সদরে অন্দরে-কে আসছে সুড়ঙ্গপথে! by মোস্তফা হোসেইন

হস্য উপন্যাসের মতোই মনে হতে পারে। আসলে বাস্তবেই ঘটেছে। আমাদের বাংলাদেশে_মিরসরাই। রহস্য দানাবেঁধে উঠেছে সুড়ঙ্গপথ নিয়ে। কেন করা হয়েছে এত বড় সুড়ঙ্গ? এর পেছনে কোনো বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে কি? আর কারাই বা করল এমন কাজ? ভাবা যায়_জঙ্গিদের কথা। অথচ জঙ্গিরা মোটামুটি দমে গেছে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর। উলফা নামের ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীরও জায়গা নেই এ দেশে।


তাহলে নতুন কোনো গোষ্ঠীর কি উদ্ভব হয়েছে? নানা রকম প্রশ্ন দেখা দিতে পারে চট্টগ্রামের পাহাড়ের গায়ে আঘাত দেখে।
অবস্থান বিবেচনায় মনে হতে পারে, নাশকতার পরিকল্পনা থাকতে পারে। দুষ্কৃতকারীদের লক্ষ্য হতে পারে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে। যুক্তি হচ্ছে, রেললাইনের কাছাকাছি জায়গা থেকে শুরু হয়েছে এই সুড়ঙ্গ। জায়গাটা মিরসরাই এলাকা থেকে শুরু। এই বিষয়ে কথা হয়েছে সময় টেলিভিশনের ফেনী ব্যুরোর প্রধান বখতিয়ার মুন্নার সঙ্গে। তাঁর বক্তব্য_সত্যিই এক আশ্চর্য ঘটনা। সুড়ঙ্গ কেটে কেটে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে নেওয়া হয়েছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মধ্য তালবাড়িয়া অঞ্চলের বন বিভাগের গবানিয়া বিটসংলগ্ন পাহাড়ে সুড়ঙ্গ। পাহাড়ের ভেতরে কোনো নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই যে এই প্রচেষ্টা, তা বোঝা যায় স্পষ্ট। মন্দিরা টিলায় তেমনি তিনটি সুড়ঙ্গ। চার ফুট গিয়ে বাংকারের মতো গেছে একটি ডাইনে, আরেকটি বাঁয়ে। বদরগোঁ টিলায় আট ফুট গিয়ে বাঁক নিয়ে আবারও চলে গেছে ৪৩ ফুট। এর মাঝখানে বেশ গভীর গর্ত একটা। অনায়াসে দাঁড়িয়ে থাকা যায় সেই গর্তে। গর্তের মধ্যেই এমনভাবে সিঁড়ির মতো করে দেওয়া হয়েছে, যা দেখলে মনে হতে পারে সেখানে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে। এগুলো মাটিচোরদের কাজ নয়। যারা পাহাড় কেটে মাটি নিয়ে যায়, তাদের মাটি কাটার সময় এমন পরিকল্পনার প্রয়োজন হয় না। পরিকল্পিতভাবে ত্রিভুজের মতো হয় না সুড়ঙ্গগুলো। দেখে মনে হয়, যুদ্ধক্ষেত্রের বাংকার যেন। দেয়ালের গায়ে চিহ্নগুলো প্রমাণ করে, এই কাজ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো গোষ্ঠীর। এই কাজ প্রকাশ্যেও করা হয়নি। জায়গাটা এমন অবস্থানে, যেখানে সব সময় মানুষের আনাগোনা থাকে না। পাহাড়ের পাশে রেলপথের ধারে রয়েছে ধানের জমি। সেখানে মানুষ আসে শুধু ধান পাকার আগে। বন্য শূকর তাড়ানোর প্রয়োজনে। সেই সময়ও কৃষক অবস্থান নেয় জমির ওপর বানানো টংঘরে। আর সুড়ঙ্গ বানানো হয়েছে এমন সময়, যখন ধানের জমিগুলো ছিল খালি এবং সেখানে কৃষকদের থাকার কথা নয় সংগত কারণেই। যে জন্য যারাই এই কাজ করেছে, তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি গোপনীয়তা রক্ষায়।
কোন কারণে এই কাজটিতে নাশকতার আশঙ্কা থেকে যায়? এর জন্য আমরা তাকাতে পারি ওই এলাকার নিকট-অতীতের কিছু ঘটনার দিকে। মিরসরাই থেকে ফটিকছড়ি এবং আশপাশে রয়েছে কথিত কিছু মৌলবাদী উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর আস্তানা। না, আমাদের ভাবতে হবে সেখানকার আরো কিছু পরিস্থিতির কথা। মনে আছে, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে যুব কমান্ডের কিছু ক্যাডারকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারও পরে নিজামপুর পাহাড়ে অস্ত্র উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ২০০৭ সালে কয়লা টিলা পাহাড় থেকে গ্রেনেডসহ বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।
প্রশ্ন আসতে পারে, তারাই কি তাহলে আবারও সংগঠিত হয়ে বড় কোনো নাশকতার পরিকল্পনা করছে? দেশে কি তাহলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে? যারা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের কথা সামনে আনবেন_তাদেরও কথা বলার আছে। স্পষ্টত সেখানে আরো কিছু যোগ করার আছে। মনে করা যেতে পারে, সরকারের অধিকতর নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে ওখানে তেমন কিছু হয়নি। হতে পারে, জনগণের সাবধানতাও একটি কারণ হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে নিরাপত্তাব্যবস্থার সাফল্যকে অচিরেই ম্লান করে দিল নরসিংদীর ঘটনা। নির্বাচিত একজন পৌর মেয়রকে নৃশংসভাবে খুন করার পর সংগত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে_এই খুনিরাও কি তাহলে পরিকল্পনার সুড়ঙ্গ দিয়েই ঢুকেছে, আর বেরিয়েও গেছে সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে?
এই সুড়ঙ্গ দুয়েকটি পাহাড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কারণ সারা দেশেই এরা ছড়িয়ে যেতে শুরু করেছে, এমনই আশঙ্কা করা যায়। অন্তত নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর পরই যখন টাঙ্গাইলের যুবলীগ নেতা খুন হওয়ার ঘটনা ঘটল, তখনই ঘটনাক্রম আমাদের এমনটা ভাবতে বাধ্য করে। আমরা এই মুহূর্তে কি স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের সেইসব ঘটনার কথা স্মরণ করব? মনে আছে কি সেই সময় কিভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের ধরে ধরে মারা শুরু হয়েছিল? কমপক্ষে চারজন সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য খুন হয়েছিলেন ওই সময়। তখন অবশ্য ইসলামী জঙ্গির উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু তখন তাদের পূর্বসূরি ও একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত ও মুসলিম লীগের অনুসারীরা এ দেশে ছিল। তারা রাজনৈতিক আদর্শের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করত জীবনহানির মাধ্যমে। আমরা ভুলে যাইনি, সেই সময় সর্বহারার রাজত্ব কায়েম করার নামে কিভাবে সারা দেশের পাটের গুদামে আগুন জ্বালানো থেকে শুরু করে রেললাইন উপড়ে ফেলার মতো নাশকতামূলক কাজও হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ওই সময় টার্গেট হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। মৃত্যুবরণ করেছে তাদেরই বেশি নেতা-কর্মী। আজকে ২০১১ সালে এসেও তাদের প্রেতাত্মারা আবার খড়গ নিয়ে এগিয়ে আসছে না তো?
জঙ্গিরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি এ দেশ থেকে। বাংলা ভাই কিংবা শায়খ আবদুর রহমানের মতো জঙ্গি সর্দারদের মৃত্যুর পর ওদের সবাই শেষ হয়ে গেছে, এটা কি আমরা ভাবতে শুরু করেছি! না, এমন ভাবনা ঠিক হবে না। কারণ তাদের শক্তি শুধু দুই নেতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আমরা দেখেছি, সারা দেশে একসঙ্গে প্রায় অর্ধসহস্র জঙ্গি কাজ করেছিল। বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিল। সেই সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি, জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক কত শক্তিশালী ছিল! প্রশ্ন হচ্ছে, এই অর্ধসহস্রাধিক জঙ্গি কি ধরা পড়েছে? না, ধরা পড়েনি তারা। সংগত কারণেই আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করতে পারি, চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকায় যে সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে, তা কারো না কারো কীর্তি। তারাই তা ব্যবহার করতে পারে! সম্ভবত এই কাজ সেই জঙ্গিদেরই। তাহলে আমরা এও ধরে নিতে পারি, জঙ্গিরা বড় ধরনের নাশকতামূলক কাজ করতে যাচ্ছে এবং যার জন্য আমাদের কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই বিষয়ে সরকার এখনই যদি সাবধান না হয়, তাহলে বাংলাদেশে আবারও জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তৈরি করতে পারে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.