অন্যরকম জন্মদিনে হুমায়ূন আহমেদ by বিপুল হাসান
নন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ ৬৩ বছর পূর্ণ করছেন। ১৩ নভেম্বর পা রাখছেন ৬৪-তে। তবে এবারের জন্মদিনটি তার একেবারেই অন্যরকম। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হুমায়ূন আহমেদ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহ্যাটনে মেমোরিয়াল স্লোয়ান কেটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসাধীন আছেন। মুক্তধারাসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙালীদের বিভিন্ন সংগঠন জন্মদিনে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন গত ১৪ সেপ্টেম্বর। তার সঙ্গে আছেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ও দুই ছেলে নিশাদ ও নিনিদ। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিশ্বখ্যাত মেমোরিয়াল সেøায়ান কেটারিং হাসপাতালে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় লেখকের চিকিৎসা। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই চিকিৎসায় হুমায়ূন আহমেদকে মোট আটটি কেমোথেরাপি নিতে হবে। এরই মধ্যে দুটি কেমোথেরাপি নিয়েছেন তিনি। বাংলানিউজকে হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ অবস্থা জানান তার দীর্ঘদিনের প্রধান সহকারী জুয়েল রানা। তিনি জানান, দ্বিতীয় দফা কেমোথেরাপি নেওয়ার পর লেখক বর্তমানে হাসপাতালের পাশ্ববর্তী লং আইল্যান্ডে কুইন্সের ভাড়া বাড়িতে আছেন। কেমোথেরাপির কারণে লেখকের ক্ষুধামন্দা ছাড়া আর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় নি। দ্বিতীয় কেমোথেরাপি দেওয়ার পর তার কিছু শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে । আরো ছয়টি কেমোথেরাপি নিতে হবে তাকে । চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি অবিরত লিখে চলেছেন।
এক হুমায়ূন আহমেদকে আমরা নানাভাবে নানারূপে চিনি। প্রথম জীবনে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অতঃপর লেখক ও নাট্যকার। একসময় নিজেই নাটক বানানো শুরু করলেন। নাটক নির্মাণ করতে করতেই তার শখ হলো চলচ্চিত্র বানানোর। এখন তো ছবি নির্মাণ তার নেশার মতো হয়ে গেছে। যদিও ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিটির পর তিনি নতুন কোনো ছবি বানাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ দেশের প্রকাশনাশিল্পকে আজকের বিকশিত জায়গায় নিয়ে আসার পেছনে হুমায়ূন আহমেদের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। কথাসাহিত্যে দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তিনি রয়েছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এখনো একুশে বইমেলায় তার লেখা বই-ই বেস্ট সেলার। তৈরি করেছেন মিসির আলী আর হিমুর মতো পরস্পরবিপরীত দুই অদ্ভুত চরিত্র। টিভি নাটকেও তিনি যোগ করেছেন বৈচিত্র্য। সেই কবেকার ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’-এর কথা আজও মানুষ মনে রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকাব্য ‘আগুনের পরশমণি’র মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন। পরে নির্মাণ করেছেন একে একে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘আমার আছে জল’ প্রভৃতি ছবি। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে অন্য পরিচালকরাও নির্মাণ করেছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্র, নাটক ও ধারাবাহিক নাটক। অবশ্য বহুমুখী মেধার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদ সবার আগে নিজেকে লেখক ভাবতেই পছন্দ করেন।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে নানাবাড়িতে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ, মা আয়েশা আহমেদ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় হুমায়ূন আহমেদ। ছোট দুই ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব। মুহম্মদ জাফর ইকবাল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, একই সঙ্গে একজন নামি লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট। বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনকে জনপ্রিয় করায় তার রয়েছে অসামান্য অবদান। ছোট ভাই আহসান হাবীব একজন কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।
হুমায়ূন আহমেদের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের নানা জায়গায়। পুলিশ ইন্সপেক্টর বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদের বদলির চাকরি সুবাদে সিলেট, দিনাজপুর, রাঙামাটি, বরিশাল, বান্দরবানসহ নানা জায়গায় কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর।
হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম কাজল। তার ভালো নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। সাত বছর বয়সে তার বাবা নাম বদলে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। বাবার দিক দিয়ে তাদের হলো পীরবংশ। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুর গ্রাম হলো তার পৈতৃকনিবাস। হুমায়ূন আহমেদের বাবাকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পিরোজপুর থেকে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদের তীরে গুলি করে হত্যা করে।
হুমায়ূন আহমেদের ছেলেবেলার প্রথম ভাগ কাটে সিলেটে। সেখানে কিশোরীমোহন পাঠশালায় পড়ালেখায় হাতেখড়ি। ছোটবেলা খুব দুষ্টু ছিলেন তিনি। পড়ালেখায় খুব একটা মন ছিল না। তার বাল্যবন্ধু শংকর পরীক্ষায় ফেল করলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, এই ভয়ে হুমায়ূন আহমেদ তাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন । শিক্ষকদের অবাক করে দিয়ে ক্লাসে প্রথম হন এবং জুনিয়র বৃত্তিও পান। মেট্রিক পরীক্ষায় তিনি বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন। এরপর ঢাকায় এসে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। এখানকার সাউথ হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন তিনি। ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হতে চেয়েছিলেন অর্থনীতিতে। কিন্তু কেমিস্ট্রির পরিচিত শিক্ষক মাহবুবুল আলমকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে খুঁজে পেয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন, ভর্তি হন কেমিস্ট্রিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও তিনি স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। থাকতেন মহসিন হলের ৫৬৪ নম্বর রুমে।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ সাহিত্যচর্চা করতেন।‘সাহিত্য বাসর’ নামে তাদের একটি নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা হতো। আড়াল থেকে এই আড্ডার কান্ডকারখানা দেখতেন, শুনতেন হুমায়ূন আহমেদ। বাসায় বাবার সংগ্রহে ছিল প্রচুর বই। সেইসূত্রে ছোটবেলা থেকেই তার বইয়ের সঙ্গে সখ্য। বাবার কাছ থেকেই সঙ্গীতপ্রীতিটা এসেছে হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের। পরে পিএইচডি করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে ১৯৮২ সালে তার গবেষণা সম্পন্ন হয় এবং পিএইচডি অর্জন করেন। সেই ইউনিভার্সিটি থেকেই তাকে শিক্ষকতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভোগবাদী আমেরিকার যাপিত জীবন তার পছন্দ না হওয়ায় দেশে ফিরে আসেন। আমেরিকার ক্যারিয়ার গড়ার চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপকের চাকরিই ছিল তার প্রার্থিত। পরে সাহিত্য ও নাটকের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে চাকরির সময়ই তিনি প্রথম বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের বয়স ছিল তখন মাত্র ১৪। ঝোঁকের মাথায় তাদের বিয়েটি হয়েছিল গুলতেকিনের এক ফুফুর সহযোগিতায়। এই সংসারে হুমায়ূন আহমেদের তিন মেয়ে নোভা, শিলা ও বিপাশা এবং এক ছেলে নূহাশ। দীর্ঘ দাম্পত্যের পর গুলতেকিন আহমেদের সঙ্গে বিয়ে-বিচ্ছেদ করে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এই সংসারে দুই পুত্র সন্তানের বাবা হুমায়ূন আহমেদ। দুই ছেলের নাম নিষাদ ও নিনিদ।
সাহিত্যজগতে হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব স্বাধীনতার পর পর আলোড়ন জাগানো উপন্যাস ‘নন্দিত নরক’-এর মাধ্যমে। যদিও অনেক সাহিত্যিকের মতোই পদ্য দিয়েই তার লেখালেখির শুরু। কিন্তু পরে গদ্যই হয়ে ওঠে তার পথ চলার বাহন। শঙ্খনীল কারাগার, নির্বাসন, অচিনপুর, প্রথম প্রহর, কোথাও কেউ নেই, আমার আছে জল, পেন্সিলে আঁকা পরী, ফেরা প্রভৃতি তার আলোচিত উপন্যাস। এসব উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্র রচনায় তিনি দেখিয়েছেন অদ্ভুত দক্ষতা। সহজ বর্ণনাভঙ্গি তার উপন্যাসকে নিয়ে গেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি দুই জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী ও হিমু। তারা তিনজন, ফিহা সমীকরণ, শূন্যসহ বেশকিছু সায়েন্স ফিকশনও লিখেছেন তিনি। শিশুতোষ সহিত্যেও পিপলি বেগম, বোতল ভূত, পুতুল প্রভৃতি মজাদার উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি তৈরি করে নিয়েছেন আলাদা জায়গা। এখনও সমানে লিখে চলেছেন এই লেখক। যদিও তার সাম্প্রতিক সময়ের উপন্যাসকে অনেকেই ‘বাণিজ্যিক’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। তবে জনপ্রিয়তার তার ধারেকাছে এখন পর্যন্ত কোনও লেখকই পৌঁছাতে পারেননি।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদও কম জনপ্রিয় নন। প্রতি ঈদেই তার রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত নাটক দর্শকদের কাছে থাকে অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে। মেমোরিয়াল সেøায়ান কেটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থার মধ্যেও এই ঈদের জন্য তিনি দুটি নাটক লিখে পাঠিয়েছেন। নাটক দুটি হচ্ছে ‘রহিমার পতিগৃহে যাত্রা’ ও ‘চৌধুরী খালেকুজ্জামানের মৃত্যু চিন্তা’। হুমায়ূন আহমেদের প্রধান সহকারী পরিচালক জুয়েল রানার পরিচালনায় এই ঈদে নাটক দুটি প্রচারিত হয়েছে যথাক্রমে এটিএন বাংলা ও চ্যানেল আইতে। চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের নতুন ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’-এর শুটিং এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বাকি আছে ছবিটির পোস্ট প্রডাকশনের কাজ।
স্বপ্নবাজ হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখছেন নতুন স্বপ্ন। অসুস্থ অবস্থায় তার পাঠানো একটি লেখায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি কেন জানি আমেরিকায় আসার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, হতদরিদ্র বাংলাদেশ হবে এশিয়ায় ক্যান্সার চিকিৎসার পীঠস্থান।’ শুধু স্বপ্ন দেখার মধ্যেই তিনি সীমিত থাকেন নি । জানিয়েছেন অঙ্গীকার। লিখেছেন, ‘যদি বেঁচে দেশে ফিরি, আমি চেষ্টা শুরু করব এই স্বপ্ন পূরণের। আমি হাত পাতব সাধারণ মানুষের কাছে।’
হুমায়ূন আহমেদ সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন এই প্রত্যাশা সারা দেশের মানুষের। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল গড়ে তুলতে তিনি উদ্যোগ নিলে অবশ্যই দেশের মানুষ সাড়া দেবে। হুমায়ূন আহমেদ ৬৩তম জন্মদিনে সারাদেশের মানুষের সঙ্গে বাংলানিউজও দ্রুত লেখকের রোগমুক্তি কামনা করছে।
এক হুমায়ূন আহমেদকে আমরা নানাভাবে নানারূপে চিনি। প্রথম জীবনে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অতঃপর লেখক ও নাট্যকার। একসময় নিজেই নাটক বানানো শুরু করলেন। নাটক নির্মাণ করতে করতেই তার শখ হলো চলচ্চিত্র বানানোর। এখন তো ছবি নির্মাণ তার নেশার মতো হয়ে গেছে। যদিও ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিটির পর তিনি নতুন কোনো ছবি বানাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ দেশের প্রকাশনাশিল্পকে আজকের বিকশিত জায়গায় নিয়ে আসার পেছনে হুমায়ূন আহমেদের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। কথাসাহিত্যে দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তিনি রয়েছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এখনো একুশে বইমেলায় তার লেখা বই-ই বেস্ট সেলার। তৈরি করেছেন মিসির আলী আর হিমুর মতো পরস্পরবিপরীত দুই অদ্ভুত চরিত্র। টিভি নাটকেও তিনি যোগ করেছেন বৈচিত্র্য। সেই কবেকার ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’-এর কথা আজও মানুষ মনে রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকাব্য ‘আগুনের পরশমণি’র মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন। পরে নির্মাণ করেছেন একে একে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘আমার আছে জল’ প্রভৃতি ছবি। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে অন্য পরিচালকরাও নির্মাণ করেছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্র, নাটক ও ধারাবাহিক নাটক। অবশ্য বহুমুখী মেধার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদ সবার আগে নিজেকে লেখক ভাবতেই পছন্দ করেন।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে নানাবাড়িতে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ, মা আয়েশা আহমেদ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় হুমায়ূন আহমেদ। ছোট দুই ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব। মুহম্মদ জাফর ইকবাল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, একই সঙ্গে একজন নামি লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট। বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনকে জনপ্রিয় করায় তার রয়েছে অসামান্য অবদান। ছোট ভাই আহসান হাবীব একজন কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।
হুমায়ূন আহমেদের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের নানা জায়গায়। পুলিশ ইন্সপেক্টর বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদের বদলির চাকরি সুবাদে সিলেট, দিনাজপুর, রাঙামাটি, বরিশাল, বান্দরবানসহ নানা জায়গায় কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর।
হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম কাজল। তার ভালো নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। সাত বছর বয়সে তার বাবা নাম বদলে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। বাবার দিক দিয়ে তাদের হলো পীরবংশ। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুর গ্রাম হলো তার পৈতৃকনিবাস। হুমায়ূন আহমেদের বাবাকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পিরোজপুর থেকে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদের তীরে গুলি করে হত্যা করে।
হুমায়ূন আহমেদের ছেলেবেলার প্রথম ভাগ কাটে সিলেটে। সেখানে কিশোরীমোহন পাঠশালায় পড়ালেখায় হাতেখড়ি। ছোটবেলা খুব দুষ্টু ছিলেন তিনি। পড়ালেখায় খুব একটা মন ছিল না। তার বাল্যবন্ধু শংকর পরীক্ষায় ফেল করলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, এই ভয়ে হুমায়ূন আহমেদ তাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন । শিক্ষকদের অবাক করে দিয়ে ক্লাসে প্রথম হন এবং জুনিয়র বৃত্তিও পান। মেট্রিক পরীক্ষায় তিনি বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন। এরপর ঢাকায় এসে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। এখানকার সাউথ হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন তিনি। ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হতে চেয়েছিলেন অর্থনীতিতে। কিন্তু কেমিস্ট্রির পরিচিত শিক্ষক মাহবুবুল আলমকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে খুঁজে পেয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন, ভর্তি হন কেমিস্ট্রিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও তিনি স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। থাকতেন মহসিন হলের ৫৬৪ নম্বর রুমে।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ সাহিত্যচর্চা করতেন।‘সাহিত্য বাসর’ নামে তাদের একটি নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা হতো। আড়াল থেকে এই আড্ডার কান্ডকারখানা দেখতেন, শুনতেন হুমায়ূন আহমেদ। বাসায় বাবার সংগ্রহে ছিল প্রচুর বই। সেইসূত্রে ছোটবেলা থেকেই তার বইয়ের সঙ্গে সখ্য। বাবার কাছ থেকেই সঙ্গীতপ্রীতিটা এসেছে হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের। পরে পিএইচডি করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে ১৯৮২ সালে তার গবেষণা সম্পন্ন হয় এবং পিএইচডি অর্জন করেন। সেই ইউনিভার্সিটি থেকেই তাকে শিক্ষকতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভোগবাদী আমেরিকার যাপিত জীবন তার পছন্দ না হওয়ায় দেশে ফিরে আসেন। আমেরিকার ক্যারিয়ার গড়ার চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপকের চাকরিই ছিল তার প্রার্থিত। পরে সাহিত্য ও নাটকের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে চাকরির সময়ই তিনি প্রথম বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের বয়স ছিল তখন মাত্র ১৪। ঝোঁকের মাথায় তাদের বিয়েটি হয়েছিল গুলতেকিনের এক ফুফুর সহযোগিতায়। এই সংসারে হুমায়ূন আহমেদের তিন মেয়ে নোভা, শিলা ও বিপাশা এবং এক ছেলে নূহাশ। দীর্ঘ দাম্পত্যের পর গুলতেকিন আহমেদের সঙ্গে বিয়ে-বিচ্ছেদ করে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এই সংসারে দুই পুত্র সন্তানের বাবা হুমায়ূন আহমেদ। দুই ছেলের নাম নিষাদ ও নিনিদ।
সাহিত্যজগতে হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব স্বাধীনতার পর পর আলোড়ন জাগানো উপন্যাস ‘নন্দিত নরক’-এর মাধ্যমে। যদিও অনেক সাহিত্যিকের মতোই পদ্য দিয়েই তার লেখালেখির শুরু। কিন্তু পরে গদ্যই হয়ে ওঠে তার পথ চলার বাহন। শঙ্খনীল কারাগার, নির্বাসন, অচিনপুর, প্রথম প্রহর, কোথাও কেউ নেই, আমার আছে জল, পেন্সিলে আঁকা পরী, ফেরা প্রভৃতি তার আলোচিত উপন্যাস। এসব উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্র রচনায় তিনি দেখিয়েছেন অদ্ভুত দক্ষতা। সহজ বর্ণনাভঙ্গি তার উপন্যাসকে নিয়ে গেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি দুই জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী ও হিমু। তারা তিনজন, ফিহা সমীকরণ, শূন্যসহ বেশকিছু সায়েন্স ফিকশনও লিখেছেন তিনি। শিশুতোষ সহিত্যেও পিপলি বেগম, বোতল ভূত, পুতুল প্রভৃতি মজাদার উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি তৈরি করে নিয়েছেন আলাদা জায়গা। এখনও সমানে লিখে চলেছেন এই লেখক। যদিও তার সাম্প্রতিক সময়ের উপন্যাসকে অনেকেই ‘বাণিজ্যিক’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। তবে জনপ্রিয়তার তার ধারেকাছে এখন পর্যন্ত কোনও লেখকই পৌঁছাতে পারেননি।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদও কম জনপ্রিয় নন। প্রতি ঈদেই তার রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত নাটক দর্শকদের কাছে থাকে অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে। মেমোরিয়াল সেøায়ান কেটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থার মধ্যেও এই ঈদের জন্য তিনি দুটি নাটক লিখে পাঠিয়েছেন। নাটক দুটি হচ্ছে ‘রহিমার পতিগৃহে যাত্রা’ ও ‘চৌধুরী খালেকুজ্জামানের মৃত্যু চিন্তা’। হুমায়ূন আহমেদের প্রধান সহকারী পরিচালক জুয়েল রানার পরিচালনায় এই ঈদে নাটক দুটি প্রচারিত হয়েছে যথাক্রমে এটিএন বাংলা ও চ্যানেল আইতে। চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের নতুন ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’-এর শুটিং এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বাকি আছে ছবিটির পোস্ট প্রডাকশনের কাজ।
স্বপ্নবাজ হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখছেন নতুন স্বপ্ন। অসুস্থ অবস্থায় তার পাঠানো একটি লেখায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি কেন জানি আমেরিকায় আসার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, হতদরিদ্র বাংলাদেশ হবে এশিয়ায় ক্যান্সার চিকিৎসার পীঠস্থান।’ শুধু স্বপ্ন দেখার মধ্যেই তিনি সীমিত থাকেন নি । জানিয়েছেন অঙ্গীকার। লিখেছেন, ‘যদি বেঁচে দেশে ফিরি, আমি চেষ্টা শুরু করব এই স্বপ্ন পূরণের। আমি হাত পাতব সাধারণ মানুষের কাছে।’
হুমায়ূন আহমেদ সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন এই প্রত্যাশা সারা দেশের মানুষের। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল গড়ে তুলতে তিনি উদ্যোগ নিলে অবশ্যই দেশের মানুষ সাড়া দেবে। হুমায়ূন আহমেদ ৬৩তম জন্মদিনে সারাদেশের মানুষের সঙ্গে বাংলানিউজও দ্রুত লেখকের রোগমুক্তি কামনা করছে।
No comments