কালের যাত্রা by পীষূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
গত বছরের আবর্জনা দূর করে তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে উড়িয়ে দিয়ে নব-বৈশাখ এসেছে, শুরু হয়েছে নববর্ষ ১৪১৮। তাকে স্বাগত জানাই। ফেলে আসা বছরের সবই কি আবর্জনা! কেবলই ছাইভস্ম! কিছুই কি অর্জন নেই সেখানে! 'উড়াইয়া' যদি দেখি ছাই, অমূল্য রতন কিছুই কি মিলিবে না!
অবশ্যই মিলবে। চৈত্রের দাবদাহে পোড়ে প্রকৃতি, বাঁকে বাঁকে চলা ছোট নদী শুকিয়ে যায়, শস্যক্ষেত ফেটে চৌচির। এ সবই সত্য। আবহমান বাংলা সহস্র বছর ধরে তবু পুড়তে পুড়তেও হাসে। হাসতে হাসতে জীবনবাজি রেখে বেঁচে থাকে নতুন দিনের প্রত্যাশায়। শুভ দিনের স্বপ্নে। বর্ষশেষে হিসাব-নিকাশের হালখাতা হালনাগাদ হয়। ঘরদোর, আসবাব ঘষামাজা হয়। পূজা-পার্বণ হয়। নানা আচার পালনের মধ্য দিয়ে বাঙালি কত না আনন্দ খুঁজে পায়! বেনেবৌ আর কোকিলের ডাকে কত না কল্পকথার জন্ম হয় গেরস্তের ঘরে। প্রাণে প্রাণে, জীবনে জীবনে যোগ হয়ে উপচে পড়ে আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ার। চৈত্র-বৈশাখ ঘিরে বাঙালির যত আনন্দ, তত উৎকণ্ঠা। নতুন যে দিন আসছে, তা মঙ্গল বয়ে আনবে তো! ধূলিময় ঝড়ে শঙ্কা বাড়াবে না তো! অনেক দিনের জগদ্দল পাথর-চাপায় দম আটকে-থাকা বিবর্ণ তৃণদল মাত্র ২৫-২৬ মাস আগে আলোর স্পর্শ পেয়ে জীবন ফিরে পেয়েছে। কত চড়াই-উতরাই, কত কঠিন বাধা পার হয়ে দেশের মানুষ মুক্ত এবং অনুকূল পরিবেশে সংসদ নির্বাচন করেছে, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছে। অর্জন করেছে যে নিরঙ্কুশ জয়, সেই জয় তো আরো বেশি বাঙালি হওয়ার জন্য। দীর্ঘ ঐতিহ্যের শিকড়নিঃসৃত পীযূষধারায় সিক্ত ও পবিত্র হয়ে আগামীর পথে প্রকৃত বাঙালি হিসেবে অনেক দূর পেঁৗছানোর জন্য। প্রকৃত বাঙালিত্বে সাম্প্রদায়িকতা নেই, ধর্মান্ধতা নেই। জঙ্গিবাদ ও মানবতাবিরোধী বর্বরতা নেই। আছে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধন। আছে সহমর্মিতা, সহনশীলতা এবং মানবিকতা। একাত্তরে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে এসবই ছিল মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন। যুদ্ধজয়ের ভেতর প্রকৃত বাঙালি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু গত ৪০ বছরে একাত্তরের পরাজিতরা গভীর ষড়যন্ত্র এবং সুপরিকল্পিত কূটচালে বাঙালি হওয়ার পথে বারবার আঘাত হেনেছে। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বাঙালির অবিসংবাদিত নেতাকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলার প্রাণপাখিকে তারা সংগীতহারা করেছে। মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সহস্র বছরের উজ্জ্বল দর্শন ও মূল্যবোধ। মুক্তিযুদ্ধ-বাঙালি-বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক অবয়বে কালিমা লেপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে নানাভাবে। বাংলাদেশটাকে একাত্তরের ঘৃণ্য ঘাতকদের অভয়ারণ্য বানিয়ে বছরের পর বছর ধরে চালিয়েছে সন্ত্রাস ও অনৈতিকতার দুঃশাসন। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে জাতীয় ও সামাজিক_সবক্ষেত্রে সুচিন্তিত কু-উদ্যোগে বিকৃত করা হয়েছে বাঙালির সব অর্জন। উপেক্ষিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর জয়গাথা। একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে দেশ-বিদেশে পালিয়ে থাকা কাক-শকুন-শৃগালের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে অপরাজনীতির নষ্ট ডিম। বাঙালির ভাগ্যাকাশে সৃষ্টি করা হয়েছে মহাদুর্যোগের ঘনঘটা। বাংলার শ্যামল মায়ের অঙ্গ থেকে একে একে খুলে নেওয়া হয়েছে অলংকার, করা হয়েছে নিরাভরণ। বিশাল ভাবমূর্তির বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে সুচতুরভার খর্বাকৃতি দুর্বৃত্তের সমকক্ষ করার ঘৃণ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও সামাজিক পর্যায়ে। একাত্তরের বিজয়ীর দেশের পথে চলেছে সারিবদ্ধ পাকিস্তানি উটের বহর। অবশেষে রাজাকারদের গাড়িতে উড়ল জাতীয় পতাকা। জাতির অহংকারে যেন খামচে ধরল পুরনো শকুন। এত পাপ, এত অনাচার সহ্য করার ইতিহাস তো বাঙালির নেই। তাই বুঝি ১৫ পৌষ, ২৯ ডিসেম্বর, স্বতঃস্ফূর্ত ভোটদানের মাধ্যমে বাঙালি জানাল প্রতিবাদ, ঘটে গেল নীরব বিপ্লব। ঐতিহাসিক গণরায়ে নতুন উষার আলোয় দেখা দিল দিনবদলের পথনিশানা। বাঙালিত্বের পথে বাঙালি হওয়ার জন্য। সেই বাঙালি হওয়ার পথ ধরে আবার এসেছে বৈশাখের দিন, নববর্ষ ১৪১৮। রাজধানীসহ দেশের সব শহর-উপশহরে বৈশাখের প্রথম দিবসে রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল। বসেছে মেলা। বেজেছে বাঁশি। ঝলমলে পোশাক, খোঁপায় ফুল, কাচের চুড়ি আর ঢল ঢল সোনার অঙ্গ রঙ্গে দুলিয়ে নেচে উঠেছে বঙ্গললনা। চারদিকে গান আর গান। মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে এ রকম আনন্দোৎসব আর আছে কি!
'এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো।' বাঙালি মধ্যবিত্তকে বৈশাখ চিনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নববর্ষ উদযাপনে পরিশীলিত নান্দনিকতার ছোঁয়ায় এবং নিজ জন্মদিনের আয়োজনে। বৈশাখের পঁচিশেই তো ঋষিকবির জন্ম। প্রৌঢ় প্রহরের কোনো এক দিনে পঁচিশে বৈশাখ শিরোনামের দীর্ঘ এক পদ্যে ছোট ছোট জন্ম-মৃত্যুর সীমানায় কবি নিজেই গেঁথেছিলেন নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা বিনাসুতার মালা। বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ পহেলা বৈশাখকে নিত্যদিনের জীবনচর্চায়, নান্দনিকতার পরিশীলিত সংস্কৃতিতে প্রিয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আগামী পঁচিশে বৈশাখ তাঁর সার্ধশত জন্মজয়ন্তী। তাঁকে প্রণতি জানাই।
বাংলাদেশের বাঙালির কাছে তিনি তো উজ্জ্বল বাতিঘর। ছয় দশকের গোড়ার দিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানলগ্নে পাকিস্তানি শাসকরা তাদের দুঃশাসন ষড়যন্ত্রে বাঙালির রবীন্দ্রনাথের ওপর খৰ চালিয়ে বন্ধ করতে চেয়েছিল আবহমান সংস্কৃতিচর্চার সব পথ। রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবার্ষিকী পালনে অসাম্প্রদায়িক শিল্পমনস্ক মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছিল পাকিস্তানিদের আঘাত। এর পর থেকে বাঙালির সব দুর্বিপাকে, সংগ্রামে, দুঃসময়ে, জয়ে, আনন্দ-বেদনায় তিনি বাঙালির প্রাণের আরাম হয়ে নিত্যসঙ্গী হয়েছেন। তাঁর অমর দর্শন 'যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে মুক্ত কর হে বন্ধ' কেবল সমাজ-সংস্কৃতিতেই নয়, প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল বাঙালির রাজনৈতিক চর্চাতেও। উদয়ের পথে সামনে চলতে রবীন্দ্রনাথের অভয়বাণীকে হৃদয়ে তুলে নিলেন বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু। ছয় দফা ঘোষণা করে তিনি শোনালেন মুক্তির বার্তা। ধারাবাহিকতায় এল ছায়ানটের উদ্যোগে বাঙালির বর্ষবরণ উৎসব। রমনা বটমূলের সেই অনুষ্ঠান প্রায় অর্ধশতক পরে আজ বাঙালির জাতীয় উৎসব, মধ্যবিত্তের প্রাণের মিলনমেলা। বিশ্বের সব বাঙালি আজ এই বর্ষবরণ উৎসবের গর্বিত অংশীদার। তারপর একে একে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় এবং '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। সব পর্বেই রবীন্দ্রনাথ। সব কৃতিত্বেই বঙ্গবন্ধু।
প্রায় আড়াই বছর আগে ১৫ পৌষ কিংবা ২৯ ডিসেম্বরে ব্যাপক গণরায়ে অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দর্শন, ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার। জীবনের সব কর্মযজ্ঞে, জাতীয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে। নব বৈশাখে, নতুন বছরে সেই অঙ্গীকার উজ্জ্বলতর করতে খোলা হোক সুবর্ণ হালখাতা। চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক দর্শনে এগিয়ে যাক গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিনাশী শত্রুর বিচার এবং শাস্তিতে আসুক স্বস্তি। সব হীনম্মন্যতা পরিহার করে হৃত গৌরবের তিলক আঁকা হোক বাঙালির উন্নত ললাটে। শুধুই বাঙালি হওয়া নয়, বিশ্বমানব হওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে পথচলা। ১৪১৮ বঙ্গাব্দের শুরু থেকে তবে হোক বাঙালির স্বপ্নপূরণের শুভযাত্রা। জয় বাংলা।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
'এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো।' বাঙালি মধ্যবিত্তকে বৈশাখ চিনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নববর্ষ উদযাপনে পরিশীলিত নান্দনিকতার ছোঁয়ায় এবং নিজ জন্মদিনের আয়োজনে। বৈশাখের পঁচিশেই তো ঋষিকবির জন্ম। প্রৌঢ় প্রহরের কোনো এক দিনে পঁচিশে বৈশাখ শিরোনামের দীর্ঘ এক পদ্যে ছোট ছোট জন্ম-মৃত্যুর সীমানায় কবি নিজেই গেঁথেছিলেন নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা বিনাসুতার মালা। বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ পহেলা বৈশাখকে নিত্যদিনের জীবনচর্চায়, নান্দনিকতার পরিশীলিত সংস্কৃতিতে প্রিয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আগামী পঁচিশে বৈশাখ তাঁর সার্ধশত জন্মজয়ন্তী। তাঁকে প্রণতি জানাই।
বাংলাদেশের বাঙালির কাছে তিনি তো উজ্জ্বল বাতিঘর। ছয় দশকের গোড়ার দিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানলগ্নে পাকিস্তানি শাসকরা তাদের দুঃশাসন ষড়যন্ত্রে বাঙালির রবীন্দ্রনাথের ওপর খৰ চালিয়ে বন্ধ করতে চেয়েছিল আবহমান সংস্কৃতিচর্চার সব পথ। রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবার্ষিকী পালনে অসাম্প্রদায়িক শিল্পমনস্ক মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছিল পাকিস্তানিদের আঘাত। এর পর থেকে বাঙালির সব দুর্বিপাকে, সংগ্রামে, দুঃসময়ে, জয়ে, আনন্দ-বেদনায় তিনি বাঙালির প্রাণের আরাম হয়ে নিত্যসঙ্গী হয়েছেন। তাঁর অমর দর্শন 'যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে মুক্ত কর হে বন্ধ' কেবল সমাজ-সংস্কৃতিতেই নয়, প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল বাঙালির রাজনৈতিক চর্চাতেও। উদয়ের পথে সামনে চলতে রবীন্দ্রনাথের অভয়বাণীকে হৃদয়ে তুলে নিলেন বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু। ছয় দফা ঘোষণা করে তিনি শোনালেন মুক্তির বার্তা। ধারাবাহিকতায় এল ছায়ানটের উদ্যোগে বাঙালির বর্ষবরণ উৎসব। রমনা বটমূলের সেই অনুষ্ঠান প্রায় অর্ধশতক পরে আজ বাঙালির জাতীয় উৎসব, মধ্যবিত্তের প্রাণের মিলনমেলা। বিশ্বের সব বাঙালি আজ এই বর্ষবরণ উৎসবের গর্বিত অংশীদার। তারপর একে একে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় এবং '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। সব পর্বেই রবীন্দ্রনাথ। সব কৃতিত্বেই বঙ্গবন্ধু।
প্রায় আড়াই বছর আগে ১৫ পৌষ কিংবা ২৯ ডিসেম্বরে ব্যাপক গণরায়ে অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দর্শন, ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার। জীবনের সব কর্মযজ্ঞে, জাতীয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে। নব বৈশাখে, নতুন বছরে সেই অঙ্গীকার উজ্জ্বলতর করতে খোলা হোক সুবর্ণ হালখাতা। চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক দর্শনে এগিয়ে যাক গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিনাশী শত্রুর বিচার এবং শাস্তিতে আসুক স্বস্তি। সব হীনম্মন্যতা পরিহার করে হৃত গৌরবের তিলক আঁকা হোক বাঙালির উন্নত ললাটে। শুধুই বাঙালি হওয়া নয়, বিশ্বমানব হওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে পথচলা। ১৪১৮ বঙ্গাব্দের শুরু থেকে তবে হোক বাঙালির স্বপ্নপূরণের শুভযাত্রা। জয় বাংলা।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments