ইসলামে শ্রম ও অর্থনৈতিক চিন্তা by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

জীবনধারণের জন্য মানব সমাজকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। বড় বড় আকাঙ্ক্ষা অর্জন করার জন্য উদ্যম ও প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। কোনো জাতিকে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে হলে অবশ্যই সেই জাতিকে কর্মতৎপর হতে হবে; অলসতা পরিহার করতে হবে। এক কথায়_ মানুষের জন্য পানাহার যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি কাজও জরুরি।


ইসলাম কাজকে বেশ বিস্তৃত পরিসরে চিন্তা করে। মানুষের সঙ্গে সৃষ্টি জগতের অন্যান্য সম্পর্কের মতোই কাজও পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক উভয়দিক থেকেই প্রয়োজনীয়। এই মূলনীতির আলোকেই মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ জীবনের প্রত্যেকটি বিষয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও কাঠামো অনুযায়ী সম্পাদিত হয়। ইসলামী চিন্তাদর্শ অনুযায়ী মানুষের জীবনের দুটি দিক রয়েছে। একটি তার বস্তুগত জীবন; অপরটি আধ্যাত্মিক জীবন। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টিকুলের সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং অপরাপর সব সৃষ্টির ওপর মানুষকে মর্যাদাবান করেছেন। তাই মানুষের কর্তব্য হলো তার অভ্যন্তরীণ মেধা ও সৃজনশীলতা এবং তার বোধ ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে মানবীয় পূর্ণতায় পেঁৗছার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহতায়ালা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা, পন্থা ও উপায়-উপকরণ দিয়ে দিয়েছেন। যাতে মানুষ তার বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলো সহজেই মেটাতে পারে। মানুষ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য কাজ করতে বাধ্য। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, ইসলামের দৃষ্টিতে কাজের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
কর্মতৎপরতা ইহকাল এবং পরকালীন জগতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণী একটি উপায়। কোরআনে কারিমের প্রায় আশিটিরও বেশি আয়াতে মানুষের সৌভাগ্যের শর্ত হিসেবে দুটি বিষয়ের কথা উলেল্গখ করেছে। একটি হলো তার ইমান; অপরটি সৎ কাজ। পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য সময় দেওয়া এবং পরিশ্রম করা সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত। সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যে, 'ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিধিবিধানের আলোকে জনকল্যাণ ও সামাজিক মর্যাদাকে উন্নত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সেবামূলক কাজকর্ম কিংবা পণ্য উৎপাদন করার জন্য যেসব তৎপরতা চালানো হয়, সেসব তৎপরতাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয়।'
আয় উপার্জনের মৌলিক পন্থা হলো কর্মতৎপরতা। কোরআনে কারিমের বহু আয়াতে মানুষের জীবিকার প্রয়োজন মেটানোর জন্য আল্লাহর দেওয়া রহমত ও অনুগ্রহের খোঁজে মানুষকে জমিনে চাষাবাদ করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করে বহুভাবে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। বহু আয়াতে আসমান এবং জমিনকে মানুষের বশীভূত করার কথা, দিন-রাত সৃষ্টির কথা, বাতাস এবং বৃষ্টিকে পাঠানোর কথা, নৌকা চালানোসহ ইত্যাদির কথা উলেল্গখ করা হয়েছে। আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ কামনা এবং রুটি-রুজির অনুসন্ধান প্রসঙ্গেই এসবের উলেল্গখ করা হয়েছে। আর আল্লাহতায়ালাও তার প্রাকৃতিক নিয়ামতগুলোকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব মানুষের ওপর অর্পণ করেছেন। মানুষের দায়িত্ব হলো দিন-রাত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেককে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ এবং উন্নতি বিধান করা। কোরআনে কারিমের সূরা হুদের ৬১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা মানুষকে জমিনে চাষাবাদ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহতায়ালা মানুষের জন্য সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধাকে প্রস্তুত করে রেখেছেন, এখন মানুষের কাজ হলো সেগুলোকে খুঁজে বের করা এবং সেগুলোর সাহায্যে নিজেদের সার্বিক অভাব ও দৈন্যতা দূর করা।
কোরআনে কারিমের অসংখ্য আয়াতে মানুষের জন্য দেওয়া আল্লাহর নিয়ামতের কথা বলা হয়েছে। সূরা লোকমানের ২০ নম্বর আয়াতে এই নিয়ামতের কথা বলা হয়েছে এভাবে, 'তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নিয়ামতগুলো পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন?'
একইভাবে সূরা কাসাসের ৭৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহর দেওয়া সেসব নিয়ামতকে পরকালীন জীবনের পাথেয় সঞ্চয়ের কাজে ব্যবহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তা দিয়ে পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার লাভবান হওয়ার কথা ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।' প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিকে জয় করে আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতগুলো অর্জন করতে হলে শ্রমের কোনো বিকল্প নেই। কর্মহীন জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে সেসব অর্জন করার কোনো সুযোগ নেই। আয়াতে 'প্রকৃতিকে জয় করা' বলার মানে হলো, ব্যবসা-বাণিজ্য, পশুপালন, কৃষিকাজ, খনিজসম্পদ উত্তোলনসহ নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনের মতো কাজ করার মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। আর এসব কাজ করতে গেলে মেধা খাটাতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়। এই পরিশ্রমই উন্নতি ও সৌভাগ্যের মূল চাবিকাঠি। মানুষের জন্য আল্লাহতায়ালা কাজ করার ওপর এত গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও অনেকে মনে করেন জীবন-জীবিকার জন্য কাজ করা দুনিয়া পূজার শামিল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, রুটি-রুজির বিষয়টি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়েই আছে; ফলে কাজের মাঝে তার কোনো লাভ-ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অথচ সব নবী-রাসূলই (আ.) পৃথিবীতে এসে ব্যাপক পরিশ্রম করেছেন এবং অন্যদেরও সৎ পথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.