সড়ক খাতে বরাদ্দ কেবলই কমছে-আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়হীনতায় ঝুলে গেছে সংস্কারপ্রক্রিয়া by পার্থ সারথি দাস

সংস্কারের অভাবে সারা দেশের প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক বেহাল। গত প্রায় আড়াই মাসে ঢিমেতালে কাজ চললেও এগুলো পুরোপুরি সচল হতে পারছে না। এদিকে সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয়হীনতার কারণে সড়ক সংস্কারে বরাদ্দ দিন দিনই কমছে। মন্ত্রীরা একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। এ অবস্থায় অর্থাভাবে সড়ক সংস্কারের পুরো প্রক্রিয়াটিই ঝুলে গেছে। সমস্যা উত্তরণে সড়ক তহবিল গঠনের প্রস্তাবটিও আটকে আছে আট বছর ধরে।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, অর্থ, যোগাযোগ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, সড়ক মেরামতে জরুরি অর্থ বরাদ্দ নিয়ে অর্থ ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সর্বোপরি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তদারকি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সড়ক সংস্কার প্রক্রিয়া ঝুলে পড়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় গত আগস্ট মাসে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের চাহিদা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠায়। একই সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয় এ চাহিদার কথা। কিন্তু গত দুই মাসে ছাড় হয়েছে মাত্র ৫৮০ কোটি টাকা।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের নথিপত্রে দেখা গেছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১১-১২ এই চার অর্থবছরে সড়ক মেরামতের জন্য চাহিদার তুলনায় বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। সড়ক মেরামতের জন্য চলতি অর্থবছরে পাঁচ হাজার ১০০ কোটি টাকা চাওয়া
হয়। এর মধ্যে ৬৯০ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এখনো ১১০ কোটি টাকা আটকে আছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে চার হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় পেয়েছে ৬৮৮ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে চাওয়া হয় চার হাজার চার কোটি টাকা। পাওয়া যায় ৬১০ কোটি টাকা। তারও আগে ২০০৮-৯ অর্থবছরে চার হাজার ২০৬ কোটি টাকা চেয়ে পাওয়া গেছে মাত্র ৫৬৬ কোটি টাকা।
জানা গেছে, শুধু সড়ক মেরামত খাত নয়; পুরো সড়ক খাতেই ক্রমাগত হারে বরাদ্দ কমছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এডিবির ৮ দশমিক ১ ভাগ বরাদ্দ ছিল সড়ক খাতে। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা নেমে আসে চার দশমিক ৫৮ ভাগে। চলতি অর্থবছরে তা আরো কমে গেছে।
একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, অর্থ, পরিকল্পনা ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় সড়ক খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ মিলছে না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কৌশলগত ত্রুটিও এজন্য দায়ী। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত উলি্লখিত তিনটি মন্ত্রণালয় সড়ক খাতে বরাদ্দ নিয়ে এক দিনও বিশেষভাবে বৈঠক করেনি।
নাজুক সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে চারদিকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠলে গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সংসদ ও সংসদের বাইরে 'অর্থ নেই' বলে অনুযোগ করেন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। তিনি বারবারই দাবি করছেন, অর্থ না পাওয়ায় সড়ক সংস্কারের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, সড়ক মেরামতের জন্য বাজেটে বরাদ্দ কম। সংশোধিত বাজেটে অর্থপ্রাপ্তির আশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, সড়ক ঠিক রাখতে গেলে অর্থ লাগবে।
যোগাযোগমন্ত্রীর অনুযোগের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাজে অস্বচ্ছতার অভিযোগ তোলেন। সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর সংসদে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে যথাযথ হিসাব না দেওয়ার অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, 'সড়ক সংস্কারের বরাদ্দ থাকে রাজস্ব খাতে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন ঠিক করবে তাদের খাতওয়ারি হিসাব। অথচ কোন খাতে কত বরাদ্দ থাকবে_এমন হিসাব যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কখনোই দেয়নি। তাদের খরচের কোনো হিসাবও জানি না।' তিনি আরো বলেন, 'বেহাল মহাসড়ক সংস্কারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে প্রথমবারের মতো যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত টাকা খরচের একটি হিসাব দিলেও তা ছিল অশুদ্ধ। এর পরও ৮০ শতাংশ অর্থ ছাড় দিয়েছি। বরাদ্দের বাকি ১১০ কোটি টাকাও মন্ত্রণালয় চাইলেই দেওয়া হবে।'
ঝুলে আছে সড়ক তহবিল গঠনের প্রস্তাব
আট বছর ধরে প্রতিশ্রুতি আর সভা আয়োজনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সড়ক তহবিল গঠনের প্রস্তাবনা। দেশের চলাচল অনুপযোগী সড়ক সংস্কারের অর্থসংস্থানের জন্য ২০০৩ সালে সড়ক তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই বিষয়টি ফাইলচাপা পড়ে যায়। গত ঈদুল ফিতরের সময়ে ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে আবার এ নিয়ে তোড়জোর শুরু হয়। এই তহবিল গঠনের জন্য সড়ক তহবিল বোর্ড আইন-২০১১ নীতিগত অনুমোদনের জন্য গত ২৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। কিন্তু আরো কিছু তথ্য চেয়ে এটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে গত ২ অক্টোবর।
যোগাযোগ সচিব মোজাম্মেল হক খান বলেন, সড়ক তহবিলসংক্রান্ত আইনের খসড়া বিষয়ে মন্ত্রিসভা বিভাগ থেকে আরো তথ্য চাওয়া হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী তথ্যগুলো দেওয়ার চেষ্টা করছি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের সংযুক্ত তহবিল থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ, সড়ক ব্যবহারকারী যানবাহন থেকে আদায়কৃত চার্জ, যানবাহনের বার্ষিক লাইসেন্স ফি, সড়ক ও সেতুর টোল, যানবাহনের জরিমানা, আন্তর্জাতিক ট্রানজিটসহ বিভিন্ন চার্জ, উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে পাওয়া ঋণ বা অনুদান এবং বোর্ড অর্জিত বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থে এই তহবিল গঠন করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.