শিল্পীর ভুবন-বিদগ্ধ বীক্ষণ by সিলভিয়া নাজনীন
শিল্পী নিসার হোসেন আমাদের সময়ের এমনই একজন শিল্পী, যিনি তাঁর শিল্পকর্ম, গবেষণা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ভেতর সমাজকে দেখিয়ে দিচ্ছেন তাঁর ক্ষত, অবক্ষয়ের বিস্তার এবং অবশ্যই তা থেকে পরিত্রাণের উপায়। একজন পরিপূর্ণ শিল্পী, সমাজলগ্ন চিন্তাবিদ এবং তাত্ত্বিকের সমকালীন উদাহরণ নিসার হোসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের পেছন দিকে ছায়াঘন পরিবেশের একাংশে শিক্ষক আবাসনে শিল্পী নিসার হোসেনের স্টুডিও। স্টুডিও অভিধায় ঠিক অনুভব করা যাবে না তাঁর ধ্যানমগ্ন হওয়ার নৈঃশব্দ বেষ্টিত পরিমণ্ডলটিকে। হঠাৎ করেই মনে হতে পারে লোকজ সংগ্রহের কোনো জাদুঘর অথবা কোনো সমৃদ্ধ লাইব্রেরি কিংবা কোনো নিবিষ্ট শিল্পীর চিত্রল ভুবন। অতি সাধারণ একটি দরজা পেরোলেই এক অনন্যসাধারণ জগৎ। নানা দেশের লোকজ সংগ্রহের অনেক নমুনা, সরাচিত্র, বিভিন্ন ধরনের মোটিফ, মুখোশ, লোকজ পুতুল, মনসাঘট, ডোকরার তৈরি নানা ফর্ম, রিকশা পেইন্টিংয়ের বৈচিত্র্যময় ভুবনে শিল্পী একান্ত সময় কাটান নিজের সঙ্গে; কখনো বই কখনোবা কোবাল্ট, প্রুশিয়ান ব্লু, আইভরি ব্ল্যাক আর ভারমিলিয়ান-ক্রিমসান রেডের সঙ্গে পেইন্টিংয়ে নিমগ্ন থাকেন। শিল্পকর্মে স্বকীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, জীবনের সব অভিজ্ঞতাকে একইভাবে দেখার সুযোগ নেই। আর্টকে একটি জার্নি হিসেবে দেখলে সব সময় একই বিষয়ে থাকাও সম্ভব নয়। একটি ঘরের সব জানালা দিয়ে তো একই দৃশ্য দেখা যায় না। তাই এই পরিবর্তন থাকা উচিত শিল্পীর কাজে ও চিন্তায়। আবার দীর্ঘদিনের চর্চার কিছু বিষয় থাকবে কাজে। পিকাসোর বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ বিভিন্ন রকম; কিন্তু আমরা বলতে পারি এটা তাঁর কাজ, কী করে? আসলে কোনো কোনো শিল্পীর কাজের পরিবর্তন সারফেসে দেখা যায়। আবার সোমনাথ হোরের শিল্পকর্মে তা প্রিন্ট, স্কাল্পচার, অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজও আছে, তবে তাঁর যে চরিত্র তা অত্যন্ত গভীর পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে আসে। সেটা সারফেসের না হলেও। অথচ তাঁর তো পরিচিতির সমস্যা হয় না। আমাদের শিল্পী কামরুল হাসানের কাজে ফোক আর্ট আছে, পিকাসো বা মাতিসের কাজে অভিজ্ঞতা আছে, নন্দলাল-যামিনী রায়েরও অভিজ্ঞতা আছে—সব ছাপিয়ে কামরুল হাসানের স্বকীয়তা দৃষ্টিগোচর হয়। বর্তমান সময়ে শিল্পীদের স্টাইল তৈরির প্রবণতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থেই ট্যালেন্টেড শিল্পীদের স্টাইল নিয়ে ভাবতে হয় না; কিন্তু যারা মেধাহীন তারা নিজের আইডেন্টিটি সংকটে ভোগে, তাই সারফেসে এমন কিছু বিষয় রেখে যায় যা দিয়ে নিজেকে চেনানো যায়। খুব দুর্বল শিল্পীর জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।’
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, রশীদ চৌধুরীর মতো পথিকৃৎ শিল্পীসহ ওয়াহিদুল হক, কলিম শরাফীর মতো ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেয়েছেন কৈশোরকালে। বাবা ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেনের যথাযথ উত্তরসূরি শিল্পী নিসার হোসেনের মনোগঠনের পুরোটাই সাংস্কৃতিক আবহে দারুণভাবে আবিষ্ট। শিল্পই তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, ভালোবাসা এবং জীবনযাপন। সহজাত প্রবণতায় সহজেই তিনি শিল্পকে তুলে ধরেন অনুরাগীর সামনে। ‘আমার নিজের কাজের সময় দেখি প্রিমিটিভ আর্য আমাকে প্রভাবিত করে বেশি। ইন্টেলেক্ট দিয়ে কাজের চেয়ে প্রিমিটিভ বিষয়ই ভেবেছি; চাইল্ড আর্ট, ফোক বা ট্রাইবাল আর্ট টানে আমাকে; এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যাদের নেই, তাদের বিষয়ে আগ্রহী আমি। এ ধরনের শিল্পের একটি সমস্যা—কীভাবে এই আর্ট কনটেম্পরারি হবে! আমি যে সোসাইটিতে আছি এর ছাপ তো আমার কাজে থাকতে হবে।’
সমাজকে উপস্থাপন করা তথা শিল্পের সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন শিল্পী নিসার হোসেন। আশির দশকে শিল্পবলয়কে নাড়িয়ে দেওয়া ‘সময়’ গ্রুপের অন্যতম সদস্য তিনি। সমাজবিমুখ কথিত বিশুদ্ধ বিমূর্তবাদিতাকে কখনো প্রশ্রয় দিতে দেখা যায়নি তাঁর ক্যানভাসে।
শিল্পের সঙ্গে অনেক বেশি সময় দেওয়ার তাগিদ থেকেই তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বলয়, যেখানে সাধারণত কারও প্রবেশাধিকার নেই। একজন উত্তরাধুনিক ঋষির আস্তানায় যতটা ধ্যানমগ্ন হওয়া সম্ভব শিল্পী নিসার হোসেনের স্টুডিওতে তার সৃজনপ্রক্রিয়ার উপকরণেই তা রয়েছে। ধ্যানের জন্য আলাদা নির্জনতা থাকলেও ওই নির্জনে বসে ভাবনার বিষয় কিন্তু অনেকটাই কোলাহলকেন্দ্রিক—‘এই শহরের বিশৃঙ্খল অবস্থা আমাকে তাড়িত করে। অনিয়মতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা, দুর্ভোগ, হতাশা, কোনো স্পেস নেই—নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না, ওভারলোডেড শহর-ঘরবাড়ি, জনসংখ্যা অনেক বেশি—এসবই আমার প্রতিদিনের সঙ্গী। আর এই মুহূর্তে আমি মিনিয়েচারের কিছু এলিমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। এই যে প্রচুর ক্রাউড, এটা আমার এখনকার ল্যাঙ্গুয়েজ।’
শিল্পী নিসার হোসেন: জন্ম ১৯৬১ সালে ঢাকায়। বর্তমান চারুকলা অনুষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে বিএফএ শেষ করেন। ১৯৮৫ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে এমএফএ করেন। তিনি দেশে-বিদেশে বেশ কিছু একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, রশীদ চৌধুরীর মতো পথিকৃৎ শিল্পীসহ ওয়াহিদুল হক, কলিম শরাফীর মতো ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেয়েছেন কৈশোরকালে। বাবা ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেনের যথাযথ উত্তরসূরি শিল্পী নিসার হোসেনের মনোগঠনের পুরোটাই সাংস্কৃতিক আবহে দারুণভাবে আবিষ্ট। শিল্পই তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, ভালোবাসা এবং জীবনযাপন। সহজাত প্রবণতায় সহজেই তিনি শিল্পকে তুলে ধরেন অনুরাগীর সামনে। ‘আমার নিজের কাজের সময় দেখি প্রিমিটিভ আর্য আমাকে প্রভাবিত করে বেশি। ইন্টেলেক্ট দিয়ে কাজের চেয়ে প্রিমিটিভ বিষয়ই ভেবেছি; চাইল্ড আর্ট, ফোক বা ট্রাইবাল আর্ট টানে আমাকে; এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যাদের নেই, তাদের বিষয়ে আগ্রহী আমি। এ ধরনের শিল্পের একটি সমস্যা—কীভাবে এই আর্ট কনটেম্পরারি হবে! আমি যে সোসাইটিতে আছি এর ছাপ তো আমার কাজে থাকতে হবে।’
সমাজকে উপস্থাপন করা তথা শিল্পের সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন শিল্পী নিসার হোসেন। আশির দশকে শিল্পবলয়কে নাড়িয়ে দেওয়া ‘সময়’ গ্রুপের অন্যতম সদস্য তিনি। সমাজবিমুখ কথিত বিশুদ্ধ বিমূর্তবাদিতাকে কখনো প্রশ্রয় দিতে দেখা যায়নি তাঁর ক্যানভাসে।
শিল্পের সঙ্গে অনেক বেশি সময় দেওয়ার তাগিদ থেকেই তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বলয়, যেখানে সাধারণত কারও প্রবেশাধিকার নেই। একজন উত্তরাধুনিক ঋষির আস্তানায় যতটা ধ্যানমগ্ন হওয়া সম্ভব শিল্পী নিসার হোসেনের স্টুডিওতে তার সৃজনপ্রক্রিয়ার উপকরণেই তা রয়েছে। ধ্যানের জন্য আলাদা নির্জনতা থাকলেও ওই নির্জনে বসে ভাবনার বিষয় কিন্তু অনেকটাই কোলাহলকেন্দ্রিক—‘এই শহরের বিশৃঙ্খল অবস্থা আমাকে তাড়িত করে। অনিয়মতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা, দুর্ভোগ, হতাশা, কোনো স্পেস নেই—নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না, ওভারলোডেড শহর-ঘরবাড়ি, জনসংখ্যা অনেক বেশি—এসবই আমার প্রতিদিনের সঙ্গী। আর এই মুহূর্তে আমি মিনিয়েচারের কিছু এলিমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। এই যে প্রচুর ক্রাউড, এটা আমার এখনকার ল্যাঙ্গুয়েজ।’
শিল্পী নিসার হোসেন: জন্ম ১৯৬১ সালে ঢাকায়। বর্তমান চারুকলা অনুষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে বিএফএ শেষ করেন। ১৯৮৫ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে এমএফএ করেন। তিনি দেশে-বিদেশে বেশ কিছু একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
No comments