হাসির গল্প by বনফুল
খুব ছোট ছোট করিয়া মাথায় চুল ছাঁটা, স্থানে স্থানে মাংস বাহির করা। উহার উপর মাথা ও কপাল বেষ্টন করিয়া কয়েক ফেরতা টোয়াইনজাতীয় সুতা বেশ জোরে বাঁধা থাকাতে রগের শিরাগুলি স্ফীত এবং চক্ষু দুইটি লাল। এইখানেই বিসদৃশতার শেষ হয় নাই।
রোমশ নাসারন্ধ্রে কফ ও নস্য মিলিয়া দৃষ্টিকটুতার সৃষ্টি করিয়াছে, এবং তাহা কয়েক দিনের না-কামানো দাড়িগোঁফের সহযোগে যে চিত্রটি সৃজন করিয়াছে, তাহা মাধুর্যময় নহে।
বারান্দায় একটি শিশু তারস্বরে চিৎকার করিতেছে। ঘরের ভিতর আর একটি মেয়ে রোগশয্যায় শায়িত।
কৃত্তিবাস, ওরে কিতে—
রক্তচক্ষু তুলিয়া ভদ্রলোক ঘরের দিকে চাহিলেন।
কিতে—
কৃত্তিবাসের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
উচ্চতর কণ্ঠে পুনরায় ডাকিলেন, কিতে—
কেহ আসিল না।
সগর্জনে, ওরে শালা কিতে—
গর্জনে রোগশয্যায় শায়িত মেয়েটির নিদ্রাভঙ্গ হইল এবং সেও কাঁদিতে লাগিল। ক্ষীণ স্বরে একটানা ধরনের কান্না। বারান্দার শিশুটি আগে হইতেই কাঁদিতেছিল। এ ক্ষীণ কণ্ঠে নয়, জোরেই। দুই প্রকার ক্রন্দনের প্রভাবে ভদ্রলোক আরও চটিয়া গেলেন। কণ্ঠস্বর অসম্ভব রকম চড়াইয়া ক্ষেপিয়া তিনি চিৎকার করিতে লাগিলেন, কিতে, কিতে, কিতে—ওরে শালা!
ফলোদয় হইল।
কিতে আসিল না বটে, আসিলেন হরিদ্রালাঞ্ছিতবসনা স্থূলাঙ্গিনী একটি মহিলা। তাহাতেই ফল ফলিল। ভদ্রলোক অকস্মাৎ অত্যন্ত নরম হইয়া গেলেন এবং অপ্রতিভভাবে মিটিমিটি চাহিতে লাগিলেন। মহিলাটি কিন্তু কিছুমাত্র নরম এবং কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হইয়া রোষকষায়িত লোচনে কিছুক্ষণ নীরবে চাহিলেন। তাহার পর একটি হাত কোমরে দিয়া অপর হস্তটি আস্ফাালন করতঃ সক্রোধে প্রশ্ন করিলেন, ব্যাপারখানা কি, পাড়া যে মাথায় তুলেছ!
আমতা-আমতা করিয়া ভদ্রলোক বলিলেন, গরম জলটা—
গরম জলটা! আমার কি দশখানা হাত!
তোমাকে তো বলিনি। কিতে কোথা গেল?
কিতে গেছে বাজারে।
সকালে তাকে একবার বাজারে পাঠিয়েছিলে না?
আবার পাঠিয়েছি।
ও।
ইহার বেশি আর কিছু বলিতে ভদ্রলোক ভরসা করিলেন না। এমন সময় স্বয়ং কৃত্তিবাস আসিয়া দ্বারপ্রান্তে দেখা দিল এবং বলিল, পাঁচ-ফোড়ন এনেছি মা।
ভদ্রলোক আরক্ত নয়ন দুইটি কৃত্তিবাসের কুণ্ঠিত-নয়নে স্থাপিত করিতেই কৃত্তিবাস বলিল, জল এখুনি করে আনছি বাবু, হয়ে গেছে বোধ হয়, চড়িয়ে দিয়ে এসেছি।
কৃত্তিবাস চলিয়া গেল। মহিলাটি বাহির হইয়া গেলেন ও যাইবার সময় বারান্দায় ক্রন্দন-নিরত শিশুটির পৃষ্ঠে দুমদুম করিয়া কয়েকটা কিল বসাইয়া দিয়া বলিলেন, খালি বায়না, খালি বায়না, খালি বায়না! পোড়ারমুখী মেয়ে হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলে আমার!
ক্রন্দন ঘোরতর হইয়া উঠিল। রুগ্ন মেয়েটি ক্ষীণকণ্ঠে কাঁদিয়া বলিল, বড্ড মাথা ব্যথা করছে বাবা।
স্ত্রীর যে রণচণ্ডী মূর্তি এইমাত্র তিনি প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহাকে এখন কিছু বলা সম্ভবপর হইবে বলিয়া তাঁহার মনে হইল না। নিজেই উঠিয়া গিয়া টেম্পারেচারটা লইলেন। দেখিলেন জ্বর বাড়িয়া ১০৫০ হইয়াছে। খানিকক্ষণ থার্মোমিটারটার পানে নিবদ্ধদৃষ্টি থাকিয়া হরিহরবাবু দীর্ঘনিশ্বাস না ফেলিয়া ধমকাইয়া উঠিলেন।
পাশ ফিরে শো, চেঁচাসনি।
পাঁচ-ছয় বছরের মেয়েটি পাশ ফিরিয়া শুইল।
দুয়ারে কড়কড় শব্দে কড়া নড়িয়া উঠিল। হরিহরবাবু কপাট খুলিয়া যাহা আশঙ্কা করিতেছিলেন, তাহাই দেখিলেন— মুদি বিল আনিয়াছে।
বলিলেন, পরশু দেব, আজ হাতে কিছু নেই।
কটূক্তি করিয়া লোকটা চলিয়া গেল।
জল এনেছি বাবু।
পিছন ফিরিয়া হরিহরবাবু দেখিলেন, কেৎলিহস্তে কুণ্ঠিত কৃত্তিবাস দাঁড়াইয়া আছে। গামলা-টামলা আন।
কেৎলি নামাইয়া কৃত্তিবাস চলিয়া গেল এবং বড়-গোছের গামলা ও খানিকটা ঠাণ্ডা জল লইয়া আসিল। হরিহরবাবু নিজেই ঠাণ্ডা জল মিশাইয়া হাত দিয়া দেখিলেন, উত্তাপ মনোমত হইয়াছে কি না। দেখিলেন, হয় নাই। পুনরায় খানিকটা গরম জল ঢালিতে যাইতেছিলেন এমন সময় অসুস্থ মেয়েটি বমি করিতে শুরু করিল।
ওরে কিতে— দেখ তুই ওকে—
কৃত্তিবাস মেয়েটিকে সামলাইতে লাগিল। হরিহরবাবু ঠাণ্ডা জল গরম জল ঠিকমত মিশাইয়া লইলেন। তাহার পর বলিলেন, ওকে শুইয়ে দে। একবার তুই আমার ছোট টেবিলটা আর কাগজ কলম দিয়ে যা তো।
হরিহরবাবু একটি হাতল-ভাঙা চেয়ারে বসিয়া গরম জলে পা দুইটি ডুবাইয়া ফুটবাথ লইতে লাগিলেন। কৃত্তিবাস কাগজ কলম দোয়াত ও টেবিল দিয়া গেল।
চেয়ারের ছারপোকাগুলি কামড়াইতে শুরু করিয়াছে, পাশের গলিটাতে দুইটি কুকুর ঝগড়া করিতেছে, বারান্দায় ক্রন্দনরোল সমানে চলিয়াছে, অসম্ভব মাথা ধরিয়াছে। হরিহরবাবু বাম হস্তে রগ দুইটি টিপিয়া ধরিয়া নিমীলিত নয়নে চিন্তা করিতে লাগিলেন। আজই লিখিয়া দিতে হইবে। সম্পাদক মহাশয় তাগাদা দিয়াছেন, নিজের তাগাদাও প্রবলতর। ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া হরিহরবাবু একটি হাসির গল্পের প্লট ভাবিতে লাগিলেন। হাসির গল্প লেখাতেই তাঁহার নাম।
বনফুল: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি, যাঁর আসল নাম বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যের মণিহারীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কৈশোরে যখন লেখালেখি শুরু করেন তখন শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের নাম লুকাতে তিনি বনফুল ছদ্মনাম ধারণ করেন। ব্যক্তিজীবনে বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় একজন চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৯৯ সালে ও মৃত্যু ১৯৭৯ সালে।
বারান্দায় একটি শিশু তারস্বরে চিৎকার করিতেছে। ঘরের ভিতর আর একটি মেয়ে রোগশয্যায় শায়িত।
কৃত্তিবাস, ওরে কিতে—
রক্তচক্ষু তুলিয়া ভদ্রলোক ঘরের দিকে চাহিলেন।
কিতে—
কৃত্তিবাসের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
উচ্চতর কণ্ঠে পুনরায় ডাকিলেন, কিতে—
কেহ আসিল না।
সগর্জনে, ওরে শালা কিতে—
গর্জনে রোগশয্যায় শায়িত মেয়েটির নিদ্রাভঙ্গ হইল এবং সেও কাঁদিতে লাগিল। ক্ষীণ স্বরে একটানা ধরনের কান্না। বারান্দার শিশুটি আগে হইতেই কাঁদিতেছিল। এ ক্ষীণ কণ্ঠে নয়, জোরেই। দুই প্রকার ক্রন্দনের প্রভাবে ভদ্রলোক আরও চটিয়া গেলেন। কণ্ঠস্বর অসম্ভব রকম চড়াইয়া ক্ষেপিয়া তিনি চিৎকার করিতে লাগিলেন, কিতে, কিতে, কিতে—ওরে শালা!
ফলোদয় হইল।
কিতে আসিল না বটে, আসিলেন হরিদ্রালাঞ্ছিতবসনা স্থূলাঙ্গিনী একটি মহিলা। তাহাতেই ফল ফলিল। ভদ্রলোক অকস্মাৎ অত্যন্ত নরম হইয়া গেলেন এবং অপ্রতিভভাবে মিটিমিটি চাহিতে লাগিলেন। মহিলাটি কিন্তু কিছুমাত্র নরম এবং কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হইয়া রোষকষায়িত লোচনে কিছুক্ষণ নীরবে চাহিলেন। তাহার পর একটি হাত কোমরে দিয়া অপর হস্তটি আস্ফাালন করতঃ সক্রোধে প্রশ্ন করিলেন, ব্যাপারখানা কি, পাড়া যে মাথায় তুলেছ!
আমতা-আমতা করিয়া ভদ্রলোক বলিলেন, গরম জলটা—
গরম জলটা! আমার কি দশখানা হাত!
তোমাকে তো বলিনি। কিতে কোথা গেল?
কিতে গেছে বাজারে।
সকালে তাকে একবার বাজারে পাঠিয়েছিলে না?
আবার পাঠিয়েছি।
ও।
ইহার বেশি আর কিছু বলিতে ভদ্রলোক ভরসা করিলেন না। এমন সময় স্বয়ং কৃত্তিবাস আসিয়া দ্বারপ্রান্তে দেখা দিল এবং বলিল, পাঁচ-ফোড়ন এনেছি মা।
ভদ্রলোক আরক্ত নয়ন দুইটি কৃত্তিবাসের কুণ্ঠিত-নয়নে স্থাপিত করিতেই কৃত্তিবাস বলিল, জল এখুনি করে আনছি বাবু, হয়ে গেছে বোধ হয়, চড়িয়ে দিয়ে এসেছি।
কৃত্তিবাস চলিয়া গেল। মহিলাটি বাহির হইয়া গেলেন ও যাইবার সময় বারান্দায় ক্রন্দন-নিরত শিশুটির পৃষ্ঠে দুমদুম করিয়া কয়েকটা কিল বসাইয়া দিয়া বলিলেন, খালি বায়না, খালি বায়না, খালি বায়না! পোড়ারমুখী মেয়ে হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলে আমার!
ক্রন্দন ঘোরতর হইয়া উঠিল। রুগ্ন মেয়েটি ক্ষীণকণ্ঠে কাঁদিয়া বলিল, বড্ড মাথা ব্যথা করছে বাবা।
স্ত্রীর যে রণচণ্ডী মূর্তি এইমাত্র তিনি প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহাকে এখন কিছু বলা সম্ভবপর হইবে বলিয়া তাঁহার মনে হইল না। নিজেই উঠিয়া গিয়া টেম্পারেচারটা লইলেন। দেখিলেন জ্বর বাড়িয়া ১০৫০ হইয়াছে। খানিকক্ষণ থার্মোমিটারটার পানে নিবদ্ধদৃষ্টি থাকিয়া হরিহরবাবু দীর্ঘনিশ্বাস না ফেলিয়া ধমকাইয়া উঠিলেন।
পাশ ফিরে শো, চেঁচাসনি।
পাঁচ-ছয় বছরের মেয়েটি পাশ ফিরিয়া শুইল।
দুয়ারে কড়কড় শব্দে কড়া নড়িয়া উঠিল। হরিহরবাবু কপাট খুলিয়া যাহা আশঙ্কা করিতেছিলেন, তাহাই দেখিলেন— মুদি বিল আনিয়াছে।
বলিলেন, পরশু দেব, আজ হাতে কিছু নেই।
কটূক্তি করিয়া লোকটা চলিয়া গেল।
জল এনেছি বাবু।
পিছন ফিরিয়া হরিহরবাবু দেখিলেন, কেৎলিহস্তে কুণ্ঠিত কৃত্তিবাস দাঁড়াইয়া আছে। গামলা-টামলা আন।
কেৎলি নামাইয়া কৃত্তিবাস চলিয়া গেল এবং বড়-গোছের গামলা ও খানিকটা ঠাণ্ডা জল লইয়া আসিল। হরিহরবাবু নিজেই ঠাণ্ডা জল মিশাইয়া হাত দিয়া দেখিলেন, উত্তাপ মনোমত হইয়াছে কি না। দেখিলেন, হয় নাই। পুনরায় খানিকটা গরম জল ঢালিতে যাইতেছিলেন এমন সময় অসুস্থ মেয়েটি বমি করিতে শুরু করিল।
ওরে কিতে— দেখ তুই ওকে—
কৃত্তিবাস মেয়েটিকে সামলাইতে লাগিল। হরিহরবাবু ঠাণ্ডা জল গরম জল ঠিকমত মিশাইয়া লইলেন। তাহার পর বলিলেন, ওকে শুইয়ে দে। একবার তুই আমার ছোট টেবিলটা আর কাগজ কলম দিয়ে যা তো।
হরিহরবাবু একটি হাতল-ভাঙা চেয়ারে বসিয়া গরম জলে পা দুইটি ডুবাইয়া ফুটবাথ লইতে লাগিলেন। কৃত্তিবাস কাগজ কলম দোয়াত ও টেবিল দিয়া গেল।
চেয়ারের ছারপোকাগুলি কামড়াইতে শুরু করিয়াছে, পাশের গলিটাতে দুইটি কুকুর ঝগড়া করিতেছে, বারান্দায় ক্রন্দনরোল সমানে চলিয়াছে, অসম্ভব মাথা ধরিয়াছে। হরিহরবাবু বাম হস্তে রগ দুইটি টিপিয়া ধরিয়া নিমীলিত নয়নে চিন্তা করিতে লাগিলেন। আজই লিখিয়া দিতে হইবে। সম্পাদক মহাশয় তাগাদা দিয়াছেন, নিজের তাগাদাও প্রবলতর। ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া হরিহরবাবু একটি হাসির গল্পের প্লট ভাবিতে লাগিলেন। হাসির গল্প লেখাতেই তাঁহার নাম।
বনফুল: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি, যাঁর আসল নাম বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যের মণিহারীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কৈশোরে যখন লেখালেখি শুরু করেন তখন শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের নাম লুকাতে তিনি বনফুল ছদ্মনাম ধারণ করেন। ব্যক্তিজীবনে বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় একজন চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৯৯ সালে ও মৃত্যু ১৯৭৯ সালে।
No comments