বাংলা উইকিপিডিয়া এখন by মুনির হাসান
বাংলা নববর্ষ পালিত হয় সারা দেশে আনন্দ, উৎসবে এবং সব ভালোকে আহ্বান জানিয়ে। ঢাকাসহ নানা স্থানে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। নানা জায়গাজুড়ে চলে সুন্দরের আবাহন। কয়েক বছর ধরে, সুনির্দিষ্টভাবে বললে ২০০৭ সাল থেকে ঢাকায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির সামনে সেই আবাহনে আরেক দল সুন্দরের পূজারীদের পাওয়া যায়।
ডুগডুগি কিংবা ঢোল বাজিয়ে তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন উৎসবপ্রেমীদের। তাঁদের হাতে ধরা ব্যানারে লেখা থাকে, ‘বাংলা উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করুন।’
প্রথমত, উইকিপিডিয়া। পরে বাংলা, দুইয়ে মিলিয়েই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ। যখন তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ব্যাপারটি কী, তখন তাঁরা ব্যাখ্যা করেন, উইকিপিডিয়া হলো আমাদের সবার বিশ্বকোষ। সবাই মিলে, সবার জন্য এই বিনে পয়সার তথ্য ভান্ডার!
কেবল বিনে পয়সার বলে এটি মূল্যহীন নয়, বরং অমূল্য। আর তথ্যের এই অমূল্য রত্নভান্ডার গড়ে তুলছেন আমার-আপনার মতো আমজনতা!
আমজনতার বিশ্বকোষ
সব সময় ধারণা ছিল কতিপয় চশমা আঁটা সবজান্তা লিখবেন জ্ঞানের আকর। লিখেছেনও বটে। শুরুর দিকে বিশ্বকোষগুলো ব্যক্তিপ্রচেষ্টার। পরে সম্পাদক-রচয়িতার কলেবর বেড়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি সীমায়িত থেকেছে গোষ্ঠীর মধ্যে, কখনো সেটা জ্ঞান সমিতি (যেমন আমাদের বাংলাপিডিয়ার আয়োজক সংস্থা এশিয়াটিক সোসাইটি) কিংবা কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগ (যেমন, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা)।
তবে কম্পিউটার আর ইন্টানেটের জন্ম নীরবে-নিভৃতে গড়ে তুলেছে এক ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি। ছোটবেলা থেকে আমরা ‘ছোট ছোট বালুকণা’র মহাদেশ আর ‘বিন্দু বিন্দু জল কণা’র মহাসাগর গড়ার কথা পড়েছি। কিন্তু বিন্দুর সত্যিকারের সিন্ধু হওয়ার রূপকথা চাক্ষুষ দেখার জন্য আমাদের এই একুশ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
২০০১ সালের ১৫ জানুয়ারি জিমি ওয়ালেস নামের এক ক্ষ্যাপা লোক ভাবলেন—বিন্দু দিয়ে সিন্ধু রচনায় কাজটা শুরু হোক একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তোলার মাধ্যমে। দুটি কারণে তিনি বুকে বল পেলেন—প্রথমত, কম্পিউটারের মাধ্যমে সমন্বিত কাজ বা কোলাবরেশন অনেক সহজ আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্ভব সেটিকে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া!
দর্শনটাও সহজ। সবাই মিলে একটি বিশ্বকোষ লিখে ফেলা। যে ভাবা, সেই কাজ। শুরু হয়ে গেল প্রজেক্ট উইকিপিডিয়া (www.wikipedia.org)। শুরুটা হলো ইংরেজি ভাষায়, তবে অন্য ভাষাভাষীরাও পিছিয়ে রইলেন না। শুরুতে কিছু নিয়মকানুন ঠিক করা হলো, তবে মেনে নেওয়া হলো যে সেগুলো পরিবর্তিত হলেও হতে পারবে। ঠিক হলো বিশ্বকোষের ভুক্তি বা নিবন্ধ যোগ হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। অর্থাৎ কেউ যদি ভাবে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি নিবন্ধ থাকবে, তাহলেই সই। তবে, শেষ পর্যন্ত সেটি থাকবে কি না, তা নির্ভর করে বিষয়টির সার্বজনীনতার ওপর। প্রকাশযোগ্যতার ওপর। প্রশ্ন হলো কীভাবে এই সার্বজনীনতা, প্রকাশযোগ্যতা মাপা হবে। কতক সহজ নিয়ম—প্রথমত, বিশ্বাসযোগ্য ও লিখিত রেফারেন্স থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেগুলো যাচাইযোগ্য হতে হবে। ব্যস্ হয়ে গেল বিশ্বকোষ লেখার প্রস্তুতি! তো, লেখবে কে? কেবল পণ্ডিতেরা? না, ঠিক হলো যে কেউ লিখতে পারবেন, যখন-তখন লিখতে পারবেন। কেবল তিনি কিছু নিয়মকানুন মেনে চলবেন। প্রথমত, অন্যের লেখা চুরি করবেন না, আবেগতাড়িত হবেন না এবং প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে যাচাই করা যায় এমন রেফারেন্স দেবেন। একইভাবে লেখক নিজের ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করবেন না। মানে, নির্মোহ থেকে ‘কেবল তথ্য-উপাত্ত’ প্রকাশ করবেন, তথ্য-উপাত্ত প্রকাশের জন্য ভাষার যে মাধুর্য ও বাঙময় তো দরকার, সেটি জায়েজ!
এভাবেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রকাশিত জ্ঞানভান্ডার। বিশ্বের প্রায় ২০০টির বেশি ভাষায় এখন উইকিপিডিয়া রয়েছে। এর মধ্যে ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে রয়েছে ৪০ লাখেরও বেশি নিবন্ধ!!! বিন্দু থেকে সিন্ধু!!!
আবার মায়ের ভাষাও
২০০৪ সাল থেকে বাংলাভাষাতেও রয়েছে উইকিপিডিয়া (http://bn.wikipedia.org)। এই উইকিপিডিয়া গড়ে তুলছে একদল স্বেচ্ছাসেবক। উইকিপিডিয়ার সংস্কৃতিতে এই কর্মী বাহিনীকে বলা হয় উইকিপিডিয়ান। বাংলা ভাষায় কাজ করছেন এমন উইকিপিডিয়ানদের মধ্যে যেমন আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, ক্রীড়াবিদ, তেমনি আছেন গ্রামের মেঠোপথে ঘুরে বেড়ায় যে চঞ্চল কিশোর, সে-ও। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এখন বাংলা উইকিপিডিয়াতে প্রায় ২৩ হাজার নিবন্ধ সৃষ্টি হয়েছে।
তবে হ্যাঁ, ইংরেজি উইকিপিডিয়ার মতো এখনো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেনি আমাদের প্রাণপ্রিয় বিশ্বকোষ। এখনো এখানে ভালোমানের নিবন্ধনের সংখ্যা হাতে গোনা। অন্যতম কারণ হলো আমাদের সক্রিয় উইকিপিডিয়ার সংখ্যাল্পতা। ফলে প্রতিনিয়িত এটিকে বিকশিত করার কাজটি এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না, অথচ কে না জানে, বাংলা ভাষায় জ্ঞানের এই মুক্ত আকরকে বিকশিত করার কাজটি করতে হবে আমাকে, আপনাকেই।
কেমন করে যুক্ত হবেন
যেমনটি বলেছি আগে, এ কাজে যুক্ত হতে পারেন সবাই। দরকার একটি ইন্টারনেট সংযোগওয়ালা কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনসেট। চলে যান বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রধান পাতায়। ব্যবহারকারী হিসেবে নিজেকে নিবন্ধিত করে ফেলুন। ব্যস্, হয়ে গেল আপনার প্রাক-প্রস্তুতি। এবার বাংলা ও ইংরেজি উইকিপিডিয়ার কিছু নিবন্ধ পড়ুন। সেগুলোর নানা বৈশিষ্ট্য খেয়াল করুন। দেখবেন, বেশির ভাগই মেদহীন, বাহুল্যবর্জিত। স্টাইলটা বুঝে ফেলেছেন? ব্যস্ এবার নেমে পড়ুন। তা বললেন? জীবনে এক লাইনও লেখেননি? না, কোনো সমস্যা নেই। উইকিপিডিয়া না হলে আমরা কখনোই বুঝতে পারতাম না সারা পৃথিবীতে লাখ লাখ লেখক আছেন। তাঁদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত গবেষকদের চেয়েও ভালো লেখেন। আমরা যারা বাংলা উইকিপিডিয়ার সঙ্গে জড়িত, তারা বলি, এখন আমাদের ভুক্তি সংখ্যা বাড়ানোর দরকার নেই। দরকার হলো নিবন্ধের মান বাড়ানো। আপনি আপনার পছন্দের যেকোনো বিষয় নিয়ে শুরু করতে পারেন। অথবা শুরু করতে পারেন দৈবচয়নের মাধ্যমে। প্রধান পাতায় বাঁদিকে একটি লিংক দেখবেন, ‘অজানা যেকোনো পৃষ্ঠায়’। সেটিতে ক্লিক করলেই দৈব ভিত্তিতে আপনি একটি ভুক্তি পাবেন। আপনার বিচারে সেটি যদি ভালোমানের ও তথ্যসমৃদ্ধ হয়, তাহলে পরের নিবন্ধে চলে যান। নতুবা সেটি নিয়ে কাজ করুন।
তথ্য-উপাত্ত কোথায় পাবেন? বাঁ দিকে দেখুন। সেই ভুক্তির অন্য ভাষার নিবন্ধগুলোর লিংক সেখানে পাবেন। সেখান থেকে ইংরেজি ভাষায় (অথবা অন্য যে ভাষা আপনি পারেন) ভুক্তিতে চলে যান।
পেয়ে গেলেন, আপনার তথ্য সূত্র। এবার নিজের মতো করে ইংরেজির তথ্যগুলো বাংলাতে যোগ করে দিন। লেখার সময় বাংলা বানানোর প্রতি যত্নশীল হবেন এবং আবেগ বাদ দেবেন!
আপনি যদি প্রতিদিন এক লাইন করে লেখেন, তাহলে এক বছরে আপনি ৩৬৫ লাইন যুক্ত করতে পারবেন। আমি জানি, আপনি যখন শুরু করবেন, তখন নিজেকে এক লাইনে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। যেমনটি রাখেননি জাস্টিন অ্যান্থনি ন্যাপ। তিনি একাই ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় ১০ লাখ সম্পাদনা করেছেন।
আমি জানি, শুরুতে আপনার বেশ কিছু সমস্যা হবে। তবে, ভয় পাবেন না। অন্য উইকিপিডিয়ানরা আপনাকে সহায়তা করার জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছেন। আপনি দেখবেন আপনার অ্যাকাউন্ট খোলার পরপরই কেউ একজন আপনাকে স্বাগত জানাবেন। অন্য একজন টিউটরিয়ালের হদিস দেবেন। আপনি যুক্ত হয়ে যাবেন একদল স্বেচ্ছাসেবীর নেটওয়ার্কে, বাংলা ভাষায় মুক্ত বিশ্বকোষ সৃষ্টি করা যাঁদের ব্রত।
এই কাজগুলো আপনি মোবাইল ফোনসেটেও করতে পারবেন। বাংলা উইকিপিডিয়ার রয়েছে মোবাইল-সংস্করণ (http://bn.m.wikipedia.org)। কাজে যখন আটকে থাকবেন জ্যামে, তখন লিখতে পারবেন ইংরেজি ট্রাফিক জ্যাম কীভাবে আমাদের ‘যানজট’ হলো! বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ একটি জ্ঞানকোষ তৈরির স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। উইকিপিডিয়া তার সঙ্গে যুক্ত করেছে ‘সবার দ্বারা, সবার জন্য, বিনে পয়সায়’।
আমি, আপনি, আমরা সবাই মিলে সেই কাজটি এগিয়ে নিতে পারি। কেবল দরকার, সাহস, একাগ্রতা আর নিষ্ঠা।
এসবের কোনটা আপনার কম আছে, বলুন তো?
লেখক: সভাপতি, উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ
প্রথমত, উইকিপিডিয়া। পরে বাংলা, দুইয়ে মিলিয়েই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ। যখন তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ব্যাপারটি কী, তখন তাঁরা ব্যাখ্যা করেন, উইকিপিডিয়া হলো আমাদের সবার বিশ্বকোষ। সবাই মিলে, সবার জন্য এই বিনে পয়সার তথ্য ভান্ডার!
কেবল বিনে পয়সার বলে এটি মূল্যহীন নয়, বরং অমূল্য। আর তথ্যের এই অমূল্য রত্নভান্ডার গড়ে তুলছেন আমার-আপনার মতো আমজনতা!
আমজনতার বিশ্বকোষ
সব সময় ধারণা ছিল কতিপয় চশমা আঁটা সবজান্তা লিখবেন জ্ঞানের আকর। লিখেছেনও বটে। শুরুর দিকে বিশ্বকোষগুলো ব্যক্তিপ্রচেষ্টার। পরে সম্পাদক-রচয়িতার কলেবর বেড়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি সীমায়িত থেকেছে গোষ্ঠীর মধ্যে, কখনো সেটা জ্ঞান সমিতি (যেমন আমাদের বাংলাপিডিয়ার আয়োজক সংস্থা এশিয়াটিক সোসাইটি) কিংবা কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগ (যেমন, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা)।
তবে কম্পিউটার আর ইন্টানেটের জন্ম নীরবে-নিভৃতে গড়ে তুলেছে এক ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি। ছোটবেলা থেকে আমরা ‘ছোট ছোট বালুকণা’র মহাদেশ আর ‘বিন্দু বিন্দু জল কণা’র মহাসাগর গড়ার কথা পড়েছি। কিন্তু বিন্দুর সত্যিকারের সিন্ধু হওয়ার রূপকথা চাক্ষুষ দেখার জন্য আমাদের এই একুশ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
২০০১ সালের ১৫ জানুয়ারি জিমি ওয়ালেস নামের এক ক্ষ্যাপা লোক ভাবলেন—বিন্দু দিয়ে সিন্ধু রচনায় কাজটা শুরু হোক একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তোলার মাধ্যমে। দুটি কারণে তিনি বুকে বল পেলেন—প্রথমত, কম্পিউটারের মাধ্যমে সমন্বিত কাজ বা কোলাবরেশন অনেক সহজ আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্ভব সেটিকে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া!
দর্শনটাও সহজ। সবাই মিলে একটি বিশ্বকোষ লিখে ফেলা। যে ভাবা, সেই কাজ। শুরু হয়ে গেল প্রজেক্ট উইকিপিডিয়া (www.wikipedia.org)। শুরুটা হলো ইংরেজি ভাষায়, তবে অন্য ভাষাভাষীরাও পিছিয়ে রইলেন না। শুরুতে কিছু নিয়মকানুন ঠিক করা হলো, তবে মেনে নেওয়া হলো যে সেগুলো পরিবর্তিত হলেও হতে পারবে। ঠিক হলো বিশ্বকোষের ভুক্তি বা নিবন্ধ যোগ হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। অর্থাৎ কেউ যদি ভাবে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি নিবন্ধ থাকবে, তাহলেই সই। তবে, শেষ পর্যন্ত সেটি থাকবে কি না, তা নির্ভর করে বিষয়টির সার্বজনীনতার ওপর। প্রকাশযোগ্যতার ওপর। প্রশ্ন হলো কীভাবে এই সার্বজনীনতা, প্রকাশযোগ্যতা মাপা হবে। কতক সহজ নিয়ম—প্রথমত, বিশ্বাসযোগ্য ও লিখিত রেফারেন্স থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেগুলো যাচাইযোগ্য হতে হবে। ব্যস্ হয়ে গেল বিশ্বকোষ লেখার প্রস্তুতি! তো, লেখবে কে? কেবল পণ্ডিতেরা? না, ঠিক হলো যে কেউ লিখতে পারবেন, যখন-তখন লিখতে পারবেন। কেবল তিনি কিছু নিয়মকানুন মেনে চলবেন। প্রথমত, অন্যের লেখা চুরি করবেন না, আবেগতাড়িত হবেন না এবং প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে যাচাই করা যায় এমন রেফারেন্স দেবেন। একইভাবে লেখক নিজের ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করবেন না। মানে, নির্মোহ থেকে ‘কেবল তথ্য-উপাত্ত’ প্রকাশ করবেন, তথ্য-উপাত্ত প্রকাশের জন্য ভাষার যে মাধুর্য ও বাঙময় তো দরকার, সেটি জায়েজ!
এভাবেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রকাশিত জ্ঞানভান্ডার। বিশ্বের প্রায় ২০০টির বেশি ভাষায় এখন উইকিপিডিয়া রয়েছে। এর মধ্যে ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে রয়েছে ৪০ লাখেরও বেশি নিবন্ধ!!! বিন্দু থেকে সিন্ধু!!!
আবার মায়ের ভাষাও
২০০৪ সাল থেকে বাংলাভাষাতেও রয়েছে উইকিপিডিয়া (http://bn.wikipedia.org)। এই উইকিপিডিয়া গড়ে তুলছে একদল স্বেচ্ছাসেবক। উইকিপিডিয়ার সংস্কৃতিতে এই কর্মী বাহিনীকে বলা হয় উইকিপিডিয়ান। বাংলা ভাষায় কাজ করছেন এমন উইকিপিডিয়ানদের মধ্যে যেমন আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, ক্রীড়াবিদ, তেমনি আছেন গ্রামের মেঠোপথে ঘুরে বেড়ায় যে চঞ্চল কিশোর, সে-ও। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এখন বাংলা উইকিপিডিয়াতে প্রায় ২৩ হাজার নিবন্ধ সৃষ্টি হয়েছে।
তবে হ্যাঁ, ইংরেজি উইকিপিডিয়ার মতো এখনো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেনি আমাদের প্রাণপ্রিয় বিশ্বকোষ। এখনো এখানে ভালোমানের নিবন্ধনের সংখ্যা হাতে গোনা। অন্যতম কারণ হলো আমাদের সক্রিয় উইকিপিডিয়ার সংখ্যাল্পতা। ফলে প্রতিনিয়িত এটিকে বিকশিত করার কাজটি এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না, অথচ কে না জানে, বাংলা ভাষায় জ্ঞানের এই মুক্ত আকরকে বিকশিত করার কাজটি করতে হবে আমাকে, আপনাকেই।
কেমন করে যুক্ত হবেন
যেমনটি বলেছি আগে, এ কাজে যুক্ত হতে পারেন সবাই। দরকার একটি ইন্টারনেট সংযোগওয়ালা কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনসেট। চলে যান বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রধান পাতায়। ব্যবহারকারী হিসেবে নিজেকে নিবন্ধিত করে ফেলুন। ব্যস্, হয়ে গেল আপনার প্রাক-প্রস্তুতি। এবার বাংলা ও ইংরেজি উইকিপিডিয়ার কিছু নিবন্ধ পড়ুন। সেগুলোর নানা বৈশিষ্ট্য খেয়াল করুন। দেখবেন, বেশির ভাগই মেদহীন, বাহুল্যবর্জিত। স্টাইলটা বুঝে ফেলেছেন? ব্যস্ এবার নেমে পড়ুন। তা বললেন? জীবনে এক লাইনও লেখেননি? না, কোনো সমস্যা নেই। উইকিপিডিয়া না হলে আমরা কখনোই বুঝতে পারতাম না সারা পৃথিবীতে লাখ লাখ লেখক আছেন। তাঁদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত গবেষকদের চেয়েও ভালো লেখেন। আমরা যারা বাংলা উইকিপিডিয়ার সঙ্গে জড়িত, তারা বলি, এখন আমাদের ভুক্তি সংখ্যা বাড়ানোর দরকার নেই। দরকার হলো নিবন্ধের মান বাড়ানো। আপনি আপনার পছন্দের যেকোনো বিষয় নিয়ে শুরু করতে পারেন। অথবা শুরু করতে পারেন দৈবচয়নের মাধ্যমে। প্রধান পাতায় বাঁদিকে একটি লিংক দেখবেন, ‘অজানা যেকোনো পৃষ্ঠায়’। সেটিতে ক্লিক করলেই দৈব ভিত্তিতে আপনি একটি ভুক্তি পাবেন। আপনার বিচারে সেটি যদি ভালোমানের ও তথ্যসমৃদ্ধ হয়, তাহলে পরের নিবন্ধে চলে যান। নতুবা সেটি নিয়ে কাজ করুন।
তথ্য-উপাত্ত কোথায় পাবেন? বাঁ দিকে দেখুন। সেই ভুক্তির অন্য ভাষার নিবন্ধগুলোর লিংক সেখানে পাবেন। সেখান থেকে ইংরেজি ভাষায় (অথবা অন্য যে ভাষা আপনি পারেন) ভুক্তিতে চলে যান।
পেয়ে গেলেন, আপনার তথ্য সূত্র। এবার নিজের মতো করে ইংরেজির তথ্যগুলো বাংলাতে যোগ করে দিন। লেখার সময় বাংলা বানানোর প্রতি যত্নশীল হবেন এবং আবেগ বাদ দেবেন!
আপনি যদি প্রতিদিন এক লাইন করে লেখেন, তাহলে এক বছরে আপনি ৩৬৫ লাইন যুক্ত করতে পারবেন। আমি জানি, আপনি যখন শুরু করবেন, তখন নিজেকে এক লাইনে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। যেমনটি রাখেননি জাস্টিন অ্যান্থনি ন্যাপ। তিনি একাই ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় ১০ লাখ সম্পাদনা করেছেন।
আমি জানি, শুরুতে আপনার বেশ কিছু সমস্যা হবে। তবে, ভয় পাবেন না। অন্য উইকিপিডিয়ানরা আপনাকে সহায়তা করার জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছেন। আপনি দেখবেন আপনার অ্যাকাউন্ট খোলার পরপরই কেউ একজন আপনাকে স্বাগত জানাবেন। অন্য একজন টিউটরিয়ালের হদিস দেবেন। আপনি যুক্ত হয়ে যাবেন একদল স্বেচ্ছাসেবীর নেটওয়ার্কে, বাংলা ভাষায় মুক্ত বিশ্বকোষ সৃষ্টি করা যাঁদের ব্রত।
এই কাজগুলো আপনি মোবাইল ফোনসেটেও করতে পারবেন। বাংলা উইকিপিডিয়ার রয়েছে মোবাইল-সংস্করণ (http://bn.m.wikipedia.org)। কাজে যখন আটকে থাকবেন জ্যামে, তখন লিখতে পারবেন ইংরেজি ট্রাফিক জ্যাম কীভাবে আমাদের ‘যানজট’ হলো! বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ একটি জ্ঞানকোষ তৈরির স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। উইকিপিডিয়া তার সঙ্গে যুক্ত করেছে ‘সবার দ্বারা, সবার জন্য, বিনে পয়সায়’।
আমি, আপনি, আমরা সবাই মিলে সেই কাজটি এগিয়ে নিতে পারি। কেবল দরকার, সাহস, একাগ্রতা আর নিষ্ঠা।
এসবের কোনটা আপনার কম আছে, বলুন তো?
লেখক: সভাপতি, উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ
No comments