকে অগ্রসর করে নিতেই হবে।
যতীন সরকার: শিক্ষাবিদ, লেখক।
No comments