ইতিহাস-বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় by আনোয়ার হোসেন

বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় দেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে আসতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু দুঃসহ কলঙ্কের একটি বোঝা ঠিকই অপসারিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ চলেছে। কিন্তু কেন ১৫ আগস্ট সংঘটিত করা হলো, এর পেছনে কারা ছিল তার কার্যকর তদন্ত এখনও হয়নি।


খন্দকার মোশতাকের ভূমিকাও অনেকটাই অনালোচিত। জেল হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি। দেশকে এ কলঙ্কের দায় থেকে মুক্ত করতেই হবে


আজ ৫ নভেম্বর। ৩৬ বছর আগে এই দিনে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রসমাজের ডাকে ৬ ঘণ্টার হরতাল পালিত হয়েছিল। এর আগের দিন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছাত্র-জনতা জানায় শ্রদ্ধাঞ্জলি। তার আগের দিন ৩ নভেম্বর সেনা ও বিমানবাহিনীর প্রতিবাদী একটি অংশের অসম সাহসী পদক্ষেপের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিরা রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
একটু ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনালগ্ন থেকেই খন্দকার মোশতাক আহমদসহ একটি মহল প্রচার করতে শুরু করে যে, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চলতে থাকলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচানো যাবে না। তাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করে প্রতিশোধ নেবে। মোশতাক চক্রের এ 'বঙ্গবন্ধুপ্রীতি' ছিল নিছক ছলনা, বাংলাদেশ যেন স্বাধীনতার পথ থেকে সরে আসে_ এটাই তারা চেয়েছিল। মুজিবনগরেও তাদের এ চক্রান্ত চলে। কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এম কামরুজ্জামান প্রমুখ নেতার স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের কারণে তা সফল হয়নি। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, স্বাধীনতাও আসবে, বঙ্গবন্ধুও আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন বীরের বেশে। ২৫ মার্চ থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ-আনসার বাহিনীর সদস্যরা অসম সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তাঞ্চলে ছাত্র ও যুবকরাও মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করতে থাকে। এমন পরিস্থিতি খন্দকার মোশতাকের কাম্য ছিল না।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর নতুন করে ষড়যন্ত্রের শুরু। এর লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট_ বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দিতে হবে। একাত্তরের মতো তার অবর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যেভাবে প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তেমনটি ঘটতে দেওয়া যাবে না। খন্দকার মোশতাক তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কর্নেল রশীদকে সঙ্গে পান। রশীদের সঙ্গে যুক্ত হয় কর্নেল ফারুক। মেজর ডালিমের মতো নানা কারণে ক্ষুব্ধ কিছু বিপথগামী সেনা অফিসার মিলে এভাবে একটি অশুভ চক্র গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত চূড়ান্ত হলে ঘাতকরা সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জিয়াউর রহমানকেও তাতে যুক্ত করায় তৎপর হয় এবং সেখান থেকে 'গো অ্যাহেড' সংকেত মেলে। তবে অতিমাত্রায় কুশলী এ সেনা কর্মকর্তা নিজেকে সামনে নিয়ে আসতে রাজি হননি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল স্বাধীন দেশের জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব (যদিও কাগজে-কলমে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল ছিল ক্ষমতায়) তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ গড়ে তোলায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী একটি দলের জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছুই হতে পারে না। ঘাতকরা ঢাকার সীমিত অংশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। অথচ সে সময়েই দলের অনেক প্রবীণ নেতাকে খুনি চক্রের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে দেখে সারাদেশের কর্মী-সমর্থকদের মনে নেমে আসে গভীর হতাশা। অক্টোবরের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রতিবাদ আমরা দেখেছি। তারা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেছিল। কিন্তু তাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিবাদ হিসেবে গ্রহণ করা চলে না।
এমন অবস্থাতেই সশস্ত্র বাহিনীর কয়েকজন অফিসার খুনিদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা ছিলেন সেনা ও বিমানবাহিনীর তরুণ অফিসার। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অফিসারদের অভ্যুত্থান সংঘটনে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের কথা আমরা জানি। বিমানবাহিনীর সদস্যরা থাকত পেছনের সারিতে। ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আমরা দেখি এক ভিন্ন চিত্র। তারা মিগ-২১ জঙ্গি বিমান নিয়ে বঙ্গভবন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থানরত খুনি চক্রকে নির্মূল করায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা মনে করেন, ১৭৫৭ সালে পলাশীতে মীরজাফর যেমন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাও তেমনই ঘৃণ্য শক্তি। তাদের কোনোভাবেই ক্ষমতায় রাখা যায় না। তাদের কারণে দেশের উন্নতির চাকা থেমে গেছে। তরুণ বিমান সেনারা তাদের পরিকল্পনা নিয়ে বিমানবাহিনীর উপ-প্রধান বাশারের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সায় দেন। তবে জিয়াউর রহমানকে বিষয়টি জানাতে বলেন। একই সঙ্গে এটাও বলেন যে, খন্দকার মোশতাকের নিয়োগকৃত এ সেনাপ্রধান বলিষ্ঠ অবস্থান নেবেন না। মোশতাক চক্রকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা জিয়াউর রহমানকে জানানো হলে তিনি কেবল বলেছিলেন, 'এখন কি সময় হয়েছে?'
খুনিদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্তরা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে তাদের পরিকল্পনা প্রথমে অবহিত করেননি। তাদের চিন্তা ছিল, মধ্য নভেম্বরে আঘাত হানার। কিন্তু নভেম্বর মাসের প্রথম দিনেই সন্দেহ দেখা দেয়, খুনিরা তাদের পরিকল্পনা জেনে গেছে। এর পেছনে জিয়াউর রহমানের হাত রয়েছে, এমন ধারণা প্রবল ছিল। এ অবস্থায় মাত্র একদিনের প্রস্তুতিতে ৩ নভেম্বর সকালেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে মিগ-২১ বিমান আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়। শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীও যথোচিত কর্মপন্থা গ্রহণ করে। এ সময় বিমানবাহিনীর প্রধান এমএজি তাওয়াবকে আটক করার চেষ্টা চলে। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে পাকিস্তানপন্থি। তবে তাকে বাঁচিয়ে দেন আরেক পাকিস্তানপন্থি সেনা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। বিমানবাহিনীর দ্বিতীয় ব্যক্তি বাশার বিমান ঘাঁটিতে এসে মিগ-২১ বিমানের অভিযানের সফলতা দেখে সন্তুষ্ট হন। পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় বঙ্গভবন থেকে ভীতসন্ত্রস্ত খন্দকার মোশতাক এবং তার সহযোগী খুনি চক্র আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায়। তাদের নিয়ন্ত্রণে ট্যাঙ্ক ছিল, কিন্তু বিমান হামলা হলে তা রোধ করা যাবে না বলে ধারণা করেছিল। খুনিদের মনে শঙ্কা সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত বিমান সেনারা দাবি করেছেন, গোটা ঘটনা খালেদ মোশাররফ জেনেছেন বঙ্গভবনের ওপরে মিগ-২১ জঙ্গি বিমানের অনেকবার চক্কর দেওয়ার পরে। জিয়াউর রহমান এ সময় নিজেকে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার কথা বলেন এবং বাসাতেই 'বন্দি অবস্থায়' অবস্থান করেন। ধূর্ত এমএজি তাওয়াব এ সময় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করায় তরুণ অফিসারদের প্রশংসা করেন। খালেদ মোশাররফকেও তিনি অভিনন্দর জানান। এভাবে দুই মেরুর দু'জন পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠেন।
৪ নভেম্বর খুনিরা নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ দাবি করে প্রস্তাব পাঠায়। অভ্যুত্থানের উদ্যোক্তারা খুনিদের ক্ষমতা থেকে সরাতে চেয়েছিল। তাদের নিজেদের উচ্চাভিলাষ ছিল না। এ কারণে বেতার কেন্দ্র দখল করে কোনো ঘোষণাও তারা প্রচার করেনি। খুনিরা ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ায় তারা মনে করেন, মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে_ দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা গেছে। এদিন বটতলায় ছাত্রদের সমাবেশ হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সভায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে_ এসব তাদের কিছুই জানা ছিল না। এমনকি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সংঘটিত ভয়াবহ অপরাধের বিষয়েও তারা তেমন ভালোভাবে অবগত ছিলেন না। পরে জেনেছেন, খন্দকার মোশতাকের সরাসরি নির্দেশেই এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
৬ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে। সে সময় একদিকে একদল সিপাহি কর্নেল তাহেরের ছবি নিয়ে ট্রাকে ট্রাকে মিছিল করতে থাকে; আরেক দল মিছিল বের করে খন্দকার মোশতাকের ছবি নিয়ে। শেষ রাতের দিকে খন্দকার মোশতাক ঢাকা বেতার কেন্দ্রে যান ভাষণ দেওয়ার জন্য। তিনি ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন, এমন আচরণ করতে থাকেন। এ সময় কর্নেল তাহের বেতার কেন্দ্রে প্রবেশ করে তার হাত থেকে লিখিত ভাষণের কপি ছিনিয়ে নেন। মাইক্রোফোন যন্ত্রও সামনে থেকে সরিয়ে ফেলেন। পরে তাহের গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে জিয়াউর রহমানের বাসায় তার কথা হয়। কিন্তু নিজের বাসায় ফিরে দ্রুতই বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং উপস্থিত সৈনিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের বলেন, 'জিয়া বিট্রেড'। ৭ নভেম্বর সকালে রাস্তায় রাস্তায় মিছিলের ছবি বদলে গেল_ তাহেরের পরিবর্তে জিয়াউর রহমানের ছবি। আরেক দলের মিছিলে মোশতাকের ছবি। কর্নেল তাহের চলে গেলেন পলাতক জীবনে। পরে তাকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতাদেরসহ গ্রেফতার করা হয়। বিমানবাহিনীর যেসব তরুণ অফিসারকে ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানানো হয়েছিল তাদের ৭ নভেম্বরের পর ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হয়। এ ধরনের বিচারে কোনো ডকুমেন্ট থাকে না। তাদের কয়েকজনকে মৃৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং কয়েকজনের হয় কারাদণ্ড। পরে মৃত্যুদণ্ড রদ করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে আরেকটি পরিবর্তন সংঘটিত হয়_ জিয়াউর রহমানের একচেটিয়া রাজত্ব। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে, কিছু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে মেনে নেননি এবং খুনিদের তারা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেন। বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় দেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে আসতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু দুঃসহ কলঙ্কের একটি বোঝা ঠিকই অপসারিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ চলেছে। কিন্তু কেন ১৫ আগস্ট সংঘটিত করা হলো, এর পেছনে কারা ছিল তার কার্যকর তদন্ত এখনও হয়নি। খন্দকার মোশতাকের ভূমিকাও অনেকটাই অনালোচিত। জেল হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি। দেশকে এ কলঙ্কের দায় থেকে মুক্ত করতেই হবে।

আনোয়ার হোসেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.