মননে সৃজনে মুক্তির সাধনা by রফিকুল ইসলাম
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে আমরা এক বিকলাঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ পেয়েছিলাম, যার সঙ্গে লাহোর প্রস্তাবের মিল ছিল না। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যখন ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের হাতে ভারত আর মুসলিম লীগের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার দিয়ে যায় তখন উপমহাদেশ ছিল উন্মত্ত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাক্ত। পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ হওয়ায় এই দুই প্রদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং মানবতার চরম
অবমাননা ঘটেছিল। সেই পরিবেশে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যে মুষ্টিমেয় ক'জন বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি মৌতাতে আচ্ছন্ন না হয়ে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার বুনিয়াদ রচনা করেন, চট্টগ্রামের মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন অন্যতম প্রধান পুরুষ। তখনকার অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল, আধুনিক, সাংস্কৃতিক কর্মী মাহবুব উল আলম চৌধুরীর পরিচয় পাওয়া যায় চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মাসিক 'সীমান্ত' পত্রিকায় মুদ্রিত পূর্ব-পশ্চিম বাংলার মানবতাবাদী লেখকদের রচনা থেকে। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে যারা একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন তাদের মূলে ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। সেই সম্মেলনে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেসব শিল্পী-সাহিত্যিক অংশ নিয়েছিলেন, ওই সম্মেলন থেকেই এ দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণে নিহত ভাষাশহীদদের নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রচিত 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি' কবিতাটি মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে অমরত্ব দান করেছে। কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে বাহান্নর একুশের চেতনায় সাংস্কৃতিক কর্মীরা এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছিলেন। বস্তুত চট্টগ্রামে প্রগতিশীল সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনেও চট্টগ্রাম থেকে বিশাল সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল নিয়ে এসেছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী, যে সম্মেলন ছিল ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে 'যুক্তফ্রন্টের' ঐতিহাসিক বিজয় উৎসবও বটে।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন মূলত একজন কবি এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু পরাধীন ব্রিটিশ যুগের অবসানে এবং ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি যুগের সূচনাতে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত পূর্ব বাংলাকে একটি অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। সেই অন্ধকার দিনে সমাজসচেতন এবং বামপন্থি চিন্তা-চেতনায় অভিষিক্ত মাহবুব উল আলম চৌধুরী পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে শামিল না হয়ে পারেননি। অন্যথা তিনি শুধু সাহিত্যচর্চা করেই বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারতেন। কারণ তার শিল্প-সাহিত্য ও সাঙ্গীতিক রুচি ছিল অত্যন্ত গভীর। কিন্তু তিনি সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেননি। তার রাজনৈতিক চেতনা ছিল একাধারে শ্রেণী-সচেতন, গণতান্ত্রিক এবং জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ। ফলে কোনো দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও তিনি ছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের এক সাহসী সৈনিক। সে কারণেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত 'দৈনিক স্বাধীনতা' পত্রিকার সম্পাদকরূপে তিনি কিছুদিন সাংবাদিক জীবনযাপন করেছিলেন। কিন্তু বাঁধাধরা পেশাগত জীবনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না, তাই স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে স্বাধীনভাবেই জীবনধারণ করে গেছেন। তার মূল কাজ ছিল সাহিত্য সাধনা ও সংস্কৃতির সেবা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। চিন্তা-চেতনায় তিনি ছিলেন গভীরভাবে দেশপ্রেমিক, স্বদেশচিন্তা ছিল তার মনন ও সৃজনশীলতার মূল বিষয়।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন একজন পরিশীলিত রুচির সংবেদনশীল মানুষ। যে কোনো আসরে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। তার প্রাণখোলা হাসি, গভীর রসবোধ এবং বুদ্ধিদীপ্ত বাচন মানুষকে সহজেই আকর্ষণ করত। এ কারণেই কখনও তার বন্ধু বা ভক্তের অভাব ঘটেনি, যারা আজও তার অভাব মর্মে মর্মে অনুভব করে থাকেন। বাস্তবিকই তার মতো এমন বহুমাত্রিক সামাজিক মানুষ আজকের দিনে খুব একটা দেখা যায় না। তার প্রয়াণে আমাদের সমাজ জীবনে যে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর মতো বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব একটি সমাজ ও দেশকে সমৃদ্ধ করে তোলে। ফলে তার অভাব আজও অনুভূত হয়।
প্রফেসর রফিকুল ইসলাম : ভিসি
ইউল্যাব ইউনিভার্সিটি
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন মূলত একজন কবি এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু পরাধীন ব্রিটিশ যুগের অবসানে এবং ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি যুগের সূচনাতে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত পূর্ব বাংলাকে একটি অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। সেই অন্ধকার দিনে সমাজসচেতন এবং বামপন্থি চিন্তা-চেতনায় অভিষিক্ত মাহবুব উল আলম চৌধুরী পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে শামিল না হয়ে পারেননি। অন্যথা তিনি শুধু সাহিত্যচর্চা করেই বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারতেন। কারণ তার শিল্প-সাহিত্য ও সাঙ্গীতিক রুচি ছিল অত্যন্ত গভীর। কিন্তু তিনি সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেননি। তার রাজনৈতিক চেতনা ছিল একাধারে শ্রেণী-সচেতন, গণতান্ত্রিক এবং জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ। ফলে কোনো দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও তিনি ছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের এক সাহসী সৈনিক। সে কারণেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত 'দৈনিক স্বাধীনতা' পত্রিকার সম্পাদকরূপে তিনি কিছুদিন সাংবাদিক জীবনযাপন করেছিলেন। কিন্তু বাঁধাধরা পেশাগত জীবনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না, তাই স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে স্বাধীনভাবেই জীবনধারণ করে গেছেন। তার মূল কাজ ছিল সাহিত্য সাধনা ও সংস্কৃতির সেবা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। চিন্তা-চেতনায় তিনি ছিলেন গভীরভাবে দেশপ্রেমিক, স্বদেশচিন্তা ছিল তার মনন ও সৃজনশীলতার মূল বিষয়।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন একজন পরিশীলিত রুচির সংবেদনশীল মানুষ। যে কোনো আসরে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। তার প্রাণখোলা হাসি, গভীর রসবোধ এবং বুদ্ধিদীপ্ত বাচন মানুষকে সহজেই আকর্ষণ করত। এ কারণেই কখনও তার বন্ধু বা ভক্তের অভাব ঘটেনি, যারা আজও তার অভাব মর্মে মর্মে অনুভব করে থাকেন। বাস্তবিকই তার মতো এমন বহুমাত্রিক সামাজিক মানুষ আজকের দিনে খুব একটা দেখা যায় না। তার প্রয়াণে আমাদের সমাজ জীবনে যে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর মতো বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব একটি সমাজ ও দেশকে সমৃদ্ধ করে তোলে। ফলে তার অভাব আজও অনুভূত হয়।
প্রফেসর রফিকুল ইসলাম : ভিসি
ইউল্যাব ইউনিভার্সিটি
No comments