এই 'দেবদূতেরা' কাদের আধিপত্যের পাহারাদার সেজেছেন?-কালের আয়নায় by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

গোটা পুঁজিবাদী বিশ্ব এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ব্রিটেনের ইকোনমিক ডিপ্রেশন 'ডাবলডিপে' গেছে। লন্ডনের রাস্তায় চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি কমানোর ছাত্র বিক্ষোভ। ইউরোপের দুটি দেশে সরকারের পতন ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) লন্ডনের 'ডেইলি স্টার' কাগজ প্রথম পাতায় ছবি ছেপেছে, এক তরুণী প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে লেখা : আই ওয়ান্ট এ জব_ আমি চাকরি চাই।


মার্কিন সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে, ওসামা হত্যা, গাদ্দাফি হত্যা দ্বারাও প্রেসিডেন্ট ওবামা তার জনপ্রিয়তায় যে ধস নেমেছে তা ফেরাতে পারবেন না। তিনি আমেরিকাকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত করতে না পারলে ওয়ান টার্ম প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিতে হবে।
আমেরিকার বিশ্বখ্যাত দার্শনিক পণ্ডিত গোর মারডেল বলেছেন, 'বলা হয় সমাজতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে। আসলে পুঁজিবাদের মৃত্যু হয়েছে বহুবার। তথাপি পুঁজিবাদ যে বারবার বেঁচে ওঠে তার কারণ, ড্রাকুলার মতো তার মানুষের রক্ত শোষণের ক্ষমতা ও প্রবৃত্তি রয়েছে। যখনই পুঁজিবাদ রোগগ্রস্ত হয়, মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর হয়, তখনই নির্মমভাবে আর্থিক কৃচ্ছ্রতার নামে গরিব মানুষের সকল ওয়েলফেয়ার সার্ভিসের ব্যয় কাট করে, তাদের ওপর বিপুল করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে এবং তাতে সফল হয়।
মারডেলের এই কথা যে কত সত্য, তা বর্তমান আমেরিকা ও ইউরো জোনের সংকট এবং অর্থনৈতিক ধসের দিকে তাকালেও বোঝা যায়। এই অর্থনৈতিক ধস ত্রিশের মন্দার চেয়েও ভয়াবহ। পশ্চিমা পত্রপত্রিকাতেই স্বীকার করা হচ্ছে, 'ঞযরং রং হড়ঃ ঃযব পৎরংরং ড়ভ বপড়হড়সু, ঃযরং রং ঃযব পৎরংরং ড়ভ পধঢ়রঃধষরংস.' (এটা অর্থনীতির সংকট নয়, এটা পুঁজিবাদের সংকট)। গরিব মানুষকে হত্যা করে এবারও পুঁজিবাদ আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর ত্রিশের মন্দার ধাক্কা (ঃযব মৎবধঃ ফরঢ়ৎবংংড়হ ড়ভ ৩০ং) কাটাতে পশ্চিমা পুঁজিবাদ আরেকটি যুদ্ধের আয়োজন করেছিল, সেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। এই যুদ্ধের সময় পুঁজিবাদের ছত্রছায়াতেই ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয় এবং একা ফ্যাসিবাদী জার্মানি কয়েক লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য হিটলারকে স্কেপগোট করে তার ওপরই সব দোষ চাপানো হয়। কিন্তু এই পুঁজিবাদ ও বিশ্ব আধিপত্য রক্ষার জন্য যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল যে ৫০ লাখ ভারতীয়কে (বাঙালিকে) পরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে হত্যা করেছেন, সে ইতিহাস পুঁজিবাদী ইতিহাসবিদেরা সযত্নে গোপন করেন।
সম্প্রতি নিউইয়র্কের বেসিক বুকস প্রকাশনী জার্মানিতে বসবাসকারী ভারতীয় সাংবাদিক মধুশ্রী মুখার্জির 'ঈযঁৎপযরষষ্থং ঝবপৎবঃ ডধৎ' (চার্চিলের গোপন যুদ্ধ) নামে যে বইটি প্রকাশ করেছেন, তা বিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এই বইতে তথ্য-প্রমাণ দ্বারা দেখানো হয়েছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও বিশ্ব পুঁজিবাদকে রক্ষার জন্য চার্চিল যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে কৃত্রিম উপায়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে ৫০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডে নাৎসিদের হলোকাস্টের চেয়ে কম ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড নয়। 'চার্চিলস সিক্রেট ওয়ার' বইটিতেই বলা হয়েছে, আমেরিকায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সঙ্গে এক বৈঠকে চার্চিল যখন ভারতে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আভাস দিচ্ছিলেন, তখন তিনি সভয়ে বলে উঠেছিলেন, 'মি. চার্চিল, আপনি দেখছি হিটলারের ভাষায় কথা বলছেন।'
একুশ শতকে আজ আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে আরও ভয়াবহ ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে। এবার আরও অতিকায় গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজম মৃত্যুশয্যায়। তাকে বাঁচানোর জন্য তৃতীয় মহাযুদ্ধ শুরু করা না হলেও আরও ভয়াবহ মারণাস্ত্র দ্বারা গালফ যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ, লিবিয়া যুদ্ধ ইত্যাদি খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ বাধিয়ে, জাতিবিদ্বেষ ছড়িয়ে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিবিদ্বেষ, বর্তমানে ইসলামবিদ্বেষ) গোটা বিশ্বকে কার্যত রণাঙ্গনে পরিণত করা হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চার্চিলের মুখে রুজভেল্ট সাহেব হিটলারের ভাষা শুনেছিলেন। এখন ওবামা, ক্যামেরন থেকে শুরু করে পুঁজিবাদী বিশ্বের সকল নেতার মুখেই হিটলারের চেয়েও সদম্ভ ভাষা শোনা যাচ্ছে।
পুঁজিবাদ শুধু তার হিংস্র নখরদন্ত (যুদ্ধাস্ত্র) দ্বারাই আত্মরক্ষা ও আধিপত্য রক্ষার চেষ্টা চালায় না, তাদের প্রোপাগান্ডা মেশিন আরও শক্তিশালী। এই প্রোপাগান্ডার শক্তিতে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করে তারা বুঝতে দেয় না, তারাই বিশ্ববাসীর আসল শত্রু। তারা নকল শত্রু সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে বিশ্বের মানুষকে বোঝায়, পুঁঁজিবাদ বিশ্বের সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্যই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে নামতে বাধ্য হয়েছে। তারা জনগণের পরিত্রাতা।
এই প্রোপাগান্ডা সফল করার জন্য তারা বিশ্বের যে অংশের মানুষকে শোষণ করে, পদানত রাখে তাদের মধ্য থেকেই এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী খুঁজে বের করে তাদের নোবেল পুরস্কার থেকে শুরু করে সব রকমের আন্তর্জাতিক সন্মান দিয়ে বিশ্বখ্যাত করে তোলে এবং তাদের দ্বারা পুঁজিবাদী শোষণ ও আধিপত্যকে আড়াল করার জন্য এমন সব তত্ত্ব প্রচার করা হয়, যে তত্ত্ব দ্বারা মানুষ সহজেই প্রভাবিত ও প্রতারিত হয়। নওমি চমস্কির মতে, এই পণ্ডিতরা সকলেই যে জ্ঞানপাপী তা নয়। তারা নিজেরাও নিজেদের পাণ্ডিত্যাভিমান থেকে এতটা অন্ধ হয়ে যান যে, তারা যে নিজেদের অজ্ঞাতেই পুঁজিবাদী শোষণ ও আগ্রাসনের সাফাই সাক্ষী হয়ে গেছেন তা বুঝতে পারেন না।
দুটি উদাহরণ দেব। নোবেল লরিয়েট ড. অমর্ত্য সেনের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা। তার পাণ্ডিত্যের প্রতি কোনো প্রকার কটাক্ষ না করে সবিনয়ে লিখছি, দুর্ভিক্ষ সম্পর্কিত তার বিখ্যাত থিওরিতে তিনি কোনো কোনো দেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, ইনফরমেশনের সুযোগ-সুবিধার অভাব ইত্যাদি নানা কথা টেনে এনেছেন এবং রেফারেন্স হিসেবে চীনের দুর্ভিক্ষগুলোর কথাও বলেছেন। কিন্তু ভারত উপমহাদেশের দুর্ভিক্ষগুলোর কারণ দর্শাতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী অমানবিক চক্রান্তগুলোর ওপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করেননি।
ড. অমর্ত্য সেনের আলোচনায় অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের আমলে পঞ্চাশের ('৪৩-এর) দুর্ভিক্ষের কথা আছে, কিন্তু এই শাসনের সূচনায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (বঙ্কিমের আনন্দমঠে উলি্লখিত দুর্ভিক্ষ) কথা কিংবা তার কারণের কথা নেই। ড. সেনের থিওরি পাঠ করলে মনে হবে, স্বাধীন বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, তা বুঝি দেশটিতে তৎকালে গণতান্ত্রিক শাসনের অনুপস্থিতি, ইনফরমেশন গ্যাপ এবং ব্যবস্থাপনায় অযোগ্যতা ও অদক্ষতার জন্য হয়েছে। এই দুর্ভিক্ষ ঘটানোর জন্য নেপথ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কারসাজি, যা পরে মার্কিন সংবাদপত্রেই 'ফুড এজ এ উইপন' শীর্ষক আলোচনায় স্বীকৃত হয়েছে, তা ড. সেনের গোচরে আসেনি বলেই কি এই দুর্ভিক্ষের কথা আড়ালে আড়ালে বলেও তিনি আসল কারণ এড়িয়ে গেছেন? এভাবে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ার শস্য সমৃদ্ধ দেশগুলোতেও দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির দায় থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদকে মুক্ত রাখার কাজে ড. সেনের অর্থনৈতিক থিওরিকে কাজে লাগানো গেছে বলেই তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কি-না এ প্রশ্নও আজকাল অনেকে তোলেন। এ প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা অবশ্যই আমার নেই।
আরেকটি দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে যখন এক-এগারোর বহু আগে থেকে মাইনাস টু থিওরি উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন অর্থাৎ দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যর্থ এই ধুয়া তুলে একটি অনির্বাচিত এলিট সরকারের শাসন (অবশ্যই পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায়) প্রবর্তনের জোর তৎপরতা (আলোচনা সভা, সেমিনার ও মিডিয়া প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে) চালাচ্ছিলেন আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজ, তখন এই সুশীল সমাজের প্রভাবশালী প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান একটি থিওরি দিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, 'ঞযব সবসনবৎং ড়ভ ঃযব ধপঃরাব ংবৎারপবং ধৎব ঃযব ঢ়ধৎঃ ড়ভ পরারষ ংড়পরবঃং' (সামরিক বাহিনীর লোকেরাও সুশীল সমাজের অংশ)। আমি তার এই বক্তব্যের তখনই প্রতিবাদ করেছিলাম।
পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে 'ওহঃবষষবপঃঁধষ মধহম ড়ভ ভড়ঁৎ' বা 'বুদ্ধিজীবী চার রত্নের' আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের মধ্যে রেহমান সোবহান একজন। এই চারজনের মধ্যে তিনি ও আরেকজন সৎ এবং বিবেকবান পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত। তা সত্ত্বেও রেহমান সোবহানের এই থিওরি যে পরবর্তীকালে একটি গরষরঃধৎু নধপশবফ, ঁহবষবপঃবফ বষরঃ পরারষ মড়াবৎহসবহঃ (সামরিক বাহিনীর সহায়তায় অনির্বাচিত এলিট সিভিল গভর্নমেন্ট) বা এক-এগারোর সরকারের ক্ষমতায় আসার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করবে, তা সম্ভবত তিনি নিজেও জানতেন না। চীনের এক কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীর কথা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি বলেছেন, "নোবেল পুরস্কার ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার দ্বারা আজকাল বিশ্ব পুঁজিবাদ সাবেক তৃতীয় বিশ্বে যেসব 'দেবদূত' খাড়া করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তারা আসলে কাদের দূত, বিশ্বব্যাপী মারণাস্ত্রের ঝনঝনানি, যুদ্ধ বিস্তার, মধ্যপ্রাচ্যে কিলিং ফিল্ড তৈরি করার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী আজ তা বুঝতে শুরু করেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদের আগ্রাসী দানব চেহারাকে আড়াল করার জন্যই শোষিত ও নির্যাতিত দেশগুলো থেকেই কিছু নির্বাচিত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীকে মানবতা, মানুষের অসীম সম্ভাবনা ইত্যাদি সম্পর্কিত গালভরা বুলি আউড়ে দেবদূত সাজার এবং নিপীড়িত মানুষকে বিভ্রান্ত করার বিশ্বমঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।"
চীনের এই কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীর কথাকে পশ্চিমা বিশ্ব হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সম্প্রতি ভিয়েনার কংগ্রেস সেন্টারে সামাজিক ব্যবসা সম্মেলনে আরেক নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সংবর্ধনার বহর দেখে এবং ভাষণ শুনে চীনের বুদ্ধিজীবী দ্বারা বর্ণিত দেবদূতের কথা মনে হলো। ড. ইউনূস 'মানুষের অসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য' সম্মেলনে আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজম আজ চরম সংকটের মুখে পড়ে সেই সম্ভাবনাকে যুদ্ধ, ধ্বংস, নির্বিচার ড্রোন বোমা হামলায় যে ধ্বংস করছে তার ভাষণে সে সম্পর্কে একটি কথাও নেই।
তিনি এই যুদ্ধ ও ধ্বংসের বাস্তবতাকে তার ভাষণে সম্পূর্ণ অস্বীকৃত ও অনুচ্চারিত রেখে মানুষের অসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর এমন সব ফাঁকা বুলি ঝেড়েছেন, যাতে মনে হয় বিশ্বে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়নি, পুঁজিবাদ আগ্রাসী মূর্তি ধারণ করেনি, সব ঠিকঠাক আছে। মানুষ তার সম্ভাবনাকে কাজে লাগালে তার থিওরিমতো সামাজিক ব্যবসাতে ঢুকলেই সব মুশকিল আসান। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে এখন যেসব যুব অভ্যুত্থান সে সম্পর্কে তার ভাষণে একটি কথাও নেই। বুঝতে অসুবিধা হয় না, তিনি কাদের পক্ষ নিয়ে, কাদের দুষ্কৃতি আড়াল করে মানুষকে আশার ললিত বাণী শোনানোর জন্য এখনও সক্রিয় রয়েছেন।
অথচ সম্মেলনে যারা উপস্থিত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশের কণ্ঠে ফাঁকা আশার বুলি নেই। বিশ্বব্যাপী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভয়াবহ অস্থিরতার কথা উল্লেখ করে অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ভার্নার ফেইনম্যান বলেছেন, 'ভয়াবহ অর্থনৈতিক অস্থিরতায় ইউরোপের দুই ট্রিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে গেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে অবিশ্বাস্য হারে মানুষ। আমি বিশ্বাস করি, ৫০ শতাংশ তরুণকে কর্মহীন রেখে মানুষের কোনো সম্ভাবনাকেই কাজে লাগানো যাবে না, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা যাবে না।' একই কথা সম্মেলনে বলেছেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব থমাস স্টেলজার। তিনি বলেছেন, 'গত ১৫ বছরে বিশ্বে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। অথচ এই সময়ে ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এই ব্যবধান ও বৈষম্যকে দূর না করে মানুষের সম্ভাবনাকে কোনো কাজে লাগানো সম্ভব নয়।
এই ব্যবধান, বৈষম্য ও বঞ্চনাকে বিশ্বব্যাপী জিইয়ে রেখেছে বর্তমানের আগ্রাসী পুঁজিবাদ। এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত সংগ্রাম ও জয়লাভ ছাড়া বিশ্বমানবের কোনো সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো দূরের কথা, বিশ্বমানবতার অস্তিত্ব রক্ষাই সম্ভব নয়। এই ধ্বংস ও বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়েও ড. ইউনূসের মতো সাবেক তৃতীয় বিশ্বের 'দেবদূতদের' মুখে শান্তি ও সম্ভাবনার আশার বাণী। এটা কি বর্তমান ধ্বংস ও বিপর্যয়ের আসল হোতাদের আড়ালে রেখে বিশ্বের মানুষকে বিভ্রান্ত ও সংগ্রামবিমুখ করে রাখার আদিষ্ট ভূমিকা পালন নয়? আর বিশ্বব্যাপী এই ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ধ্বংস ও বিপর্যয়ের প্রতিবিধান কি ড. ইউনূসের 'সামাজিক ব্যবসায়ের' হাতুড়ে নোস্খা? হাসব, না কাঁদব বুঝতে পারছি না।
লন্ডন, ১৮ নভেম্বর ২০১১, শুক্রবার

No comments

Powered by Blogger.