বহে কাল নিরবধি-চালিকাশক্তি গণতন্ত্র নয়, ভূরাজনীতি by এম আবদুল হাফিজ
মিয়ানমারকে পাশ্চাত্যের হঠাৎ আলিঙ্গন দৃষ্টিসীমার অতীত একটি অভিনবত্ব। গত বছর পর্যন্ত দেশটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তাক করা কিছু দেশের অন্যতম- যাদের সরকার উৎখাত হওয়ার তালিকায় ছিল। এদের ওপর আরোপিত ছিল পাশ্চাত্যের অবরোধ।
এ অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা পাশ্চাত্যের রাজধানীগুলোতে সম্প্রতি দূত পাঠায় এই নিশ্চয়তা দিয়ে যে মিয়ানমার এখন থেকে দ্রুত গণতান্ত্রিক সংস্কারে বদ্ধপরিকর। এর ফলেই ওয়াশিংটন এবং ব্রাসেলসসের মিয়ানমার নীতিতে উল্টোমুখ।
একপাক্ষিকভাবে আরোপিত অনেক অবরোধই হিলারি ক্লিনটন গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে মিয়ানমার সফর করার পর এখন উত্তোলিত হওয়ার পথে। উল্লেখ্য, হিলারি ক্লিনটনের হাইপ্রোফাইল সফরটিই ছিল দেশটিতে গত ৫০ বছরে সবচেয়ে উচ্চ পদপর্যাদাসম্পন্ন কোনো মার্কিনির প্রথম সফর। এ সফরের সিদ্ধান্তটি আসে প্রেসিডেন্ট ওবামার বালিতে অনুষ্ঠিত আসিয়ান সামিটের অব্যবহিত পর। ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি নতুন অধ্যায়ে পৌঁছাতে চান। ওবামা এ কথারও ঘোষণা দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলোর ভৌগোলিক বিবাদে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গেই থাকবে।
ওবামা এবং তাঁর প্রশাসনের অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা খোলাখুলি ঘোষণা দিয়েছেন যে ২০১১ সালের শেষ দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার পরাশক্তির অবস্থান থেকে চীনকে একমাত্র প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে। পেন্টাগনের সর্বশেষ স্ট্র্যাটেজিক ডকট্রিন চীনকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে পরিবেষ্টন (containment) করার ওপরই গুরুত্ব দেয়। হিলারি ক্লিনটনের সফরকেও মার্কিন মিডিয়ায় ওই একইভাবেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে ওবামা প্রশাসন আলোচ্য অঞ্চলে চীনের উত্থানকে ব্যাহত করতে চায়।
হিলারি ক্লিনটনের অব্যবহিত পরই ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালেইন জুপপা আসেন মিয়ানমারে। অতঃপর ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম হেগ এবং জাপানের বাণিজ্যমন্ত্রী ইউকিউ এডানো আসেন মিয়ানমারে, যে দেশটিতে এত দিন চীনেরই একক প্রভাব ছিল। আর কিছুটা প্রভাব ছিল ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের। এরই বিপরীতে ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর দানবীয় (draconian) অবরোধ আরোপ করে রেখেছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা ভারত ও অন্যান্য দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছিল মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে দূরত্ব রাখতে। ইয়াঙ্গুনে পৌঁছানোর আগেই ক্লিনটন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এমন দেশ থেকে সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল, যাদের দৃষ্টি শুধু অন্য দেশের সম্পদ আহরণে, কিন্তু দেশটির উন্নয়নে নয়।
ক্লিনটনের এনএলডির অং সান সু চির সঙ্গে দুটি বহুল প্রচারিত বৈঠক হয়। সেনা পরিচালিত নির্বাচনে অংশ নিতে দুই বছর আগে সু চিকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ২০ বছরে এটিই ছিল প্রথম নির্বাচন এবং তাও অনেক অনিয়মে ভরা। অবশ্য সেনা প্রণীত ২০০৮ সালের শাসনতন্ত্রে পার্লামেন্টের সামান্যই ক্ষমতা ছিল। প্রেসিডেন্ট বা পার্লামেন্টের যেকোনো সিদ্ধান্তকে সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবেই ভেটো করতে পারত। শুধু তা-ই নয়, মিলিটারি চাইলেই পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন নিজেদের দখলে রাখতে পারত। গত এপ্রিলে সু চির পার্লামেন্টের উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ ২০০৮ সালের সংবিধানের স্বীকৃতি বলে দেখা হচ্ছে। যদিও তাঁর নিজের সংগঠনেরই অনেকে তাঁর এই সিদ্ধান্তকে পছন্দ করেনি। তবে হিলারি ক্লিনটন গণতন্ত্রের সংগ্রামে তাঁর অবশ্য পালনীয় সমর্থনের কথা বারবার বলেছেন। তাঁর কথায় তিনি দেশটি সফর করছেন সামরিক জান্তার হঠাৎ পাশ্চাত্যপ্রীতির নেপথ্যে তাঁর অভিপ্রায় বুঝতে।
মিয়ানমারের নতুন প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোয়ে প্রেসিডেন্ট থেইন সিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ক্লিনটন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানান। অবশ্য ক্লিনটন নিজেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য বেশ কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং কারেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি। ক্লিনটনের সফরের আগেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চীনের সঙ্গে তাদের প্রস্তাবিত মাল্টিবিলিয়ন ডলার, হাইড্রো ইলেকট্রিক চুক্তিটি বাতিল করে। এ প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত ইরাবতী নদীর ওপর বাঁধটি পরিবেশবাদীদের বিরোধিতার মুখে পড়ে। ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এ বাঁধটির দক্ষিণ চীনে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা ছিল।
অর্থনৈতিকভাবে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ছিল গভীর এবং নিবিড়। এখন পাশ্চাত্যের দিকে ঝুঁকতে এবং চীনের অর্থনৈতিক বন্ধনকে শিথিল করতে বেশ কিছু পরিবর্তন ও পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন হচ্ছে, যাতে পাশ্চাত্যের ঝোলানো মুলাগুলো আহরণে মিয়ানমার তার শর্তগুলো পূর্ণ করতে পারে। তবে একটি কথা এখনই স্পষ্ট যে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়নে পাশ্চাত্যের মাথাব্যথা সামান্যই। পাশ্চাত্যের আসল লক্ষ্য মিয়ানমারকে চীনের প্রভাববলয় থেকে যত শিগগির সম্ভব সরিয়ে নেওয়া এবং এর জন্য আসিয়ানের সম্মিলিত শক্তিকে ব্যবহার করে মিয়ানমারকে ড্রাগনের সাঁড়াশি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করা।
হিলারি ক্লিনটন তাঁর সফরকালে এ কথারও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র আর ভবিষ্যতে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে মিয়ানমারের ঋণপ্রাপ্তির পথে বিঘ্ন হবে না। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নিজেও মিয়ানমারে তাদের বিপুল বিনিয়োগে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। লক্ষণীয় যে এ জন্য বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যেই দলে দলে মিয়ানমারে আসতেও শুরু করেছে। মার্কিন ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিতে অধুনা বিশ্বে বিপুলভাবে সম্পদশালী মিয়ানমারই আকর্ষণীয় নতুন দিগন্ত। সামরিক জান্তাও আকর্ষণীয়ভাবে বিনিয়োগকারীদের জন্য অন্তত আট বছরের কর অব্যাহতির ব্যবস্থা রেখেছে। তদুপরি এ সময় নাগাদ মিয়ানমারের শ্রমিকরাও সম্ভবত বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন বেতনভুক।
যে কারণেই হোক, অত্যন্ত রক্ষণশীল সামরিক জান্তার একটি পরিবর্তন ও ভাগ্যপরীক্ষার অপেক্ষায় ছিল। চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক অনেক পুরনো হওয়া সত্ত্বেও চীনের অগ্রগতি মিয়ানমারের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। অবরোধ আরোপিত মিয়ানমারের জন্য অনেক পথ খোলা ছিল না। চীন যেখানে মিয়ানমারকে যা-ই দিয়েছে বাধ্য হয়ে তাকে তাই গ্রহণ করতে হয়েছে। মিয়ানমার প্রেসিডেন্টের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার কথায় মিয়ানমার সে জন্যই অবরোধের অবসান ঘটিয়ে প্রতিযোগিতাকে সামনে টেনে আনতে চেয়েছিল। সেটাই এখন ঘটছে। পাশ্চাত্য অবরোধ শিথিল করায় অনেক প্রতিযোগীই এখন ব্রিফকেস হাতে মিয়ানমারে লাভজনক বিনিয়োগের প্রত্যাশায় ঘুরছে। বলা বাহুল্য, আগামীতে এ প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হবে। পাশ্চাত্যও তার স্বপ্নের এশিয়া প্যাসিফিককে ড্রাগনমুক্ত করতে সক্ষম হবে।
প্রেসিডেন্টের আরেকজন উপদেষ্টার কথায় 'আরব বসন্ত' ও মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গিকে শানিত করেছে এবং পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে। তবে অহিংসবাদী সু চি আরব বসন্তের উদ্বেলতার বিরুদ্ধে তাঁর জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে পরিবর্তন শান্তিপূর্ণ পথেই আসা কাঙ্ক্ষিত। তিনি সামরিক এ পরিবর্তনের ধারাকে প্রকারান্তরে অনুমোদন দিয়েছেন, যদি তিনি এলএলডিকে পুনর্নিবন্ধনের জন্য অনুমতি দেন।
গণতন্ত্রের আলাপ-আলোচনা মানবাধিকারের চর্চা এবং গণতন্ত্রসংশ্লিষ্ট আচার-আচরণ- এসবই ওপরের আস্তরণ, শক্তির খেলায় যা এখানেও ষোলআনাই বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় কথা, ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস, কলামিস্ট
একপাক্ষিকভাবে আরোপিত অনেক অবরোধই হিলারি ক্লিনটন গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে মিয়ানমার সফর করার পর এখন উত্তোলিত হওয়ার পথে। উল্লেখ্য, হিলারি ক্লিনটনের হাইপ্রোফাইল সফরটিই ছিল দেশটিতে গত ৫০ বছরে সবচেয়ে উচ্চ পদপর্যাদাসম্পন্ন কোনো মার্কিনির প্রথম সফর। এ সফরের সিদ্ধান্তটি আসে প্রেসিডেন্ট ওবামার বালিতে অনুষ্ঠিত আসিয়ান সামিটের অব্যবহিত পর। ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি নতুন অধ্যায়ে পৌঁছাতে চান। ওবামা এ কথারও ঘোষণা দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলোর ভৌগোলিক বিবাদে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গেই থাকবে।
ওবামা এবং তাঁর প্রশাসনের অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা খোলাখুলি ঘোষণা দিয়েছেন যে ২০১১ সালের শেষ দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার পরাশক্তির অবস্থান থেকে চীনকে একমাত্র প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে। পেন্টাগনের সর্বশেষ স্ট্র্যাটেজিক ডকট্রিন চীনকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে পরিবেষ্টন (containment) করার ওপরই গুরুত্ব দেয়। হিলারি ক্লিনটনের সফরকেও মার্কিন মিডিয়ায় ওই একইভাবেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে ওবামা প্রশাসন আলোচ্য অঞ্চলে চীনের উত্থানকে ব্যাহত করতে চায়।
হিলারি ক্লিনটনের অব্যবহিত পরই ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালেইন জুপপা আসেন মিয়ানমারে। অতঃপর ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম হেগ এবং জাপানের বাণিজ্যমন্ত্রী ইউকিউ এডানো আসেন মিয়ানমারে, যে দেশটিতে এত দিন চীনেরই একক প্রভাব ছিল। আর কিছুটা প্রভাব ছিল ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের। এরই বিপরীতে ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর দানবীয় (draconian) অবরোধ আরোপ করে রেখেছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা ভারত ও অন্যান্য দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছিল মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে দূরত্ব রাখতে। ইয়াঙ্গুনে পৌঁছানোর আগেই ক্লিনটন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এমন দেশ থেকে সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল, যাদের দৃষ্টি শুধু অন্য দেশের সম্পদ আহরণে, কিন্তু দেশটির উন্নয়নে নয়।
ক্লিনটনের এনএলডির অং সান সু চির সঙ্গে দুটি বহুল প্রচারিত বৈঠক হয়। সেনা পরিচালিত নির্বাচনে অংশ নিতে দুই বছর আগে সু চিকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ২০ বছরে এটিই ছিল প্রথম নির্বাচন এবং তাও অনেক অনিয়মে ভরা। অবশ্য সেনা প্রণীত ২০০৮ সালের শাসনতন্ত্রে পার্লামেন্টের সামান্যই ক্ষমতা ছিল। প্রেসিডেন্ট বা পার্লামেন্টের যেকোনো সিদ্ধান্তকে সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবেই ভেটো করতে পারত। শুধু তা-ই নয়, মিলিটারি চাইলেই পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন নিজেদের দখলে রাখতে পারত। গত এপ্রিলে সু চির পার্লামেন্টের উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ ২০০৮ সালের সংবিধানের স্বীকৃতি বলে দেখা হচ্ছে। যদিও তাঁর নিজের সংগঠনেরই অনেকে তাঁর এই সিদ্ধান্তকে পছন্দ করেনি। তবে হিলারি ক্লিনটন গণতন্ত্রের সংগ্রামে তাঁর অবশ্য পালনীয় সমর্থনের কথা বারবার বলেছেন। তাঁর কথায় তিনি দেশটি সফর করছেন সামরিক জান্তার হঠাৎ পাশ্চাত্যপ্রীতির নেপথ্যে তাঁর অভিপ্রায় বুঝতে।
মিয়ানমারের নতুন প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোয়ে প্রেসিডেন্ট থেইন সিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ক্লিনটন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানান। অবশ্য ক্লিনটন নিজেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য বেশ কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং কারেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি। ক্লিনটনের সফরের আগেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চীনের সঙ্গে তাদের প্রস্তাবিত মাল্টিবিলিয়ন ডলার, হাইড্রো ইলেকট্রিক চুক্তিটি বাতিল করে। এ প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত ইরাবতী নদীর ওপর বাঁধটি পরিবেশবাদীদের বিরোধিতার মুখে পড়ে। ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এ বাঁধটির দক্ষিণ চীনে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা ছিল।
অর্থনৈতিকভাবে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ছিল গভীর এবং নিবিড়। এখন পাশ্চাত্যের দিকে ঝুঁকতে এবং চীনের অর্থনৈতিক বন্ধনকে শিথিল করতে বেশ কিছু পরিবর্তন ও পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন হচ্ছে, যাতে পাশ্চাত্যের ঝোলানো মুলাগুলো আহরণে মিয়ানমার তার শর্তগুলো পূর্ণ করতে পারে। তবে একটি কথা এখনই স্পষ্ট যে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়নে পাশ্চাত্যের মাথাব্যথা সামান্যই। পাশ্চাত্যের আসল লক্ষ্য মিয়ানমারকে চীনের প্রভাববলয় থেকে যত শিগগির সম্ভব সরিয়ে নেওয়া এবং এর জন্য আসিয়ানের সম্মিলিত শক্তিকে ব্যবহার করে মিয়ানমারকে ড্রাগনের সাঁড়াশি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করা।
হিলারি ক্লিনটন তাঁর সফরকালে এ কথারও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র আর ভবিষ্যতে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে মিয়ানমারের ঋণপ্রাপ্তির পথে বিঘ্ন হবে না। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নিজেও মিয়ানমারে তাদের বিপুল বিনিয়োগে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। লক্ষণীয় যে এ জন্য বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যেই দলে দলে মিয়ানমারে আসতেও শুরু করেছে। মার্কিন ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিতে অধুনা বিশ্বে বিপুলভাবে সম্পদশালী মিয়ানমারই আকর্ষণীয় নতুন দিগন্ত। সামরিক জান্তাও আকর্ষণীয়ভাবে বিনিয়োগকারীদের জন্য অন্তত আট বছরের কর অব্যাহতির ব্যবস্থা রেখেছে। তদুপরি এ সময় নাগাদ মিয়ানমারের শ্রমিকরাও সম্ভবত বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন বেতনভুক।
যে কারণেই হোক, অত্যন্ত রক্ষণশীল সামরিক জান্তার একটি পরিবর্তন ও ভাগ্যপরীক্ষার অপেক্ষায় ছিল। চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক অনেক পুরনো হওয়া সত্ত্বেও চীনের অগ্রগতি মিয়ানমারের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। অবরোধ আরোপিত মিয়ানমারের জন্য অনেক পথ খোলা ছিল না। চীন যেখানে মিয়ানমারকে যা-ই দিয়েছে বাধ্য হয়ে তাকে তাই গ্রহণ করতে হয়েছে। মিয়ানমার প্রেসিডেন্টের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার কথায় মিয়ানমার সে জন্যই অবরোধের অবসান ঘটিয়ে প্রতিযোগিতাকে সামনে টেনে আনতে চেয়েছিল। সেটাই এখন ঘটছে। পাশ্চাত্য অবরোধ শিথিল করায় অনেক প্রতিযোগীই এখন ব্রিফকেস হাতে মিয়ানমারে লাভজনক বিনিয়োগের প্রত্যাশায় ঘুরছে। বলা বাহুল্য, আগামীতে এ প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হবে। পাশ্চাত্যও তার স্বপ্নের এশিয়া প্যাসিফিককে ড্রাগনমুক্ত করতে সক্ষম হবে।
প্রেসিডেন্টের আরেকজন উপদেষ্টার কথায় 'আরব বসন্ত' ও মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গিকে শানিত করেছে এবং পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে। তবে অহিংসবাদী সু চি আরব বসন্তের উদ্বেলতার বিরুদ্ধে তাঁর জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে পরিবর্তন শান্তিপূর্ণ পথেই আসা কাঙ্ক্ষিত। তিনি সামরিক এ পরিবর্তনের ধারাকে প্রকারান্তরে অনুমোদন দিয়েছেন, যদি তিনি এলএলডিকে পুনর্নিবন্ধনের জন্য অনুমতি দেন।
গণতন্ত্রের আলাপ-আলোচনা মানবাধিকারের চর্চা এবং গণতন্ত্রসংশ্লিষ্ট আচার-আচরণ- এসবই ওপরের আস্তরণ, শক্তির খেলায় যা এখানেও ষোলআনাই বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় কথা, ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস, কলামিস্ট
No comments