ঢাকার ফয়েজ আহ্মদ by মফিদুল হক
ফয়েজ আহ্মদ ঢাকার সন্তান, বিক্রমপুরে তাঁর জন্ম, যে বিক্রমপুরবাসীর জন্য ঢাকা ছিল বিশেষ গর্বের শহর, নিজেদের শহর। দেশভাগ-পরবর্তীকালে জেলা শহর ঢাকা আকস্মিকভাবে রূপান্তরিত হয়েছিল প্রাদেশিক রাজধানীতে। সে সময় থেকে ঢাকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন ফয়েজ আহ্মদ।
দেশভাগ-পূর্ববর্তী ঢাকা শহরও তাঁর একেবারে অচেনা ছিল না। তখন স্কুলপড়ুয়া হিসেবে ঢাকায় আসা এবং অভিনব এক শহরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। সাংবাদিক হিসেবে ফয়েজ আহ্মদ জীবনভর অন্যের সম্পর্কে লিখে গেছেন, নিজের কথা বলা তাঁর বিশেষ হয়ে ওঠেনি। তিনি লিখেছিলেন, ‘জীবন শুরু খবর নিয়ে/ জীবন-সারা খবর দিয়ে।’ জীবনকর্ম থেকে অবসর নিয়ে আরেক ধরনের কাজে যখন তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন সেই পরিণত বয়সে লেখা ছড়া-কবিতায় ফয়েজ আহ্মদের ঢাকা-দর্শনের ছায়াপাত রয়েছে। ১১ বছর বয়সে ফয়েজ আহ্মদ প্রথম ঢাকায় এলেন এবং মুগ্ধ হলেন ঝলমলে পোশাকে সজ্জিত ব্যান্ডপার্টি দেখে। পরিণত বয়সের ছড়ায় তিনি লিখেছিলেন, ‘ঢাকায় আছে ব্যাগপাইপার বাদক/ তারা হলেন প্রাচীন গায়ক সাধক/ বিয়ে বাড়ির তারা/ উৎসবে প্রাণহারা/ মাতিয়ে তুলেন পাড়া/ মনকে দেবে নাড়া।/ বাদকরা সব পোশাক পরেন নবাবী/ কিন্তু তারা শান্ত কোমল স্বভাবী।’
এ ছড়ায় কৌতুকছলে নবাববাড়ির প্রসঙ্গ টেনেছেন ফয়েজ আহ্মদ। নবাববাড়ির আধিপত্যের বিরুদ্ধে তো পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় জোর লড়াই করে এগোতে হয়েছিল ফয়েজ আহ্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের। এই লড়াইয়ে ফয়েজ আহ্মদের ছিল অভিনব এবং আলাদা সম্পৃক্তি, তাঁর পিতা এন্ট্রান্স পাস করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নিতে যাওয়ার প্রাক্কালে এক বিজ্ঞাপন দেখে মত পরিবর্তন করেন এবং নবাববাড়ির গভর্নরের কাজে যোগ দেন। শব্দটা গভর্নরই বটে, আমাদের কাছে এর স্ত্রীলিঙ্গ সমধিক পরিচিত; এই গভর্নর অর্থাৎ নবাব পরিবারের পুত্রদের শিক্ষার দায়িত্ব নেন ফয়েজ আহ্মদের পিতা, যেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিনও।
স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ শীর্ষক সাংবাদিকতা-সুলভ কলাম লিখে ফয়েজ আহ্মদ যখন হইচই ফেলে দিলেন সেসব লেখায়ও ঢাকার জীবন, বিশেষভাবে পঞ্চাশের দশকের ঢাকাজীবনের চমৎকার পরিচয় রয়েছে। সে সময়কার ঢাকায় যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁরা জীবনে কখনো ঢাকার সংস্কৃতির প্রভাব এড়াতে পারেননি। এই প্রভাবের যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা সবাই যে ঢাকা শহরের আদি বাসিন্দা তা বলা যাবে না। এই আদি বাসিন্দা বলতে কেবল ঢাকা শহরের অধিবাসীদের বোঝায় না, ঢাকা জেলার বিক্রমপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, মানিকগঞ্জ ইত্যাদি বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষ জীবনের তাড়নায় ঢাকাবাসী হয়েছেন, অথবা ঢাকার সঙ্গে নানা লেনদেন বিনিময়ে লিপ্ত হয়েছেন। ফলে ঢাকার সংস্কৃতির তাঁরা হয়ে উঠেছেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফয়েজ আহ্মদ ঢাকারই একজন হিসেবে হয়ে উঠেছিলেন ঢাকাই সংস্কৃতির প্রতিভূ। আর তাঁর বান্ধব এম আর আখতার মুকুল বহিরাগত একজন হিসেবে ঢাকাই সংস্কৃতির এমন প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন যে ঢাকা থেকে তাঁকে আর আলাদা করে দেখবার উপায় ছিল না। একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ‘চরমপত্র’ রচনা ও পাঠের মধ্য দিয়ে ঢাকাই সংস্কৃতির রসভান্ডার ও শক্তিময়তার অনিন্দ্য প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এম আর আখতার মুকুল। ফয়েজ ভাই ও মুকুল ভাই যে ছিলেন হরিহর আত্মা, সেটা বোধ হয় সম্ভব হয়েছিল ঢাকার সূত্রে এমন মধুর মিলনে।
তবে ফয়েজ আহ্মদের সঙ্গে ঢাকার যোগ আরও ব্যাপ্ত, নিবিড় ও গভীর। তিনি ও ঢাকা শহর বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পরস্পরের হাত ধরে এক মিতালির মধ্য দিয়ে যেন বড় হয়ে উঠেছে এবং উভয়ে উভয়কে প্রভাবিত করেছে। ফয়েজ আহ্মদের মধ্যে যদি ঢাকার প্রভাব শনাক্ত করতে হয়, তবে সর্বাগ্রে বলতে হবে তাঁর রসবোধের কথা, সে সঙ্গে রয়েছে তাঁর বৈঠকি মেজাজ। ফয়েজ আহ্মদের এই রসবোধের প্রকাশ মেলে তাঁর জীবনধারায়, কৌতুকী দৃষ্টিতে তিনি দেখেন জীবন এবং সাধারণ আটপৌরে নিত্যকার ঘটনাপ্রবাহ থেকে ছেঁকে তুলে আনতে পারেন রসের উপাদান। এই রসিকতা জীবনের দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও দুঃখজয়ের উপাদান জোগায় অজান্তে। যেমন তাঁর সৃষ্ট অভিধা ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’, পঞ্চাশের দশকে বন্যাকবলিত ঢাকার জলমগ্ন পথে গভীর রাতে ঘরে-ফেরার বিড়ম্বনা বর্ণনা দিয়েছেন ফয়েজ আহ্মদ, আর কোনো উপায় না পেয়ে জল ঠেলে গৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য মাঠে চরে বেড়ানো বেতো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হন সাংবাদিক। এই দুঃখকথা এমন ভঙ্গিতে পরিবেশন করেন ফয়েজ আহ্মদ যে তা হয়ে ওঠে রসকথা এবং পরিণামে প্রতীকী ও কাব্যিক ব্যঞ্জনায় রূপান্তরিত হয় জীবনের পথে ছুটে চলা নিঃসঙ্গ এক অলৌকিক অশ্বারূঢ় ব্যক্তির রূপকে, যে অভিযাত্রী বুঝি ফয়েজ আহ্মদ স্বয়ং।
দুই.
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ঢাকার ইতিহাস রচনা করতে হলে যে কাউকে বড়ভাবে ফয়েজ আহ্মদের রচনার শরণ নিতে হবে, তবে এর আড়ালে যে আছে আরেক ইতিহাস তার হদিস করতে হলে জানতে হবে ফয়েজ আহ্মদের জীবন ও কর্মের পরিচয়। সদ্য-তরুণ ফয়েজ আহ্মদ যখন ঢাকায় স্থিত হন, তখন থেকেই তিনি দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেছেন ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে এবং নিজেকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন আলাদা ব্যক্তিসত্তারূপে।
ঢাকায় তখন মুসলিম লীগের প্রবল দাপট এবং পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মুক্তচিন্তার যেকোনো প্রয়াসের টুঁটি চেপে ধরতে বদ্ধপরিকর। ঢাকা থেকে উৎখাত হয়ে গেছে প্রগতি লেখক সংঘ, সভা-সমাবেশের ওপরও হামলে পড়ছে সরকারি পেটোয়া বাহিনী। সেই ১৯৫০ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের প্রশ্রয়ে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ ঘিরে সমবেত হয়েছিলেন একদল তরুণ এবং ফয়েজ আহ্মদ ছিলেন এই উদ্যোগের মধ্যমণি, প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক। একই সময়ে হুল্লোড় নামক শিশু-কিশোর মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে ফয়েজ আহ্মদ আরেক হুল্লোড় বাধিয়ে বসেন। আরেকদিকে ফতেহ লোহানী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলামের উদ্যোগে প্রকাশিত হচ্ছে অগত্যা, নামেই পত্রিকার ব্যতিক্রমের পরিচয়, রঙ্গব্যঙ্গের চাবুক হাতে প্রতিক্রিয়ার পিঠে সপাৎ সপাৎ দাগ বসিয়ে দিচ্ছে। আরেক তরুণ মাহবুব জামাল জাহেদি প্রকাশ করছেন সাহিত্য-মাসিক মুক্তি। তরুণ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও খান সারওয়ার মুরশিদ প্রকাশ করছেন উচ্চমানের ইংরেজি মাসিক নিউ ভ্যালুজ। এমনিভাবে ঢাকা যেন অস্বীকার করছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব, মুসলিম লীগের শাসন।
এরপর ভাষা আন্দোলন স্রোতের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেল প্রতিক্রিয়ার মহা-আড়ম্বরপূর্ণ সৌধ, নতুন এক যুগ সম্প্রদায় নতুন যে জাগরণ সূচিত করল, তাতে শহর ঢাকার অধিবাসীদের ছিল নিবিড় ও আন্তরিক সম্পৃক্তি। ফয়েজ আহ্মদের শহর হয়ে উঠল ঢাকা, নবাবী প্রভাব আর বিশেষ রইল না সেখানে। কিন্তু রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাবের বিচারে নবাববাড়ির পরাজয় ঘটলেও পাকিস্তানি শাসনক্ষমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বারবার তারা পেছন দুয়ার দিয়ে কার্যসিদ্ধি করেছে। সে সঙ্গে ঢাকায় এসে উপচে পড়ছিল দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। শহর ক্রমান্বয়ে স্ফীত হয়ে ধারণ করছিল অচেনা রূপ।
নতুন এই মহানগরে, বিশেষত স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় কেটেছে বড় একটা সময়। তারপর ক্রমান্বয়ে জোর হয়েছিল স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, সংহত হয়ে উঠল সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং এ ক্ষেত্রে বর্ষীয়ান ফয়েজ আহ্মদ হয়ে উঠলেন সংস্কৃতি অঙ্গনের অবিসংবাদিত নেতা। নিজেকে নিজেই বারবার ছাপিয়ে গেছেন এবং তেমনি এক চমক দিয়ে তিনি ধানমন্ডিতে মনোরম এক আবাসে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘শিল্পাঙ্গন’, ঢাকায় আর্ট গ্যালারির ধারণার পথিকৃৎ রূপায়ণ। সূচনার সেই বছরগুলোয় শিল্পবৈরী এক পরিবেশে শিল্প-ধারণার স্বীকৃতি আদায়ে প্রায় এককভাবে লড়তে হয়েছিল ফয়েজ আহ্মদকে এবং লড়াইয়ে তিনি কখনো পিছপা ছিলেন না। যথার্থ পথিকৃৎ হিসেবে শিল্পাঙ্গনের গড়ে উঠেছিল অনেক অনুগামী, গ্যালারি এবং প্রদর্শনী এখন হয়ে উঠেছে ঢাকার সংস্কৃতিজগতের নিয়মিত ঘটনা।
এমনি এক পরিস্থিতিতে ফয়েজ আহ্মদ স্বেচ্ছায় নিজেকে গুটিয়ে নিলেন আনুষ্ঠানিক পোশাকি সব পদ ও অবস্থান থেকে। সেটাও তাঁর আরেক চমক, যেমনটা কেবল তিনিই পারেন। প্রায় ছয় দশক আগে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে এই শহরে প্রবেশ করেছিলেন এক নবীন। চোখ-মুখে তাঁর ছিল বিস্ময়, হাতে ছিল বহুবিচিত্র রঙিন পতাকা। তার পর থেকে রঙে-রূপে তিনি মাতিয়ে তুলেছেন মানুষদের, যে কাজে হাত দিয়েছেন সেখানে রেখেছেন রসবোধ ও জীবনবোধের পরিচয়। ঢাকা শহরকে তিনি রাঙিয়ে তুলেছেন নানা রঙের বিভায়, একেবারেই প্রতীকী অর্থে।
আজ তিনি নেই, কিন্তু শহরের গায়ে লেগে আছে তাঁর রঙের বিভা। কজন পারেন এমনভাবে সবার জীবনে রং লাগাতে? ফয়েজ আহ্মদ পেরেছিলেন, তিনি নমস্য।
এ ছড়ায় কৌতুকছলে নবাববাড়ির প্রসঙ্গ টেনেছেন ফয়েজ আহ্মদ। নবাববাড়ির আধিপত্যের বিরুদ্ধে তো পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় জোর লড়াই করে এগোতে হয়েছিল ফয়েজ আহ্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের। এই লড়াইয়ে ফয়েজ আহ্মদের ছিল অভিনব এবং আলাদা সম্পৃক্তি, তাঁর পিতা এন্ট্রান্স পাস করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নিতে যাওয়ার প্রাক্কালে এক বিজ্ঞাপন দেখে মত পরিবর্তন করেন এবং নবাববাড়ির গভর্নরের কাজে যোগ দেন। শব্দটা গভর্নরই বটে, আমাদের কাছে এর স্ত্রীলিঙ্গ সমধিক পরিচিত; এই গভর্নর অর্থাৎ নবাব পরিবারের পুত্রদের শিক্ষার দায়িত্ব নেন ফয়েজ আহ্মদের পিতা, যেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিনও।
স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ শীর্ষক সাংবাদিকতা-সুলভ কলাম লিখে ফয়েজ আহ্মদ যখন হইচই ফেলে দিলেন সেসব লেখায়ও ঢাকার জীবন, বিশেষভাবে পঞ্চাশের দশকের ঢাকাজীবনের চমৎকার পরিচয় রয়েছে। সে সময়কার ঢাকায় যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁরা জীবনে কখনো ঢাকার সংস্কৃতির প্রভাব এড়াতে পারেননি। এই প্রভাবের যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা সবাই যে ঢাকা শহরের আদি বাসিন্দা তা বলা যাবে না। এই আদি বাসিন্দা বলতে কেবল ঢাকা শহরের অধিবাসীদের বোঝায় না, ঢাকা জেলার বিক্রমপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, মানিকগঞ্জ ইত্যাদি বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষ জীবনের তাড়নায় ঢাকাবাসী হয়েছেন, অথবা ঢাকার সঙ্গে নানা লেনদেন বিনিময়ে লিপ্ত হয়েছেন। ফলে ঢাকার সংস্কৃতির তাঁরা হয়ে উঠেছেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফয়েজ আহ্মদ ঢাকারই একজন হিসেবে হয়ে উঠেছিলেন ঢাকাই সংস্কৃতির প্রতিভূ। আর তাঁর বান্ধব এম আর আখতার মুকুল বহিরাগত একজন হিসেবে ঢাকাই সংস্কৃতির এমন প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন যে ঢাকা থেকে তাঁকে আর আলাদা করে দেখবার উপায় ছিল না। একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ‘চরমপত্র’ রচনা ও পাঠের মধ্য দিয়ে ঢাকাই সংস্কৃতির রসভান্ডার ও শক্তিময়তার অনিন্দ্য প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এম আর আখতার মুকুল। ফয়েজ ভাই ও মুকুল ভাই যে ছিলেন হরিহর আত্মা, সেটা বোধ হয় সম্ভব হয়েছিল ঢাকার সূত্রে এমন মধুর মিলনে।
তবে ফয়েজ আহ্মদের সঙ্গে ঢাকার যোগ আরও ব্যাপ্ত, নিবিড় ও গভীর। তিনি ও ঢাকা শহর বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পরস্পরের হাত ধরে এক মিতালির মধ্য দিয়ে যেন বড় হয়ে উঠেছে এবং উভয়ে উভয়কে প্রভাবিত করেছে। ফয়েজ আহ্মদের মধ্যে যদি ঢাকার প্রভাব শনাক্ত করতে হয়, তবে সর্বাগ্রে বলতে হবে তাঁর রসবোধের কথা, সে সঙ্গে রয়েছে তাঁর বৈঠকি মেজাজ। ফয়েজ আহ্মদের এই রসবোধের প্রকাশ মেলে তাঁর জীবনধারায়, কৌতুকী দৃষ্টিতে তিনি দেখেন জীবন এবং সাধারণ আটপৌরে নিত্যকার ঘটনাপ্রবাহ থেকে ছেঁকে তুলে আনতে পারেন রসের উপাদান। এই রসিকতা জীবনের দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও দুঃখজয়ের উপাদান জোগায় অজান্তে। যেমন তাঁর সৃষ্ট অভিধা ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’, পঞ্চাশের দশকে বন্যাকবলিত ঢাকার জলমগ্ন পথে গভীর রাতে ঘরে-ফেরার বিড়ম্বনা বর্ণনা দিয়েছেন ফয়েজ আহ্মদ, আর কোনো উপায় না পেয়ে জল ঠেলে গৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য মাঠে চরে বেড়ানো বেতো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হন সাংবাদিক। এই দুঃখকথা এমন ভঙ্গিতে পরিবেশন করেন ফয়েজ আহ্মদ যে তা হয়ে ওঠে রসকথা এবং পরিণামে প্রতীকী ও কাব্যিক ব্যঞ্জনায় রূপান্তরিত হয় জীবনের পথে ছুটে চলা নিঃসঙ্গ এক অলৌকিক অশ্বারূঢ় ব্যক্তির রূপকে, যে অভিযাত্রী বুঝি ফয়েজ আহ্মদ স্বয়ং।
দুই.
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ঢাকার ইতিহাস রচনা করতে হলে যে কাউকে বড়ভাবে ফয়েজ আহ্মদের রচনার শরণ নিতে হবে, তবে এর আড়ালে যে আছে আরেক ইতিহাস তার হদিস করতে হলে জানতে হবে ফয়েজ আহ্মদের জীবন ও কর্মের পরিচয়। সদ্য-তরুণ ফয়েজ আহ্মদ যখন ঢাকায় স্থিত হন, তখন থেকেই তিনি দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেছেন ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে এবং নিজেকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন আলাদা ব্যক্তিসত্তারূপে।
ঢাকায় তখন মুসলিম লীগের প্রবল দাপট এবং পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মুক্তচিন্তার যেকোনো প্রয়াসের টুঁটি চেপে ধরতে বদ্ধপরিকর। ঢাকা থেকে উৎখাত হয়ে গেছে প্রগতি লেখক সংঘ, সভা-সমাবেশের ওপরও হামলে পড়ছে সরকারি পেটোয়া বাহিনী। সেই ১৯৫০ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের প্রশ্রয়ে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ ঘিরে সমবেত হয়েছিলেন একদল তরুণ এবং ফয়েজ আহ্মদ ছিলেন এই উদ্যোগের মধ্যমণি, প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক। একই সময়ে হুল্লোড় নামক শিশু-কিশোর মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে ফয়েজ আহ্মদ আরেক হুল্লোড় বাধিয়ে বসেন। আরেকদিকে ফতেহ লোহানী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলামের উদ্যোগে প্রকাশিত হচ্ছে অগত্যা, নামেই পত্রিকার ব্যতিক্রমের পরিচয়, রঙ্গব্যঙ্গের চাবুক হাতে প্রতিক্রিয়ার পিঠে সপাৎ সপাৎ দাগ বসিয়ে দিচ্ছে। আরেক তরুণ মাহবুব জামাল জাহেদি প্রকাশ করছেন সাহিত্য-মাসিক মুক্তি। তরুণ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও খান সারওয়ার মুরশিদ প্রকাশ করছেন উচ্চমানের ইংরেজি মাসিক নিউ ভ্যালুজ। এমনিভাবে ঢাকা যেন অস্বীকার করছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব, মুসলিম লীগের শাসন।
এরপর ভাষা আন্দোলন স্রোতের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেল প্রতিক্রিয়ার মহা-আড়ম্বরপূর্ণ সৌধ, নতুন এক যুগ সম্প্রদায় নতুন যে জাগরণ সূচিত করল, তাতে শহর ঢাকার অধিবাসীদের ছিল নিবিড় ও আন্তরিক সম্পৃক্তি। ফয়েজ আহ্মদের শহর হয়ে উঠল ঢাকা, নবাবী প্রভাব আর বিশেষ রইল না সেখানে। কিন্তু রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাবের বিচারে নবাববাড়ির পরাজয় ঘটলেও পাকিস্তানি শাসনক্ষমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বারবার তারা পেছন দুয়ার দিয়ে কার্যসিদ্ধি করেছে। সে সঙ্গে ঢাকায় এসে উপচে পড়ছিল দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। শহর ক্রমান্বয়ে স্ফীত হয়ে ধারণ করছিল অচেনা রূপ।
নতুন এই মহানগরে, বিশেষত স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় কেটেছে বড় একটা সময়। তারপর ক্রমান্বয়ে জোর হয়েছিল স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, সংহত হয়ে উঠল সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং এ ক্ষেত্রে বর্ষীয়ান ফয়েজ আহ্মদ হয়ে উঠলেন সংস্কৃতি অঙ্গনের অবিসংবাদিত নেতা। নিজেকে নিজেই বারবার ছাপিয়ে গেছেন এবং তেমনি এক চমক দিয়ে তিনি ধানমন্ডিতে মনোরম এক আবাসে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘শিল্পাঙ্গন’, ঢাকায় আর্ট গ্যালারির ধারণার পথিকৃৎ রূপায়ণ। সূচনার সেই বছরগুলোয় শিল্পবৈরী এক পরিবেশে শিল্প-ধারণার স্বীকৃতি আদায়ে প্রায় এককভাবে লড়তে হয়েছিল ফয়েজ আহ্মদকে এবং লড়াইয়ে তিনি কখনো পিছপা ছিলেন না। যথার্থ পথিকৃৎ হিসেবে শিল্পাঙ্গনের গড়ে উঠেছিল অনেক অনুগামী, গ্যালারি এবং প্রদর্শনী এখন হয়ে উঠেছে ঢাকার সংস্কৃতিজগতের নিয়মিত ঘটনা।
এমনি এক পরিস্থিতিতে ফয়েজ আহ্মদ স্বেচ্ছায় নিজেকে গুটিয়ে নিলেন আনুষ্ঠানিক পোশাকি সব পদ ও অবস্থান থেকে। সেটাও তাঁর আরেক চমক, যেমনটা কেবল তিনিই পারেন। প্রায় ছয় দশক আগে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে এই শহরে প্রবেশ করেছিলেন এক নবীন। চোখ-মুখে তাঁর ছিল বিস্ময়, হাতে ছিল বহুবিচিত্র রঙিন পতাকা। তার পর থেকে রঙে-রূপে তিনি মাতিয়ে তুলেছেন মানুষদের, যে কাজে হাত দিয়েছেন সেখানে রেখেছেন রসবোধ ও জীবনবোধের পরিচয়। ঢাকা শহরকে তিনি রাঙিয়ে তুলেছেন নানা রঙের বিভায়, একেবারেই প্রতীকী অর্থে।
আজ তিনি নেই, কিন্তু শহরের গায়ে লেগে আছে তাঁর রঙের বিভা। কজন পারেন এমনভাবে সবার জীবনে রং লাগাতে? ফয়েজ আহ্মদ পেরেছিলেন, তিনি নমস্য।
No comments