শেকড়ের ডাক-ইলিয়াস আলী, হরতাল ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা by ফরহাদ মাহমুদ
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ১৯ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত হোটেল রূপসী বাংলায় (সাবেক শেরাটন) ছিলেন। এরপর থেকে তিনি কোথায় গেলেন, কোথায় আছেন, জীবিত আছেন কি না- কিছুই জানা যাচ্ছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তাঁকে সরকারের কোনো বাহিনী গুম করেছে।
পুলিশ ও র্যাবের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। র্যাব ও পুলিশ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা ইলিয়াস আলীর সন্ধান পেতে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় তারা ইলিয়াস আলীর খোঁজে হানাও দিচ্ছে। সরকারও বলেছে, ইলিয়াস আলীর ঘটনায় সরকার বিব্রত এবং ইলিয়াস আলীর সন্ধানে তারা আন্তরিকভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারের কোনো কোনো শীর্ষ ব্যক্তি সন্দেহ পোষণ করেছেন, রাজনৈতিক ফায়দা লোটা কিংবা ইস্যু তৈরির জন্য বিএনপিই ইলিয়াস আলীকে গুম করে থাকতে পারে। এদিকে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে ১৯ এপ্রিল বৃহত্তর সিলেটে এবং ২২, ২৩ ও ২৪ তারিখ সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। হরতাল কোথাও অহিংস ছিল না। ২১ এপ্রিল হরতালের আগের দিন আতঙ্ক সৃষ্টির কৌশল হিসেবে একজন বাসচালককে পুড়িয়ে মারা হয়। দেশব্যাপী হরতালের প্রথম দিনে সাভারে একটি গাড়িকে হরতালকারীরা তাড়া করলে চালক দ্রুত পালানোর চেষ্টা করেন এবং দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। হরতালের সময় কয়েক ডজন গাড়ি ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় পুলিশ ও হরতালকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়, থানায় হামলা চালানো হয় এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস ও বাসভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় পুলিশসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয় এবং ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে মিলিয়ে মোট তিনজনের মৃত্যু হয়। কিন্তু ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে গোটা দেশ যেমন অন্ধকারে ছিল তেমনি অন্ধকারে রয়ে গেছে। এক বিশাল তথ্যশূন্যতার মধ্যে নানা রকম অনুমান ডালপালা বিস্তার করছে।
আসলে সব মানুষই তথ্য পেতে চায়, প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়। আর যখনই তথ্যের অভাব হয়, ভেতরের প্রশ্নগুলো উত্তরহীন থেকে যায়, তখনই মানুষ তার কল্পনা শক্তি বা অনুমানকে কাজে লাগায়। সৃষ্টি হয় অনুমানভিত্তিক ব্যাখ্যা। এক কান, দুকান হতে হতে তা কখনো কখনো গল্পেরও রূপ নেয়। আবার কেউ কেউ তথ্যশূন্যতার এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ স্বার্থে গুজব ছড়ায় অথবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। এটি যেমন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির ক্ষেত্রে ঘটেছিল, তেমনি ইলিয়াস আলীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে ইতিমধ্যে যেসব ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, যুক্তি বা অনুমানের কথা লোকমুখে প্রচলিত হয়েছে, তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরছি।
১. সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নিয়ে যে অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে, সেটিকে ধামাচাপা দিতে কিংবা জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতে ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে।
২. সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ির চালকের (যিনি পিলখানায় বিজিবির গেটে গাড়ি ঢুকিয়েছিলেন) সঙ্গে ইলিয়াস আলীর যোগাযোগ ছিল এবং তাঁর পরিকল্পনায়ই সেটি ঘটেছে, তারই প্রতিশোধ হিসেবে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
৩. সিলেটে বিএনপির একাধিক উপদল রয়েছে, যাঁরা ইলিয়াস আলীর শক্তি-সামর্থ্যের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না, তেমনি একটি উপদল এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
৪. কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে বলছেন, প্রয়াত একজন নেতার ছেলে এই ঘটনার মূল নায়ক এবং ইতিমধ্যে ইলিয়াস আলীকে মেরে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনুমতি নিয়েই তা করা হয়েছে এবং এতে আইএসআইকেও কাজে লাগানো হয়েছে।
৫. ইলিয়াস আলী দাপটের সঙ্গে সিলেটে বিএনপির রাজনীতি করলেও তিনি কখনো জামায়াতকে সহ্য করেননি এবং তাঁর কারণে জামায়াত সিলেটে মাথাচাড়া দিতে পারছিল না। তাই জামায়াত সুপরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করেছে। এটি বিশ্বাসযোগ্য করতে লন্ডনস্থিত স্বনামখ্যাত একজন বাংলাদেশির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, তাঁকে নাকি একজন জামায়াতকর্মী বলেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই ইলিয়াস আলীকে 'নাই' করে দেওয়া হবে।
৬. ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে সিলেটে বিএনপি টিপাইমুখ নিয়ে জোরদার আন্দোলন উঠেছিল। তাই তাঁর ওপর ভারত খুব নাখোশ হয়েছিল এবং ভারতই তাঁকে গুম করেছে।
৭. ঘটনাটি পুলিশ বা র্যাব ঘটায়নি। এটি ঘটিয়েছে আরেকটি সরকারি বাহিনী, যারা সচরাচর এ ধরনের ঘটনা ঘটায় না। এর সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশ রয়েছে।
৮. ইলিয়াস আলীর কী হয়েছে, তা তো বোঝা যাচ্ছে বিএনপির হরতাল আহ্বান এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির কৌশল থেকেই। তারা সেই সব তারিখে হরতাল দিচ্ছে, যেসব তারিখে আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শুনানি থাকছে। এটি আসলে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির একটি অপচেষ্টা মাত্র।
৯. তাঁকে নাকি অপহরণ করেছিল সরকারি বাহিনী। তাঁকে নাকি ছাড়া হচ্ছে না বেশ কিছু শর্তে আপস না করার কারণে। যেমন- তিনি আর রাজনীতি করবেন না। বলতে হবে তিনি বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই আত্মগোপন করেছিলেন ইত্যাদি।
এমন আরো অনেক অনুমানের কথাই আমরা শুনছি। এর কোনটা যে অনুমান, কোনটা যুক্তি এবং কোনটা নিজ নিজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে প্রচারিত গুজব, তা সবক্ষেত্রে বলা মুশকিল। তবে কিছু কিছু বক্তব্যে যে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, তা অনুমান করা যায়। যা হোক, একটি কথা তো সত্য যে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ১০ দিন হয়ে গেছে। পুলিশ, র্যাব কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শত চেষ্টা করেও তাঁর কোনো সন্ধান আমাদের দিতে পারেনি। এই ব্যর্থতার দায় তো সরকারকেই বহন করতে হবে। শুধু ইলিয়াস আলী নয়, এর আগেও অনেকে অপহৃত হয়েছেন। কারো কারো মৃতদেহ মিলেছে। আবার বছরের পর বছর চলে গেলেও কারো কারো কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি। কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা, জনমনে গভীর উদ্বেগেরই জন্ম দেবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাই জনমনের এই উদ্বেগের বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। উদ্বেগ কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। তা না করে, মাঝেমধ্যে বেফাঁস উক্তি করলে সমস্যার গভীরতা ও বিস্তৃতি বাড়বে বই কমবে না।
অন্যদিকে ইলিয়াস আলীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপি হরতাল ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের যেসব কর্মসূচি দিয়ে চলেছে, তাও কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইলিয়াস আলীর জন্য দেশের মানুষও ব্যথিত, তারাও দ্রুত তাঁর সন্ধান চায়। কিন্তু একে পুঁজি করে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির কিংবা দেশের কোটি কোটি মানুষকে দুর্ভোগে ফেলার কোনো অধিকার বিএনপির নেই- সেটা মনে রাখতে হবে। হ্যাঁ, স্বীকার করি, হরতাল করার গণতান্ত্রিক অধিকার বিএনপির আছে। কিন্তু মানুষ পুড়িয়ে, বোমা মেরে, বাসে কিংবা ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে, আতঙ্ক বিস্তার করে কিংবা নির্যাতনের মাধ্যমে মানুষকে বাধ্য করে হরতাল পালনের কোনো অধিকার গণতন্ত্র কাউকে দেয়নি, বিএনপিকেও দেয়নি। ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে হরতাল হয়েছে, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময়ও হরতাল হয়েছে, সেসব হরতালে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। হরতাল করার জন্য কারো ওপর জবরদস্তি করার প্রয়োজন হয়নি। কারণ, তখন ইস্যু ছিল, হরতালের পক্ষে যুক্তি ছিল। হরতালের নামে এখন যা করা হচ্ছে তাকে কোনো মতেই গণতান্ত্রিক বা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যাবে না। আমরা কোনোভাবেই এ ধরনের হরতালের পুনরাবৃত্তি চাই না।
অন্যদিকে সরকারি দলের যেসব নেতা বলেন, হরতালে আওয়ামী লীগও মাঠে থাকবে- আমরা তারও নিন্দা জানাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী রয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় নামলে দেশকে সংঘাতের দিকেই কেবল ঠেলে দেওয়া হবে। গত কয়েক দিনের হরতালের সময় এ রকম অনেক সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছেও। দেশকে এভাবে সংঘাত-সংঘর্ষের পথে ঠেলে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। আর এভাবে হরতালও প্রতিরোধ করা যায় না। বরং ভয়ে মানুষ রাস্তাঘাট ছেড়ে যায় এবং হরতাল আরো সফল হয়। তাই সরকারি দলের কাছে আমরা আরো গঠনমূলক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক আচরণ আশা করি। বিএনপির কয়েকজন নেতাকে ডেকে নিয়ে আলোচনা করুন। ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে কী কী করেছেন এবং কী কী করা যায়- তা নিয়ে আলোচনা করুন। সর্বোপরি দ্রুত ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করুন। তা না হলে দেশের মানুষ কি পুলিশ ও গোয়েন্দাদের এই ব্যর্থতা দেখার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে যাবে?
লেখক : সাংবাদিক
আসলে সব মানুষই তথ্য পেতে চায়, প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়। আর যখনই তথ্যের অভাব হয়, ভেতরের প্রশ্নগুলো উত্তরহীন থেকে যায়, তখনই মানুষ তার কল্পনা শক্তি বা অনুমানকে কাজে লাগায়। সৃষ্টি হয় অনুমানভিত্তিক ব্যাখ্যা। এক কান, দুকান হতে হতে তা কখনো কখনো গল্পেরও রূপ নেয়। আবার কেউ কেউ তথ্যশূন্যতার এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ স্বার্থে গুজব ছড়ায় অথবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। এটি যেমন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির ক্ষেত্রে ঘটেছিল, তেমনি ইলিয়াস আলীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে ইতিমধ্যে যেসব ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, যুক্তি বা অনুমানের কথা লোকমুখে প্রচলিত হয়েছে, তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরছি।
১. সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নিয়ে যে অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে, সেটিকে ধামাচাপা দিতে কিংবা জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতে ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে।
২. সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ির চালকের (যিনি পিলখানায় বিজিবির গেটে গাড়ি ঢুকিয়েছিলেন) সঙ্গে ইলিয়াস আলীর যোগাযোগ ছিল এবং তাঁর পরিকল্পনায়ই সেটি ঘটেছে, তারই প্রতিশোধ হিসেবে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
৩. সিলেটে বিএনপির একাধিক উপদল রয়েছে, যাঁরা ইলিয়াস আলীর শক্তি-সামর্থ্যের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না, তেমনি একটি উপদল এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
৪. কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে বলছেন, প্রয়াত একজন নেতার ছেলে এই ঘটনার মূল নায়ক এবং ইতিমধ্যে ইলিয়াস আলীকে মেরে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনুমতি নিয়েই তা করা হয়েছে এবং এতে আইএসআইকেও কাজে লাগানো হয়েছে।
৫. ইলিয়াস আলী দাপটের সঙ্গে সিলেটে বিএনপির রাজনীতি করলেও তিনি কখনো জামায়াতকে সহ্য করেননি এবং তাঁর কারণে জামায়াত সিলেটে মাথাচাড়া দিতে পারছিল না। তাই জামায়াত সুপরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করেছে। এটি বিশ্বাসযোগ্য করতে লন্ডনস্থিত স্বনামখ্যাত একজন বাংলাদেশির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, তাঁকে নাকি একজন জামায়াতকর্মী বলেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই ইলিয়াস আলীকে 'নাই' করে দেওয়া হবে।
৬. ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে সিলেটে বিএনপি টিপাইমুখ নিয়ে জোরদার আন্দোলন উঠেছিল। তাই তাঁর ওপর ভারত খুব নাখোশ হয়েছিল এবং ভারতই তাঁকে গুম করেছে।
৭. ঘটনাটি পুলিশ বা র্যাব ঘটায়নি। এটি ঘটিয়েছে আরেকটি সরকারি বাহিনী, যারা সচরাচর এ ধরনের ঘটনা ঘটায় না। এর সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশ রয়েছে।
৮. ইলিয়াস আলীর কী হয়েছে, তা তো বোঝা যাচ্ছে বিএনপির হরতাল আহ্বান এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির কৌশল থেকেই। তারা সেই সব তারিখে হরতাল দিচ্ছে, যেসব তারিখে আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শুনানি থাকছে। এটি আসলে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির একটি অপচেষ্টা মাত্র।
৯. তাঁকে নাকি অপহরণ করেছিল সরকারি বাহিনী। তাঁকে নাকি ছাড়া হচ্ছে না বেশ কিছু শর্তে আপস না করার কারণে। যেমন- তিনি আর রাজনীতি করবেন না। বলতে হবে তিনি বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই আত্মগোপন করেছিলেন ইত্যাদি।
এমন আরো অনেক অনুমানের কথাই আমরা শুনছি। এর কোনটা যে অনুমান, কোনটা যুক্তি এবং কোনটা নিজ নিজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে প্রচারিত গুজব, তা সবক্ষেত্রে বলা মুশকিল। তবে কিছু কিছু বক্তব্যে যে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, তা অনুমান করা যায়। যা হোক, একটি কথা তো সত্য যে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ১০ দিন হয়ে গেছে। পুলিশ, র্যাব কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শত চেষ্টা করেও তাঁর কোনো সন্ধান আমাদের দিতে পারেনি। এই ব্যর্থতার দায় তো সরকারকেই বহন করতে হবে। শুধু ইলিয়াস আলী নয়, এর আগেও অনেকে অপহৃত হয়েছেন। কারো কারো মৃতদেহ মিলেছে। আবার বছরের পর বছর চলে গেলেও কারো কারো কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি। কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা, জনমনে গভীর উদ্বেগেরই জন্ম দেবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাই জনমনের এই উদ্বেগের বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। উদ্বেগ কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। তা না করে, মাঝেমধ্যে বেফাঁস উক্তি করলে সমস্যার গভীরতা ও বিস্তৃতি বাড়বে বই কমবে না।
অন্যদিকে ইলিয়াস আলীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপি হরতাল ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের যেসব কর্মসূচি দিয়ে চলেছে, তাও কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইলিয়াস আলীর জন্য দেশের মানুষও ব্যথিত, তারাও দ্রুত তাঁর সন্ধান চায়। কিন্তু একে পুঁজি করে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির কিংবা দেশের কোটি কোটি মানুষকে দুর্ভোগে ফেলার কোনো অধিকার বিএনপির নেই- সেটা মনে রাখতে হবে। হ্যাঁ, স্বীকার করি, হরতাল করার গণতান্ত্রিক অধিকার বিএনপির আছে। কিন্তু মানুষ পুড়িয়ে, বোমা মেরে, বাসে কিংবা ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে, আতঙ্ক বিস্তার করে কিংবা নির্যাতনের মাধ্যমে মানুষকে বাধ্য করে হরতাল পালনের কোনো অধিকার গণতন্ত্র কাউকে দেয়নি, বিএনপিকেও দেয়নি। ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে হরতাল হয়েছে, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময়ও হরতাল হয়েছে, সেসব হরতালে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। হরতাল করার জন্য কারো ওপর জবরদস্তি করার প্রয়োজন হয়নি। কারণ, তখন ইস্যু ছিল, হরতালের পক্ষে যুক্তি ছিল। হরতালের নামে এখন যা করা হচ্ছে তাকে কোনো মতেই গণতান্ত্রিক বা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যাবে না। আমরা কোনোভাবেই এ ধরনের হরতালের পুনরাবৃত্তি চাই না।
অন্যদিকে সরকারি দলের যেসব নেতা বলেন, হরতালে আওয়ামী লীগও মাঠে থাকবে- আমরা তারও নিন্দা জানাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী রয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় নামলে দেশকে সংঘাতের দিকেই কেবল ঠেলে দেওয়া হবে। গত কয়েক দিনের হরতালের সময় এ রকম অনেক সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছেও। দেশকে এভাবে সংঘাত-সংঘর্ষের পথে ঠেলে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। আর এভাবে হরতালও প্রতিরোধ করা যায় না। বরং ভয়ে মানুষ রাস্তাঘাট ছেড়ে যায় এবং হরতাল আরো সফল হয়। তাই সরকারি দলের কাছে আমরা আরো গঠনমূলক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক আচরণ আশা করি। বিএনপির কয়েকজন নেতাকে ডেকে নিয়ে আলোচনা করুন। ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে কী কী করেছেন এবং কী কী করা যায়- তা নিয়ে আলোচনা করুন। সর্বোপরি দ্রুত ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করুন। তা না হলে দেশের মানুষ কি পুলিশ ও গোয়েন্দাদের এই ব্যর্থতা দেখার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে যাবে?
লেখক : সাংবাদিক
No comments