ধর নির্ভয় গান-নৈশব্দ থেকে অর্থবহ শব্দে! by আলী যাকের
হয়তো সময় এসেছে নৈশব্দ ও শব্দ নিয়ে অর্থ ও অনর্থের যে বিতর্ক, তার ওপরে নতুন করে কথা শুরু করার। হয়তো সময় এসেছে আমাদের বুকে হাত দিয়ে এই প্রতিজ্ঞা করার যে, যথাযথ কথা বলতে না পারি হয়তোবা, চুপ করে থাকতে তো পারব! আমাদের রাজনীতিবিদরা, যারা খামোখা কথা বলেন, তাদের উচিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে আমাদের ভবিষ্যৎকে ছেড়ে দেওয়া
শব্দের কোনো শেষ নেই। বিশ্বের কোথাও, কখনও শব্দের কোনো শেষ ছিল না। হবেও না কোনো দিন। নানা ধরনের শব্দ আমাদের প্রতিনিয়তই শ্রুতিগোচর হয়। এই শব্দের রকমভেদ নানা জায়গায় নানা রকম। কিছু শব্দ আছে, যা কেবল বড় বড় নগরগুলোতে আমরা প্রতিনিয়ত শুনতে পাই। এই শব্দগুলো কর্ণবিদারক। তবে বড় একঘেয়ে। যেমন_ পাকা রাস্তার ওপরে বড় গাড়ি চলার ঘর্ঘর শব্দ, ছোট গাড়ি চলার শোঁ শোঁ শব্দ, কারখানা চলার সাঁই সাঁই শব্দ, ট্রেনের ঘটাং ঘং শব্দ অথবা লোহার ওপরে লোহার বাড়ি মারার শব্দ। আমি গতবার সিঙ্গাপুর শহরে গিয়ে এ ধরনের শব্দের সঙ্গে আরও বিশদভাবে পরিচিত হয়েছি, এদের সঙ্গে সখ্য হয়েছে। আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে বসার ঘরের প্রশস্ত জানালা পথে ওই বড় শহরের এসব শব্দ প্রতিনিয়ত শুনতে পেতাম।
অবশ্য এ কথা সত্য যে, সব শহরে একই ধরনের শব্দ শোনা যায় না। আমাদের দেশের ছোটখাটো শহরগুলোতে অত্যন্ত বিশৃঙ্খল শব্দ আমাদের কানে আসে। বিশেষ করে কোনো ব্যস্ত রাস্তার পাশে জানালার ধারে যদি বসা যায়, তবে সেই শব্দ অনেক সময় সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় ব্রেকের আর্তনাদ, পাকা রাস্তার ওপর টায়ারের চিৎকার এবং তার পরেই একটি দুর্ঘটনার শব্দ আমাকে সচকিত করে। তখন আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করি কত বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ওই সব শহরের ব্যস্ত বাজারে গেলে নানা ধরনের শব্দ কানে আসে। বিক্রেতার চিৎকার, ক্রেতার দরকষাকষি, হঠাৎ মারপিট, কিংবা ইটপাথর ছোড়াছুড়ির শব্দ এসবের অন্তর্গত। ছোট শহরের শব্দ বিন্যাসে এ ধরনের বৈচিত্র্য বোধহয় সেই শহরগুলোকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে। যদিও কিছুদিন যাওয়ার পর ওগুলোকেও বিরক্তিকর বলে মনে হয়। তখন আমরা বুঝি নৈশব্দের শক্তি কত বেশি।
আজ অবশ্য আমি নীরবতা, নিস্তব্ধতা বা নৈশব্দ সম্বন্ধে লিখব বলে কলম ধরেছি। শুরুতেই উইলিয়াম শেক্সপিয়রের এক মহান উক্তির কথা মনে পড়ে গেল, যা তিনি তার 'হ্যামলেট' নাটকের শেষে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'এবং অতঃপর যা রইল, তা নিস্তব্ধতা'! এবারে আমি যখন সিঙ্গাপুরে ছিলাম, তখন এক বাংলাদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তিনি একটি ছোটখাটো ফ্যাক্টরিতে একজন দক্ষ মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন। যদিও আমি স্বভাবগতভাবে খুব একটা আলাপী নই, তবুও সুদূর প্রবাসে এক স্বদেশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ায় মনটা বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ভাবলাম একটু আলাপ করি। আমার দীর্ঘদিন ধরেই জানার ইচ্ছা ছিল যে, আমার দেশজ ভাইয়েরা বিদেশে কেমনভাবে দিন কাটান। ওই ভিনদেশি ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদি অবশ্যই তার নিজ দেশের চেয়ে অনেক ভিন্ন। আমার এই নব্য আবিষ্কৃত বন্ধু যা বললেন, তাতে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তিনি যা বললেন, তাতে মনে হলো যে যখন তারা ভিন দেশে থাকেন, তখন তারা একেবারেই নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে থাকেন। যেন এক একজন রেশমের গুটি। তারা ঘোরাফেরা করেন, কাজে যান, বাজার-সদাই করেন, কিন্তু এই প্রত্যেকটি কাজের পেছনে একটিই উদ্দেশ্য থাকে, আর তা হলো যে দেশে তারা থাকেন সে দেশে নিজের জীবনকে সহনীয় করে তোলা। সে দেশের মানুষ অথবা সমাজ কিংবা চারপাশের জীবন তাদের কখনও স্পর্শ করে না। তারা কাজে যান, ফিরে আসেন, রান্না করেন, আহার করেন এবং তাদের কষ্টার্জিত সব অর্থ, সামান্য কিছু খাই-খরচার জন্য রেখে, পাঠিয়ে দেন নিজের দেশে। আমার খুব জানার ইচ্ছা হলো যে, তারা বিনোদনের জন্য কী করে থাকেন। বিশেষ করে এমন একটি শহরে যেখানে নিজ ভাষার কোনো অনুষ্ঠানই তারা দেখতে পান না? আমার বন্ধু বললেন, যখন বাসায় থাকেন, তারা টেলিভিশন দেখেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, টেলিভিশনের অনুষ্ঠান কি বুঝতে পারেন? জবাবে বললেন, না, তারা কিছু বোঝেন না। কেননা ম্যান্দারিন কিংবা ইংরেজি ভাষা তাদের আয়ত্তে নেই। তারা টেলিভিশন দেখার সময় আওয়াজ বন্ধ করে দেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, তাহলে কী দেখেন? তিনি বললেন, অ্যাকশন দেখেন কিংবা দৃশ্যাবলি অথবা সুন্দর মানুষগুলোকে, তাদের বাসস্থান এবং আরও দেখেন তারা কত সুখী। তিনি আরও বললেন, বিজাতীয় শব্দ তার একেবারে পছন্দ নয়। ওই শব্দ শুনলে তার মাথা ধরে।
আমি আমার এই নতুন বন্ধুর কথা থেকে নিস্তব্ধতার আরও একটি সংজ্ঞা পেয়ে যাই। বহু বছর আগে আমার এক অতি প্রিয় ইংরেজি ভাষার লেখক অল্ডাস হাক্সলি সব অভিব্যক্তির ওপরে নিস্তব্ধতাকে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, অভিব্যক্তির দিক দিয়ে নৈশব্দের কাছাকাছি যদি কিছু আসতে পারে তা হচ্ছে সঙ্গীত। আমরা যত বেশিই বলি না কেন, নিস্তব্ধতার স্তুতি বলে শেষ করবার নয়। সঙ্গীত অত্যন্ত অভিব্যক্তিময়। কিন্তু নৈশব্দের পরেই তার স্থান। আমি ভাবি কত সত্য এ কথা। বিশেষ করে যখন আমরা যুক্তিহীন, কর্মকাণ্ডহীন, অযাচিত শব্দের ভারে প্রায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছি, তখন। আমরা মুহ্যমান হয়ে পড়েছি এক শব্দ দূষণ দ্বারা। এ যে কেবল পাকা রাস্তার ওপরে ব্রেকের ঘসটানি, মাইকের অযাচিত চিৎকার, অথবা হাট-বাজারে গণমানুষের উচ্চকিত কথাবার্তা, তা-ই নয়, শব্দদূষণ, এক অর্থে, রাজনীতিবিদরাও করছেন। তারা অত্যন্ত যুক্তিবহির্ভূত এবং অযাচিতভাবে এমন সব কথাবার্তা বলছেন, অর্থহারা ভাবে ভরা ভাষায়, যা আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।
আমি অতি সম্প্রতি তরুণদের এক সমাবেশে গিয়েছিলাম। তারা সবাই সম্মিলিত হয়েছিলেন তাদের বৃত্তি, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের করণীয় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে। তাদের যুক্তিগ্রাহ্য কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বড্ড ভালো লাগল। তাদের মধ্যে কেউ একজন একটিও অর্থহীন বাক্য উচ্চারণ করলেন না। তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হলো তারা আছেন বলেই হয়তো আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ আছে। ওইখানে বসেই ভাবলাম, তারা যদি সন্তান হন, তবে কী করে তাদের পিতারা আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ হতে পারেন? ওই সম্মিলনে বসে কমপক্ষে ১৫ জনের বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বলতে বাধা নেই, একটি বক্তৃতাও আমার শব্দদূষণ বলে মনে হয়নি। স্বীকার করি, ওই বক্তব্যে উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যই যে অভিব্যক্তিময় ছিল, তা হয়তো নয়। কিন্তু এ কথা হয়তো নিদ্বর্িধায় বলা যায়, যদি তাদের কথা ব্যর্থ হয়ে যায় তবে তো সঙ্গীত রয়েছেই। আর সঙ্গীতেও যদি না কুলায়, থাকল অনন্ত অভিব্যক্তিময় নিস্তব্ধতা।
হয়তো সময় এসেছে নৈশব্দ ও শব্দ নিয়ে অর্থ ও অনর্থের যে বিতর্ক, তার ওপরে নতুন করে কথা শুরু করার। হয়তো সময় এসেছে আমাদের বুকে হাত দিয়ে এই প্রতিজ্ঞা করার যে, যথাযথ কথা বলতে না পারি হয়তোবা, চুপ করে থাকতে তো পারব! আমাদের রাজনীতিবিদরা, যারা খামোখা কথা বলেন, তাদের উচিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে আমাদের ভবিষ্যৎকে ছেড়ে দেওয়া। আর আমাদের আপামর জনসাধারণের উচিত তাদের সন্তানদের সমাজ, দেশ এবং মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলা, যেন তারা ব্যক্তিস্বার্থে আকৃষ্ট হয়ে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি না দেয়। যেসব যুক্তিবান তরুণের কথা সেদিনের ওই সমাবেশে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি, তারা যদি তাদের যৌক্তিক চিন্তা নিয়ে এদেশের রাজনীতিতে আসেন, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল_ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নতুবা হাতের পাঁচ হিসেবে নৈশব্দ তো রয়েছেই।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
অবশ্য এ কথা সত্য যে, সব শহরে একই ধরনের শব্দ শোনা যায় না। আমাদের দেশের ছোটখাটো শহরগুলোতে অত্যন্ত বিশৃঙ্খল শব্দ আমাদের কানে আসে। বিশেষ করে কোনো ব্যস্ত রাস্তার পাশে জানালার ধারে যদি বসা যায়, তবে সেই শব্দ অনেক সময় সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় ব্রেকের আর্তনাদ, পাকা রাস্তার ওপর টায়ারের চিৎকার এবং তার পরেই একটি দুর্ঘটনার শব্দ আমাকে সচকিত করে। তখন আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করি কত বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ওই সব শহরের ব্যস্ত বাজারে গেলে নানা ধরনের শব্দ কানে আসে। বিক্রেতার চিৎকার, ক্রেতার দরকষাকষি, হঠাৎ মারপিট, কিংবা ইটপাথর ছোড়াছুড়ির শব্দ এসবের অন্তর্গত। ছোট শহরের শব্দ বিন্যাসে এ ধরনের বৈচিত্র্য বোধহয় সেই শহরগুলোকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে। যদিও কিছুদিন যাওয়ার পর ওগুলোকেও বিরক্তিকর বলে মনে হয়। তখন আমরা বুঝি নৈশব্দের শক্তি কত বেশি।
আজ অবশ্য আমি নীরবতা, নিস্তব্ধতা বা নৈশব্দ সম্বন্ধে লিখব বলে কলম ধরেছি। শুরুতেই উইলিয়াম শেক্সপিয়রের এক মহান উক্তির কথা মনে পড়ে গেল, যা তিনি তার 'হ্যামলেট' নাটকের শেষে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'এবং অতঃপর যা রইল, তা নিস্তব্ধতা'! এবারে আমি যখন সিঙ্গাপুরে ছিলাম, তখন এক বাংলাদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তিনি একটি ছোটখাটো ফ্যাক্টরিতে একজন দক্ষ মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন। যদিও আমি স্বভাবগতভাবে খুব একটা আলাপী নই, তবুও সুদূর প্রবাসে এক স্বদেশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ায় মনটা বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ভাবলাম একটু আলাপ করি। আমার দীর্ঘদিন ধরেই জানার ইচ্ছা ছিল যে, আমার দেশজ ভাইয়েরা বিদেশে কেমনভাবে দিন কাটান। ওই ভিনদেশি ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদি অবশ্যই তার নিজ দেশের চেয়ে অনেক ভিন্ন। আমার এই নব্য আবিষ্কৃত বন্ধু যা বললেন, তাতে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তিনি যা বললেন, তাতে মনে হলো যে যখন তারা ভিন দেশে থাকেন, তখন তারা একেবারেই নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে থাকেন। যেন এক একজন রেশমের গুটি। তারা ঘোরাফেরা করেন, কাজে যান, বাজার-সদাই করেন, কিন্তু এই প্রত্যেকটি কাজের পেছনে একটিই উদ্দেশ্য থাকে, আর তা হলো যে দেশে তারা থাকেন সে দেশে নিজের জীবনকে সহনীয় করে তোলা। সে দেশের মানুষ অথবা সমাজ কিংবা চারপাশের জীবন তাদের কখনও স্পর্শ করে না। তারা কাজে যান, ফিরে আসেন, রান্না করেন, আহার করেন এবং তাদের কষ্টার্জিত সব অর্থ, সামান্য কিছু খাই-খরচার জন্য রেখে, পাঠিয়ে দেন নিজের দেশে। আমার খুব জানার ইচ্ছা হলো যে, তারা বিনোদনের জন্য কী করে থাকেন। বিশেষ করে এমন একটি শহরে যেখানে নিজ ভাষার কোনো অনুষ্ঠানই তারা দেখতে পান না? আমার বন্ধু বললেন, যখন বাসায় থাকেন, তারা টেলিভিশন দেখেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, টেলিভিশনের অনুষ্ঠান কি বুঝতে পারেন? জবাবে বললেন, না, তারা কিছু বোঝেন না। কেননা ম্যান্দারিন কিংবা ইংরেজি ভাষা তাদের আয়ত্তে নেই। তারা টেলিভিশন দেখার সময় আওয়াজ বন্ধ করে দেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, তাহলে কী দেখেন? তিনি বললেন, অ্যাকশন দেখেন কিংবা দৃশ্যাবলি অথবা সুন্দর মানুষগুলোকে, তাদের বাসস্থান এবং আরও দেখেন তারা কত সুখী। তিনি আরও বললেন, বিজাতীয় শব্দ তার একেবারে পছন্দ নয়। ওই শব্দ শুনলে তার মাথা ধরে।
আমি আমার এই নতুন বন্ধুর কথা থেকে নিস্তব্ধতার আরও একটি সংজ্ঞা পেয়ে যাই। বহু বছর আগে আমার এক অতি প্রিয় ইংরেজি ভাষার লেখক অল্ডাস হাক্সলি সব অভিব্যক্তির ওপরে নিস্তব্ধতাকে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, অভিব্যক্তির দিক দিয়ে নৈশব্দের কাছাকাছি যদি কিছু আসতে পারে তা হচ্ছে সঙ্গীত। আমরা যত বেশিই বলি না কেন, নিস্তব্ধতার স্তুতি বলে শেষ করবার নয়। সঙ্গীত অত্যন্ত অভিব্যক্তিময়। কিন্তু নৈশব্দের পরেই তার স্থান। আমি ভাবি কত সত্য এ কথা। বিশেষ করে যখন আমরা যুক্তিহীন, কর্মকাণ্ডহীন, অযাচিত শব্দের ভারে প্রায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছি, তখন। আমরা মুহ্যমান হয়ে পড়েছি এক শব্দ দূষণ দ্বারা। এ যে কেবল পাকা রাস্তার ওপরে ব্রেকের ঘসটানি, মাইকের অযাচিত চিৎকার, অথবা হাট-বাজারে গণমানুষের উচ্চকিত কথাবার্তা, তা-ই নয়, শব্দদূষণ, এক অর্থে, রাজনীতিবিদরাও করছেন। তারা অত্যন্ত যুক্তিবহির্ভূত এবং অযাচিতভাবে এমন সব কথাবার্তা বলছেন, অর্থহারা ভাবে ভরা ভাষায়, যা আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।
আমি অতি সম্প্রতি তরুণদের এক সমাবেশে গিয়েছিলাম। তারা সবাই সম্মিলিত হয়েছিলেন তাদের বৃত্তি, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের করণীয় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে। তাদের যুক্তিগ্রাহ্য কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বড্ড ভালো লাগল। তাদের মধ্যে কেউ একজন একটিও অর্থহীন বাক্য উচ্চারণ করলেন না। তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হলো তারা আছেন বলেই হয়তো আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ আছে। ওইখানে বসেই ভাবলাম, তারা যদি সন্তান হন, তবে কী করে তাদের পিতারা আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ হতে পারেন? ওই সম্মিলনে বসে কমপক্ষে ১৫ জনের বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বলতে বাধা নেই, একটি বক্তৃতাও আমার শব্দদূষণ বলে মনে হয়নি। স্বীকার করি, ওই বক্তব্যে উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যই যে অভিব্যক্তিময় ছিল, তা হয়তো নয়। কিন্তু এ কথা হয়তো নিদ্বর্িধায় বলা যায়, যদি তাদের কথা ব্যর্থ হয়ে যায় তবে তো সঙ্গীত রয়েছেই। আর সঙ্গীতেও যদি না কুলায়, থাকল অনন্ত অভিব্যক্তিময় নিস্তব্ধতা।
হয়তো সময় এসেছে নৈশব্দ ও শব্দ নিয়ে অর্থ ও অনর্থের যে বিতর্ক, তার ওপরে নতুন করে কথা শুরু করার। হয়তো সময় এসেছে আমাদের বুকে হাত দিয়ে এই প্রতিজ্ঞা করার যে, যথাযথ কথা বলতে না পারি হয়তোবা, চুপ করে থাকতে তো পারব! আমাদের রাজনীতিবিদরা, যারা খামোখা কথা বলেন, তাদের উচিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে আমাদের ভবিষ্যৎকে ছেড়ে দেওয়া। আর আমাদের আপামর জনসাধারণের উচিত তাদের সন্তানদের সমাজ, দেশ এবং মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলা, যেন তারা ব্যক্তিস্বার্থে আকৃষ্ট হয়ে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি না দেয়। যেসব যুক্তিবান তরুণের কথা সেদিনের ওই সমাবেশে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি, তারা যদি তাদের যৌক্তিক চিন্তা নিয়ে এদেশের রাজনীতিতে আসেন, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল_ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নতুবা হাতের পাঁচ হিসেবে নৈশব্দ তো রয়েছেই।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments