চারুশিল্প-স্বপ্ন ও মৃত্তিকার দিঘল মাঠ by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

শিল্পের বিস্তৃতি ঘটে দর্শক, সংগ্রাহক, আলোচকের হাত ধরে। বাংলাদেশে গত ছয় দশকের শিল্প সৃষ্টির ধারাবাহিক উত্তরণের খোঁজ মেলে গুলশানের সাজু আর্ট গ্যালারির ৩৮তম গ্র্যান্ড এক্সিবিশনে। সময়টা ১৯৭৪। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী শিল্পকলার অঙ্গন সমৃদ্ধ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও আগামীর বাংলাদেশ ভাবনায়।


রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বাইরে রাজনীতিতে শিল্পকর্মের প্রদর্শন ও বিপণনকক্ষ গড়ে তোলেন শিল্পসংগ্রাহক রমিজ আহমদ চৌধুরী (সাজু)। সেই থেকে দীর্ঘ ৩৮ বছর পর্যন্ত শিল্প সংগ্রহ, বিপণন ও প্রদর্শনীর জন্য এ আয়োজন চলছে। রাজধানীতে এক দশক আগে ব্যক্তি উদ্যোগে শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শন, আলোচনা, কথোপকথনের জন্য গড়ে উঠেছে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস, শিল্পাঙ্গন, গ্যালারি চিত্রক, গ্যালারি কায়া, গ্যালারি কসমস, ব্যাসিলিও, গ্যালারি জলরঙ, রেডিয়াস, বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ।
এ ছাড়া ভাড়াভিত্তিক প্রদর্শনীকক্ষের ব্যবস্থাপনায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা-গ্যালারি, দৃক গ্যালারি রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালা গ্যালারি, জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তন। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের বাজারে গড়ে ওঠা সাজু আর্ট গ্যালারির দীর্ঘ পথযাত্রা যেমন পৃষ্ঠপোষকতা, তেমনি শিল্পকর্মের বিপণন ও সংগ্রাহকের সঙ্গে শিল্পীর যোগাযোগ স্থাপনের কাজটি করা হয়েছে। ৭ এপ্রিল শুরু হওয়া সাজু আর্ট গ্যালারির ৭১তম শিল্পকর্ম প্রদর্শনী এবং ৩১তম ‘গ্র্যান্ড গ্রুপ আর্ট এক্সিবিশনে’ অগ্রজ পথিকৃৎ শিল্পীদের কাজের পাশাপাশি অনুজ একেবারে সমসাময়িক ভাবনায় আশ্রিত ৮৫ শিল্পীর নানা মাধ্যমের ১৩৫টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। পথিকৃৎ শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের চেনা-কাঠ খোদাই চিত্র ‘ঢোলকে’র পাশাপাশি এস এম সুলতানের ‘কৃষক’ শিরোনামের ফসল তোলার মুহূর্তকে নিয়ে আঁকা ছবি দর্শকদের চেনা ছবি আবার দেখার তৃষ্ণা মেটায়। শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদের কাঠ খোদাই চিত্র ‘ফ্লাড’ বা বন্যা। ছবিটির বিস্তৃত অংশজুড়ে কালোর আধিক্যে খানিক আলোর রেখায় উদ্ভাসিত বন্যার মুহূর্ত দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। কবি শামসুর রাহমানের কবিতা অবলম্বনে আঁকা আমিনুল ইসলামের রেখাচিত্রের চারপাশে কাগজের পোড়া অংশ কবিতার সঙ্গে গভীর কালো রঙের সম্মিলন ভাবনায় বিলীন হয়েছে। মোহাম্মদ কিবরিয়ার মৃত্তিকালগ্ন ঘ্রাণের আভাস বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদী প্রকাশভঙ্গি আবারও মোহাম্মদ কিবরিয়ার শিল্পকর্মে ব্যবহূত মাটির ঘ্রাণের উপলব্ধি এনে দেয়। শিল্পী মনিরুল ইসলামের চারটি কাজে বিশুদ্ধ জ্যামিতিক রেখার ব্যবহার রং ও বুলেটের উপস্থিতি চেনা মনিরুল ইসলামের কাজকে আবারও আমাদের প্রাণিত করে। শিল্পী কনক চাঁপা চাকমার ‘মিউজিক’ ছবিতে পাহাড়ি জনপদে ব্যবহূত উপকরণ হাতে বাঁশের চোঙের ব্যবহার তুলে এনেছেন হালকা গাঢ় নীল, সাদা ও গাঢ় রঙের সাহায্যে।
খ্যাতিমান পথিকৃৎ শিল্পীদের একটি কাজও কোনো কোনো শিল্পীর একাধিক কাজের উপস্থিতি প্রদর্শনীকে করেছে বর্ণাঢ্য। দশক বিভাজনে হিসাব কষলে কিছু শিল্পীকে এ প্রদর্শনীতে পাওয়া যায় না। এ আয়োজনের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে চলতি দশকে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাওয়া তিন শিল্পীর কাজের উপস্থিতি। শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম ও সদ্য প্রয়াত শিল্পী ফখরুল ইসলামের কাজ আমাদের আবেগাক্রান্ত করে। বাস্তবধর্মী চিত্রকর্মের সঙ্গে নিরীক্ষাধর্মী, আধা বিমূর্ত, একেবারে বিমূর্ত শিল্পকর্মের পাশাপাশি কারুশিল্প, ট্যাপেস্ট্রি, ছোট আকৃতির ভাস্কর্য, ছাপচিত্রের প্রদর্শনের মাধ্যমে ৮৫ জন শিল্পীর নানামাত্রিক মাধ্যমের কাজ এ প্রদর্শনীকে বর্ণাঢ্য রূপ দিয়েছে। এ থেকে বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ধরন, মাধ্যম, অগ্রগতি উৎকর্ষের অবস্থা বোঝা যায়। পুরো মাত্রায় বাণিজ্যিক একটি গ্যালারির এ আয়োজন বাংলাদেশের শিল্পান্দোলনের ধারাবাহিক উত্তরণকে পাঠ করা সম্ভব।
গত শতকের পর এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চায় রত শিল্পীরা প্রথাগত ফ্রেমবন্দী ক্যানভাসের বাইরে এসে স্থাপনাশিল্প, ভিডিও আর্ট, ভিডিও ইনস্টলেশন, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়া প্রতিষ্ঠানের শিল্পের প্রথাগত ব্যাকরণ মেনে চলা রং ক্যানভাসের প্রতি ঝোঁক থাকা বাঞ্ছনীয়। নিরীক্ষারত তরুণ শিল্পীদের বিশ্ব শিল্পকলার পরিধিতে পদচারণে গড়ে উঠেছে পরিবর্তিত শিল্পকর্ম। শিল্পকর্ম সংগ্রাহকদের কাছে প্রিয় শিল্পীর কাজ পৌঁছে দেওয়ার জন্য, গ্যালারির সংগ্রহ সমৃদ্ধির জন্য সাজু শিল্পাঙ্গন ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত কাজের উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন: পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, শামসুল ইসলাম নিজামী, সমরজিৎ রায়চৌধুরী, আবু তাহের, মনিরুল ইসলাম, মিজানুর রহিম, মাহমুদুল হক, আবদুস সাত্তার, কালিদাস কর্মকার, আব্দুস শাকুর শাহ, বীরেন সোম, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, নাসিম আহমেদ নাদভী, নাইমা হক, জামাল আহমদ, মোহাম্মদ ইউনুস, শামসুদ্দোহা, নাসরিন বেগম, রোকেয়া সুলতানা, তাজুল ইসলাম, ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ, কনক চাঁপা চাকমা, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ ইকবাল প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.