তোতো by দীপু মাহমুদ

তানিয়া খুব অবাক হয়ে খাঁচার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। খাঁচা ফাঁকা। পাখিটা নেই। তানিয়া বারান্দার গ্রিলের দিকে তাকাল। না, সেখানেও নেই। পাখিটা যত দিন ধরে খাঁচায় আটকা, তাতে তার ওড়ার ক্ষমতা থাকার কথা নয়।
দীপ্রটা হয়েছে বড্ড বেখেয়াল।


তানিয়া ভাবল, সকালে পাখিটাকে খাবার দিয়েছিল কি না, কে জানে। নাকি খাবার দিয়ে খাঁচার দরজা খোলা রেখেছিল! তানিয়া চিৎকার করে ডাকল, দীপ্র!
হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর স্কুল বন্ধ। দীপ্রর এখন অখণ্ড অবসর। গল্পের বই পড়া ওর নেশার মতো। সময় পেলে ছবিও আঁকে। মাঝেমধ্যে কোনো একটা সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে মেতে থাকে। এখন মেতে আছে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল তৈরি নিয়ে। বৃষ্টি আর মেঘ খুবই ডিস্টার্ব করছে ওকে। গতকাল সারা দিন বৃষ্টি হয়েছে। ঝমঝম করে, ফিসফিস করে, টিপটিপ করে। আজ আবার আকাশের মন খারাপ। গোমড়া মুখ করে আছে। কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। এক্ষুনি যেন ঝরঝর করে কেঁদে দেবে। এই ছিঁচকাঁদুনে আকাশটার ওপর বড়ই বিরক্ত দীপ্র।
তানিয়া ঘরের ভেতরটা দেখতে দেখতে আবার ডাকল, দীপ্র!
রাতুল জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
তানিয়া এবার সত্যি রাগল। বলল, ‘দেখো তো, ছেলেটা দিন দিন দুষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কথা শোনে না একেবারে।’ বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে ডাকল, ‘দীপ্র!’
রাতুল দীপ্রর ঘরের ভেতর উঁকি দিল। দীপ্র পুব দিকের জানালার পাশে উবু হয়ে বসে আছে। ওর সামনে ছড়ানো-ছিটানো ইলেকট্রিক তার, সিলিকনের পাত, স্ক্রু-ড্রাইভারসহ আরও অনেক কিছুর জঞ্জাল। রাতুল বলল, ‘দীপ্র! মা তোমাকে ডাকে, বাবা। মায়ের কথা শোনো।’
দীপ্র শরীর দোলাতে দোলাতে বাঁ হাতটা বাবার দিকে প্রসারিত করে বলল, ‘আসছি, আসছি।’
রাতুল এগিয়ে গিয়ে দীপ্রর কাঁধের ওপর হাত রাখল। বলল, ‘আসছি না, আসো। মা কখন থেকে ডাকছেন না, তোমাকে! উত্তর দিচ্ছ না কেন?’
একঝটকায় উঠে লাফ দিয়ে এসে মায়ের সামনে দাঁড়াল দীপ্র। বলল, ‘বলো, কী হয়েছে?’
তানিয়া বলল, ‘সকালে পাখিকে খাবার দিয়েছিলি।’
দীপ্র বলল, ‘ও হো! একেবারে ভুলে গেছি।’ বলেই দৌড়ের ভঙ্গিতে ঝট করে খাঁচার ওদিকে যাওয়ার জন্য ঘুরে গেল।
তানিয়া বলল, ‘পাখিটা খাঁচায় নেই।’
রাতুল দেখল, পাখির খাঁচার দরজা খোলা। খাঁচার ভেতর পাখি নেই।
রাতুল বলল, ‘ওর মনে হয় খাঁচায় আটকা থাকতে আর ভালো লাগছিল না। অনেক দিন হয়ে গেল এই ছোট্ট খাঁচাটা ওর পৃথিবী হয়ে গেছে। আজ নিজে খাঁচার দরজা খুলে উড়ে গেছে মুক্ত আকাশে।’
তানিয়া বলল, ‘তুমি দেখেছ, ও নিজে দরজা খুলে উড়ে গেছে?’
রাতুল বলল, ‘ধারণা করছি।’
দীপ্র বলল, ‘বাবা, ওকে আমরা কত আদর করতাম। কত ভালো ভালো খাবার দিতাম। গতকালও ওকে আমি ছাদে নিয়ে গিয়ে বৃষ্টির পানিতে গোসল করিয়ে এনেছি। ও তাহলে আমাদের ছেড়ে চলে গেল কেন?’
রাতুল বলল, ‘হয়তো গতকাল যখন বৃষ্টির পানিতে গোসল করছিল, তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে পাখিটার মনে হয়েছিল মুক্ত আকাশে অঝোর ধারায় ভেজার আনন্দই অন্য রকম।’
দীপ্র বলল, ‘বাবা! পাখিরা কি মানুষের কথা বুঝতে পারে?’
রাতুল বলল, ‘হুঁ, পারে।’
‘আমি ওর একটা নাম দিয়েছিলাম। কাউকে বলিনি। তোতো। নাম ধরে ডাকলে পাখিটা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাত। তোতো আমার কথা বুঝত। আমি যখন পাকা পেয়ারা টুকরো করে নিয়ে গিয়ে ডাকতাম, তোতো এসে খাঁচার ভেতর থেকে ঠোঁট বের করে আমার হাত থেকে পেয়ারা খেত।’
তারপর খুব মন খারাপ করে দীপ্র বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোতো কেন চলে গেল, বাবা!’
‘মুক্ত আকাশ ওকে ডাকছিল। ওর দুটো পাখা তো ওড়ার জন্য। ওর ওড়ার সাধ হয়েছে। আকাশে। অনেক ওপরে উড়ে গেছে।’
‘ও কি আকাশেই থাকবে?’
‘না। একটা সবুজ ঘন গাছে ওর একটা ছোট্ট ঘর আছে। একেবারে নিজের ঘর। ইচ্ছে হলে বৃষ্টির সময় সেই ঘর থেকে ডানা বের করে বৃষ্টিতে ভেজাবে। ইচ্ছে হলে উড়ে যাবে আকাশে। আবার ফিরে আসবে সেই ঘরে।’
রাতে কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারছিল না দীপ্র। বারবার শুধু ওর তোতোর কথা মনে পড়ছিল। দীপ্র বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘পাখিটা কি আর ফিরে আসবে না, বাবা?’
রাতুল বলল, ‘তুমি কি একবারও পাখিটার কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছ ও কেমন আছে? ওর মনের ভেতর সারা দিন কী কথা বলে, ও কী চায়? বলো, তুমি জিজ্ঞেস করেছ কোনো দিন পাখিটাকে? তাহলে পাখিটা ফিরবে কেন?’
দীপ্র বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি পাখিটাকে খুব আদর করতাম। বিশ্বাস করো, বাবা। ও আমার আদর বুঝত। খাঁচার ভেতর আঙুল দিলে ঠোঁট বাড়িয়ে আমার হাতে আদর করে দিত। আচ্ছা বাবা, আমি যদি এখন জোরে জোরে ওর নাম ধরে ডাকি, পাখিটা ফিরে আসবে না?’
‘যে যায়, সে যায়। সে আর কখনো ফেরে না। তবুও ডেকে দেখো। যদি ফেরে।’
দীপ্র দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দূরে একটা গাছের দিকে তাকিয়ে লম্বা সুরে জোরে ডাকল, ‘তো-তো...।’
খুব মন খারাপ করে ঘুমুতে গেল দীপ্র। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই গেল পাখির খাঁচার কাছে। গিয়েই আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘বাবা! মা! তোতো ফিরে এসেছে। দেখে যাও।’
তানিয়া আর রাতুল বারান্দায় গিয়ে দেখে সত্যি দীপ্রর তোতো ফিরে এসেছে। পাখিটা বসে আছে খাঁচার ভেতর।

No comments

Powered by Blogger.