অতিদরিদ্রদের কথা by মেছবাহ উদ্দিন আহমদ
দাফতরিক কাজে বাগেরহাট এসেছি, উঠেছি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন হোটেল আল-আমিনে। ১৯ অক্টোবর বুধবার সন্ধ্যায় কাজ সেরে হোটেলে ঢোকার রাস্তায় একজন মৃতপ্রায় মহিলাকে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠি। হাতে তখনও ভিক্ষার থলিটা ধরে আছে। তার শিয়রের কাছেই অসহায় ফ্যাকাশে মুখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৫-৬ বছরের একটি ছেলে। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মা? ছেলেটি 'হ্যাঁ' সূচক মাথা নাড়ল।
কী হয়েছে, এ কথার উত্তরে সে বলল, বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, সারাদিন তুমি এবং তোমার মা কিছু খেয়েছ? সে 'না' সূচক মাথা নাড়ল। বুঝতে অসুবিধা হলো না মহিলা কেন বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। এরই মধ্যে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল এবং সবাই তাকিয়ে দেখার মধ্যে দায়িত্ব শেষ করল। কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করলাম, কিন্তু কী করা যায় তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অবশেষে পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে এক গল্গাস পানি এনে ছেলেটিকে বললাম, তোমার মায়ের মুখে ছিটিয়ে দাও। ছেলেটি তাই করল এবং কিছুক্ষণ পর মহিলার জ্ঞান ফিরল। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। মহিলার ছেলেটি এবং আরেকজনের সহায়তায় পাশের রেস্টুরেন্টে নিয়ে বসিয়ে তাদের জন্য একবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করে আমি আমার নাগরিক দায়িত্ব শেষ করে হোটেলে ঢুকলাম। একটি কথা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, কত দিন এই মা-ছেলেকে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ থাকতে হবে? সে কি অনন্তকাল? রাষ্ট্র, সমাজ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতি কী দায়িত্ব পালন করছে?
সরকারি হিসাবেই বর্তমানে প্রায় তিন কোটি লোক অতিদরিদ্রদের নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা স্পষ্ট নয়। একের পর এক সরকার আসে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের ঊধর্ে্ব থেকে জনস্বার্থে কাজ করার শপথ নিয়ে। কিন্তু প্রত্যেক সরকারই শপথ ভঙ্গ করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে তৎপর হয়। আর তা স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র শ্রেণীর বিপরীতে ধনী এবং প্রভাবশালীদের পক্ষে। ধনীদের আরও ধনী হওয়ার সব অনুকূল পরিবেশ এই দেশে বিদ্যমান থাকলেও নেই শুধু অতিদরিদ্রদের টিকে থাকার নিশ্চয়তা। দিন দিন প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বাড়লেও কমছে না ধনী ও দরিদ্রদের ব্যবধান। অর্থাৎ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না এদেশের অতিদরিদ্র জনগণ। সরকার প্রতি বছর বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় হিসেবে যে বরাদ্দ অতিদরিদ্রদের জন্য রাখে, তারও একটা উলেল্গখযোগ্য অংশ আত্মসাৎ হয়ে যায়। অতিদরিদ্রদের জন্য সরকারি-বেসরকারি অর্থায়নে যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম রয়েছে, তা তাদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে কিছুটা সহায়ক হলেও টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যথেষ্ট নয়।
পিএইচডি গবেষক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
No comments