দুর্নীতির জরিপ-টিআইবির সমালোচক টিআইবির বন্ধু by ইফতেখারুজ্জামান
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক ২৩ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে প্রকাশিত জাতীয় খানা জরিপ বরাবরের মতো ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত করেছে। প্রতিবেদনের ফলাফলে সারা দেশে এবং দেশের বাইরে অগণিত মানুষ, যাঁরা যথার্থতা খুঁজে পেয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই আমাদের কাজের প্রেরণার উৎস।
আর যাঁরা এতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন, এমনকি আমাদের কাজকে ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন, তাঁদের আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সূত্রমতে, বাস্তবে আমাদের বন্ধুই মনে করি। আমাদের কাজে আরও উৎকর্ষ অর্জনের জন্য তাঁরা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, যা আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সহায়ক হবে।
অন্যদিকে কোনো কোনো সমালোচক কর্তৃক টিআইবি আবারও ‘শুট দ্য ম্যাসেঞ্জার’ প্রবণতার শিকার হয়েছে, যেন ঝড়ের বিপৎসংকেত প্রদানকারী যন্ত্রটাকে ভেঙে ফেললেই ঝড় থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। চারদলীয় সরকারের সময় টিআইবির বিরুদ্ধে দেশের ৬৪ জেলায় মামলা করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এক-এগারোর পরিচয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা টিআইবির প্রতিবেদনে ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলেছিলেন। কারণ, সিডর-পরবর্তী ত্রাণকর্মে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছিল টিআইবি।
টিআইবি এ রকম আক্রমণে আহত হয় কিন্তু পরাজিত হয় না। কারণ, টিআইবির কাজের উদ্দেশ্য দেশের উন্নয়ন ও সমাজ পরিবর্তনে, বিশেষ করে দুর্নীতি প্রতিরোধে যারা অঙ্গীকারবদ্ধ, সরকারসহ এ রকম অন্য সব স্টেকহোল্ডারের হাতকে শক্তিশালী করা। আর এ কাজটি করতে গিয়ে টিআইবি তার সব সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করে সর্বোত্তম স্বচ্ছতা, সততা, বস্তুনিষ্ঠতা ও গুণগত উৎকর্ষ নিশ্চিত করতে।
কোনো কোনো সমালোচক টিআইবির খানা জরিপের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, পরিসংখ্যান ও জরিপবিজ্ঞানের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করেই নির্বাচিত সেবা খাতে দুর্নীতিবিষয়ক খানা জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। তথ্যের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করে সমগ্র বাংলাদেশে জরিপের প্রতিপাদ্য বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরযোগ্য চিত্র তুলে ধরার জন্য মোট ছয় হাজার খানার নির্বাচন করতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রণীত ‘ইনটিগ্রেটেড মাল্টিপারপাস স্যাম্পলিং ফার্ম (আইএমপিএস)’ অনুসরণ করা হয়েছে। খানা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘দেয়ার স্টেজ সার্টিফাইড ক্লাস্টার স্যাম্পলিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। জরিপের খানা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে আইএমপিএসের প্রতিটি স্তর থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসইউ) অর্থাৎ মৌজা বা মহল্লা নির্বাচন করা হয়। প্রতিটি স্তর থেকে কতটি মৌজা বা মহল্লা নির্বাচন করা হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে দেশের ৬৪টি জেলার জন্য যে ১৬টি স্তর রয়েছে, তার প্রতিটির মোট জনসংখ্যাকে স্কয়ার রুট ট্রান্সফরমেশনের মাধ্যমে নিরূপিত আনুপাতিক হার ব্যবহার করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে দেশের ছয়টি বিভাগের ৬৪টি জেলায় বিস্তৃত এবং পল্লি ও নগর এলাকার জনসংখ্যার যথার্থ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
খানা নির্বাচনে দৈবচয়ন (র্যানডম) পদ্ধতি অনুসরণ করায় কোনো নির্দিষ্ট খাতে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা আগে থেকে নির্ধারণ করার কোনো সুযোগ এ ধরনের জরিপে থাকে না। দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত ছয় হাজার খানার অভিজ্ঞতাভিত্তিক জরিপ হওয়ায় উত্তরদাতারা সংশ্লিষ্ট খানা যেসব খাতে সেবা নিয়েছেন, শুধু সংশ্লিষ্ট সেসব খাতের সেবারই অভিজ্ঞতার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি ছিল এ রকম: নির্বাচিত যেকোনো একটি খাতে গত এক বছরে উত্তরদাতা কোনো সেবা গ্রহণ করেছেন কি না। উত্তর যদি না হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন কি না বা ঘুষ দিতে হয়েছে কি না সে প্রশ্ন আর করা হয়নি। আর যদি উত্তর ইতিবাচক হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কী ধরনের দুর্নীতির শিকার বা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানে বাধ্য হয়েছেন, সেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
লক্ষণীয় যে খাতওয়ারি সেবাগ্রহীতার হারের যে চিত্র জরিপের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়েছে, তাও বাস্তবচিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকারের মতো খাতগুলোতে সেবাগ্রহণকারী খানার হার সবচেয়ে বেশি; যথাক্রমে ৯৭ দশমিক ১, ৮১ দশমিক ৮ ও ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে কর ও শুল্ক, বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলার মতো খাতে সেবাগ্রহীতার হার তুলনামূলকভাবে কম, যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯, ১০ দশমিক ৯ এবং ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। অতএব প্রতিবেদনে প্রকাশিত সার্বিক দুর্নীতির চিত্রের মতোই খাতওয়ারি ঘুষ আদায়সহ দুর্নীতির যে বিশ্লেষণ প্রতিভাত হয়েছে, তা শুধু পরিসংখ্যান ও জরিপবিজ্ঞানের মাপকাঠিতেই নয়, সার্বিক চলমান বাস্তবতা বিবেচনায় সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য।
অতএব খাতওয়ারি জরিপকৃত সেবাগ্রহণকারীর সংখ্যা সম্পর্কে কোনো কোনো মহল কর্তৃক যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, তা নিতান্তই অমূলক। উদাহরণস্বরূপ জরিপ অনুযায়ী, বিচারব্যবস্থায় সেবা নিয়েছেন ১০ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা, যা এ খাতের সার্বিক চিত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। দেশের শতভাগ মানুষ বিচারব্যবস্থায় সেবা নিয়েছেন এ কথা নিশ্চয়ই বলা যাবে না। জরিপে অংশগ্রহণকারী ছয় হাজার জনকেই যদি সব খাতের দুর্নীতির সম্পর্কে প্রশ্ন করা হতো, তাহলে সেটি জনমত বা ধারণাভিত্তিক ফল দিত, অভিজ্ঞতাভিত্তিক হতো না।
টিআইবির এই জরিপ সম্পূর্ণ নির্ভুল, এটি বলা যাবে না। কোনো সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণার ফলাফলই নির্ভুল হয় না। তবে জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য ও বিশ্লেষণের গ্রহণযোগ্যতা ও উৎকর্ষের যে মূল মাপকাঠি, তা হলো সম্ভাব্য সহনীয় ত্রুটির মাত্রা, যা এই জরিপে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জরিপকালে সার্বিকভাবে দুর্নীতির শিকার হওয়া খানার প্রাক্কলিত হারের ত্রুটির মাত্রা ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়া খানার প্রাক্কলিত হারের সম্ভাব্য ত্রুটির মাত্রা ১ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে বিভিন্ন খাতের দুর্নীতির প্রাক্কলনসমূহের জন্য সম্ভাব্য ত্রুটির মাত্রা ± ০১.৯৬ থেকে ± ৫.৭ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে মানতে হবে যে জরিপের ফলাফলের সর্বোচ্চ সম্ভব গ্রহণযোগ্যতা ও উৎকর্ষ নিশ্চিত করা হয়েছে।
জরিপটির পরিকল্পনা, ডিজাইন, পদ্ধতি নির্ধারণ, নমুনায়ন পর্যায় থেকে তথের বিশ্লেষণ ও খসড়া প্রতিবেদন প্রণয়নসহ প্রতিটি স্তরে টিআইবির গবেষণা টিমকে বৈজ্ঞানিক পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের পাঁচজন খ্যাতিমান পরিসংখ্যান ও সামাজিক বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ। তাঁরা হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী সালেহ্ আহমেদ ও অধ্যাপক এম এ কবীর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান, অধ্যাপক পি কে মতিউর রহমান ও অধ্যাপক মোহাম্মদ শোয়ায়ব। তাঁদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও পেশাদারি উৎকর্ষের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটেছে এই জরিপের তথ্য ও বিশ্লেষণে।
টিআইবির এই জরিপ একান্তই তথ্যনির্ভর ও সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে, কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থেকে নিরেটভাবে নির্মোহতার সঙ্গে বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়েছে। জরিপটি পুরোপুরি অভিজ্ঞতাভিত্তিক, কোনো ধরনের ধারণা বা মতামত গ্রহণের সুযোগ ছিল না। সুতরাং, জরিপের ফলাফলও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত। অন্যদিকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট খাত ও বিভাগের উচ্চপর্যায়ের সম্মানিত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট খাতে দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে যেসব বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, টিআইবির জরিপ তারই বিজ্ঞানসম্মত যথার্থতা প্রদান করেছে।
টিআইবির কাজের প্রকৃতিটাই এ রকম যে ক্ষমতাবানদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে যাঁরা আমাদের সাদরে গ্রহণ করেন, তাঁরাই আবার সময়সাপেক্ষে আমাদের প্রত্যাখ্যান করেন। তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু জনস্বার্থে, সরকারের যথাযথ অনুমতিক্রমে অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সরকারসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে, সে কারণে ইতিমধ্যে এর সুফলও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দুর্নীতি বিষয়ে গবেষণা, প্রচারণা ও দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা ও চাহিদা সৃষ্টির অদম্য প্রয়াসের পাশাপাশি বাংলাদেশ যে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের অংশীদার রাষ্ট্র, তা সম্ভব হয়েছে টিআইবিরই গবেষণালব্ধ ক্যাম্পেইনের পরিপ্রেক্ষিতে। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর পরিবর্তে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী সময়ে এর কার্যকরতা নিশ্চিতকরণের দাবি, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ প্রণয়ন ও বর্তমান সংসদে উত্থাপিত খসড়া তথ্য প্রদানকারীর সুরক্ষা আইনের মতো দুর্নীতি প্রতিরোধক গুরুত্বপূর্ণ আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনে টিআইবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তাই আমরা আশাবাদী। আমরা আরও আশাবাদী এ কারণে যে আমাদের সাম্প্রতিক অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি মানুষ দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকার জন্য সরকারের ওপর আস্থা রাখছে। অন্যদিকে দেশে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। এই দুইয়ের সমন্বয়ে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে সাফল্য অজর্নের সম্ভাবনা অসীম। শুধু প্রয়োজন যাঁদের হাতে বাস্তবিক পক্ষে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার, তাঁদের সদিচ্ছা ও সত্যকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।
অন্যদিকে কোনো কোনো সমালোচক কর্তৃক টিআইবি আবারও ‘শুট দ্য ম্যাসেঞ্জার’ প্রবণতার শিকার হয়েছে, যেন ঝড়ের বিপৎসংকেত প্রদানকারী যন্ত্রটাকে ভেঙে ফেললেই ঝড় থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। চারদলীয় সরকারের সময় টিআইবির বিরুদ্ধে দেশের ৬৪ জেলায় মামলা করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এক-এগারোর পরিচয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা টিআইবির প্রতিবেদনে ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলেছিলেন। কারণ, সিডর-পরবর্তী ত্রাণকর্মে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছিল টিআইবি।
টিআইবি এ রকম আক্রমণে আহত হয় কিন্তু পরাজিত হয় না। কারণ, টিআইবির কাজের উদ্দেশ্য দেশের উন্নয়ন ও সমাজ পরিবর্তনে, বিশেষ করে দুর্নীতি প্রতিরোধে যারা অঙ্গীকারবদ্ধ, সরকারসহ এ রকম অন্য সব স্টেকহোল্ডারের হাতকে শক্তিশালী করা। আর এ কাজটি করতে গিয়ে টিআইবি তার সব সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করে সর্বোত্তম স্বচ্ছতা, সততা, বস্তুনিষ্ঠতা ও গুণগত উৎকর্ষ নিশ্চিত করতে।
কোনো কোনো সমালোচক টিআইবির খানা জরিপের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, পরিসংখ্যান ও জরিপবিজ্ঞানের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করেই নির্বাচিত সেবা খাতে দুর্নীতিবিষয়ক খানা জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। তথ্যের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করে সমগ্র বাংলাদেশে জরিপের প্রতিপাদ্য বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরযোগ্য চিত্র তুলে ধরার জন্য মোট ছয় হাজার খানার নির্বাচন করতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রণীত ‘ইনটিগ্রেটেড মাল্টিপারপাস স্যাম্পলিং ফার্ম (আইএমপিএস)’ অনুসরণ করা হয়েছে। খানা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘দেয়ার স্টেজ সার্টিফাইড ক্লাস্টার স্যাম্পলিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। জরিপের খানা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে আইএমপিএসের প্রতিটি স্তর থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসইউ) অর্থাৎ মৌজা বা মহল্লা নির্বাচন করা হয়। প্রতিটি স্তর থেকে কতটি মৌজা বা মহল্লা নির্বাচন করা হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে দেশের ৬৪টি জেলার জন্য যে ১৬টি স্তর রয়েছে, তার প্রতিটির মোট জনসংখ্যাকে স্কয়ার রুট ট্রান্সফরমেশনের মাধ্যমে নিরূপিত আনুপাতিক হার ব্যবহার করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে দেশের ছয়টি বিভাগের ৬৪টি জেলায় বিস্তৃত এবং পল্লি ও নগর এলাকার জনসংখ্যার যথার্থ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
খানা নির্বাচনে দৈবচয়ন (র্যানডম) পদ্ধতি অনুসরণ করায় কোনো নির্দিষ্ট খাতে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা আগে থেকে নির্ধারণ করার কোনো সুযোগ এ ধরনের জরিপে থাকে না। দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত ছয় হাজার খানার অভিজ্ঞতাভিত্তিক জরিপ হওয়ায় উত্তরদাতারা সংশ্লিষ্ট খানা যেসব খাতে সেবা নিয়েছেন, শুধু সংশ্লিষ্ট সেসব খাতের সেবারই অভিজ্ঞতার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি ছিল এ রকম: নির্বাচিত যেকোনো একটি খাতে গত এক বছরে উত্তরদাতা কোনো সেবা গ্রহণ করেছেন কি না। উত্তর যদি না হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন কি না বা ঘুষ দিতে হয়েছে কি না সে প্রশ্ন আর করা হয়নি। আর যদি উত্তর ইতিবাচক হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কী ধরনের দুর্নীতির শিকার বা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানে বাধ্য হয়েছেন, সেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
লক্ষণীয় যে খাতওয়ারি সেবাগ্রহীতার হারের যে চিত্র জরিপের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়েছে, তাও বাস্তবচিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকারের মতো খাতগুলোতে সেবাগ্রহণকারী খানার হার সবচেয়ে বেশি; যথাক্রমে ৯৭ দশমিক ১, ৮১ দশমিক ৮ ও ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে কর ও শুল্ক, বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলার মতো খাতে সেবাগ্রহীতার হার তুলনামূলকভাবে কম, যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯, ১০ দশমিক ৯ এবং ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। অতএব প্রতিবেদনে প্রকাশিত সার্বিক দুর্নীতির চিত্রের মতোই খাতওয়ারি ঘুষ আদায়সহ দুর্নীতির যে বিশ্লেষণ প্রতিভাত হয়েছে, তা শুধু পরিসংখ্যান ও জরিপবিজ্ঞানের মাপকাঠিতেই নয়, সার্বিক চলমান বাস্তবতা বিবেচনায় সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য।
অতএব খাতওয়ারি জরিপকৃত সেবাগ্রহণকারীর সংখ্যা সম্পর্কে কোনো কোনো মহল কর্তৃক যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, তা নিতান্তই অমূলক। উদাহরণস্বরূপ জরিপ অনুযায়ী, বিচারব্যবস্থায় সেবা নিয়েছেন ১০ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা, যা এ খাতের সার্বিক চিত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। দেশের শতভাগ মানুষ বিচারব্যবস্থায় সেবা নিয়েছেন এ কথা নিশ্চয়ই বলা যাবে না। জরিপে অংশগ্রহণকারী ছয় হাজার জনকেই যদি সব খাতের দুর্নীতির সম্পর্কে প্রশ্ন করা হতো, তাহলে সেটি জনমত বা ধারণাভিত্তিক ফল দিত, অভিজ্ঞতাভিত্তিক হতো না।
টিআইবির এই জরিপ সম্পূর্ণ নির্ভুল, এটি বলা যাবে না। কোনো সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণার ফলাফলই নির্ভুল হয় না। তবে জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য ও বিশ্লেষণের গ্রহণযোগ্যতা ও উৎকর্ষের যে মূল মাপকাঠি, তা হলো সম্ভাব্য সহনীয় ত্রুটির মাত্রা, যা এই জরিপে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জরিপকালে সার্বিকভাবে দুর্নীতির শিকার হওয়া খানার প্রাক্কলিত হারের ত্রুটির মাত্রা ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়া খানার প্রাক্কলিত হারের সম্ভাব্য ত্রুটির মাত্রা ১ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে বিভিন্ন খাতের দুর্নীতির প্রাক্কলনসমূহের জন্য সম্ভাব্য ত্রুটির মাত্রা ± ০১.৯৬ থেকে ± ৫.৭ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে মানতে হবে যে জরিপের ফলাফলের সর্বোচ্চ সম্ভব গ্রহণযোগ্যতা ও উৎকর্ষ নিশ্চিত করা হয়েছে।
জরিপটির পরিকল্পনা, ডিজাইন, পদ্ধতি নির্ধারণ, নমুনায়ন পর্যায় থেকে তথের বিশ্লেষণ ও খসড়া প্রতিবেদন প্রণয়নসহ প্রতিটি স্তরে টিআইবির গবেষণা টিমকে বৈজ্ঞানিক পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের পাঁচজন খ্যাতিমান পরিসংখ্যান ও সামাজিক বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ। তাঁরা হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী সালেহ্ আহমেদ ও অধ্যাপক এম এ কবীর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান, অধ্যাপক পি কে মতিউর রহমান ও অধ্যাপক মোহাম্মদ শোয়ায়ব। তাঁদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও পেশাদারি উৎকর্ষের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটেছে এই জরিপের তথ্য ও বিশ্লেষণে।
টিআইবির এই জরিপ একান্তই তথ্যনির্ভর ও সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে, কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থেকে নিরেটভাবে নির্মোহতার সঙ্গে বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়েছে। জরিপটি পুরোপুরি অভিজ্ঞতাভিত্তিক, কোনো ধরনের ধারণা বা মতামত গ্রহণের সুযোগ ছিল না। সুতরাং, জরিপের ফলাফলও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত। অন্যদিকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট খাত ও বিভাগের উচ্চপর্যায়ের সম্মানিত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট খাতে দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে যেসব বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, টিআইবির জরিপ তারই বিজ্ঞানসম্মত যথার্থতা প্রদান করেছে।
টিআইবির কাজের প্রকৃতিটাই এ রকম যে ক্ষমতাবানদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে যাঁরা আমাদের সাদরে গ্রহণ করেন, তাঁরাই আবার সময়সাপেক্ষে আমাদের প্রত্যাখ্যান করেন। তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু জনস্বার্থে, সরকারের যথাযথ অনুমতিক্রমে অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সরকারসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে, সে কারণে ইতিমধ্যে এর সুফলও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দুর্নীতি বিষয়ে গবেষণা, প্রচারণা ও দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা ও চাহিদা সৃষ্টির অদম্য প্রয়াসের পাশাপাশি বাংলাদেশ যে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের অংশীদার রাষ্ট্র, তা সম্ভব হয়েছে টিআইবিরই গবেষণালব্ধ ক্যাম্পেইনের পরিপ্রেক্ষিতে। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর পরিবর্তে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী সময়ে এর কার্যকরতা নিশ্চিতকরণের দাবি, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ প্রণয়ন ও বর্তমান সংসদে উত্থাপিত খসড়া তথ্য প্রদানকারীর সুরক্ষা আইনের মতো দুর্নীতি প্রতিরোধক গুরুত্বপূর্ণ আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনে টিআইবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তাই আমরা আশাবাদী। আমরা আরও আশাবাদী এ কারণে যে আমাদের সাম্প্রতিক অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি মানুষ দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকার জন্য সরকারের ওপর আস্থা রাখছে। অন্যদিকে দেশে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। এই দুইয়ের সমন্বয়ে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে সাফল্য অজর্নের সম্ভাবনা অসীম। শুধু প্রয়োজন যাঁদের হাতে বাস্তবিক পক্ষে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার, তাঁদের সদিচ্ছা ও সত্যকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।
No comments