জনপ্রতিক্রিয়া-১২ ও ১৪ মার্চ—দুটোই তো দেখল জনগণ! by এ কে এম জাকারিয়া

বিরোধীদলীয় জোটের ১২ মার্চের সমাবেশ নিয়ে সরকার কী করেছে, সেই আলোচনা থাক। দিন তিনেক ধরে জনগণের ভোগান্তির কথা বাদ দিলে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। এরপর ১৪ মার্চ ছিল সরকারি দল ও জোটের মহাসমাবেশ।

১২ মার্চের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে এসেছে ১৪ মার্চের মহাসমাবেশ। মাঝে সময় ছিল এক দিন। ১৩ মার্চ রেলমন্ত্রী ও ‘পার্লামেন্টারিয়ান’ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদে বললেন, ‘১২ মার্চ দেখেছেন, ১৪ মার্চ দেখেননি।’ এ ধরনের মন্তব্যে ভয় পাওয়ারই কথা। রেলমন্ত্রীর এ বক্তব্য পড়ে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে এক পাঠক মন্তব্য করেছেন, ‘১০, ১১ ও ১২ যথেষ্ট দেখিয়েছেন। দয়া করে আর দেখাবেন না।’ এখন আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, দুটি দিনই তো দেখলাম, পার্থক্যটি আসলে কী?
যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের কথাবার্তা জনগণ কীভাবে নেন, সেটা বিবেচনায় নেওয়া তাঁদের জন্য খুবই জরুরি। দলের কড়া সমর্থক যাঁরা, তাঁরা তাঁদের নেতা-নেত্রীরা যা-ই বলেন, তার পক্ষে দাঁড়ান। চোখ বন্ধ করে ভোটও দিয়ে আসেন দলের পক্ষে। কিন্তু এর বাইরের অংশটিই বড়, যাঁদের ভোটেই নির্বাচনের পাল্লা এদিক-ওদিক ওঠানামা করে। তাঁরা নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যকে কীভাবে নেন, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের নেতা-নেত্রীরা তা মানেন বলে মনে হয় না। নেতা-নেত্রীরা কী বলেন, জনগণের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া কী হয়, সেটা আগে খুব সহজে আন্দাজ করা যেত না। গণমাধ্যম ও পাঠকের মধ্যে পারস্পরিক সক্রিয়তা এখন যে মাত্রায় বেড়েছে, তাতে কাজটি সহজ হয়েছে। একটি খবর পাঠ করে এখন পাঠক প্রতিক্রিয়া জানাতে যে মাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন, তা আগে কল্পনাও করা যেত না। পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণ সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সরকার বা বিরোধী দল তাদের সম্পর্কে জনমতের গতিবিধি বোঝার জন্য নানা ধরনের জরিপ ও সমীক্ষা করে থাকে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকেও প্রতিবছর সরকারের বর্ষপূর্তিতে এ ধরনের জরিপ করা হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে। গত ৬ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে করা এক জরিপে সরকার ও বিরোধী দল সম্পর্কে জনগণের অবস্থানের একটি চিত্র পাওয়া গেছে। এ ধরনের জরিপ বিবেচনায় নিলে নিজেদের সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যায়। আমাদের দেশের সরকার ও বিরোধী দল অবশ্য নিজেদের সংশোধনের প্রয়োজন আছে—এমন মনে করে বলে মনে হয় না। তবে জনমতের গতিবিধি বুঝতে সরকারও নাকি নানা ধরনের জরিপ করে থাকে, আর সে ক্ষেত্রে তাদের ভরসা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। গণমাধ্যম ও পাঠকের এই পারস্পরিক সক্রিয়তার যুগে রাজনৈতিক দলগুলো বা তাদের নেতারা নিজেদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পেতে পারেন গণমাধ্যমে পাঠকদের প্রতিক্রিয়াগুলো বিবেচনায় নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের নেতা-নেত্রীরা কি আদৌ তার ধার ধারেন?
১২ মার্চ বিরোধীদলীয় জোটের জনসভা নিয়ে প্রথম আলোর মূল শিরোনামটি ছিল ‘৯০ দিন সময় দিলেন খালেদা’। এর মধ্যেই তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে হবে। মহাসমাবেশে দেওয়া খালেদা জিয়ার ভাষণ নিয়ে ছিল আরেকটি প্রতিবেদন, ‘সরকার রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভ ভেঙে দিয়েছে’। প্রথমটিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ৭৪ জন, আর দ্বিতীয়টিতে ৯৫ জন পাঠক। এই প্রতিক্রিয়াগুলোতে বিরোধী দলের মহাসমাবেশ নিয়ে সরকারের অবস্থানের সমালোচনা রয়েছে অনেক, আছে বিরোধী দলের প্রতি সমর্থনসূচক অনেক বক্তব্য। তবে এ বক্তব্যগুলো খালেদা জিয়ার না জানলেও চলবে। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তাঁর যে মন্তব্যগুলো জানা উচিত, তার কয়েকটি তুলে ধরছি।
‘এমন কিছুর প্রতিশ্রুতি দেবেন না, যা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। হাসিনার মতো যেমন, ১০ টাকা কেজি চাল, ডিজিটাল বিপ্লব।’—পথিক।
‘আহা রে, দেশের জনগণের জন্য কী মায়া।’—মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান।
এক পাঠক লিখেছেন, ‘আপনারা তো পুরো দেশটাই তছনছ করে দিয়েছিলেন। হাওয়া ভবনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, সাংবিধানিক পদ না থাকলেও যুবরাজদ্বয়ের মাতব্বরি, গ্রেনেড হামলা, হামলাকারীদের বাঁচানোর জন্য জজ মিয়া নাটক, জঙ্গি, বোমা হামলা, সন্ত্রাসের অতি ব্যাপকতা (বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনী নামানো), গাজীপুরে জনপ্রিয় নেতা হত্যা, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যাসহ অগণিত বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী হত্যা, নির্যাতন, রেকর্ড পরিমাণ দুর্নীতি...বলে-লিখে শেষ করা যাবে না।’
‘আপনাদেরও আমরা চিনি আর ভালো করেই জানি, আপনি, আপনার ছেলে আর জামাতিরা কী কী করতে পারেন। কত প্রতিশ্রুতিও দিলেন, ক্ষমতায় গেলে ভুলে যান কেন? ক্ষমতায় থাকতে এসব কাজগুলো করলে তো কোনো অসুবিধাই হতো না। আর আপনাদেরও ক্ষমতা ছাড়তে হতো না।’—সুজন
‘২০০৬ সালে বিএনপি ও জামায়াত সরকার এর থেকেও অনেক নোংরামি করেছিল, আমি আওয়ামী লীগের অতিরিক্ত তৎপরতার বিরোধিতা করছি, তবে এর সঙ্গে বলছি, আপনারা ধোয়া তুলসী পাতা নন।’—মোল্লা বাবুল।
‘সবই বুঝলাম, সবই মানলাম। হাসিনার বিরুদ্ধে বলা কথাগুলোর ১০০ শতাংশ সত্যি। কিন্তু ম্যাডাম, আপনি ক্ষমতায় গেলে যা করবেন বলছেন, তা কি আর ক্ষমতা পেলে মনে রাখবেন? যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ! আমরা আগেও দেখেছি, এখনো দেখছি, এ আর নতুন কী?’—সাইফুল আনাম।
‘এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে জনসভায় বেশি লোক হয়েছে বলেই আপনাদের প্রতি ও আপনার বিশ্বস্বীকৃত...ছেলের প্রতি জনসমর্থন বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারের অযোগ্যতার জন্য মানুষের ক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে।’—রাসেল।
আরেকজন প্রশ্ন করেছেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না জিয়ার পাশে কেন তারেকের ছবি?’
‘আপনারা তো পুরো দেশটাই তছনছ করে দিয়েছিলেন।’ ‘ম্যাডাম, এখন থেকেই লিস্ট করুন রাষ্ট্রের কোন স্তম্ভ ভালো আছে, সেগুলোতে আপনিই ভাঙবেন!’—ইয়াকুব।
‘আয়নায় বিএনপির নিজের চেহারা দেখা উচিত। ভূতের মুখে রাম নাম।’—আব্দুল কুদ্দুস।
এবার ১৪ মার্চ ১৪ দলের মহাসমাবেশ প্রসঙ্গ। প্রথম আলোর শিরোনামটি ছিল, ‘পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া ভুলে যান: প্রধানমন্ত্রী’। বিরোধীদলীয় নেত্রীর উদ্দেশে তাঁর এই আহ্বান। এই প্রতিবেদনে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ৯৭ জন পাঠক। ক্ষমতায় থাকলে যে কথাগুলো শোনা হয় না, কিন্তু শোনা জরুরি, সে রকম কিছু মন্তব্যই তুলে ধরছি।
‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা পরস্পরকে সম্মান করতে জানি না। প্রতিবারই আমরা দেখি যে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বক্তব্য দেওয়ার সময় শোভনীয়তা রক্ষা করেন না। এবারও তার প্রমাণ পেলাম এই প্রতিবেদনে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অবশ্যই সত্য বলার অধিকার রয়েছে, কিন্তু এটা হওয়া উচিত শোভনীয়ভাবে। প্রধানমন্ত্রী যদি এই পদে থেকে এভাবে কথা বলেন, তবে তাঁর দলের লোকজন কীভাবে কথা বলবে, তা আমরা অনুমান করতে পারি। এটা অগ্রহণযোগ্য।’—মো. রফিকুল ইসলাম।
‘বদনাম ছেড়ে একটু উন্নতির কথা বলেন, প্লিজ।—বাদল।
এক পাঠক লিখেছেন ‘দুই নেতার কথা আর ভালো লাগে না।’
‘পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন ভুলে যান—এর জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করেন।...মানুষের ওপর আস্থা রাখেন।’
‘যতই চেষ্টা করুন পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন ভুলে যান—এ কথা তিনি কাকে বলেছেন, বোঝা গেল না। বেগম জিয়া তো একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছেন। বেগম জিয়ার জায়গায় তিনি থাকলে তিনিও তা চাইতেন।’—টি এলাহি।
‘নেতাদের বাচন সংযত না হলে দেশের অসংযত রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দেশের মানুষের মনে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশা জাগিয়ে রাখতে হলে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সুশাসন উপহার দিতে হলে সংযত বাচন রপ্ত করা খুবই জরুরি। দেশের কোনো নাগরিককেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলা উচিত নয়। কেউ যদি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে অর্থ নিয়ে থাকেন এবং সরকারের কাছে তার প্রমাণ থাকে, তাহলে সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। কারও বিরুদ্ধে যদি কোনো দুর্নীতি বা লুটপাটের অভিযোগ থাকে এবং সেই অভিযোগটি বিচারাধীন বা তদন্তাধীন থাকে, সে ক্ষেত্রে আইনকে তার স্বাভাবিক পথে চলতে দেওয়া উচিত। কিন্তু আইনগত বা নিয়মতান্ত্রিক পথে না গিয়ে রাজপথের জনসভায় যেসব ভাষা উচ্চারিত হয়, তা কারও কাম্য নয়। দুঃখের বিষয়, এ ধরনের ভাষা জাতির রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে সাহায্য করবে না। সবারই আত্মজিজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হওয়া উচিত।’—এস এম বিল্লাহ।
‘নিজেদের সমালোচনা করতে শিখুন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। একই কথা বারবার শুনতে শুনতে আমরা অসুস্থ বোধ করছি।’
‘আমার বিশ্বাস, ’৯০-এর পর আজ পর্যন্ত কেউ পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। ফয়সালা সব সময় জনগণই করেছে।’—এন হাসান রাজু।
অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই কয়েকজন পাঠকের প্রতিক্রিয়ায় কি একটি যথাযথ চিত্র পাওয়া যায়? পুরোপুরি যথাযথ না হলেও একট ধারণা নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। জনচিন্তার একটি প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিফলন নিশ্চয়ই এতে ঘটে। ৩০ কোটি লোকের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বশীল একটি জনমত জরিপ বা সমীক্ষার ক্ষেত্রে কয়েক হাজার লোকের মতামতকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়। সেই বিবেচনায় এই পাঠকদের মন্তব্যগুলো উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। পাঠকেরা তাঁদের মতামত দিয়ে রাজনৈতিক দল ও তাঁদের নেতৃত্বকে সহায়তার কাজটিই করে যাচ্ছেন। ১২ মার্চের পর ১৪ মার্চ—দুটো রাজনৈতিক কর্মসূচিই জনগণ দেখল। এর জনপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারেও একটি ধারণা পাওয়া গেল। কিন্তু পাঠকদের এই সহায়তা রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করবে, সেই ভরসা করা কঠিন।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.