মত ও মন্তব্য-নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন : একটি পর্যালোচনা by হারুন হাবীব

ব শঙ্কা ও আতঙ্কের অবসান ঘটিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। গুরুত্বপূর্ণ এই সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন ডা. সেলিনা হায়াত আইভী। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী শামীম ওসমান ভোটে হেরে গেলেন। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজিরবিহীন দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনটি সম্পন্ন হলো।


নারী ও পুরুষ ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি, পুলিশ, র‌্যাব, স্ট্রাইকিং মোবাইল ফোর্সের সার্বক্ষণিক টহল, রিটার্নিং অফিসারের দৃঢ় মনোভাব_সব কিছু মিলিয়ে গোটা ভোটপর্বে এমন একটি আস্থার পরিবেশ বজায় থেকেছে, যা সচরাচর আমাদের দেশের নির্বাচনগুলোতে দেখা যায় না। যাঁরা অজানা আতঙ্কে ঘরে গুটিয়ে ছিলেন, সুন্দর পরিবেশ দেখে তাঁরাও গেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে ভোটকেন্দ্রে। যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে সরকারের রাজনৈতিকবিরোধীরা নানা কারচুপি বা ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছিলেন, ভোটারদের অভিজ্ঞতা ঠিক তার উল্টো হলো। যন্ত্র ব্যবহারে বয়স্ক ভোটারদের কিছুটা সমস্যা দেখা দিলেও ইভিএম যাঁরা ব্যবহার করেছেন, তাঁরা প্রায় সবাই উৎফুল্ল। ভোটারদের মধ্যে নতুন মেশিনটি নিয়ে ছিল ব্যাপক আগ্রহ। মেশিনে টিপ দেওয়ার পর ভোটটি ঠিকমতো পছন্দের প্রার্থী পেলেন কি না_এ কৌতূহল ছিল প্রায় সব ভোটারের মধ্যে। বলতেই হবে, শেষ পর্যন্ত তাঁদের কৌতূহল মিটেছে এবং ইভিএম গ্রহণযোগ্য হয়েছে। দলীয় চাপে ভোটের ঠিক আগের দিন নাটকীয়ভাবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। সেনাবাহিনী নিয়োগে সরকার নির্বাচন কমিশনের অনুরোধ রক্ষা করেনি বলে অভিযোগ উঠলেও ভোট গ্রহণের দিনটি যেন নতুন অভিজ্ঞতা দান করেছে দেশবাসীকে। বলতেই হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল ও নজরদারি নারায়ণগঞ্জবাসীকে সেনা মোতায়েন না হওয়ার হতাশা পুরোটাই ভুলিয়ে দিয়েছে। সেলিনা হায়াত আইভী প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, তাঁর এ জয় চাঁদাবাজ ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে। এর পর তিনি বলেছেন, এ জয় জনতার ও গণমানুষের। মোট কথা, জনগণ যে কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না, তা আবার প্রমাণিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জে।
সেনা মোতায়েন না হওয়ার প্রথমদিকে সমালোচনা করলেও ভোটগ্রহণ শেষে আইভী বলেছেন, সেনাবাহিনী ছাড়া নির্বাচন একটি ইতিবাচক দিক। এভাবেও যে নির্বাচন করা যায়, নির্বাচন কমিশন তা প্রমাণ করেছে। অন্যদিকে পরাজিত প্রার্থী শামীম ওসমান প্রথমদিকে অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়া জানালেও পরে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দিত করেছেন, নবনির্বাচিত মেয়রের সঙ্গে এক কাতারে কাজ করারও প্রকাশ্য অঙ্গীকার জানিয়েছেন। এ সবই সুস্থ ধারার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মঙ্গলজনক দিক বলে আমরা মনে করি। আশা করব, রাজনীতির এ ধারা অব্যাহত থাকবে। নির্বাচন কমিশনের প্রায় সবাই শান্তিপূর্ণ ভোটপর্ব সমাপ্ত হওয়ায় তৃপ্ত। তাঁরা ঠিক যেভাবে আশা করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে। ভোটাররা অবাধে ভোট দিয়েছেন। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ ভোটে কেবল নির্বাচন কমিশনই খুশি নয়, খুশি নারায়ণগঞ্জের সব শ্রেণীর ভোটার, যাঁরা তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করতে পেরেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনটি ছিল নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার একটি বড় লড়াই, একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সে লড়াই ও চ্যালেঞ্জে আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি বিজয়ী হয়েছে। এর প্রধান কারণ, প্রতিটি নির্বাচনী কর্মকর্তার দৃঢ়তা, শ্রম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর শক্ত অবস্থান এবং সর্বোপরি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের দৃঢ়তা।
এ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য এবং নগর আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান ছিলেন বহুল আলোচিত প্রার্থী। অনেক নাটকীয়তার পরও তিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ডা. সেলিনা হায়াত আইভী নিজেও ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য। আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট নেতাও তিনি। শেষ পর্যন্ত দলের মনোনয়ন না পেয়ে কিছুটা হতাশ হলেও নির্বাচন থেকে তিনি সরে যাননি। একদিকে নির্বাচন থেকে সরে যাননি, অন্যদিকে দলের বিরুদ্ধেও কোনো কথা বলেননি। বলতেই হবে, তাঁর এ আচরণে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় মিলেছে। এনসিসির নির্বাচনটি দলীয় নয়, কিন্তু এ ধরনের বড় নির্বাচনে দলের প্রভাব আমাদের দেশে একেবারেই এড়ানো সম্ভব নয়। এর একটি প্রধান কারণ এই যে এখানে প্রত্যেক প্রার্থীই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে উঠে আসেন এবং দলীয় বিবেচনায়ই গোটা ভোটপর্ব সমাধা হয়। সে কারণে আইন সংশোধন করে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলো দলীয় ভিত্তিতে করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করি। এ ভোটের আরো যেটি সবার চোখে পড়েছে, তা হচ্ছে_ভোটগ্রহণ শুরুর মাত্র সাড়ে ছয় ঘণ্টা আগে নির্বাচন থেকে নাটকীয়ভাবে সরে দাঁড়ান অন্যতম মেয়র পদপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন যে তাঁর নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশেই তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। প্রায় সব মহল থেকেই এ প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হয়েছে যে কেন বিএনপি তৈমূর আলম খন্দকারকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করল। কারণ হয়তো একটি নয়, অনেক। কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় ঠেকাতে, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের গায়ে কাদা লাগাতে এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতেই সেনা মোতায়েন না করার অজুহাতে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে তার প্রার্থীকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে বিএনপি। এর মধ্যে দলটির কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনায় আনা হয়েছিল। ভোট বর্জনের একেবারেই পক্ষে ছিলেন না তৈমূর। ফল যা-ই হোক, তৈমূরের হয়তো এ ধারণাই জন্মেছিল যে আওয়ামী ঘরানার দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর দ্বৈরথে তিনি বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু দলের চাপে তাঁকে সরে যেতে হয়েছে। দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তাঁকে 'বলি' দেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের একটি অতিনাটকীয় সিদ্ধান্তের পেছনে আরো কোনো কারণ ছিল কি না, সেটিও আলোচনায় আনছেন অনেকে। অনেকেই এও বলার চেষ্টা করছেন যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় ঠেকাতেই তৈমূরকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। কারণ বিএনপির আশঙ্কা, শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচিত হলে সরকারের প্রতি জনসমর্থনের প্রতিফলন ঘটবে, জনগণ সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে_এ মর্মে বিএনপির দাবি অসার প্রমাণ হবে। দ্বিতীয়ত, শামীম ওসমান বিজয়ী হলে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির রাজনীতি কঠিন হয়ে পড়বে, যার ঢেউ এসে লাগবে ঢাকায়। অন্য মতটি হচ্ছে, গোপন জনমত জরিপে তৈমূরের পরাজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিল বিএনপি। তাই হারের লজ্জা এড়িয়ে রাজনীতির কৌশলগত জয় নিশ্চিত করতে চেয়েছে বিএনপি। সে যা-ই হোক, সুষ্ঠুভাবে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ায় কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। এক. প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে না তা নয়, কিন্তু সেনা মোতায়েন ছাড়াও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব; দুই. নির্বাচন কমিশন, সরকার ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং দৃঢ়তা থাকলে মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারে, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা যায় এবং তিন. দ্রুত ফল জানতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের ব্যবহার একটি গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভালোয় ভালোয় ভোটপর্বটি সমাধা হওয়ায় জনমনের আতঙ্ক কেটে গেছে। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন ও র‌্যাবসহ অন্যান্য আইন রক্ষাকারী সংস্থার সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণগঞ্জবাসীও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য বলে আমি মনে করি। তারা প্রমাণ করেছে, ভোটদান নাগরিকের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার, এ অধিকার নিশ্চিত করতে তাদের একদিকে যেমন সতর্কতা প্রয়োজন, অন্যদিকে প্রয়োজন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
নারায়ণগঞ্জের দুটি পরিবারই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে বহুকাল ধরে জড়িত। আইভীর বাবা মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমদ চুনকা ১৯৭৩-এর ডিসেম্বরে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনিও অনেকটা একইভাবে সেদিনকার সরকারদলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। আইভীর বিজয়টি ঠিক ৩৭ বছর আগের সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। প্রায় সব অর্থেই নাসিক নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি সুসংবাদ। পরিপূর্ণভাবে শান্তিপূর্ণ এবং অবাধ এই নির্বাচনে মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিয়েছে। ভোটারদের এ অধিকার রক্ষা গণতন্ত্রের জন্য জরুরি। সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কোনো জাতীয় নির্বাচন নয়। এর পরও সারা দেশেই এ নির্বাচন ব্যাপক সাড়া তুলেছিল এবং আমার বিশ্বাস, আগামী জাতীয় নির্বাচনে এ নির্বাচন যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে। এ নির্বাচনে হয়তো আরেকটি শিক্ষা আছে। প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল ভোটারদের মতামত সম্পর্কে জ্ঞান থাকা ভালো। অন্যথায় ফল প্রত্যাশিত হয় না। দল বা হাইকমান্ডের মনোভাব যে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল প্রমাণিত হয়, তার একটি প্রমাণ এ নির্বাচন। এ প্রশ্নটিও প্রণিধানযোগ্য যে রাজনীতিবিদদের 'ক্লিন ইমেজ' ভোটারদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.