জনসংস্কৃতি-গ্রামীণ মেলাগুলো ফিরে আসুক by জিয়াউল হক
আকসার মেলা চারদিকে। কর মেলা, ব্যাংকঋণ মেলা, উচ্চশিক্ষা মেলা, সফটওয়্যার মেলা, কম্পিউটার মেলা, চাকরি মেলা, আবাসন মেলা, আনন্দ মেলা, বাণিজ্য মেলাসহ আজকাল নিয়মিত আয়োজিত রংবেরঙের মেলাগুলো নগরবাণিজ্যের অন্যতম আলোড়ন।
কেবল বস্তুগত পণ্যদ্রব্যের বিপণনে নয়, সেবাপণ্যের বাজারজাতেও মেলা পরিণত হয়েছে অন্যতম বাণিজ্যকৌশলে। গ্রামদেশে আয়োজিত বিচিত্র সব মেলার পাশাপাশি সত্তর ও আশির দশকে নগর ঢাকায় নববর্ষে কিছু সর্বজনীন মেলার আয়োজন চলতে থাকে। বাণিজ্যের কৌশল হিসেবে মেলাকে ব্যবহার করার ধারণা বিকশিত হয়েছে মূলত অমর একুশের গ্রন্থমেলার অভাবনীয় সাফল্যের সূত্র ধরে। অমর একুশের গ্রন্থমেলা কেবল বই কেনাবেচার স্থান নয়, এটা হলো লেখক-পাঠক-ছাত্র-যুবার মিলনমেলা।
বিবিধ উপলক্ষে আয়োজিত গ্রামীণ মেলাগুলো ছিল সমাজকাঠামোর চিরায়ত আর্থসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-দক্ষতা, উপকরণ আর ব্যবহার বা আচরণের যৌথ আনুষ্ঠানিকতা, বিপুলভাবে যা প্রতীকময়তা-ঋদ্ধ। প্রয়োজনের বিকিকিনির পাশাপাশি মেলার নান্দনিক চর্চাগুলো দিয়েছে বিনোদন; শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, চর্চা ও মিথস্ক্রিয়া ছিল সামাজিকীকরণের অন্যতম প্রক্রিয়া। মেলার সেসব কৃষিকালীন যৌবন-জৌলুশ হারিয়েছে কবেই; হীন যেনতেন প্রকারের মুনাফা-লক্ষ্য কলুষিত করেছে মেলা। মেলায় এখন ‘এক ঝাঁক উড়ন্ত বলাকার ঝুমুর ঝুমুর নৃত্য’ বা মাংসাশীদের জন্য অপভ্রংশযাত্রা বা অর্থলিপ্সাজাগানিয়া হাউজির ব্যাপক বিস্তার। সমকালীন গ্রামীণ মেলাগুলো আজ আর সব বয়সের মানুষের সাধারণ স্থান নয়, সম্ভোগ আর পুরুষতান্ত্রিকতার হাত ধরে নারীর শত্রুও বটে।
গ্রামীণ মেলার সর্বজনীনতার হূত গৌরব পুনরুদ্ধার কি সম্ভব? ১৪১৫ বঙ্গাব্দে ‘গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান’ আয়োজিত ১৫টি নিরীক্ষাধর্মী মেলার অভিজ্ঞতা বলছে সম্ভব। ১৪১৭ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ-পৌষের ২৮টি মেলা সে সম্ভাবনায় দিয়েছে প্রত্যয়গতি।
মেলাগুলো গ্রামীণ উৎপাদকদের পণ্য বিপণনে রাখছে ব্যাপক ভূমিকা। মেলার স্টলে সবার সামনে তৈরি মুড়িমুড়কি আর পিঠাপুলির মাধ্যমে তাৎক্ষণিক রসনাবিলাস নিশ্চয়ই ক্রেতার মতো বিক্রেতার জন্যও লাভজনক। বীজ-গাছ, গ্রামীণ গবেষকের উদ্ভাবিত জৈবসার আর দা-খুন্তি-কাঁচি-নিড়ানিসহ বিবিধ কৃষি উপকরণ, হাঁড়ি-পাতিল-ঝাড়ুসহ বিচিত্র গৃহস্থালি সরঞ্জামের বিক্রি এবং ক্ষেত্রবিশেষে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার প্রদর্শন মেলাগুলোকে পরিণত করেছে সমগ্র গ্রামের প্রতিরূপে।
স্থানীয় ও জাতীয় পরিসরে উদ্ভাবিত নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তির প্রদর্শন ও সম্প্রসারণে মেলাগুলো পালন করছে কালোপযোগী ভূমিকা। জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ-প্রকৃতির বিরূপতা মোকাবিলায় বা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোয় সক্ষম—এমন প্রযুক্তি প্রদর্শন ও সম্প্রসারণ করা। যেমন—খরাপ্রবণ এলাকায় নতুন সেচপদ্ধতি জনপ্রিয় করতে কিংবা লবণসহিষ্ণু জাতের ধান পরিচিত করতে কিংবা জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ এলাকার বসতঘরের নতুন কাঠামো শেখাতে, মূল্যবান ব্যবহারিক জ্ঞানের বিস্তার কার্যক্রমে মেলাগুলোর অবদান বিপন্ন গ্রাম্য জীবনে আশাজাগানিয়া আলোকবর্তিকা। বহু জাতের বীজ ও বিলুপ্তপ্রায় বনজ-ফলদ-ঔষধি গাছপালার প্রদর্শন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রদান করছে উৎসাহব্যঞ্জক গতি।
সরকারি সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর পরিচিতি এবং তথ্য প্রদর্শনেও মেলাগুলো ভূমিকা রাখছে। সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, ভ্রাম্যমাণ মাটি পরীক্ষা কেন্দ্র, কৃষি তথ্য বিভাগ, সম্প্রসারণ বিভাগসহ অনেক সরকারি বিভাগ মেলাগুলোতে নিজেদের স্টল স্থাপনের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে সেবা-সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রযুক্তি।
মেলাগুলো সকাল-বিকেলে পরিণত হয়েছে খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ধরনের বিনোদনধর্মী কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে। হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, দড়ি টানাটানি, লাঠিখেলা, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াইসহ লোকপ্রিয় খেলাগুলোর প্রতিযোগিতা গ্রামের মানুষদের দিচ্ছে বিপুল আনন্দ। সন্ধ্যায় বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত আর নাটক বা যাত্রার আয়োজন শত শত নারী-পুরুষের জন্য হয়ে ওঠে মনোমুগ্ধকর।
প্রকাশ্যে নারীর সগৌরব উপস্থিতি ও গমনাগমনের মধ্যে নিহিত থাকে ধর্মান্ধ মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে অগ্রাহ্য করার উপাদান। সে বিবেচনায় গ্রামীণ মেলাগুলোয় হাজার হাজার নারীর ভোররাত অবধি অবস্থান এবং যাত্রা-নাটক-লোকসংগীত উপভোগের রয়েছে গভীরতর রাজনৈতিক মাত্রা। নারীর সামাজিক গতিময়তার ক্ষেত্রে মেলাগুলোর এ সৃজনশীল ভূমিকাকে মোটেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই, বিশেষত ধর্মান্ধ মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিকাশের উর্বর পারিপার্শ্বিকতার বিদ্যমানতার কালে। এটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক যে একেকটি মেলাকে উপলক্ষ করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শত শত নারী নাইয়র আসছেন পিত্রালয়ে, যাচ্ছেন শ্বশুরালয় বা পরিজনের বাড়িতে।
গ্রাম্য জীবনের উৎকর্ষ সাধনে এভাবে গ্রামীণ মেলাগুলো পালন করতে পারে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। যে মন্ত্রণালয়টিকে প্রায়ই সবচেয়ে গুরুত্বহীন বিবেচনা করা হয় এবং বাজেট বরাদ্দকালে অবজ্ঞাভরে সরিয়ে রাখা হয় এক পাশে, সেই সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় যথাযথ বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে সারা দেশে অন্তত সব উপজেলায় আয়োজন করতে পারে এ ধরনের গ্রামীণ জীবনযাত্রার মেলা। মেলায় গ্রামীণ জীবনযাত্রা-সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় পালন করতে পারে নেতৃত্বের ভূমিকা। অন্যদিকে, শুধু গ্রাম্য জীবনেই নয়, শহরাঞ্চলেও যেসব মেলার আয়োজন করা হয়, সেগুলোও কীভাবে জাতীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতি এবং গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, সেটাও নীতিনির্ধারণী মহলের বিশেষ বিবেচ্য হতে পারে। সংস্কৃতির আর্থ-উপাদানের ভূমিকা ছাপিয়ে মেলাগুলো স্থানীয় কৃষি-ক্রীড়া-সংগীত-নাট্য-কাব্য দল ও লোকজ উদ্ভাবকদের সৃজনশীল প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে পালন করতে পারে ব্যাপক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
নববর্ষ, ঈদ আর জাতীয় উৎসবের প্রাক্কালে রাজধানী ও মহানগরগুলোয় তাঁত ও বস্ত্রমেলা এবং কুটিরশিল্প মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। জানা যায়, সুপার মার্কেট সমিতিগুলো সংঘবদ্ধভাবে উৎকোচ দেওয়া ও বৈধ-অবৈধ পন্থায় প্রশাসন বা সিটি করপোরেশনকে প্রভাবিত করে, যাতে এসব মেলা অনুষ্ঠিত হতে না পারে। ভারত-পাকিস্তান-থাইল্যান্ড-চীনসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আমদানি করা শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি, চাদর বিক্রির একচেটিয়া অধিকার ভোগের জন্যই মার্কেটের সমিতিগুলো এভাবে দেশজ উৎপাদকদের মেলাগুলোকে বন্ধ করার অপপ্রয়াস নেয় এবং প্রায়ই সফল হয়। গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের স্বার্থে সরকার ও প্রশাসনের উচিত শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি, চাদরসহ যেসব পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়, সেগুলোর আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা অথবা দেশজ পণ্যের বাজারসুবিধা নিশ্চিত করতে বিদেশি পণ্যে ব্যাপক শুল্ক আরোপ করা এবং সব উৎসবের প্রাক্কালে রাজধানী ও মহানগরগুলোতে এসব মেলা আয়োজনে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সহায়তা দেওয়া। সরকার ও প্রশাসনের উচিত, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অধীনে গ্রামীণ জীবনের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিটি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে মেলার আয়োজন করা। জাতীয় বাজেটে মাত্র ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করলে প্রতিবছর প্রতিটি উপজেলায় অন্তত তিনটি করে মেলার আয়োজন করা সম্ভব। সমালোচনা শোনায় দেয়ালেরও কান গজিয়ে যায়; সুপরামর্শকালে মস্তিষ্কের সঙ্গে শ্রবণেন্দ্রিয়ের যোগাযোগব্যবস্থা ছিন্ন হয় প্রিয় স্বদেশে। হায়!
জিয়াউল হক মুক্তা: উন্নয়নকর্মী ও লেখক।
বিবিধ উপলক্ষে আয়োজিত গ্রামীণ মেলাগুলো ছিল সমাজকাঠামোর চিরায়ত আর্থসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-দক্ষতা, উপকরণ আর ব্যবহার বা আচরণের যৌথ আনুষ্ঠানিকতা, বিপুলভাবে যা প্রতীকময়তা-ঋদ্ধ। প্রয়োজনের বিকিকিনির পাশাপাশি মেলার নান্দনিক চর্চাগুলো দিয়েছে বিনোদন; শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, চর্চা ও মিথস্ক্রিয়া ছিল সামাজিকীকরণের অন্যতম প্রক্রিয়া। মেলার সেসব কৃষিকালীন যৌবন-জৌলুশ হারিয়েছে কবেই; হীন যেনতেন প্রকারের মুনাফা-লক্ষ্য কলুষিত করেছে মেলা। মেলায় এখন ‘এক ঝাঁক উড়ন্ত বলাকার ঝুমুর ঝুমুর নৃত্য’ বা মাংসাশীদের জন্য অপভ্রংশযাত্রা বা অর্থলিপ্সাজাগানিয়া হাউজির ব্যাপক বিস্তার। সমকালীন গ্রামীণ মেলাগুলো আজ আর সব বয়সের মানুষের সাধারণ স্থান নয়, সম্ভোগ আর পুরুষতান্ত্রিকতার হাত ধরে নারীর শত্রুও বটে।
গ্রামীণ মেলার সর্বজনীনতার হূত গৌরব পুনরুদ্ধার কি সম্ভব? ১৪১৫ বঙ্গাব্দে ‘গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান’ আয়োজিত ১৫টি নিরীক্ষাধর্মী মেলার অভিজ্ঞতা বলছে সম্ভব। ১৪১৭ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ-পৌষের ২৮টি মেলা সে সম্ভাবনায় দিয়েছে প্রত্যয়গতি।
মেলাগুলো গ্রামীণ উৎপাদকদের পণ্য বিপণনে রাখছে ব্যাপক ভূমিকা। মেলার স্টলে সবার সামনে তৈরি মুড়িমুড়কি আর পিঠাপুলির মাধ্যমে তাৎক্ষণিক রসনাবিলাস নিশ্চয়ই ক্রেতার মতো বিক্রেতার জন্যও লাভজনক। বীজ-গাছ, গ্রামীণ গবেষকের উদ্ভাবিত জৈবসার আর দা-খুন্তি-কাঁচি-নিড়ানিসহ বিবিধ কৃষি উপকরণ, হাঁড়ি-পাতিল-ঝাড়ুসহ বিচিত্র গৃহস্থালি সরঞ্জামের বিক্রি এবং ক্ষেত্রবিশেষে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার প্রদর্শন মেলাগুলোকে পরিণত করেছে সমগ্র গ্রামের প্রতিরূপে।
স্থানীয় ও জাতীয় পরিসরে উদ্ভাবিত নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তির প্রদর্শন ও সম্প্রসারণে মেলাগুলো পালন করছে কালোপযোগী ভূমিকা। জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ-প্রকৃতির বিরূপতা মোকাবিলায় বা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোয় সক্ষম—এমন প্রযুক্তি প্রদর্শন ও সম্প্রসারণ করা। যেমন—খরাপ্রবণ এলাকায় নতুন সেচপদ্ধতি জনপ্রিয় করতে কিংবা লবণসহিষ্ণু জাতের ধান পরিচিত করতে কিংবা জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ এলাকার বসতঘরের নতুন কাঠামো শেখাতে, মূল্যবান ব্যবহারিক জ্ঞানের বিস্তার কার্যক্রমে মেলাগুলোর অবদান বিপন্ন গ্রাম্য জীবনে আশাজাগানিয়া আলোকবর্তিকা। বহু জাতের বীজ ও বিলুপ্তপ্রায় বনজ-ফলদ-ঔষধি গাছপালার প্রদর্শন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রদান করছে উৎসাহব্যঞ্জক গতি।
সরকারি সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর পরিচিতি এবং তথ্য প্রদর্শনেও মেলাগুলো ভূমিকা রাখছে। সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, ভ্রাম্যমাণ মাটি পরীক্ষা কেন্দ্র, কৃষি তথ্য বিভাগ, সম্প্রসারণ বিভাগসহ অনেক সরকারি বিভাগ মেলাগুলোতে নিজেদের স্টল স্থাপনের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে সেবা-সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রযুক্তি।
মেলাগুলো সকাল-বিকেলে পরিণত হয়েছে খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ধরনের বিনোদনধর্মী কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে। হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, দড়ি টানাটানি, লাঠিখেলা, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াইসহ লোকপ্রিয় খেলাগুলোর প্রতিযোগিতা গ্রামের মানুষদের দিচ্ছে বিপুল আনন্দ। সন্ধ্যায় বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত আর নাটক বা যাত্রার আয়োজন শত শত নারী-পুরুষের জন্য হয়ে ওঠে মনোমুগ্ধকর।
প্রকাশ্যে নারীর সগৌরব উপস্থিতি ও গমনাগমনের মধ্যে নিহিত থাকে ধর্মান্ধ মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে অগ্রাহ্য করার উপাদান। সে বিবেচনায় গ্রামীণ মেলাগুলোয় হাজার হাজার নারীর ভোররাত অবধি অবস্থান এবং যাত্রা-নাটক-লোকসংগীত উপভোগের রয়েছে গভীরতর রাজনৈতিক মাত্রা। নারীর সামাজিক গতিময়তার ক্ষেত্রে মেলাগুলোর এ সৃজনশীল ভূমিকাকে মোটেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই, বিশেষত ধর্মান্ধ মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিকাশের উর্বর পারিপার্শ্বিকতার বিদ্যমানতার কালে। এটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক যে একেকটি মেলাকে উপলক্ষ করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শত শত নারী নাইয়র আসছেন পিত্রালয়ে, যাচ্ছেন শ্বশুরালয় বা পরিজনের বাড়িতে।
গ্রাম্য জীবনের উৎকর্ষ সাধনে এভাবে গ্রামীণ মেলাগুলো পালন করতে পারে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। যে মন্ত্রণালয়টিকে প্রায়ই সবচেয়ে গুরুত্বহীন বিবেচনা করা হয় এবং বাজেট বরাদ্দকালে অবজ্ঞাভরে সরিয়ে রাখা হয় এক পাশে, সেই সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় যথাযথ বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে সারা দেশে অন্তত সব উপজেলায় আয়োজন করতে পারে এ ধরনের গ্রামীণ জীবনযাত্রার মেলা। মেলায় গ্রামীণ জীবনযাত্রা-সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় পালন করতে পারে নেতৃত্বের ভূমিকা। অন্যদিকে, শুধু গ্রাম্য জীবনেই নয়, শহরাঞ্চলেও যেসব মেলার আয়োজন করা হয়, সেগুলোও কীভাবে জাতীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতি এবং গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, সেটাও নীতিনির্ধারণী মহলের বিশেষ বিবেচ্য হতে পারে। সংস্কৃতির আর্থ-উপাদানের ভূমিকা ছাপিয়ে মেলাগুলো স্থানীয় কৃষি-ক্রীড়া-সংগীত-নাট্য-কাব্য দল ও লোকজ উদ্ভাবকদের সৃজনশীল প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে পালন করতে পারে ব্যাপক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
নববর্ষ, ঈদ আর জাতীয় উৎসবের প্রাক্কালে রাজধানী ও মহানগরগুলোয় তাঁত ও বস্ত্রমেলা এবং কুটিরশিল্প মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। জানা যায়, সুপার মার্কেট সমিতিগুলো সংঘবদ্ধভাবে উৎকোচ দেওয়া ও বৈধ-অবৈধ পন্থায় প্রশাসন বা সিটি করপোরেশনকে প্রভাবিত করে, যাতে এসব মেলা অনুষ্ঠিত হতে না পারে। ভারত-পাকিস্তান-থাইল্যান্ড-চীনসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আমদানি করা শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি, চাদর বিক্রির একচেটিয়া অধিকার ভোগের জন্যই মার্কেটের সমিতিগুলো এভাবে দেশজ উৎপাদকদের মেলাগুলোকে বন্ধ করার অপপ্রয়াস নেয় এবং প্রায়ই সফল হয়। গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের স্বার্থে সরকার ও প্রশাসনের উচিত শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি, চাদরসহ যেসব পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়, সেগুলোর আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা অথবা দেশজ পণ্যের বাজারসুবিধা নিশ্চিত করতে বিদেশি পণ্যে ব্যাপক শুল্ক আরোপ করা এবং সব উৎসবের প্রাক্কালে রাজধানী ও মহানগরগুলোতে এসব মেলা আয়োজনে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সহায়তা দেওয়া। সরকার ও প্রশাসনের উচিত, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অধীনে গ্রামীণ জীবনের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিটি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে মেলার আয়োজন করা। জাতীয় বাজেটে মাত্র ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করলে প্রতিবছর প্রতিটি উপজেলায় অন্তত তিনটি করে মেলার আয়োজন করা সম্ভব। সমালোচনা শোনায় দেয়ালেরও কান গজিয়ে যায়; সুপরামর্শকালে মস্তিষ্কের সঙ্গে শ্রবণেন্দ্রিয়ের যোগাযোগব্যবস্থা ছিন্ন হয় প্রিয় স্বদেশে। হায়!
জিয়াউল হক মুক্তা: উন্নয়নকর্মী ও লেখক।
No comments