উন্নয়ন-এশীয় অর্থনৈতিক ব্যাঘ্র ও বাংলাদেশ by শেখ আবদুস সালাম
আমাদের দরকার প্রয়োজন এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন সেক্টরের নেতৃত্ব বিশেষ করে নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমাদের সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারবেন কি? যাতে আমরাও এগিয়ে যেতে পারি চীন এবং ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমানভাবে, হয়তোবা কখনও ওদের চেয়েও দ্রুত
আজ থেকে প্রায় ৫-৬ বছর আগে দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের http://www.weeklyholiday.net/com.html ' একটি বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। এ বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের সুযোগ, ভবিষ্যৎ রূপরেখা এবং আমাদের করণীয় এমন কিছু দিকনির্দেশনা তুলে ধরেছিলেন। সম্প্রতি আর এক বাঙালি নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের \'অ উরংঢ়ধংরড়হধঃব অহধষুংরং- ছঁধষরঃু ড়ভ খরভব : ওহফরধ ঠং ঈযরহধ\' শিরোনামে একটি লেখা পাঠ করার সুযোগ হয়েছে (যঃঃঢ়://িি.িবিবশষুযড়ষরফধু.হবঃ/পড়স.যঃসষ)। এ লেখাটিতে অমর্ত্য সেন এশীয় অঞ্চলের দুই বৃহৎ দেশ চীন এবং ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জীবনমান নিয়ে একটি তুলনা দাঁড় করিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণ রেখেছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি এ দুটি দেশের উন্নয়ন চালচিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রসঙ্গটিও তুলে ধরেছেন। ড. ইউনূস এবং অমর্ত্য সেনের ভাবনাগুলোকে এক করে পাঠকের কাছে তুলে ধরার প্রয়াসেই আমার এই লেখা।
তাদের তথ্য মতে, চীনের জিএনপি প্রবৃদ্ধি হার শতকরা ১০ ভাগের বেশি। ভারতের সেটা ৯ ভাগ ছুঁই ছুঁই করছে। দেশ দুটির দারিদ্র্য লেভেল ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। চীন এবং ভারত উভয় দেশেরই লোকসংখ্যা ১০০ কোটির ওপরে। অর্থনৈতিকভাবে বর্ধিষ্ণু এই দেশ দুটিতে মানুষের গড় আয়ু হচ্ছে_ চীনে ৭৩ দশমিক ৫ বছর এবং ভারতে ৬৪ দশমিক ৪ বছর। ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে যথাক্রমে ১৯ এবং ৬৬ জন। মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১ লাখে ৩৮ এবং ২৩০ জন। চীনে বয়স্ক শিক্ষার হার ৯৪ শতাংশ, আর ভারতে ৭৪ শতাংশ । উল্লেখ্য, চীনে নারী শিক্ষার হার ৯৯ শতাংশ এবং ভারতে ৮০ শতাংশের নিচে। একইভাবে চীনে ইম্যুনাইজড শিশুর হার শতকরা ৯৭ ভাগ এবং ভারতে ৬৬ ভাগ। আগেই উল্লেখ করেছি, অধ্যাপক সেন তার লেখায় বাংলাদেশের কিছু চিত্রও তুলে ধরেছেন। তার তথ্যানুযায়ী ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় ১১৭০ এবং বাংলাদেশিদের ৫৯০ মার্কিন ডলার। জাতিসংঘের মানব সম্পদ উন্নয়ন ইনডেক্সে (ঐউও) অধিকাংশ দিক থেকে বাংলাদেশ অপেক্ষা ভারতের অবস্থান উন্নত। এরপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়েছে বৈকি! বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ দশমিক ৯ বছর এবং ভারতের ৬৪ দশমিক ৪ বছর। কম ওজন নিয়ে বাংলাদেশে যেখানে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু জন্মগ্রহণ করে, সেখানে ভারতে এই হার ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে ফার্টিলিটি হার ২ দশমিক ৩, যা ভারতে ২ দশমিক ৭। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের ছেলেদের শিক্ষার হারের বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে ভারত এগিয়ে থাকলেও এই বয়স পরিসরে নারী শিক্ষার হার বাংলাদেশে বেশি।
অধ্যাপক সেন তার লেখায় স্বাস্থ্য খাতের কিছু তুলনা নির্দেশক উল্লেখ করেছেন। যেমন_ ভারতে চার বছর বয়সের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৬৬ জন এবং বাংলাদেশে তা ৫২ জন। ইনফ্যান্ট মর্টালিটির ক্ষেত্রে উভয় দেশের চিত্র কাছাকাছি_ ভারতে প্রতি হাজারে ৫০ জন এবং বাংলাদেশে ৪১ জন। তবে বাংলাদেশে ডিপিটি ভ্যাকসিনসহ ইম্যুনাইজড শিশু কভারেজ ৯৪ শতাংশ এবং ভারতে ৬৬ শতাংশ। এ সবের বাইরে চীন এবং ভারতের গণমাধ্যমের বিকাশ কার্যকারিতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ, গণতন্ত্রের চর্চা ও মূল্যবোধ_ এসব বিষয় নিয়ে প্রবন্ধটিতে আলোচনা করা হয়েছে। এতে অধ্যাপক সেন দেখিয়েছেন যে, কেবল জাতীয় আয় বা মাথাপিছু আয় সবসময় উন্নয়নের নির্দেশক হয় না, যদি না তা মানুষের জীবনমান বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে ভূমিকা রাখে।
ওপরের কয়েকটি পরিসংখ্যান থেকে আমরা দেখতে পাই, আর্থিক সূচক কিংবা জীবনমানের পার্থক্যের বিচারে চীন যেমন কোনো কোনো পয়েন্টে ভারত থেকে এগিয়ে রয়েছে, আবার কিছু কিছু পয়েন্টে ভারতও চীন থেকে এগিয়ে আছে। এসব এগিয়ে-পিছিয়ে থাকার মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে উভয় দেশ যে কমন ইমেজ বা পারসেপশন (বাস্তবতাও তাই) সৃষ্টি করে ফেলেছে, সেটা হচ্ছে এ দেশ দুটি হয়ে উঠেছে \'এশীয় অর্থনৈতিক ব্যাঘ্র\'। যারা আগামী বছরগুলোয় অনেক সমৃদ্ধ দেশকে পিছে ফেলে সামনের স্থান দখল করে নেবে। উলি্লখিত কয়েকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ভারত এবং বাংলাদেশের তুলনামূলক কয়েকটি ইন্ডিকেটরে ভারত অপেক্ষা বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় ছোট ভূখণ্ডের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখনও বহু দিক দিয়ে ভারত থেকে পিছিয়ে থাকলেও ওই এগিয়ে থাকা সূচকগুলো বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনার দেশ হিসেবে আমাদের ভাবনাকে এগিয়ে নেয়।
আসলেই কি বাংলাদেশ উন্নয়ন সম্ভাবনার দেশ? তাহলে এ সম্ভাবনার সুযোগটি কোথায়? এ রকম কিছু প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে আমরা যদি ড. ইউনূসের \'দ্য ডেইলি স্টার ফিফটিনথ অ্যানিভার্সারি স্পিচ\'টা পড়ি এবং অনুধাবন করি। ড. ইউনূস তার এই বক্তৃতায় বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কয়েকটি সুযোগ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে ১. চীন ও ভারতের মতো দুটি বৃহৎ ও পরাক্রমশালী (এরধহঃং) প্রতিবেশী থাকা এবং তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বেড়ে ওঠার সুযোগ।
২. বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের ক্রসরোডস হিসেবে তৈরি করার সুবিধা।
৩. চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি মেগা পোর্ট হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ এবং এটিকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য একটি অত্যাধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণের বাস্তব সুবিধা।
৪. পাকিস্তান থেকে ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতীয় ৭ রাজ্য_ বার্মা, থাইল্যান্ড, চীন এ ধরনের এক বা একাধিক হাইওয়ে নেটওয়ার্ক সৃষ্টির বাস্তবতা এবং এসব দেশের মধ্যে কমন পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকা।
৫. ১৮ বছরের নিচে বাংলাদেশের বিশাল (প্রায় অর্ধেক) জনগোষ্ঠী এবং সব স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছে একটি করে ল্যাপটপ তুলে দেওয়ার সুযোগকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা।
৬. পর্যাপ্ত মানবসম্পদ এবং বিশাল বিদেশি রেমিট্যান্স অর্জনের সুবিধা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে বিরাজমান এসব সুযোগ ও সম্ভাবনাকে এক করে আলোচনায় নিয়ে এলে ব্যাপারটি এ রকম দাঁড়ায় যে, চীন এবং ভারত উভয় দেশই আজ বিশ্ব রাজনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতির \'পাওয়ার হাউস\' হিসেবে বিশ্বের কাছে উঠে আসছে। বিশাল সম্ভাবনার এ দেশ দুটি আজ তাদের মার্কেট, তাদের প্রতিযোগী এবং চলার ক্ষেত্রে তাদের অংশীদার খুঁজবে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমৃদ্ধির কারণে বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে যাওয়া পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরেই এক সময় এ দেশ দুটির সানি্নধ্যে আসবে। তারা চীন এবং ভারতের টেকনোলজি, অভিজ্ঞতা, পণ্য এসব নিতে চাইবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক সেবা, ট্যুরিজম প্রভৃতি সেক্টরে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে আগ্রহী হবে। এসব সম্ভাবনার সঙ্গে তাল রেখে বাংলাদেশ যদি তার আইন, প্রতিষ্ঠান, আমলাতন্ত্র, যাতায়াত ও পরিবহন সুবিধা, আর্থিক সিস্টেম, বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা, উন্নত সেবা খাতসহ আনুষঙ্গিক দিকগুলোকে যুগোপযোগী এবং প্রয়োজনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলে, তাহলে এ অঞ্চল তথা বিশ্বের অন্যান্য দেশ চীন এবং ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সুবিধা আদান-প্রদানের সময় বাংলাদেশকেও একটি অন্তর্বর্তী \'বিজনেস স্পট\' হিসেবে বেছে নেবে। কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারীর মূল অফিস যখন চীন বা ভারতের ভূখণ্ডে থাকবে, তারা তখন চিন্তা করবে তার একটি প্রোডাকশন ইউনিট অন্য কোথাও রাখা যায় কি-না। সে ক্ষেত্রে আইনকানুন, বিদ্যুৎ, যাতায়াত, উন্মুক্ত আইসিটি সুবিধা, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর প্রভৃতি সুবিধা থাকলে বাংলাদেশই হতে পারে ওইসব বিনিয়োগকারীর একটু দূরে (অথচ খুবই কাছে) তার অবস্থান করার, অথবা আর একটি উৎপাদন ইউনিট গড়ে তোলার আদর্শ জায়গা।
বাংলাদেশ বিভিন্ন মানবসম্পদ উন্নয়ন নির্দেশকের দিক থেকে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তালিকায় তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের ওপর অমর্ত্য সেন কর্তৃক উলি্লখিত কয়েকটি চলকের সূচকের দিকে তাকালে বিষয়টি আমরা আঁচ করতে পারি। এমডিজি লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা সাধুবাদ প্রাপ্য। আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নির্দেশকগুলো সম্মুখমুখী। এ দেশে ব্যক্তি, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। আমাদের গণমাধ্যম এবং বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের অ্যালার্ট অবস্থান প্রভৃতি মিলিয়ে আমাদের একটি ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমাদের দরকার শুধু প্রয়োজন এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন সেক্টরের নেতৃত্ব, বিশেষ করে নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমাদের সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারবেন কি? যাতে আমরাও এগিয়ে যেতে পারি চীন এবং ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমানভাবে, হয়তোবা কখনও ওদের চেয়েও দ্রুত।
ড. শেখ আবদুস সালাম :অধ্যাপক
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
salam@univdhaka.edu
তাদের তথ্য মতে, চীনের জিএনপি প্রবৃদ্ধি হার শতকরা ১০ ভাগের বেশি। ভারতের সেটা ৯ ভাগ ছুঁই ছুঁই করছে। দেশ দুটির দারিদ্র্য লেভেল ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। চীন এবং ভারত উভয় দেশেরই লোকসংখ্যা ১০০ কোটির ওপরে। অর্থনৈতিকভাবে বর্ধিষ্ণু এই দেশ দুটিতে মানুষের গড় আয়ু হচ্ছে_ চীনে ৭৩ দশমিক ৫ বছর এবং ভারতে ৬৪ দশমিক ৪ বছর। ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে যথাক্রমে ১৯ এবং ৬৬ জন। মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১ লাখে ৩৮ এবং ২৩০ জন। চীনে বয়স্ক শিক্ষার হার ৯৪ শতাংশ, আর ভারতে ৭৪ শতাংশ । উল্লেখ্য, চীনে নারী শিক্ষার হার ৯৯ শতাংশ এবং ভারতে ৮০ শতাংশের নিচে। একইভাবে চীনে ইম্যুনাইজড শিশুর হার শতকরা ৯৭ ভাগ এবং ভারতে ৬৬ ভাগ। আগেই উল্লেখ করেছি, অধ্যাপক সেন তার লেখায় বাংলাদেশের কিছু চিত্রও তুলে ধরেছেন। তার তথ্যানুযায়ী ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় ১১৭০ এবং বাংলাদেশিদের ৫৯০ মার্কিন ডলার। জাতিসংঘের মানব সম্পদ উন্নয়ন ইনডেক্সে (ঐউও) অধিকাংশ দিক থেকে বাংলাদেশ অপেক্ষা ভারতের অবস্থান উন্নত। এরপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়েছে বৈকি! বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ দশমিক ৯ বছর এবং ভারতের ৬৪ দশমিক ৪ বছর। কম ওজন নিয়ে বাংলাদেশে যেখানে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু জন্মগ্রহণ করে, সেখানে ভারতে এই হার ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে ফার্টিলিটি হার ২ দশমিক ৩, যা ভারতে ২ দশমিক ৭। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের ছেলেদের শিক্ষার হারের বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে ভারত এগিয়ে থাকলেও এই বয়স পরিসরে নারী শিক্ষার হার বাংলাদেশে বেশি।
অধ্যাপক সেন তার লেখায় স্বাস্থ্য খাতের কিছু তুলনা নির্দেশক উল্লেখ করেছেন। যেমন_ ভারতে চার বছর বয়সের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৬৬ জন এবং বাংলাদেশে তা ৫২ জন। ইনফ্যান্ট মর্টালিটির ক্ষেত্রে উভয় দেশের চিত্র কাছাকাছি_ ভারতে প্রতি হাজারে ৫০ জন এবং বাংলাদেশে ৪১ জন। তবে বাংলাদেশে ডিপিটি ভ্যাকসিনসহ ইম্যুনাইজড শিশু কভারেজ ৯৪ শতাংশ এবং ভারতে ৬৬ শতাংশ। এ সবের বাইরে চীন এবং ভারতের গণমাধ্যমের বিকাশ কার্যকারিতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ, গণতন্ত্রের চর্চা ও মূল্যবোধ_ এসব বিষয় নিয়ে প্রবন্ধটিতে আলোচনা করা হয়েছে। এতে অধ্যাপক সেন দেখিয়েছেন যে, কেবল জাতীয় আয় বা মাথাপিছু আয় সবসময় উন্নয়নের নির্দেশক হয় না, যদি না তা মানুষের জীবনমান বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে ভূমিকা রাখে।
ওপরের কয়েকটি পরিসংখ্যান থেকে আমরা দেখতে পাই, আর্থিক সূচক কিংবা জীবনমানের পার্থক্যের বিচারে চীন যেমন কোনো কোনো পয়েন্টে ভারত থেকে এগিয়ে রয়েছে, আবার কিছু কিছু পয়েন্টে ভারতও চীন থেকে এগিয়ে আছে। এসব এগিয়ে-পিছিয়ে থাকার মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে উভয় দেশ যে কমন ইমেজ বা পারসেপশন (বাস্তবতাও তাই) সৃষ্টি করে ফেলেছে, সেটা হচ্ছে এ দেশ দুটি হয়ে উঠেছে \'এশীয় অর্থনৈতিক ব্যাঘ্র\'। যারা আগামী বছরগুলোয় অনেক সমৃদ্ধ দেশকে পিছে ফেলে সামনের স্থান দখল করে নেবে। উলি্লখিত কয়েকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ভারত এবং বাংলাদেশের তুলনামূলক কয়েকটি ইন্ডিকেটরে ভারত অপেক্ষা বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় ছোট ভূখণ্ডের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখনও বহু দিক দিয়ে ভারত থেকে পিছিয়ে থাকলেও ওই এগিয়ে থাকা সূচকগুলো বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনার দেশ হিসেবে আমাদের ভাবনাকে এগিয়ে নেয়।
আসলেই কি বাংলাদেশ উন্নয়ন সম্ভাবনার দেশ? তাহলে এ সম্ভাবনার সুযোগটি কোথায়? এ রকম কিছু প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে আমরা যদি ড. ইউনূসের \'দ্য ডেইলি স্টার ফিফটিনথ অ্যানিভার্সারি স্পিচ\'টা পড়ি এবং অনুধাবন করি। ড. ইউনূস তার এই বক্তৃতায় বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কয়েকটি সুযোগ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে ১. চীন ও ভারতের মতো দুটি বৃহৎ ও পরাক্রমশালী (এরধহঃং) প্রতিবেশী থাকা এবং তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বেড়ে ওঠার সুযোগ।
২. বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের ক্রসরোডস হিসেবে তৈরি করার সুবিধা।
৩. চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি মেগা পোর্ট হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ এবং এটিকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য একটি অত্যাধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণের বাস্তব সুবিধা।
৪. পাকিস্তান থেকে ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতীয় ৭ রাজ্য_ বার্মা, থাইল্যান্ড, চীন এ ধরনের এক বা একাধিক হাইওয়ে নেটওয়ার্ক সৃষ্টির বাস্তবতা এবং এসব দেশের মধ্যে কমন পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকা।
৫. ১৮ বছরের নিচে বাংলাদেশের বিশাল (প্রায় অর্ধেক) জনগোষ্ঠী এবং সব স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছে একটি করে ল্যাপটপ তুলে দেওয়ার সুযোগকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা।
৬. পর্যাপ্ত মানবসম্পদ এবং বিশাল বিদেশি রেমিট্যান্স অর্জনের সুবিধা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে বিরাজমান এসব সুযোগ ও সম্ভাবনাকে এক করে আলোচনায় নিয়ে এলে ব্যাপারটি এ রকম দাঁড়ায় যে, চীন এবং ভারত উভয় দেশই আজ বিশ্ব রাজনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতির \'পাওয়ার হাউস\' হিসেবে বিশ্বের কাছে উঠে আসছে। বিশাল সম্ভাবনার এ দেশ দুটি আজ তাদের মার্কেট, তাদের প্রতিযোগী এবং চলার ক্ষেত্রে তাদের অংশীদার খুঁজবে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমৃদ্ধির কারণে বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে যাওয়া পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরেই এক সময় এ দেশ দুটির সানি্নধ্যে আসবে। তারা চীন এবং ভারতের টেকনোলজি, অভিজ্ঞতা, পণ্য এসব নিতে চাইবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক সেবা, ট্যুরিজম প্রভৃতি সেক্টরে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে আগ্রহী হবে। এসব সম্ভাবনার সঙ্গে তাল রেখে বাংলাদেশ যদি তার আইন, প্রতিষ্ঠান, আমলাতন্ত্র, যাতায়াত ও পরিবহন সুবিধা, আর্থিক সিস্টেম, বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা, উন্নত সেবা খাতসহ আনুষঙ্গিক দিকগুলোকে যুগোপযোগী এবং প্রয়োজনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলে, তাহলে এ অঞ্চল তথা বিশ্বের অন্যান্য দেশ চীন এবং ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সুবিধা আদান-প্রদানের সময় বাংলাদেশকেও একটি অন্তর্বর্তী \'বিজনেস স্পট\' হিসেবে বেছে নেবে। কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারীর মূল অফিস যখন চীন বা ভারতের ভূখণ্ডে থাকবে, তারা তখন চিন্তা করবে তার একটি প্রোডাকশন ইউনিট অন্য কোথাও রাখা যায় কি-না। সে ক্ষেত্রে আইনকানুন, বিদ্যুৎ, যাতায়াত, উন্মুক্ত আইসিটি সুবিধা, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর প্রভৃতি সুবিধা থাকলে বাংলাদেশই হতে পারে ওইসব বিনিয়োগকারীর একটু দূরে (অথচ খুবই কাছে) তার অবস্থান করার, অথবা আর একটি উৎপাদন ইউনিট গড়ে তোলার আদর্শ জায়গা।
বাংলাদেশ বিভিন্ন মানবসম্পদ উন্নয়ন নির্দেশকের দিক থেকে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তালিকায় তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের ওপর অমর্ত্য সেন কর্তৃক উলি্লখিত কয়েকটি চলকের সূচকের দিকে তাকালে বিষয়টি আমরা আঁচ করতে পারি। এমডিজি লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা সাধুবাদ প্রাপ্য। আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নির্দেশকগুলো সম্মুখমুখী। এ দেশে ব্যক্তি, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। আমাদের গণমাধ্যম এবং বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের অ্যালার্ট অবস্থান প্রভৃতি মিলিয়ে আমাদের একটি ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমাদের দরকার শুধু প্রয়োজন এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন সেক্টরের নেতৃত্ব, বিশেষ করে নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমাদের সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারবেন কি? যাতে আমরাও এগিয়ে যেতে পারি চীন এবং ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমানভাবে, হয়তোবা কখনও ওদের চেয়েও দ্রুত।
ড. শেখ আবদুস সালাম :অধ্যাপক
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
salam@univdhaka.edu
No comments