কল্পকথার গল্প-কুমিরের রচনা ও লিমনের পা হারানো by আলী হাবিব

কী আশ্চর্য! নামে নামে এত মিল! বাংলাদেশের এক এলিট ফোর্সের সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ার এক দ্বীপ-শহরের নাম! বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের জন্ম ২০০৪ সালের ২১ মার্চ। অন্যদিকে, ক্রোয়েশিয়ার র‌্যাব শহরটির গড়ে ওঠা খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০ সালে। বাংলাদেশের র‌্যাব জোট শাসনামলে জন্ম নিয়ে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়ে পার করছে মহাজোট সরকারের আমল।


অন্যদিকে, র‌্যাব শহরটি রোমান সাম্রাজ্য থেকে বাইজান্টাইন সম্রাটের শাসন পেরিয়ে আজ ক্রোয়েশিয়ার একটি শহর। র‌্যাব শহরের রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আছে দৃষ্টিনন্দন কিছু স্মৃতিসৌধ। এখনো ছুটির দিনগুলোতে সেখানে পর্যটকদের ভিড় জমে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের র‌্যাবের সংগ্রহে রয়েছে ক্রসফায়ার নামের কলঙ্ক। মানবাধিকারের পক্ষে যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের ভাষায় এটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। অন্যদিকে, র‌্যাবের সব সময়ের ভাষ্য_আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে গিয়ে গোলাগুলির একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসীরা নিহত হয়। নাটক-সিনেমার যেমন একটি স্ক্রিপ্ট থাকে, তাতে সাজানো থাকে দৃশ্যের পর দৃশ্য-সংলাপ-নাচ-গান, ঠিক তেমনি র‌্যাবের 'ক্রসফায়ার' নিয়ে একটি চমৎকার স্ক্রিপ্ট আছে। অনেক ঘষামাজার পর এই 'স্ক্রিপ্ট' আজকের 'স্ক্রিপ্ট' হয়েছে। এই গল্প শুরু থেকেই র‌্যাবের কাছ থেকে শুনে আসছে এ দেশের মানুষ।
২০০৪ সালের ২১ মার্চ জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাব প্রথম 'অ্যাকশনে' যায় একই বছর ১৪ এপ্রিল। অর্থাৎ, নববর্ষের অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে র‌্যাব। একই বছর ১৮ জুলাই দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, র‌্যাব গঠনের পর চার মাসে র‌্যাবের হেফাজতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তখন র‌্যাবের 'স্ক্রিপ্ট' ছিল অন্য রকম। তখন র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হতো, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের পর ঘটনাস্থলেই এলাকাবাসীর গণপিটুনিতে আহত সন্ত্রাসীদের হাসপাতালে নেওয়ার পর তাদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এই গল্পে র‌্যাব বেশিদিন থাকতে পারেনি। কারণ হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার করার পর সেখানে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটে কিভাবে_এমন প্রশ্ন ওঠা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। বোধ হয় উঠেছিলও। গণপিটুনির গল্প থেকে সরে আসে র‌্যাব। আসে নতুন স্ক্রিপ্ট 'ক্রসফায়ার'। সম্ভবত পিচ্চি হান্নান এই 'ক্রসফায়ার' স্ক্রিপ্টের প্রথম অপনায়ক। র‌্যাবের গল্পে বলা হয়, ২৫ জুন রাতে উত্তরায় পিচ্চি হান্নানের দলের সঙ্গে র‌্যাবের গুলিবিনিময় হয়। গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে পিচ্চি হান্নান আহত অবস্থায় সদলবলে পালিয়ে গেলে পরদিন সাভারের একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন দেবাশীষ ও হান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই মৃত্যু হয় দুজনের। নিটেল বাবুর লাশ উদ্ধার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই এ গল্পও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। গল্প বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে আরেক দফা সংযোজন-বিয়োজন। অর্থাৎ, নতুনভাবে সম্পাদনা করে আরেকটি গল্প। এবার গল্পের শিরোনাম বদল। 'ক্রসফায়ার' নামের হত্যাযজ্ঞের নাম বদলে কখনো হয় 'এনকাউন্টার', কখনো 'বন্দুকযুদ্ধ'। যেমন_'গোলাপ যে নামে ডাকো', তেমনি 'ক্রসফায়ার', 'বন্দুকযুদ্ধ' কিংবা 'এনকাউন্টার', যা-ই বলা হোক না কেন, তা যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এটা স্বীকার করতে কেবল র‌্যাব এবং সরকারেরই বোধ হয় আপত্তি। তবে র‌্যাব স্বীকার করে নিয়েছে, গত ছয় বছরে 'ক্রসফায়ার', 'বন্দুকযুদ্ধ' কিংবা 'এনকাউন্টার' জাতীয় ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৬৯৩। র‌্যাবের দেখাদেখি পুলিশও এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয়। তবে র‌্যাবই হচ্ছে 'ক্রসফায়ার', 'বন্দুকযুদ্ধ' কিংবা 'এনকাউন্টার' চিত্রনাট্যের জন্মদাতা। কাজেই ক্রেডিট লাইন র‌্যাবেরই পক্ষে। নকল সিনেমার 'কাট অ্যান্ড পেস্ট' ফর্মুলা মেনে সব ঘটনারই গল্প মোটামুটি এক। শুধু পাল্টে যায় নাম-ঠিকানা।
'ক্রসফায়ার', 'বন্দুকযুদ্ধ', 'এনকাউন্টার' ইত্যাদি নিয়ে আলোচিত-সমালোচিত র‌্যাব নতুন করে আবার আলোচনায় আসে লিমন নামের এক দরিদ্র কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে পা হারানোর পর। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল লিমনের। নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখার কথা যে কিশোরটির, হাসপাতালের বিছানায় তাকে এখন ঘিরে আছে অনাগত দিনের দুঃস্বপ্ন। র‌্যাবের গুলিতে আহত লিমনের মা তাঁর ছেলেকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে_এমন একটি মামলা করতে আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত আদেশ দেওয়ার পরও গত ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত মামলা নেয়নি রাজাপুর থানা পুলিশ। ১০ এপ্রিল আদালতের ওই আদেশ বাহক মারফত পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজাপুর থানায়। সেখানে আদালতের আদেশ যাওয়ার পরদিন সকালে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছুটি নিয়ে চলে যান। অর্থাৎ, মামলা না নেওয়ার সব চেষ্টা করেছে পুলিশ। যেমন, হাসপাতালে ঢাকার মিডিয়া যেন যেতে না পারে, তার ব্যবস্থাও করেছিল।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের দিনমজুর তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে লিমন। নিজেও দিনমজুরি করে চালিয়ে এসেছে লেখাপড়া। র‌্যাবের একটি গুলি তার সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর লিমনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার সব চেষ্টাই করা হয়েছিল। যে গল্পে লিমনকে খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরা হয়, সেই গল্পেও আছে গোলাগুলির কিছু ঘটনা। আছে অস্ত্র উদ্ধারের কথাও। কিন্তু এখন পর্যন্ত লিমনকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি র‌্যাব। চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এলাকার মানুষকে ভয় দেখানো হয়েছে_এমন অভিযোগ আছে। কিন্তু নিরীহ লিমনকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ র‌্যাব। লিমনকে নিয়ে লেখা র‌্যাবের গল্প ধোপে টিকল না। র‌্যাব-৮-এর ডিএডি মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, 'র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে লিমন এবং তার সহযোগীরা র‌্যাবের ওপর গুলিবর্ষণ করে। র‌্যাব আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা গুলি চালায়। সংঘর্ষের পর একটি পিস্তলসহ আহত অবস্থায় লিমনকে উদ্ধার করা হয়।' র‌্যাব-৮-এর অধিনায়কও সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, 'সে (লিমন) এলাকার সন্ত্রাসী মোর্শেদের সহযোগী।' সংবাদমাধ্যমে লিমনের ঘটনাটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। র‌্যাব সরে আসে আগের অবস্থান থেকে। র‌্যাবের মহাপরিচালক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'লিমন দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে।' ঘটনার ১৯ দিন পর এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মহাপরিচালক বলেন, 'আমরা তো আর লিমনকে ধরতে যাইনি। তার অপরাধও খুঁজতে যাইনি। লিমন তো একটি ছোট ছেলে। আমরা তো বলছি না, সে খারাপ বা সন্ত্রাসী ছেলে।' আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গোলাগুলির সময় একজন গুলিবিদ্ধ হয়। এখানেও সেই গোলাগুলির গল্প। অর্থাৎ, 'গুলিবিনিময়' থেকে র‌্যাব বেরিয়ে আসতে পারছে না।
লিমনের গল্প রেখে একটি ছেলের কুমিরের রচনার গল্প বলা যাক। একটি ছেলে কুমিরের রচনা শিখেছে। ক্লাসের পরীক্ষায় যে রচনাই আসুক না কেন, সে ওই কুমিরের রচনা তার সঙ্গে যোগ করে দেবেই। নদীর রচনায় কুমির, গাছের রচনায় কুমির, মাঠ নিয়ে রচনা লিখতে গিয়ে কুমির। কোনো রচনাই কুমিরমুক্ত নয়; কুমিরযুক্ত। শিক্ষক দেখলেন, কোনোভাবেই তাকে কুমিরের রচনা থেকে বের করে আনা যাচ্ছে না। একদিন শিক্ষক ক্লাসে গরুর রচনা লিখতে দিলেন। ছাত্রটি লিখল, 'গরু একটি গৃহপালিত প্রাণী। গরু আমাদের দুধ দেয়। গরুর চারটি পা আছে, একটি লেজ আছে, দুইটি শিং আছে। রাখাল মাঠে গরু চরাতে নিয়ে যায়। মাঠের পাশেই আছে একটি নদী। রাখাল ভাই, গরু নিয়ে কখনো নদীর ধারে যাবে না। কারণ, নদীতে কুমির আছে। কুমির দেখতে খুব লম্বা। কুমিরের চারটি পা আছে। ইয়া বড় মুখ। আর কুমিরের একটি বড় লেজ আছে। সেই লেজভর্তি শুধু কাঁটা। নদীর ধারে গেলেই কুমির গরুটিকে খেয়ে ফেলবে।'
ছেলেটির এই কুমিরের রচনার মতো র‌্যাবও কোনোভাবেই 'গোলাগুলি' থেকে বের হতে পারছে না। যেমন, শেষ পর্যন্ত লিমনকে নিরপরাধ বললেও সে র‌্যাব কথিত 'গোলাগুলি'র মধ্যে পড়ে গিয়েছিল_এমনটাই বলছে র‌্যাব। 'ক্রসফায়ার', 'বন্দুকযুদ্ধ', 'এনকাউন্টার' ইত্যাদি জাতীয় 'স্ক্রিপ্ট' যতদিন থাকবে, ততদিন র‌্যাব এই 'গোলাগুলি' থেকে বের হতে পারবে না। এই 'স্ক্রিপ্ট' যতদিন থাকবে, হয়তো ততদিনই কিশোর লিমনরা শুধু পা হারিয়ে দিনমজুরি করে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.