বিজয় কুমার সত্যি এক বিজয়ী শিক্ষক by আবু তোরাব মানিক,

যিনি শুধু পেশার কারণে চাকরি করেন না, শিক্ষকতার মাধ্যমে প্রতিদিন সুনিপুণভাবে মানুষ গড়েন, যার পরিচর্যায় যে কোনো মানের স্কুলগামী শিশু কৃতী শিক্ষার্থীতে রূপান্তরিত হয়, মানুষ গড়ার সেই দক্ষ কারিগরের নাম বিজয় কুমার। তিনি ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার রানীশংকৈল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
রানীশংকেল উপজেলার চেংমারি গ্রামে ছোট কৃষক পরিবারে ১৯৫৭ সালে জন্ম


বিজয় কুমারের। স্কুলে পা না রাখতেই মাকে হারান। সংসারে অনটনের কারণে বাবা স্কুলে ভর্তি না করে সনাতন ধর্মাবলম্বী হয়েও মাদ্রাসায় ভর্তি করান। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষে একই উপজেলার কাদিহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাস করেন। টিউশনি করে নিজের খরচ যুগিয়ে ঠাকুরগাঁও কলেজ থেকে ১৯৭৯ সালে বিএসসি পাস করেন। সংসারের টানে '৮১ সালে পীরগঞ্জ উপজেলার দলুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা একজন ভালো শিক্ষক হওয়ার। এর পর ১৯৮৩ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এবং '৮৫ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরি পান। রানীশংকৈল উপজেলার নিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেই শুরু করেন উচ্চমানের শিক্ষাদানের সংগ্রাম। সে বছর উপজেলার ৪ জনের মধ্যে প্রথম ওই বিদ্যালয় থেকে ৩ জন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। প্রতি বছর সাফল্য বাড়তে থাকে। উপজেলার কর্তাদের চোখ পড়ে ওই স্কুলটির দিকে। তারা খুঁজে পান ক্রমবর্ধমান এই সাফল্যের নেপথ্য কারিগরের নাম বিজয় কুমার। উপজেলা কর্তৃপক্ষ কিছুটা কৌশল করে প্রগতিশীল মানসিকতার এই মানুষটিকে এবার নিয়ে আসেন উপজেলা সদরের প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৯২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিজয় কুমার যোগদান করেন রানীশংকৈল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেই সময় চৌচালা একটি টিনের ঘর আর তিন শিক্ষক ছিলেন এ স্কুলের সম্বল। শুরু হলো বিজয় কুমারের সাফল্যের সংগ্রাম। প্রথম বছরেই বৃত্তি পেল ৪ জন। সাবেক এমপি আলী আকবর (প্রয়াত), সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান (প্রয়াত) আবদুল কুদ্দুস, ইয়াসিন আলী, সোহরাব হোসেন, আতাউর রহমান, আইনুল হক, সইদুল হক, নিত্যানন্দ বসাক, তাজুল ইসলামসহ অনেক গুণী ব্যক্তি তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। অভিভাবকের বাড়িতে গিয়ে তাদের সচেতন করার উদ্যোগ নিলেন বিজয়। শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করার কাজ সারলেন আগে।
শিক্ষকতা যখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোচিং বাণিজ্য, তখন বিজয় কুমারের সকাল থেকে রাত স্কুলই ঘরসংসার। ছুটির পরও তিনি শিশুদের নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত কোচিং করালেন। এজন্য কারও কাছে কোনোদিন একটি টাকাও গ্রহণ করেননি; বরং দরিদ্র ছেলেদের কাপড়চোপড়, খাতা-কলম, এমনকি অনেক সময় খাওয়ার টাকা দিয়ে তাদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। শৈলেন চন্দ্র, আশরাফ আলী ও আলমগীর হোসেনের মতো অনেক দরিদ্র ছেলে আজ তার সহায়তায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। শুধু নিজে নয় সহকর্মীদেরও তিনি দক্ষ করে গড়ে তুললেন। ধীরে ধীরে তার সহকর্মী শিক্ষকরা তার মতো শ্রম দিতে শুরু করলেন। এখানকার ১৮ শিক্ষক এখন তার মতো দিনরাত বিদ্যালয়ে সময় দিচ্ছেন। এই বিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র- শিক্ষক ভাবতে শেখেননি যে, বিদ্যালয়ে দেরিতে প্রবেশ করা যায়। সকাল ৯টা ২০ মিনিটে বিদ্যালয়ে ফটক বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৩৭। প্রতিটি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মেধামানের ক্রমে এ বি সি ডি ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। যারা সবচেয়ে ভালো তাদের 'এ' গ্রুপে রাখা হয়। যারা 'ডি' গ্রুপে আছে তাদের যে মানের সেবা দিলে ধীরে ধীরে 'এ' মানে উন্নীত হবে সে মোতাবেক শিক্ষা দেওয়া হয়। যাদের প্রয়োজন আছে তাদের নাইট শিফটে নেওয়া হয়। এভাবে শতভাগ ছাত্রছাত্রীকে একই মানে উন্নীত করা হয়। তা ছাড়া ছুটির পর বিকেলে এক্সট্রা কারিকুলাম হিসেবে নাচ, গান, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, ছবি আঁকা ও খেলাধুলা শিক্ষা দেওয়া হয়। এজন্য নিজস্ব উদ্যোগে সামান্য সম্মানী দিয়ে তিনি কমিটির মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ করেছেন। এ বিদ্যালয়ে ৪টি কমিটি রয়েছে। রয়েছে কল্যাণ তহবিল। অভিভাবকরা প্রতিমাসে ২ টাকা দিয়ে এই তহবিলে ৫০ হাজার টাকা জমা করেছেন। অক্টোবর মাসের মা সমাবেশে কল্যাণ তহবিল থেকে ৩১ দরিদ্র শিক্ষার্থীকে স্কুল ইউনিফর্ম উপহার দেওয়া হয়। এমপি হাফিজ উদ্দিন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। প্রতি মাসে মা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ের ৪টি ভবনে ১৪টি কক্ষ রয়েছে। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের নামে এসব কক্ষের নাম রাখা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষের সামনে তাদের ছবি রয়েছে। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার ও সীমানাপ্রাচীর। স্কুলের ভেতরে নিজস্ব ক্যান্টিন। খেলার মাঠ, কম্পিউটার ল্যাব, সাউন্ড সিস্টেম, বাদ্যযন্ত্র তো আছেই।
কালের আবর্তে বেশ কিছুদিন ধরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তেমন লেখাপড়া হয় না_ এমন অভিযোগ রয়েছে। আর এই সুযোগে দেশের সব অঞ্চলে গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো শিক্ষক, গুণীজন ও সমাজের অগ্রসর মানুষের সন্তানরা এসব কিন্ডারগার্টেনে পড়ালেখা করছে। পেছনে পড়ে যাচ্ছে সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলো। একমাত্র প্রধান শিক্ষক বিজয় কুমারের নিরলস প্রচেষ্টায় রানীশংকৈলে এর উল্টো দৃশ্য। এখানে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ার জন্য জেলার সব এলাকা থেকে তো বটেই, অন্য জেলা থেকেও ছাত্রছাত্রীরা এই বিদ্যালয়ে এসে অধ্যয়ন করছে। লজিং, মেস, এমনকি অনেকে বাসা ভাড়া নিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের এই স্কুলে পড়াচ্ছেন। গত বছর এই বিদ্যালয় থেকে ৩৮ জন বৃত্তিলাভ করেছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ১৪৩ জন পরীক্ষা দিয়ে ১৪২ জন প্রথম বিভাগ এবং একজন দ্বিতীয় বিভাগ অর্জন করে। ১৪৩ জনই অঙ্কে শতকরা পঁচানব্বইয়ের অধিক নম্বর অর্জন করে। ২০০৯ সালে জাতীয় শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের পুরস্কার লাভ করে। ২০১০ সালে সরকার নিজ খরচে প্রধান শিক্ষক বিজয় কুমারকে শ্রীলঙ্কা সফর করায়। এবার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির দিক থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ এবং জাতীয় নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছে স্কুলটি। স্কুলে ছাত্রছাত্রীর হাজিরার গড় ৯৫ দশমিক ২৫ ভাগ। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৩৭। এবার সমাপনী পরীক্ষার্থী ১৩৩ জন।
এই প্রতিভাবান পুরুষ কয়েক বছর ধরে নিজ বাড়িতে রেখে কিছু ছাত্রকে ক্যাডেট কোচিং করান। বিভিন্ন জেলার ছাত্ররা এখানে কোচিং করতে আসেন। তাদের মধ্যে ১০৭ জন বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে পড়ালেখা করছে। এর মধ্যে রানীশংকৈল উপজেলার ৪০ জন। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী, এক ছেলে এক মেয়ের গর্বিত বাবা বিজয় কুমার বলেন, ছাত্ররা আমার সন্তানের মতো। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সন্তানস্নেহে দেখলে ওরা ভালো ফল করবেই। তিনি বলেন এই এলাকার জনগণ, সরকারি কর্মকর্তা ও অভিভাবক সবাই তাকে সহায়তা করায় তার এ সাফল্য। 

No comments

Powered by Blogger.