কালো কুচকুচে ব্রোঞ্জ ফিঙে by সারোয়ার সুমন,

দৈর্ঘ্যে তারা বড়জোর ২৪ থেকে ২৬ সেন্টিমিটার। কিন্তু ছোট্ট এ শরীরেই কখনও জঙ্গি বিমানের মতো ছোঁ মারে তারা। আবার শিয়াল কিংবা বনবিড়ালের মতো প্রাণীকেও আঘাতে রক্তাক্ত করে। স্বভাবে শান্তিপ্রিয় হয়েও সন্তানের সুরক্ষায় এমন রুদ্ররূপ ধারণ করে যে পাখি, তার নাম ব্রোঞ্জ ফিঙে। কুচকুচে কালো রঙের এ পাখির গা থাকে তেলতেলে। সূর্যের আলো পড়লে দূর থেকেও চকচক করে।


ভারত, নেপাল, ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে ব্রোঞ্জ ফিঙে আছে ২৩ প্রজাতির। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়া পছন্দ করে সাত প্রজাতির ফিঙে। বৃক্ষঘেরা ফলের বাগান কিংবা ঝোপঝাড় থাকা বন-বাগানেই থাকতে পছন্দ করে ছোট্ট এ পাখি। মাছি, পিঁপড়া কিংবা ছোট প্রজাতির পতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে এরা। শিকার ধরার আগে বেশ কিছুক্ষণ তাকে অনুসরণ করে ব্রোঞ্জ ফিঙে। এর পর এক পলকেই ছোঁ মেরে শিকার নিয়ে আসে ঠোঁটে।
চওড়া ও বলিষ্ঠ ঠোঁটের ব্রোঞ্জ ফিঙে পাখির গড় দৈর্ঘ্য ২৪ সেন্টিমিটার হলেও লেজের দৈর্ঘ্য ২৪ সেন্টিমিটারেরও বেশি। দূর থেকে কেবল তাদের কালো রঙ দৃশ্যমান হলেও কাছে নিলে বুকের ওপর দেখা যায় ব্রোঞ্জ সবুজ। গাঢ় বাদামি চোখের এ পাখির ডানা লম্বা। লেজ লম্বা ও তার প্রান্ত একটু বিস্তৃত। তাদের চোখের নিচের পাশটা ঘন কালো। পা কালো। ঠোঁটও কালো। ব্রোঞ্জ ফিঙে
যত বেশি প্রাপ্তবয়স্ক হয় তত বেশি ফুটে ওঠে তার দেহের কালো রঙ। অবশ্য ছোট আকারের ব্রোঞ্জ ফিঙে দেখতে একটু অনুজ্জ্বল।
ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্টে প্রজননের প্রস্তুতি নেয় ব্রোঞ্জ ফিঙে। এ সময় বাঁশঝাড় কিংবা আমবাগানের ডালে ঘাস কিংবা শুকনো পাতা দিয়ে বাসা বাঁধে তারা। নিজের তৈরি এ বাসাতেই প্রতি বছর তিন থেকে চারটি ডিম পাড়ে এরা। এসব ডিম থেকে বাচ্চা না ফোটা পর্যন্ত পুরুষ ও স্ত্রী ফিঙে পর্যায়ক্রমে বাসা পাহারা দেয়। বাসার জন্য কাউকে হুমকি মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ করে বসে পাহারায় থাকা ফিঙে। জীবন বাজি রেখে রক্ষা করে ডিম কিংবা তা থেকে ফোটা সন্তান। আর সঙ্গীকে সতর্কবার্তা দিতে ব্রোঞ্জ ফিঙে সুর করে ডাকে টি-টিটিউ...টি-টিটিউ...টি-টিটিউ।
অনাগত সন্তানের বেড়ে ওঠা পর্যন্ত এমন রুদ্ররূপে থাকে ফিঙে পাখি। সন্তানরা আস্তে আস্তে উড়তে শিখলে এবং নিজের খাবার নিজে খেতে পারলে মা-বাবার দায়িত্ব শেষ মনে করে ছোট্ট এ পাখি।
কুচকুচে কালো রঙ এবং সন্তানের প্রতি এমন গভীর মমত্ববোধ অন্যান্য পাখি থেকে কিছুটা হলেও আলাদা করে দিয়েছে ব্রোঞ্জ ফিঙেকে। সুন্দরবনে বসবাস করে এ পাখির বেশ কয়েকটি প্রজাতি। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ও ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেনে অনায়াসে ব্রোঞ্জ ফিঙের দেখা মেলে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কালো সখার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন, 'কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি/কালো, তা সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ...।' আর কালো রঙের ব্রোঞ্জ ফিঙে প্রসঙ্গে বিশিষ্ট গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. গাজী সৈয়দ মোঃ আসমত বলেন, 'দেখতে কুচকুচে কালো হলেও ব্রোঞ্জ ফিঙেকে কখনোই কাক মনে হয় না। তেলতেলে এ পাখি যতই কাছে আসে ততই যেন উপচে পড়ে তার কালো রঙের রূপ...।'

No comments

Powered by Blogger.