আমাদের শহরে একদল দখলদার by শেখ রোকন

ন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফে গত সপ্তাহে মিডিয়া বিশ্লেষক সংস্থা গ্গ্নোবাল ল্যাঙ্গুয়েজ মনিটরকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, অনলাইন ও ছাপা মাধ্যমে এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দটির নাম 'অকুপাই'। সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ নিউইয়র্কের লিবার্টি স্কয়ারে 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' নামে যে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূত্রপাত হয়েছিল, তা এখন বিশ্বের বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়াতেই শব্দটির এমন গৌরব।


আন্দোলনকারীদের দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, করপোরেট শোষণ, দুর্নীতি, সরকার ও রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থায় তদবিরকারীদের প্রভাবের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা অকুপাই মুভমেন্ট রীতিমতো বৈশ্বিক হয়ে পড়ার কারণ অন্যান্য দেশেও কমবেশি একই ধারণা পোষণ করা নাগরিকের সংখ্যা কম নয়। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ওই ধাঁচের আন্দোলন ৮২টি দেশের ৯৫ শহরে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদের তুলনায় মৃদুকণ্ঠে বাংলাদেশে যখন 'দখল কর' আন্দোলন শুরু হয়, ফেসবুকে আন্দোলনকারীদের 'মিট আপ' পেজে অ্যাকটিভিস্টদের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত শহরের সংখ্যা ততদিনে ২৬শ' ছাড়িয়ে গেছে। সূচনালগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, রাজু ভাস্কর্য, মিলন চত্বর সংলগ্ন এলাকাকে 'মুক্তি চত্বর' ঘোষণা করে একদল সাবেক-বর্তমান রাজনৈতিক কর্মী, ব্লগার ও অ্যাকটিভিস্ট ২২ অক্টোবর ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। স্লোগান ওয়ালস্ট্রিটের মতোই_ 'আমরা ৯৯ শতাংশ।' তারা বলতে চান, ধনসম্পদ কুক্ষিগত করেছে দেশের এক শতাংশ নাগরিক; আর বঞ্চিত বাকি ৯৯ শতাংশ। প্রথম দিনের পরে খানিকটা বিরতি দিয়ে ২ নভেম্বর থেকে শনি ও বুধবার বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত তারা অবস্থান নিচ্ছেন।
নামে ৯৯ শতাংশ হলেও কাজের বেলায় মুক্তি চত্বরে ঢাকার এক শতাংশ নাগরিকও যোগ দেননি। এদিন বরং আশপাশের ফুচকার দোকানে বেশি ভিড় দেখা গেল। এই আন্দোলনের বাজার মন্দা দেখেই বোধহয় পুলিশ ও গোয়েন্দারা গা করছে না। নিউইয়র্ক, জুরিখসহ বিভিন্ন শহরে পুলিশ আন্দোলনকারীদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও এখানে তারা বহাল তবিয়তে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আন্দোলন নিয়ে বক্তব্য, বিবৃতি দিলেও আমাদের রাজনীতিকরা বোধহয় পাত্তাই দিচ্ছেন না।
এই পরিস্থিতিতে আশা কিংবা আশঙ্কা করা যেতেই পারে যে, ঢাকাই রাজপথের আর দশটা অরাজনৈতিক আন্দোলনের মতো এটাও জমবে না। তবে এর দায় অকুপাই আন্দোলনের নয়। জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লাখনি কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের কথা বাদ দিলে, এদেশের রাজপথে নাগরিক আন্দোলন কবে গতি পেয়েছে?
কথা হচ্ছে, যথেষ্ট লোক জমায়েত না হলেই কোনো দাবি নাকচ, আর ময়দান উপচে পড়লেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশেষত এ দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন, সমাবেশে কীভাবে লোক জড়ো করা হয়, তা ওপেন সিক্রেট।
প্রশ্ন অন্যত্র। প্রথমত, এভাবে অবস্থান করে কি দাবি আদায় সম্ভব? যে 'আরব স্প্রিং'-এ উৎসাহিত হয়ে আন্দোলনকারীরা রাজপথে নেমেছিল, খোদ সেটাই এখন তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ায় 'রোদনভরা বসন্তে' পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এর শহুরে চরিত্র। নানা বিবেচনায় ইতিমধ্যে স্থির হয়ে পড়া শহুরে নাগরিকদের কেউ কেউ হয়তো তার প্রত্যক্ষ লাভের হিসাব ছাড়াই এ ধরনের আন্দোলনে সাড়া দেবেন; গণজাগরণ সৃষ্টি করা দুর অস্ত। এক শতাংশের সঙ্গে ৯৯ শতাংশের বৈষম্যের তথ্যও কতটা নতুন? বামপন্থি রাজনীতিকরা এক শতাব্দী ধরে তো এসবই বলে আসছেন! আর আন্দোলনকারীরা এখন রাজপথে দাঁড়িয়ে যা বলছেন, ব্লগে, ফেসবুকে, টুইটারে ইতিমধ্যেই কি তারা নিজেরাই তা হাজারবার বলে ফেলেননি?
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.