কালের আয়নায়-ফের মোশতাকের প্রেতাত্মার কণ্ঠ :সাধু সাবধান by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
শেখ হাসিনা, তার দল ও সরকার এখন এক অসম্ভব যুদ্ধে ব্যাপৃত। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আবার মাথা তুলেছে এবং সংঘবদ্ধ হয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুই ফ্রন্টেই আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধরত। এ সময় দলটির দরকার অখণ্ড ঐক্য, পরীক্ষিত মিত্র ও সহযোদ্ধা। এই সময় যারা অতি দরদি সেজে আওয়ামী লীগের এই ঐক্যে ভাঙন ধরাতে চায়, প্রশাসনকে বিভ্রান্ত ও দুর্বল করতে চায়, তারা আওয়ামী লীগের মিত্র নয় এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শেরও মিত্রপক্ষ নয়।
এরা মোশতাকের প্রেতাত্মার নতুন প্রচারযন্ত্র। এদের সম্পর্কে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দেশের গণতান্ত্রিক সকল মহলের সতর্ক ও সাবধান হওয়া উচিত
বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, 'আওয়ামী লীগ হচ্ছে একটি মাল্টিক্লাস পার্টি। আর এই মাল্টিক্লাস পার্টি হচ্ছে গ্রামবাংলার এককালের গহনার বা গয়নার নৌকার মতো। নামে গয়নার নৌকা। আসলে নৌকাগুলো যাত্রী বহন করে। এই গয়নার নৌকার একটা ভয়, প্রায়ই ডাকাতরা অরক্ষিত গয়নার নৌকায় যাত্রীবেশে উঠে পড়ে, তারপর নৌকা যখন মাঝ নদীতে, তখন যাত্রীদের যথাসর্বস্ব লুট করে চলে যায়।'
এই তুলনাটা টেনে বঙ্গবন্ধু বলতেন, 'মাল্টিক্লাস রাজনৈতিক দলে ও দলের নীতিতে আস্থাবান মানুষের সঙ্গে সুবিধাবাদী, ভণ্ড, বিশ্বাসঘাতক শ্রেণীও ঢুকে পড়ে। তারপর সুযোগমতো দলটিকে কব্জা করে নিজেদের অসৎ, অশুভ উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে চায়। আওয়ামী লীগেও বারবার এই ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ নেতাকর্মীরা রক্ত দিয়ে, শ্রম দিয়ে, আত্মত্যাগ দ্বারা দলটি গড়ে তুলেছে আর সুযোগমতো একদল লোক দলে ঢুকে নেতা সেজে দলটিকে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের কাজে লাগাতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকেই এটা ঘটেছে। আমার প্রায় সারাটা জীবন কেটেছে এই চিল আর শকুনদের কবল থেকে দলটাকে রক্ষার কাজে। এবার যখন সুযোগ পেয়েছি, এই গয়নার নৌকায় আর ডাকাত উঠতে দেব না। ডাকাতদের জন্য দরোজা বন্ধ। এই দল হবে কৃষক-শ্রমিক-আমজনতার পার্টি।'
বাকশাল গঠনের আগে বঙ্গবন্ধু একদিন আমাদের কয়েকজন সাংবাদিকের কাছে তার গয়নার নৌকার বহুবার বলা গল্পটি বলতে গিয়ে তার বাকশাল গঠনের মানসিক প্রস্তুতির আভাসটি দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নিয়ে বঙ্গবন্ধু কোনো অত্যুক্তি করেননি। আওয়ামী লীগের জন্ম একটি মাল্টিক্লাস রাজনৈতিক দল হিসেবে। তাতে কৃষক-শ্রমিকসহ ভূস্বামী, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য পেশার লোকও এসে জুটেছিল। ডানপন্থি, বামপন্থি, সেক্যুলার এবং মৌলবাদীরাও এসে ভিড় জমিয়েছেন।
প্রায়শই দলটি কুক্ষিগত করতে চেয়েছে সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিরা। মওলানা ভাসানী যতদিন দলের নেতা ছিলেন, ততদিন শেখ মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এবং মওলানা সাহেব দল ছাড়লে শেখ মুজিব সমমনাদের নিয়ে এই দলটিকে জনগণের দল হিসেবে টিকিয়ে রাখার কাজে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। গয়নার নৌকায় যাত্রীবেশী ডাকাতের মতো আওয়ামী লীগের নৌকায় নেতা ও কর্মীর ছদ্মবেশধারী ডাকাত বিতাড়নে তিনি বহু যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত আত্মদান করেছেন। কিন্তু দলটাকে ধ্বংস হতে দেননি।
আওয়ামী লীগকে ভেতর থেকে ছুরি মারার বহু চক্রান্তের মধ্যে দুটি চক্রান্তের কথা উল্লেখ করি। আওয়ামী লীগ জন্ম নেওয়ার মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে যখন অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হতে যায়, তখন খন্দকার মোশতাক, আবদুস সালাম খান প্রমুখ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণকারী 'আওয়ামী মুসলিম লীগের' সাইনবোর্ডটি চুরি করে পুরনো ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের একটি বাড়িতে সেটি টানিয়ে পাল্টা দল খাড়া রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।
ষাটের দশকে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন শুরু হওয়ার সময় এই আবদুস সালাম গং শেখ মুজিবের জেলে থাকার সুযোগ নিয়ে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করার চেষ্টা করেন এবং শেখ মুজিবকে দল থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দেন। এই আওয়ামী লীগের নাম হয় পিডিএফপন্থি আওয়ামী লীগ। এই চক্রান্তও সফল হয়নি। এরপর বাইরে থেকে আঘাত করে দলটি ধ্বংস করতে না পেরে প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিরা দলটির ভেতরে আশ্রয় নেন এবং দলটিকে কব্জা করে নিজেদের অশুভ রাজনীতিতে কাজে লাগাবার চেষ্টা শুরু করেন। ইতিপূর্বে বামপন্থি নেতা ও কর্মীদের একটি বড় অংশ দল ছেড়ে চলে যাওয়ায় এই ডানপন্থিদের সামনে বিরাট সুযোগ আসে। কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অবশিষ্ট প্রগতিশীল নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকায় সেই ষড়যন্ত্র সহসা সফল হয়নি। কিন্তু ডানপন্থিদের চক্রান্ত অব্যাহত থাকে। তাদের নেতৃত্বে বসেন পুরনো কুচক্রী খন্দকার মোশতাক। তিনি এবার বঙ্গবন্ধুর ভক্ত সেজে ব্রুটাসের মতো ছুরি শানাতে থাকেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মোশতাক গ্রুপের স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানি ও মার্কিন গোয়েন্দা চক্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ ধরা পড়ার পর একদিকে মুজিবনগর সরকারে তার কার্যক্রম এবং সামরিক সেক্টরে জিয়াউর রহমান (তখন মেজর) ও তার জেড ফোর্সের কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু এদের দু'জনকেই ক্ষমা করে দেন। মোশতাক পুনরায় মন্ত্রীর দফতর লাভ করেন এবং জিয়াউর রহমান মেজর জেনারেল টাইটেলসহ উপ-প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তখন এই দু'জনের অতিভক্তি যারা দেখেছেন, তাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না, এরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কী ধরনের জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন।
মোশতাকের তখন সে কী দারুণ 'বঙ্গবন্ধু-ভক্তি'। বাকশাল গঠনের সময় তাজউদ্দীন আহমদ বরং একটু মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন; কিন্তু মোশতাক ঘোষণা করলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার কাজে প্রাণ দেবেন। বঙ্গবন্ধুর পিতার অথবা মাতার মৃত্যুর সময় বঙ্গবন্ধু নৌপথে টুঙ্গিপাড়ায় গেছেন। মোশতাক তার সহযাত্রী হন। জাহাজে তার কান্নায় বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত বিচলিত হয়ে তার চোখের পানি মুছতে ছুটে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আরেকবার কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গিয়েছিলেন। ছবিতে দেখা যায়, মোশতাক তার মাথায় ছাতি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। শেখ কামাল ও জামালের বিয়েতে উকিল বাবা পর্যন্ত হয়েছিলেন খন্দকার। তারপর ১৫ আগস্টের ভোরে মোশতাক আহমদকে কী বেশে দেখা গিয়েছিল ইতিহাস তার সাক্ষী।
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিদের নেতা ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশের প্রধান নেতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মন্ত্রী মোশতাকের প্রধান কাজ ছিল, এই তাজউদ্দীন আহমদ ও দলের প্রগতিশীল অংশ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করা এবং বঙ্গবন্ধুকে তার প্রকৃত সমর্থক ও শক্তির উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত মিত্র কারা ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর। মোশতাক দ্বিতীয় মীরজাফর সেজে প্রেসিডেন্ট পদে বসলেন। আর তাজউদ্দীনসহ জাতীয় নেতাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলো জেলের ভেতরে।
মুজিবনগরে থাকাকালেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু যুব নেতা মোশতাকের চক্রান্তের সঙ্গী হয়ে তার জোটে গিয়ে জুটেছিলেন। তাদের মধ্যে তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, পরবর্তীকালে জেলহত্যা মামলায় আসামি হয়েছিলেন। আরও একজন নানা দুর্নীতিতে যুক্ত থাকা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার চক্রীদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ এবং হত্যা-পরবর্তী তার কর্মকাণ্ডে রাজনীতিতে একেবারে শূন্য অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি তৎকালীন 'চার খলিফার' একজন বলে আখ্যাত হয়েছিলেন এবং সেই সুবাদে ব্যবসায়ের নামে বিস্তর টাকা-পয়সা কামিয়েছেন। কিন্তু সুনাম কামাতে পারেননি। তবু তার বিতর্কিত চরিত্রের কথা মনে না রেখে দুটি সাধারণ নির্বাচনেই শেখ হাসিনা ঝিনাইদহ-২ কেন্দ্রে তাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
রাজনীতিতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এখন এই ব্যবসায়ী নেতা আবার রাজনীতির মাঠে নামার জন্য তৎপর হয়েছেন, কিন্তু তার পুরনো বিতর্কিত চরিত্রটি ত্যাগ করতে পারেননি। তিনি তার প্রাক্তন গুরু খন্দকার মোশতাকের কায়দায় রাজনীতির মাঠে নামার চেষ্টা করছেন এবং তার কণ্ঠে মোশতাকের প্রেতাত্মার কণ্ঠধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মোশতাক যেমন বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শের রাজনীতিকে খতম করার জন্য তার অতিভক্ত সেজেছিলেন এবং প্রথম টার্গেট করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশকেই; তেমনি এই সাবেক 'খলিফাও' হঠাৎ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পরম দরদি সেজেছেন এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় যে ক'জন অতীতের বাম ঘরানার মন্ত্রী আছেন, তাদেরসহ দলের প্রগতিশীল অংশটিকে তার আক্রমণের টার্গেট করেছেন। আবার ধুয়া তুলেছেন, আওয়ামী লীগ দল এবং আওয়ামী লীগ প্রশাসন বামপন্থিরা অর্থাৎ সাবেক কমিউনিস্টরা দখল করে নিয়েছে। এই ধুয়া একসময় ছিল মোশতাক চক্রের।
মুজিবনগরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তে এবং স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুবিরোধী ষড়যন্ত্রে মোশতাক চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এই সাবেক খলিফা। সম্ভবত সেই সুবাদেই তিনি আবার মোশতাক চক্রের অসমাপ্ত কাজটি সমাপ্ত করার তাগিদ অনুভব করেছেন। এবারের লক্ষ্যও আওয়ামী লীগকে তার প্রকৃত মিত্র ও সমর্থকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, আওয়ামী লীগের বামদের সঙ্গে ডানদের একটা সংঘর্ষ শুরু করে দেওয়া এবং পরিণামে শেখ হাসিনাকে দুর্বল করে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া।
এই উদ্দেশ্যে মোশতাক আহমদের একই কৌশল ও পন্থা গ্রহণ করেছেন এই সাবেক খলিফা। তিনি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পরম ভক্ত ও অতি দরদি সেজেছেন এবং অতীতের যেসব বামপন্থি নেতা_ যেমন নাহিদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ যারা দীর্ঘকাল হয় আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এখন হাসিনা মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে দক্ষ ও সৎ মন্ত্রী হিসেবে সুনাম কুড়াচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছেন। গত ৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি বহুল পঠিত দৈনিকে তার যে সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে, সেটি পাঠ করে শঙ্কিত হতে হয় এই ভেবে যে, দেশে মোশতাকের প্রেতাত্মার কণ্ঠস্বর সম্ভবত আবার বেজে উঠেছে।
রাজনীতির আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত এই সাবেক ছাত্রনেতা ও একাত্তরের 'খলিফার' বক্তব্য নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করতাম না। কারণ, জাতীয় রাজনীতিতে এককালের বাঘ কাদের সিদ্দিকীর মতো এরাও এখন গুরুত্বহীন। কিন্তু এই সাবেক খলিফার গত কিছুকালের তৎপরতা ও প্রচারণার ধারা দেখে মনে হয়, তিনি এই প্রচারণায় একা নন; তার পেছনে আবার পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী চক্রটি অথবা তাদের অনুসারীরা সংঘবদ্ধ হয়েছে। এদের সম্পর্কে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সতর্ক হওয়া ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
সাবেক বামপন্থিদের সম্পর্কে এই সাবেক 'খলিফা' যেসব অসত্য ও অর্ধসত্য উক্তি করেছেন, তার জবাব প্রয়োজন হলে সাবেক বামপন্থিরাই দেবেন (সম্ভবত তারা প্রয়োজন মনে করবেন না)। তবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের এই অতি দরদির (মুজিবনগরে আমার জানা তার কর্মকাণ্ডের বয়ান আপাতত স্থগিত রাখলাম) অতীত ও সাম্প্রতিক অতীতের ভূমিকাটি কী তার সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতে পারি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে থেকেই এই সাবেক খলিফা মোশতাক গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তন করেন তখন জেনারেল ওসমানী তার বিরোধিতা করলে নেপথ্যে তাকে সমর্থন জুগিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তার এই প্রিয় শিষ্যও। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি বঙ্গবন্ধু ও বাকশালের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে যে 'খলিফা'র খুনিচক্রের সঙ্গে হাত মেলাতে বিবেকে বাধেনি, তিনি এখন সেসব সাবেক বামপন্থির বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছেন, যারা বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর প্রথম প্রতিবাদ জানিয়ে সভা-মিছিল করেছেন, এমনকি লন্ডনেও সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে প্রতিরোধ, বাংলার ডাক ইত্যাদি নামে কাগজ বের করে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।
এই সময়ে তার সম্পর্কে ঢাকায় প্রচারিত একটি মজার গল্প আছে। কতটা সঠিক জানি না, তবে সঠিক না হলে ঢাকার বাজারে এমন করে প্রচারিত হতো না। প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান ছিলেন এই খলিফারও শিক্ষক। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর এই শিক্ষকের কাছে গিয়ে 'খলিফা' বলেন, 'স্যার, আমি এখন যা কিছু হতে পারি। মন্ত্রী, চিফ হুইপ, দলের সেক্রেটারি। কোনটা হবো বলুন?' শিক্ষক তাকে ধমক দিয়ে বলেছেন, 'ধীরে রজনী, ধীরে।'
স্বাধীনতার পর ডলারের ব্যবসা থেকে নানা ধরনের ব্যবসা করে এই খলিফা যখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, তখন ঢাকায় তার নবনির্মিত প্রাসাদোপম বাড়ি দেখানোর জন্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি বাড়ি দেখার পর 'খলিফা' জিজ্ঞাসা করলেন, 'স্যার, বাড়িটা কেমন দেখলেন?' মনিরুজ্জামান বলেছেন, 'চমৎকার। তুমি একটা কাজ করো, বাড়ির সামনে একটা বড় বেঞ্চি তৈরি করে দাও। লোকজন এসে তাতে বসবে এবং তোমার বাড়ি দেখবে।' 'খলিফা' তার রসিকতা বুঝতে না পেরে বলেছেন, 'তাই করব স্যার।'
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকেও সাবেক খলিফা তার বাড়ি দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হাসিনা নাকি হেসে বলেছেন, 'আপনার বাড়ি শুনেছি ভেতরে-বাইরে মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি এবং তা এতই মসৃণ যে, পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভাঙতে পারি। সুতরাং না যাওয়াই ভালো।'
শেখ হাসিনাকে মোশতাকের এই সাবেক অনুচরদের বর্তমান প্রচারণা সম্পর্কে সতর্ক করার কোনো প্রয়োজন সম্ভবত নেই। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কমরেড মণি সিংহসহ গোটা কমিউনিস্ট পার্টির (তখন মস্কোপন্থি বলে পরিচিত) এবং মুজাফ্ফর ন্যাপের অবদানের কথা তিনি জানেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মস্কোর সমর্থন আদায়ের জন্য তাদের বারবার মস্কো দৌড়াদৌড়ি, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে শর্তহীন সমর্থন দান এবং তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক ও জিয়ার খুনিচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা_ এসব এখন ইতিহাসের অধ্যায়। মোশতাক চক্রের পুরনো ও নব্য অনুসারীদের প্রচারণায় তা মুছে যাবে না।
শেখ হাসিনা, তার দল ও সরকার এখন এক অসম্ভব যুদ্ধে ব্যাপৃত। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আবার মাথা তুলেছে এবং সংঘবদ্ধ হয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুই ফ্রন্টেই আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধরত। এ সময় দলটির দরকার অখণ্ড ঐক্য, পরীক্ষিত মিত্র ও সহযোদ্ধা। এই সময় যারা অতি দরদি সেজে আওয়ামী লীগের এই ঐক্যে ভাঙন ধরাতে চায়, প্রশাসনকে বিভ্রান্ত ও দুর্বল করতে চায়, তারা আওয়ামী লীগের মিত্র নয় এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শেরও মিত্রপক্ষ নয়। এরা মোশতাকের প্রেতাত্মার নতুন প্রচারযন্ত্র। এদের সম্পর্কে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দেশের গণতান্ত্রিক সকল মহলের সতর্ক ও সাবধান হওয়া উচিত।
লন্ডন, ৪ নভেম্বর ২০১১, শুক্রবার
বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, 'আওয়ামী লীগ হচ্ছে একটি মাল্টিক্লাস পার্টি। আর এই মাল্টিক্লাস পার্টি হচ্ছে গ্রামবাংলার এককালের গহনার বা গয়নার নৌকার মতো। নামে গয়নার নৌকা। আসলে নৌকাগুলো যাত্রী বহন করে। এই গয়নার নৌকার একটা ভয়, প্রায়ই ডাকাতরা অরক্ষিত গয়নার নৌকায় যাত্রীবেশে উঠে পড়ে, তারপর নৌকা যখন মাঝ নদীতে, তখন যাত্রীদের যথাসর্বস্ব লুট করে চলে যায়।'
এই তুলনাটা টেনে বঙ্গবন্ধু বলতেন, 'মাল্টিক্লাস রাজনৈতিক দলে ও দলের নীতিতে আস্থাবান মানুষের সঙ্গে সুবিধাবাদী, ভণ্ড, বিশ্বাসঘাতক শ্রেণীও ঢুকে পড়ে। তারপর সুযোগমতো দলটিকে কব্জা করে নিজেদের অসৎ, অশুভ উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে চায়। আওয়ামী লীগেও বারবার এই ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ নেতাকর্মীরা রক্ত দিয়ে, শ্রম দিয়ে, আত্মত্যাগ দ্বারা দলটি গড়ে তুলেছে আর সুযোগমতো একদল লোক দলে ঢুকে নেতা সেজে দলটিকে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের কাজে লাগাতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকেই এটা ঘটেছে। আমার প্রায় সারাটা জীবন কেটেছে এই চিল আর শকুনদের কবল থেকে দলটাকে রক্ষার কাজে। এবার যখন সুযোগ পেয়েছি, এই গয়নার নৌকায় আর ডাকাত উঠতে দেব না। ডাকাতদের জন্য দরোজা বন্ধ। এই দল হবে কৃষক-শ্রমিক-আমজনতার পার্টি।'
বাকশাল গঠনের আগে বঙ্গবন্ধু একদিন আমাদের কয়েকজন সাংবাদিকের কাছে তার গয়নার নৌকার বহুবার বলা গল্পটি বলতে গিয়ে তার বাকশাল গঠনের মানসিক প্রস্তুতির আভাসটি দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নিয়ে বঙ্গবন্ধু কোনো অত্যুক্তি করেননি। আওয়ামী লীগের জন্ম একটি মাল্টিক্লাস রাজনৈতিক দল হিসেবে। তাতে কৃষক-শ্রমিকসহ ভূস্বামী, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য পেশার লোকও এসে জুটেছিল। ডানপন্থি, বামপন্থি, সেক্যুলার এবং মৌলবাদীরাও এসে ভিড় জমিয়েছেন।
প্রায়শই দলটি কুক্ষিগত করতে চেয়েছে সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিরা। মওলানা ভাসানী যতদিন দলের নেতা ছিলেন, ততদিন শেখ মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এবং মওলানা সাহেব দল ছাড়লে শেখ মুজিব সমমনাদের নিয়ে এই দলটিকে জনগণের দল হিসেবে টিকিয়ে রাখার কাজে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। গয়নার নৌকায় যাত্রীবেশী ডাকাতের মতো আওয়ামী লীগের নৌকায় নেতা ও কর্মীর ছদ্মবেশধারী ডাকাত বিতাড়নে তিনি বহু যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত আত্মদান করেছেন। কিন্তু দলটাকে ধ্বংস হতে দেননি।
আওয়ামী লীগকে ভেতর থেকে ছুরি মারার বহু চক্রান্তের মধ্যে দুটি চক্রান্তের কথা উল্লেখ করি। আওয়ামী লীগ জন্ম নেওয়ার মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে যখন অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হতে যায়, তখন খন্দকার মোশতাক, আবদুস সালাম খান প্রমুখ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণকারী 'আওয়ামী মুসলিম লীগের' সাইনবোর্ডটি চুরি করে পুরনো ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের একটি বাড়িতে সেটি টানিয়ে পাল্টা দল খাড়া রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।
ষাটের দশকে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন শুরু হওয়ার সময় এই আবদুস সালাম গং শেখ মুজিবের জেলে থাকার সুযোগ নিয়ে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করার চেষ্টা করেন এবং শেখ মুজিবকে দল থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দেন। এই আওয়ামী লীগের নাম হয় পিডিএফপন্থি আওয়ামী লীগ। এই চক্রান্তও সফল হয়নি। এরপর বাইরে থেকে আঘাত করে দলটি ধ্বংস করতে না পেরে প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিরা দলটির ভেতরে আশ্রয় নেন এবং দলটিকে কব্জা করে নিজেদের অশুভ রাজনীতিতে কাজে লাগাবার চেষ্টা শুরু করেন। ইতিপূর্বে বামপন্থি নেতা ও কর্মীদের একটি বড় অংশ দল ছেড়ে চলে যাওয়ায় এই ডানপন্থিদের সামনে বিরাট সুযোগ আসে। কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অবশিষ্ট প্রগতিশীল নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকায় সেই ষড়যন্ত্র সহসা সফল হয়নি। কিন্তু ডানপন্থিদের চক্রান্ত অব্যাহত থাকে। তাদের নেতৃত্বে বসেন পুরনো কুচক্রী খন্দকার মোশতাক। তিনি এবার বঙ্গবন্ধুর ভক্ত সেজে ব্রুটাসের মতো ছুরি শানাতে থাকেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মোশতাক গ্রুপের স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানি ও মার্কিন গোয়েন্দা চক্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ ধরা পড়ার পর একদিকে মুজিবনগর সরকারে তার কার্যক্রম এবং সামরিক সেক্টরে জিয়াউর রহমান (তখন মেজর) ও তার জেড ফোর্সের কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু এদের দু'জনকেই ক্ষমা করে দেন। মোশতাক পুনরায় মন্ত্রীর দফতর লাভ করেন এবং জিয়াউর রহমান মেজর জেনারেল টাইটেলসহ উপ-প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তখন এই দু'জনের অতিভক্তি যারা দেখেছেন, তাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না, এরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কী ধরনের জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন।
মোশতাকের তখন সে কী দারুণ 'বঙ্গবন্ধু-ভক্তি'। বাকশাল গঠনের সময় তাজউদ্দীন আহমদ বরং একটু মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন; কিন্তু মোশতাক ঘোষণা করলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার কাজে প্রাণ দেবেন। বঙ্গবন্ধুর পিতার অথবা মাতার মৃত্যুর সময় বঙ্গবন্ধু নৌপথে টুঙ্গিপাড়ায় গেছেন। মোশতাক তার সহযাত্রী হন। জাহাজে তার কান্নায় বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত বিচলিত হয়ে তার চোখের পানি মুছতে ছুটে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আরেকবার কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গিয়েছিলেন। ছবিতে দেখা যায়, মোশতাক তার মাথায় ছাতি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। শেখ কামাল ও জামালের বিয়েতে উকিল বাবা পর্যন্ত হয়েছিলেন খন্দকার। তারপর ১৫ আগস্টের ভোরে মোশতাক আহমদকে কী বেশে দেখা গিয়েছিল ইতিহাস তার সাক্ষী।
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিদের নেতা ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশের প্রধান নেতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মন্ত্রী মোশতাকের প্রধান কাজ ছিল, এই তাজউদ্দীন আহমদ ও দলের প্রগতিশীল অংশ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করা এবং বঙ্গবন্ধুকে তার প্রকৃত সমর্থক ও শক্তির উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত মিত্র কারা ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর। মোশতাক দ্বিতীয় মীরজাফর সেজে প্রেসিডেন্ট পদে বসলেন। আর তাজউদ্দীনসহ জাতীয় নেতাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলো জেলের ভেতরে।
মুজিবনগরে থাকাকালেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু যুব নেতা মোশতাকের চক্রান্তের সঙ্গী হয়ে তার জোটে গিয়ে জুটেছিলেন। তাদের মধ্যে তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, পরবর্তীকালে জেলহত্যা মামলায় আসামি হয়েছিলেন। আরও একজন নানা দুর্নীতিতে যুক্ত থাকা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার চক্রীদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ এবং হত্যা-পরবর্তী তার কর্মকাণ্ডে রাজনীতিতে একেবারে শূন্য অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি তৎকালীন 'চার খলিফার' একজন বলে আখ্যাত হয়েছিলেন এবং সেই সুবাদে ব্যবসায়ের নামে বিস্তর টাকা-পয়সা কামিয়েছেন। কিন্তু সুনাম কামাতে পারেননি। তবু তার বিতর্কিত চরিত্রের কথা মনে না রেখে দুটি সাধারণ নির্বাচনেই শেখ হাসিনা ঝিনাইদহ-২ কেন্দ্রে তাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
রাজনীতিতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এখন এই ব্যবসায়ী নেতা আবার রাজনীতির মাঠে নামার জন্য তৎপর হয়েছেন, কিন্তু তার পুরনো বিতর্কিত চরিত্রটি ত্যাগ করতে পারেননি। তিনি তার প্রাক্তন গুরু খন্দকার মোশতাকের কায়দায় রাজনীতির মাঠে নামার চেষ্টা করছেন এবং তার কণ্ঠে মোশতাকের প্রেতাত্মার কণ্ঠধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মোশতাক যেমন বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শের রাজনীতিকে খতম করার জন্য তার অতিভক্ত সেজেছিলেন এবং প্রথম টার্গেট করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশকেই; তেমনি এই সাবেক 'খলিফাও' হঠাৎ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পরম দরদি সেজেছেন এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় যে ক'জন অতীতের বাম ঘরানার মন্ত্রী আছেন, তাদেরসহ দলের প্রগতিশীল অংশটিকে তার আক্রমণের টার্গেট করেছেন। আবার ধুয়া তুলেছেন, আওয়ামী লীগ দল এবং আওয়ামী লীগ প্রশাসন বামপন্থিরা অর্থাৎ সাবেক কমিউনিস্টরা দখল করে নিয়েছে। এই ধুয়া একসময় ছিল মোশতাক চক্রের।
মুজিবনগরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তে এবং স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুবিরোধী ষড়যন্ত্রে মোশতাক চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এই সাবেক খলিফা। সম্ভবত সেই সুবাদেই তিনি আবার মোশতাক চক্রের অসমাপ্ত কাজটি সমাপ্ত করার তাগিদ অনুভব করেছেন। এবারের লক্ষ্যও আওয়ামী লীগকে তার প্রকৃত মিত্র ও সমর্থকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, আওয়ামী লীগের বামদের সঙ্গে ডানদের একটা সংঘর্ষ শুরু করে দেওয়া এবং পরিণামে শেখ হাসিনাকে দুর্বল করে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া।
এই উদ্দেশ্যে মোশতাক আহমদের একই কৌশল ও পন্থা গ্রহণ করেছেন এই সাবেক খলিফা। তিনি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পরম ভক্ত ও অতি দরদি সেজেছেন এবং অতীতের যেসব বামপন্থি নেতা_ যেমন নাহিদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ যারা দীর্ঘকাল হয় আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এখন হাসিনা মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে দক্ষ ও সৎ মন্ত্রী হিসেবে সুনাম কুড়াচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছেন। গত ৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি বহুল পঠিত দৈনিকে তার যে সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে, সেটি পাঠ করে শঙ্কিত হতে হয় এই ভেবে যে, দেশে মোশতাকের প্রেতাত্মার কণ্ঠস্বর সম্ভবত আবার বেজে উঠেছে।
রাজনীতির আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত এই সাবেক ছাত্রনেতা ও একাত্তরের 'খলিফার' বক্তব্য নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করতাম না। কারণ, জাতীয় রাজনীতিতে এককালের বাঘ কাদের সিদ্দিকীর মতো এরাও এখন গুরুত্বহীন। কিন্তু এই সাবেক খলিফার গত কিছুকালের তৎপরতা ও প্রচারণার ধারা দেখে মনে হয়, তিনি এই প্রচারণায় একা নন; তার পেছনে আবার পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী চক্রটি অথবা তাদের অনুসারীরা সংঘবদ্ধ হয়েছে। এদের সম্পর্কে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সতর্ক হওয়া ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
সাবেক বামপন্থিদের সম্পর্কে এই সাবেক 'খলিফা' যেসব অসত্য ও অর্ধসত্য উক্তি করেছেন, তার জবাব প্রয়োজন হলে সাবেক বামপন্থিরাই দেবেন (সম্ভবত তারা প্রয়োজন মনে করবেন না)। তবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের এই অতি দরদির (মুজিবনগরে আমার জানা তার কর্মকাণ্ডের বয়ান আপাতত স্থগিত রাখলাম) অতীত ও সাম্প্রতিক অতীতের ভূমিকাটি কী তার সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতে পারি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে থেকেই এই সাবেক খলিফা মোশতাক গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তন করেন তখন জেনারেল ওসমানী তার বিরোধিতা করলে নেপথ্যে তাকে সমর্থন জুগিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তার এই প্রিয় শিষ্যও। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি বঙ্গবন্ধু ও বাকশালের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে যে 'খলিফা'র খুনিচক্রের সঙ্গে হাত মেলাতে বিবেকে বাধেনি, তিনি এখন সেসব সাবেক বামপন্থির বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছেন, যারা বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর প্রথম প্রতিবাদ জানিয়ে সভা-মিছিল করেছেন, এমনকি লন্ডনেও সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে প্রতিরোধ, বাংলার ডাক ইত্যাদি নামে কাগজ বের করে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।
এই সময়ে তার সম্পর্কে ঢাকায় প্রচারিত একটি মজার গল্প আছে। কতটা সঠিক জানি না, তবে সঠিক না হলে ঢাকার বাজারে এমন করে প্রচারিত হতো না। প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান ছিলেন এই খলিফারও শিক্ষক। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর এই শিক্ষকের কাছে গিয়ে 'খলিফা' বলেন, 'স্যার, আমি এখন যা কিছু হতে পারি। মন্ত্রী, চিফ হুইপ, দলের সেক্রেটারি। কোনটা হবো বলুন?' শিক্ষক তাকে ধমক দিয়ে বলেছেন, 'ধীরে রজনী, ধীরে।'
স্বাধীনতার পর ডলারের ব্যবসা থেকে নানা ধরনের ব্যবসা করে এই খলিফা যখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, তখন ঢাকায় তার নবনির্মিত প্রাসাদোপম বাড়ি দেখানোর জন্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি বাড়ি দেখার পর 'খলিফা' জিজ্ঞাসা করলেন, 'স্যার, বাড়িটা কেমন দেখলেন?' মনিরুজ্জামান বলেছেন, 'চমৎকার। তুমি একটা কাজ করো, বাড়ির সামনে একটা বড় বেঞ্চি তৈরি করে দাও। লোকজন এসে তাতে বসবে এবং তোমার বাড়ি দেখবে।' 'খলিফা' তার রসিকতা বুঝতে না পেরে বলেছেন, 'তাই করব স্যার।'
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকেও সাবেক খলিফা তার বাড়ি দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হাসিনা নাকি হেসে বলেছেন, 'আপনার বাড়ি শুনেছি ভেতরে-বাইরে মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি এবং তা এতই মসৃণ যে, পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভাঙতে পারি। সুতরাং না যাওয়াই ভালো।'
শেখ হাসিনাকে মোশতাকের এই সাবেক অনুচরদের বর্তমান প্রচারণা সম্পর্কে সতর্ক করার কোনো প্রয়োজন সম্ভবত নেই। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কমরেড মণি সিংহসহ গোটা কমিউনিস্ট পার্টির (তখন মস্কোপন্থি বলে পরিচিত) এবং মুজাফ্ফর ন্যাপের অবদানের কথা তিনি জানেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মস্কোর সমর্থন আদায়ের জন্য তাদের বারবার মস্কো দৌড়াদৌড়ি, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে শর্তহীন সমর্থন দান এবং তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক ও জিয়ার খুনিচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা_ এসব এখন ইতিহাসের অধ্যায়। মোশতাক চক্রের পুরনো ও নব্য অনুসারীদের প্রচারণায় তা মুছে যাবে না।
শেখ হাসিনা, তার দল ও সরকার এখন এক অসম্ভব যুদ্ধে ব্যাপৃত। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আবার মাথা তুলেছে এবং সংঘবদ্ধ হয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুই ফ্রন্টেই আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধরত। এ সময় দলটির দরকার অখণ্ড ঐক্য, পরীক্ষিত মিত্র ও সহযোদ্ধা। এই সময় যারা অতি দরদি সেজে আওয়ামী লীগের এই ঐক্যে ভাঙন ধরাতে চায়, প্রশাসনকে বিভ্রান্ত ও দুর্বল করতে চায়, তারা আওয়ামী লীগের মিত্র নয় এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শেরও মিত্রপক্ষ নয়। এরা মোশতাকের প্রেতাত্মার নতুন প্রচারযন্ত্র। এদের সম্পর্কে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দেশের গণতান্ত্রিক সকল মহলের সতর্ক ও সাবধান হওয়া উচিত।
লন্ডন, ৪ নভেম্বর ২০১১, শুক্রবার
No comments