স্মরণ-আসুন, স্মরণ করি সন্তোষ গুপ্তকে by অজয় রায়

সন্তোষদার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল ঢাকা জিলা কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে। জজ কোর্টের পেছনে কোর্ট হাউস স্ট্রিটে আশা বোর্ডিংয়ের দোতলায় ছিল অফিস। তখন ব্রিটিশ শাসনের অবসান, দেশ বিভাগ প্রভৃতি কারণে টালমাটাল একসময় ছিল তা।


সে সময়েই জ্ঞানদা, জ্ঞান চক্রবর্তী এক বিকেলে আলাপ করিয়ে দিলেন ধুতি আর সাদা শার্ট পরা রোগাটে চেহারার এক ভঙ্গুর লোকের সঙ্গে। জানালেন, কারা বিভাগে কাজ করেন। বাড়ি বরিশাল। অবসর নিয়ে ঢাকায় এসেছেন কলকাতা থেকে। নাম সন্তোষ গুপ্ত। সেদিন একটু বিস্মিত দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিলাম তাঁর দিকে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সরকারি চাকরি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে কে কোথায় চাকরি করবেন তা নির্ধারণ করে কর্তৃপক্ষকে জানাতে। যাতে ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য কাউকে অসুবিধা ভোগ করতে না হয় সেই অজুহাতে এ পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছিল এবং তার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরও পাকাপোক্ত করা হয়েছিল। হিন্দু কর্মচারীরা অপশন নিচ্ছিলেন ভারতে এবং মুসলিম কর্মচারীরা অভিপ্রায় জ্ঞাপন করেছিলেন পাকিস্তানে কাজ করার। এ রকম পরিবেশে সন্তোষ বাবুর ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তে স্বাভাবিকভাবে একটু বিস্ময়কর মনে হয়েছিল বৈকি! প্রশ্ন করায় তিনি জানিয়েছিলেন, আমার বাড়ি তো বরিশাল। কাজেই নিজের দেশের পক্ষে অপশন দিলাম।
কলকাতায় থাকতেই সম্পর্ক ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। ঢাকায় এসেও প্রথম সুযোগেই যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। কারা বিভাগের আইজির অফিসে তাঁর পোস্টিং হয়েছিল। কিছুটা স্পর্শকাতর এলাকা। সে জন্য পার্টির সঙ্গে প্রকাশ্য যোগাযোগ না রাখার জন্যই বলা হয়েছিল তাঁকে। পাকিস্তানে কার্যত প্রকাশ্যে কাজ করা কমিউনিস্টদের জন্য সম্ভব হবে, সে বিষয়ে সংশয় ছিল কমিউনিস্টদের। সে কারণেই সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
সেদিন এই সুপারিশ যে কত সঠিক ছিল, তা অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই দমননীতি নেমে এল পার্টির ওপর। গ্রেপ্তার অভিযান চলল তাঁদের ওপর। সন্তোষ বাবুর বাড়ি নিরাপদ মনে করেই তা ব্যবহূত হতে শুরু করল ঢাকা জেলার হেড কোয়ার্টার হিসেবে। ভালোই চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পার্টির মধ্যে অনুপ্রবেশকারী পুলিশি চরের বিশ্বাসঘাতকতায় হামলা হলো সন্তোষ বাবুর বাড়িতে। বাসা থেকে আত্মগোপনকারী সরদার ফজলুল করিম, রেলশ্রমিক মো. আবদুল বারী ছাড়াও গ্রেপ্তার হলেন সন্তোষ বাবু এবং তাঁর মা। আর তারপর থেকে বলতে গেলে শুরু হলো সন্তোষ বাবুর আরেক জীবন। সরাসরি রাজনৈতিক কর্মীর কাতার থেকে সাংবাদিকতার কাতারে শামিল হলেন তিনি। তারপরের বাকি জীবন কেটেছে সাংবাদিকতায়ই। প্রধানত সংবাদ পত্রিকায়।
বস্তুত, একসময় সন্তোষ গুপ্ত এবং সংবাদকে অভিন্ন সত্তা বলে মানা হতো, অন্তত আমার কাছে। পাতলা ছিপছিপে চেহারার ব্যক্তিটি হয় সম্পাদকীয় লেখায় অথবা পত্রিকার অন্য কোনো কাজে অপূর্ব এভাবে যখনই সংবাদ -এ গেছি, তখনই দেখেছি তাঁকে। লিখছেন, আর আশপাশে উপস্থিতদের সঙ্গে আলাপে অংশও নিচ্ছেন। এভাবেই দেখতাম তাঁকে।
১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনের শুরুতেই আমাদের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকেও। দুই বছর অজ্ঞাতবাসের পর যখন গ্রেপ্তার হলাম তখন আবার দেখা হলো তাঁর সঙ্গে।
সন্তোষ বাবু যে কবিতা লিখতেন এবং ভালোই লিখতেন তা জানা ছিল। এর আগে যখন কুমিল্লা জেলে আটক ছিলেন তখন তাঁর লেখা কবিতা সম্পর্কে শুনেছিলাম বড় একজন নেতার কাছে। এবার অর্থাৎ ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে তার প্রমাণ পেলাম। প্রায় রোজই তাঁর নতুন লেখা কবিতা শোনালেন তিনি।
যখন দৈনিক পত্রিকায় কাজে বেশি করে জড়িয়ে পড়তে হলো তখন সময়াভাবে হয়তো আগের মতো লিখতে পারতেন না। পত্রিকার জন্য কাজ করতে হতো।
তা ছাড়া ছিল পড়ার অভ্যাস। জানার জন্য আকাঙ্ক্ষা ছিল অপরিসীম। খুব ভোরে উঠতেন এবং সকালবেলাটা কাটাতেন পড়ার টেবিলে। স্বাধীনতার পরে যখন স্থায়ীভাবে ঢাকায় আবাসন গড়তে হলো, তখন থাকতাম ওয়ারীতে। সন্তোষ বাবুও থাকতেন টিপু সুলতান রোডে। তখন মাঝেমধ্যে তাঁর ওখানে গেছি, তখন যা দেখেছি তা-ই বলতাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় ন্যাপের মুখপত্র নতুন বাংলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্বাভাবিকভাবে।
দেশে ফিরেও তিনি শুধু বাঙালি নয়, অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের অনুসারীদের সমর্থনে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন।
বিশেষ করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু এবং পরে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে জাতীয় চার নেতার হত্যার পর স্বাভাবিকভাবে অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পরই অনুষ্ঠান করে আবার ফিরেছেন সেই কাজের ওপর আর সে জন্যই জাতীয়তাবাদী শক্তি দেশে আরও শক্তিশালী হোক তা কামনা করেছেন। আর সেই কাজে নিজ দায়িত্ব অনুভব করে বামপন্থীরা স্বউদ্যোগে এগিয়ে আসবেন কামনা করেছেন তা। এ প্রশ্নে বামপন্থীদের সংকীর্ণতা দেখলে ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্বাভাবিকভাবে।
কিন্তু তাই বলে যৌবনের ক্ষুরধার যে বিশ্বাস নিয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন, সেই বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হননি কোনো দিন। আর সেই বিশ্বাসই তাঁকে নিয়ে গেছে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জাতীয় চেতনার উদ্বোধনের কাজের মাধ্যমে নিজেকে যুক্ত রাখতে।
এই প্রয়োজনীয়তা আজও শেষ হয়ে যায়নি। সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে পরাস্ত করে শুভ এবং কল্যাণকর শক্তির বিজয় আজও পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হয়নি। আর সে জন্যই সন্তোষ বাবু এবং তাঁর মতো যাঁরা এই সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের স্মরণ করা প্রয়োজন। তাঁদের স্মৃতি যাতে অম্লান থাকে সে জন্য পাঠ্যপুস্তকে তাঁদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এখনই দরকার তাঁদের স্মৃতি অম্লান করে রাখার জন্য উদ্যোগ নেওয়া। নিজেদের প্রয়োজনেই স্মরণ করা দরকার সন্তোষদা এবং তাঁর মতো অন্যদের স্মৃতি।

No comments

Powered by Blogger.